Search

Monday, August 23, 2010

কনক পুরুষ: ৯

জয় ভাসা-ভাসা জানত তন্ময়ের বাবার অফিস সেনাকল্যাণ ভবনে। ঠিক কোথায় এটা জানা ছিল নেই। কেয়ারটেকার গোছের একজনকে জিজ্ঞেস করতেই সমীহের একটা ভাব ফুটিয়ে তুলল আগ্রহ নিয়ে বলল, ‘ষোলো তলায় চলে যান।’
‘ষোলো তলা মানে, ঠিক কোন পাশে?’
‘অ, জানেন না বুঝি, পুরোটাই তো।’

লিফট থেকে নেমে ওর চোখ ধাঁধিয়ে গেল। তন্ময়ের বাবা সাজসজ্জার পেছনে কী বিপুল অর্থই না ব্যয় করেছেন!
রিসেপশনিস্ট মেয়েটার মুখে মহিলা-ড্রাকুলার হাসি, ‘বলুন, আপনার জন্যে কি করতে পারি?’
‘আমি ফারুকী সাহেবের সঙ্গে একটু দেখা করতে চাচ্ছিলাম।’
‘স্যার, কি আসার জন্য বলেছেন?

জ্বী না।
তাহলে দেখা হবে না।’
‘ব্যাপারটা খুব জরুরী।’
‘সরি, সম্ভব হচ্ছে না।’
‘প্লীজ, অন্তত ওনাকে বলে দেখুন।’
‘আচ্ছা, দেখি ওনার পি.এ-র সঙ্গে কথা বলে। মনে হয় না কিছু হবে। আপনার বিজনেস কার্ডটা দিন।’
‘আমার কার্ড নেই। আপনি বলুন, তন্ময়ের একজন বন্ধু দেখা করবে।’
মেয়েটি এবার টকটকে লাল ঠোঁট লম্বা করে চোখ অসম্ভব ছোট করে বলল, ‘চাকরির ব্যাপার নাকি?’
জয় সাপের দৃষ্টি নিয়ে বলল, ‘বলেছি আপনাকে চাকরির ব্যাপার?’
‘না, মানে।’
‘দয়া করে আজেবাজে কথা বলবেন না।’
মেয়েটির অপমানিত গলা,
ওখানে অপেক্ষা করুন।’

এসব কথা হচ্ছিল বারোটায়। এখন বাজে দুইটা। এই দুই ঘন্টায় কেউ কিছু জিজ্ঞেস করা দূরে থাক, তাকাল না পর্যন্ত। যেন ও একটা ফার্নিচার। এরা সবাই প্রচুর সময় নিয়ে চা খাচ্ছে, হেসে একজন অন্যজনের গায়ে ঢলে পড়ছে। ওকে চা অফার করার মত অভদ্রতা এখন পর্যন্ত কেউ দেখায়নি। চরম অপমানিত হবার মত ব্যাপার, গায়ে না মেখে উপায় নেই তবুও জয় তন্ময়ের কথা ভেবে দাঁতে দাঁত চেপে বসে রইল। মানুষকে হেয় করে এরা কি মজা পায় কে জানে!
জয় আকাশ পাতাল রাগ নিয়ে মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করল, ‘কথা বলে দেখলেন?’
‘মানে!’
‘দুই ঘন্টা আগে বললেন না কথা বলে দেখবেন। আমি জানতে চাচ্ছিলাম, এই জটিল কাজটায় আপনার কি পরিমাণ সময় লাগবে?’
‘এমন করে কথা বলছেন কেন? স্যারকে আপনার কথা বলা হয়েছে, অপেক্ষা করতে বলেছেন।’
‘তন্ময়ের বন্ধু দেখা করবে এটা বলেননি?’

