জয়ের ঘুম ভাঙল পাঁচটা দশে। ভোর হয়-হয়। কী অবাক কান্ড, কাকডাকা ভোরে কখনই ওর ঘুম ভাঙে না। ভোর দেখার সৌভাগ্য অল্পই হয়েছে কিন্তু প্রতিবারই মনে হয়েছে, আহ, বেঁচে থাকা কী আনন্দের!
অবাক হয়ে ভাবল, ও সোফায় কেন; বিছানা কি হয়েছে? বিছানার দিকে তাকিয়ে আড়ষ্ট হয়ে গেল, একটা মেয়ে গুটিসুটি মেয়ে শুয়ে আছে, এ কে! মাথা ঝাঁকিয়ে মনে মনে হাসল, কি বোকা, এ মেয়েটার সঙ্গেই তো কাল বিয়ে হয়েছে। ও কেমন গোল হয়ে শুয়ে আছে। ওর কি শীত করছে? সোফার চাদর উঠিয়ে গায়ে দিতেই ইভা ঘুম-ঘুম চোখে তাকাল। কী টলটলে ওর চোখ!
জয় বিব্রত হয়ে বলল, ‘কিছু না, তোমার শীত করছিল সম্ভবত, চাদর দিলাম।’
ইভা চাদর ভাল করে জড়িয়ে উঠে বসল।
জয় বলল, ‘ঘুম হয়েছে?’
‘হুঁ।’
উঁহুঁ, আমার ধারণা তুমি ভাল ঘুমুতে পারোনি। কি ইভা, এখনও আমাকে বিশ্বাস করতে পারছ না?’
ইভা কিছু বলল না, এমনভাবে হাসল যেন একটা সূর্য হেসে উঠল।
জয় কান পেতে কি যেন শোনার চেষ্টা করছে। গেট খোলার শব্দ হচ্ছে মনে হল। জয় বলল, ‘থ্যাঙ্ক গড, বুড্ডি যাচ্ছে তাহলে।’
ইভা অবাক হয়ে বলল, ‘বুড্ডি কে?’
‘অ, তুমি তো জানো না, আমার দূর সম্পর্কের দাদি। আমি ওনাকে সহ্য করতে পারি না। যতবার দেখা হয় ততবার মনে মনে বলি, বুড্ডি-বুড্ডি-বুড্ডি। বলো তো কি জঘণ্য একটা ব্যাপার, ভাবলেই নিজেকে চড় দিতে ইচ্ছা করে। অথচ জানো, আমার দাদি চান আমি হেসে হেসে ওনার সঙ্গে কথা বলি, গল্প করি। ছোটবেলায় কিন্তু ইনি বাচ্ছাকাচ্চা মানে আমাদের মোটেও পছন্দ করতেন না। মা’র কাছে শুনেছি কোনদিন আমাকে কোলে নেননি। একটু বড় হয়ে দাদির পেছনে ঘুরঘুর করলে দূর দূর করে তাড়িয়ে দিতেন। বড় হয়ে সম্ভবত এরই ছাপ পড়েছে আমার মধ্যে।’
ইভা অবাক চোখে তাকিয়ে রইল। মানুষটা কেমন হড়বড় করে একগাদা কথা বলছে। অসম্ভব লজ্জিত হলো, বয়স্ক একটা মানুষ সম্বন্ধে বলা কথাগুলো শুনতে ভাল লাগছে না, অথচ এর কথা কান পেতে শুনতে ইচ্ছা করছে।
জয় সচেতন হয়ে লাজুক গলায় বলল, ‘ছি-ছি, কি অবস্থা বলো তো, বাচালের মত কিসব বলছি। এমনিতে আমি কিন্তু খুব একটা কথা বলি না, আশ্চর্য, তোমার সঙ্গে কেন যে বলছি। তোমাকে বিব্রত করে ফেলেছি, সরি।’
ইভার খুব ইচ্ছা হলো বলে, তুমি বলো শুনতে ইচ্ছা করছে। বলতে পারল না। ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে ভাবল, আহ, জীবনটা এত জটিল কেন, যা বলতে চাই বলতে পারি না কেন আমরা? আনমনা হয়ে ছিল বলেই বুক থেকে চাদরটা খসে গেছে। পাতলা রেশমের মত শোবার পোষাকটায় চড়াই উৎড়াই ফুটে উঠেছে। জয় চোখে রাজ্যের মুগ্ধতা নিয়ে তাকিয়ে রইল। কী অসহ্য একটা দৃশ্য, তাকিয়ে থাকলে চোখ ধাঁধিয়ে যায় আবার চোখ ফিরিয়ে নিতেও ইচ্ছা করে না। কী কান্ড, ভেতরে কিছু পরেনি নাকি!