মেয়েটি তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলল, ‘জ্বী-ই-ই।’
জয় ফাটা বেলুনের মত চুপসে গেল। সোফায় মূর্তির মতো বসে রইল। বিশ মিনিট পর একজন এসে বলল,
ভেতরে যান, স্যার আপনাকে পাঁচ মিনিট সময় দিয়েছেন। মনে রাখবেন, জাস্ট পাঁচ মিনিট।’

বার্মা টিকের ভারী দরজা ঠেলে জয় ভেতরে ঢুকল । ঘর অন্ধকার, কোথাও আলো নেই। শুধুমাত্র নিচু একটা টেবিল ল্যাম্প উজ্জ্বল আলো ছড়াচ্ছে। রিভলভিং চেয়ারে বসা ছায়া ছায়া মানুষটাকে ঠিক চিনতে পারছে না। ফারুকী সাহেবের সঙ্গ ওর দেখা হয়েছে দু’একবার। তা-ও দূর থেকে।
রাশভারী গলায় ভেসে এল, ‘তুমি তন্ময়ের বন্ধু?’
‘জ্বী’।
‘তোমাকে পাঁচ মিনিট সময় দেখা হয়েছে, ওরা বলেছে তো?’
‘জ্বী’।
‘কি জন্যে এসেছ চট করে বলে ফেলো।’
‘আমি কি এই পাঁচ মিনিট দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলব?’
ফারুকী সাহেব অসম্ভব গম্ভীর গলায় বললেন, সিট ডাউন।’
‘ধন্যবাদ।
‘কাজের কথা বলো।’
‘আমি আপনাকে কিছু জরুরী কথা বলতে চাই। দয়া করে উত্তেজিত হবেন না।’
‘তোমার হাতে আর মাত্র চার মিনিট আছে।’
‘মনে করিয়ে দেয়ার জন্যে ধন্যবাদ। খুব একটা সময় লাগবে না। যেটা বলতে চাচ্ছিলাম, আমি যতটুকু জানি তন্ময় আপনার একমাত্র সন্তান। নিকট আত্মীয় বলতে তেমন কেউ নেই। ঠিক বলছি তো?’
‘গো অ্যাহেড।’
‘আমি জানতে চাচ্ছিলাম,
আপনি এত টাকা আয় করছেন কার জন্যে?’
ফারুকী সাহেব হিসহিস করে বললেন, ‘নিশ্চয়ই তোমার জন্যে না!’
‘এটা কিন্তু আমার প্রশ্নের উত্তর হলো না।’
‘এনাফ। তোমার প্রশ্নের উত্তর হলো, এবার আসতে পারো। এতক্ষণ সহ্য করেছি তুমি তন্ময়ের বন্ধু বলে।’
‘জ্বী, আমি তন্ময়ের বন্ধু বলেই, ওর কথা ভেবে বাইরে দুই ঘন্টা লজ্জা-শরমের মাথা খেয়ে মত ভিক্ষুকের মত বসে থেকেছি। আপনি দয়া করে পাঁচ মিনিট সময় দিয়েছেন। কেন জানেন? শুধুমাত্র এ কথাটা বলার জন্যে, তন্ময় মাত্রাতিরিক্ত ড্রাগ নিচ্ছে, ওর আয়ু  ক্রমশ ফুরিয়ে আসছে। আমার ধারণা ছিল এটা সম্ভবত আপনার জানা নেই। এটা ছিল আমার ভুল ধারণা। আমি এবার যাব।’
ফারুকী সাহেব জড়িয়ে জড়িয়ে বললেন, ‘কি-কি‌, কি বললে তুমি! তন্ময় ড্রাগ-’ জয় পুরোটা শোনার আগেই গায়ের জোরে দরজা খুলে বেরিয়ে এল।


মেয়েটা জয়ের ঝড়ো কাকের মত অবস্থা দেখে অবজ্ঞার হাসি হাসতে গিয়ে ভুলে গেল। বড় সাহেব যে ভঙ্গিতে ছুটে আসছেন এই অভূতপূর্ব দৃশ্য আগে কখনও এ অফিসে দেখা যায়নি। মনে হচ্ছে চকলেটের লোভে ছোট্ট একটা শিশু দৌড়ে আসছে। ফারুকী সাহেব জয়ের হাত আঁকড়ে প্রায় শোনা যায় না এমন গলায় বললেন, ‘প্লিজ, আমার রূমে একটু আসো।’
চেয়ারে জয়কে বসিয়ে ঘুরে নিজের চেয়ারে বসতে দিয়ে টেবিলের কোনায় হোঁচট খেলেন। রিভলভিং চেয়ারে হাত পা ছড়িয়ে এলিয়ে পড়লেন। হাই কুল এসিতেও কপালে সাদা বালুর মত ঘাম জমছে। থেমে থেমে বললেন, ‘ও কখন থেকে ড্রাগ নিচ্ছে?’
‘ঠিক জানি না, আজই জানলাম।’
‘গড-গড! একি শুনছি! আহ-আহ!’
এমুহূর্তে জয়ের এই মানুষটার জন্য কী মায়াই না লাগছে। কোমল গলায় বলল, ‘আপনি কখনও টের পাননি?’
‘নাহ। এটা আমার কল্পনাতেও আসে না!’
‘এখন সবচে’  জরুরী যেটা, ব্যাপারটা খুব ভেবেচিন্তে হ্যান্ডল করতে হবে। বাড়াবাড়ি করলে হিতে বিপরীত হবে।’
‘ওহ গড, আমি এখন কি করব?

‘শান্ত হন, আপনার সহযোগিতা সবচে জরুরি। আরেকটা কথা, আমি যে আপনাকে এসব বলেছি এটা যেন ও ঘুণাক্ষরেও জানতে না পারে। জানলে আমার সঙ্গে হয়তো যোগাযোগ বন্ধ করে দেবে। এটা খুবই খারাপ হবে।’
‘কি ড্রাগ নিচ্ছে, জানো?’
‘খারাপটাই। পেথেডিন-হেরোইন, ঠিক নেই। যখন যেটা পায়। আর আপনি তো জানেন হেরোইন পর পর তিনবার নিলে চিকিৎসা ছাড়া এটা বন্ধ করা সম্ভব না।’
ফারুকী সাহেব চশমাটা নামিয়ে রাখলেন। ঝাপসা হয়ে আছে, লাগিয়ে রাখার কোন মানে হয় না! কপালের দু’পাশ চেপে বললেন, ‘কিছু মনে করো না, তোমার নামটা?’
‘জয়’।
‘জানো, জয়, ওর মা না থাকাতে এ অবস্থা হয়েছে। স্বীকার করি আমি ভাল বাবা হতে পারিনি। হয়ে গেছি টাকা বানানোর মেশিন। আজও টাকাই বানিয়ে যাচ্ছি। কি লাভ বলো, আমি আর ক’দিন, এসব তো ওর জন্যেই। ও কেন এমন করল, কিসের অভাব ওর? যখন যা চেয়েছে তাই দিয়েছি। কোন সাধ অপূর্ণ রাখিনি। একবার বলল বাবা আমি আর লেখাপড়া করব না। আমি বিরক্ত হলাম। খুব ঝুলাঝুলি করাতে বললাম, ঠিক আছে যা, করিস না। একদিন বলল, বাবা বাইক চালাতে ভাল লাগছে না, টাকা দাও গাড়ি কিনব। আমি বললাম আমাদের তো বেশ কটাই গাড়ি, একটা নিয়ে নে। ও বলল, না আমি লেটেস্টটা কিনব। ওই গাড়ি ক’দিন চালাল। এখন গারাজে পড়ে থাকে। কোন সাধটা ওর অপূর্ণ রেখেছি!’
জয় থেমে থেমে বলল, ‘আসলে ড্রাগ নেয়ার জন্যে নির্দিষ্ট কোন কারণ থাকে না। পারিবারিক জটিলতা ছাড়াও অনেকে সঙ্গ দোষে নেয়া শুরু করে। কেউবা নতুন একটা কিছু করতে গিয়ে ফান হিসেবে শুরু করে। ওর ব্যাপারটা আসলে ঠিক বুঝতে পারছি না। ওর সঙ্গে বহুদিন পর কাল আমার বিয়েতে দেখা হলো তো। এরপর আজ সকালে এলো।’
ফারুকী সাহেব ভাঙা গলায় বললেন, ‘এখন
আমি কি করব?’
‘ড্রাগ অ্যাডিক্টদের কোথায় ভাল চিকিৎসা হয় খোঁজখবর নেন। ওকে বুঝিয়ে-শুনিয়ে ভর্তি করাতে হবে। ভর্তি না করালে বাইরে থেকে ড্রাগ নেবে, লাভ হবে না কিছু।’
‘বাসায় আছে কি না কে জানে।’
‘দুপুরে আমার ওখানে খাওয়ার কথা ছিল। ড্রাগ যোগাড় করবে বলে চলে গেল। খুব তাড়াহুড়ো করবেন না। দেখি বিকেলে ওর সঙ্গে দেখা করে। আমি আপনাদের বাড়িতে গেলে কিছু মনে করবেন না তো?’