লজ্জার শেষ রইল না যখন দেখল ইভা গলা পর্যন্ত চাদর টেনে হাত আড়াআড়ি করে রেখেছে। জয় বিড়বিড় করে বলল, ‘চা খাওয়া দরকার। ইয়ে, তুমি চা খাবে তো, তোমার জন্যে নিয়ে আসি এককাপ।’ লম্বা লম্বা পা ফেলে এগুতে নিয়ে জয় দরজায় হোঁচট খেলো। চশমা ঠিক করে এগুতে গিয়ে আড়চোখে দেখল ইভা ঘুম-ফোলা মুখে হাসি চাপার চেষ্টা করছে। কিচেনে উঁকি দিল, মা ডুমো-ডুমো করে আলু কাটছেন।
‘মা, চা হবে নাকি? অসুবিধে হলে থাক।’
জয়ের মা বিরক্ত গলায় বললেন, ‘থাক মানে, কোনদিন তোকে চা করে দেইনি!
এ ছেলেটা কেমন অদ্ভুত হয়েছে! মা’র সঙ্গেও এর বিনয়ের শেষ নেই। সেদিন চড় দিতে ইচ্ছে করছিল। রাতে চোখ লেগে গিয়েছিল, ফ্রিজে তরকারি-টরকারি সব ছিল অথচ ছেলেটা ঠান্ডা কড়কড়ে ভাত শুধু ডাল মেখে খেয়ে ঘুমিয়ে গেল। পরদিন সকালে থমথমে গলায় জিজ্ঞেস করেছিলেন: কি রে তুই আমাকে ডাকলি না যে।
ডাকব কি, তুমি ঘুমুচ্ছিলে না!
মরে তো যাইনি, ঘুমিয়ে ছিলাম।
ছি, মা!
চুপ, ফাজিল, তাই বলে তুই না খেয়ে ঘুমিয়ে পড়বি!
কি বলছ, খেলাম না!
জয় আবারও বলল, ‘মা, দু’কাপ বানিয়ো।’
জয়ের মা গরম পানিতে চা পাতা ছেড়ে বললেন, ‘বৌমা উঠেছে নাকি রে?’
‘হুঁ , ওর চা-টা বুয়াকে দিয়ে পঠিয়ে দিয়ো।’
‘তুই নিয়ে যা, ও বাথরুম পরিষ্কার করছে।’
‘থাক তাহলে, ওকে দিতে হবে না, কেবল আমার চা-টাই দাও।’
‘কি বলছিস পাগলের মত! এই না বললি বৌমা চা খাবে?’
‘বলেছি নাকি, ভুল বলেছি।’
পেছন থেকে ইভার গলা ভেসে এল, ‘মা, আমার চা-টা আমাকেই দিন।’
জয় বিচিত্র ভঙ্গিতে অতি দ্রুত ওখান থেকে বেরিয়ে গেল। পেছনে পড়ে রইল ইভার হাসি এবং মার বিস্ময়ভরা চোখ...।
*আগের পর্ব: http://www.ali-mahmed.com/2007/07/blog-post_02.html
*কনক পুরুষ: http://tinyurl.com/29uf4s
2 comments:
খানিকটা ছোট হয়ে গেছে এবারের পর্বটা। আরেকটু বেশি পড়ার ইচ্ছে ছিল :(
কিছু করার ছিল না। এটা আগের পর্বের বাকী অংশ। একটা উপন্যাসকে ফালি ফালি করা বড়ো কঠিন :)...@মুশাফ
Post a Comment