ফারুকী সাহেবের চোখ ভেজা। অসমবয়সী এক যুবকের কাছে এ লজ্জা তাঁকে বিন্দুমাত্র বিচলিত করল না। চেয়ার ছেড়ে জয়ের হাত ধরে আর্দ্র গলায় বললেন, ‘নো মাই সান, আমি খুব খুশি হব। তুমি আমার এই একটা মাত্র ছেলেকে বাঁচাও।’
‘প্লীজ, শান্ত হন। আমি আমার সাধ্যাতীত করব। তন্ময় আমার পছন্দের মানুষদের একজন। আমি ওকে খুব পছন্দ করি। আপনার মত নিশ্চয়ই মমতা-আমি, মানে-।’
‘ইটস, ইটস অলরাইট, মনটা শক্ত করো। আমরা ভেঙ্গে পড়লে ওর ক্ষতি হবে যে।’
‘আমি তাহলে এখন যাই।’
‘জয়, তুমি যদি দুপুরে আমার সঙ্গে খাও আমার খুব ভাল লাগবে। তাছাড়া তোমার সম্বন্ধে কিছুই জানি না। জানতে ইচ্ছে করছে।’
‘আজ না, অন্য কোনদিন।’
‘জরুরী কোন কাজ আছে?’
‘জ্বী, জরুরী কাজ ঠিক না, মানে-।’
‘তাহলে চলো, একসঙ্গে লাঞ্চ করি।’
‘ইয়ে মানে, ইভা-।’
‘ইভা, ইভা কে?’
‘কাল বিয়ে হলো তো, ও অপেক্ষা করবে।’
‘ওহ হো, তোমার ওয়াইফ, সরি-সরি। তা আগে বলবে তো! তুমি দেখি আচ্ছা ছেলে হে।

‘আচ্ছা, যাই তাহলে।’
‘ও, শোনো শোনে, এক মিনিট। তোমার বাসার ঠিকানাটা বলো তো?’
‘বাসাবোর একদম ভেতরে, আগমন সিনেমা হলের পেছনে। পেঁচানো রাস্তা।’
‘আহ, একটা কাগজে লিখে দাও না।’
‘একদম ভেতরে, মানে ঠিক খুঁজে-।’
ভয় পাচ্ছ, হুট করে হাজির হয়ে যাব?’
‘না-না, কি যে বলেন, ইয়্যু আ মোস্ট ওয়েলকাম।’

জয় অনেক চেষ্টা করল, লাভ হলো না। ফারুকী সাহেব কেবল এগিয়েই দিলেন না, জয়কে প্রায় ঘাড় ধরে গাড়ির ভেতর ঢুকিয়ে ড্রাইভারকে বলে দিলেন জয়কে যেন তার বাড়িয়ে পৌঁছে দেয়।

আগের পর্ব: কনক পুরুষ, ৮: http://www.ali-mahmed.com/2010/08/blog-post_22.html 

কনক পুরুষ: http://tinyurl.com/29uf4s    

2 comments:

mutasim said...

ধন্যবাদ...... ২ টি পর্ব তাড়াতাড়ি দেওয়ার জন্য....

আচ্ছা.....আপনার বই গুলো কোন প্রকাসনা থেকে প্রকাশিত হয়..?

আলী মাহমেদ - ali mahmed said...

কয়েকটা প্রকাশনী থেকেই প্রকাশিত হয়েছে। তবে অধিকাংশ বই ছাপা হয়েছে শাহবাগের 'জাগৃতি প্রকাশনী' থেকে। @mutasim