আল আমীন। এর মা অন্ধ। একটা সেলুন চালায়, কষ্টেসৃষ্টে-কায়ক্লেশে। আজ থেকে ১৫/ ২০ দিন পূর্বে এর মা আমার কাছে এই সেলুনটার জন্য টাকা চেয়েছিলেন চুল কাটাবার ঘূর্ণায়মান চেয়ার কেনার জন্য। ঠিকানা নিয়ে বলেছিলাম, পরে জানাব।
পরে বলার কারণ আছে। ন্যানো ক্রেডিট [১] নিয়ে কাজ করার পূর্বে অনেকে জোর নিষেধ করেছিলেন টাকা ফেরত পাওয়া যাবে না, আমি গা করিনি। এখন পর্যন্ত যাদের দেয়া হয়েছে কোথাও কোন সমস্যা হয়নি। ঠিক-ঠিক সবাই কথামতো টাকা পরিশোধ করে যাচ্ছেন। মন মিয়া [২] নামের এই মানুষটার কাছে ১০০০ টাকার মধ্যে এখন কেবল পাওনা ২৭০ টাকা। এরিমধ্যে এই মানুষটা খানিকটা পুঁজিও জমিয়ে ফেলেছেন। এই টাকা শোধ হলে তাঁকে ২০০০ টাকা দেয়া হবে এমনটাই স্থির হয়েছে।
কেউ কেউ আমাকে বোকা বানাবার চেষ্টাও করেছেন। ছলিম মিয়া নামের একজন চোখে পানি নিয়ে আমার কাছে টাকা চাইল ব্যবসা করার জন্য। আমি কথায় কথায় তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, আপনি থাকেন কোথায়?
ছলিম মিয়া ঠিকানা বলেছিল। আমি ওখানে গিয়ে খোঁজ নিয়ে জানলাম, ব্যবসা দূরের কথা একে কোন কাজ-কাম করতে কেউ কখনও দেখেনি। ছলিম মিয়া যে কাজটা নিয়ম করে করে সেটা হচ্ছে গাঁজা সেবন।
সলিম মিয়া পরের দিন যখন আমার কাছে আসল, আমি তাকে বলেছিলাম, কিসের ব্যবসা করবেন, গাঁজার? মানুষটা পালিয়ে বেঁচেছিল। এ হয়তো আশা করেনি আমি সত্যি সত্যি ওর অবর্তমানে বাসায় হাজির হয়ে যাব। এর হয়তো জানা ছিল না হরিজন পল্লীতে কাজ করার অভ্যেস আছে আমার।
এমনও হতে পারে ব্লগস্ফিয়ারে এটা রটে যেতে পারে আমাকে দেখা গেছে শুকরের রেসে শুকরের পিঠে। এই নিয়ে অবশ্য আমার কোন বিকার নাই।
তো, আল আমীনের দোকানটা আমি দেখে এসেছিলাম হপ্তাখানেক আগে। আল আমীন নামের ছেলেটা আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল, 'আপনে কি চুল কাটাইবেন'?
চুল কাটাবার মত যথেষ্ঠ বড়ো ছিল, কাটালে মন্দ হতো না কিন্তু আমার কুখ্যাত চুলের ছাঁট আবার সবাই দিতে পারে না। এই কুখ্যাত ছাঁট দিতে সবাই রাজিও হয় না।
আমি হাসিমুখে বললাম, চুল কাটাব না বেল (ন্যাড়া) হবো এটা এখনো ঠিক করি নাই। তা তোমার নাকি চেয়ার কেনা দরকার? বিষয় কি, তোমার তো দেখি চেয়ার একটা আছে?
আল আমীন এখন বুঝতে পারে এই মানুষটা চুল কাটাবে না এর মতলব অন্য। আল আমীন বলে, কাস্টমার দিগদারী (যন্ত্রণা) করে। কয়, কি চিয়ার রাখছস, হো... ব্যথা হয়া যায়।
কাল একে চেয়ার কেনার জন্য ১৫০০ টাকা দেয়া হয়েছিল- প্রতি মাসে ২০০, ৩০০ যা পারবে জমা দিয়ে ১৫০০ টাকা শোধ করবে। আজ এটাই দেখতে এসেছি। চোখের পলকে আমি ছবি তুলে ফেলি। আল আমীন আর উঠে দাঁড়াবার সুযোগ পায়নি, মুখে আমি বলি, চেয়ারটায় বসে থাকো।
আমি আল আমীনের এখান থেকে হেঁটে হেঁটে ফিরে আসছি। একটা ট্রাক এতোটাই পাশ ঘেঁষে গেল ফতুয়ার হাতায় আমি এর স্পর্শ টের পাই। খুব কাছ থেকে মৃত্যুকে দেখে মানুষ কি জমে যায়, জানা নেই আমার? আমি শূণ্য দৃষ্টিতে অপসৃত ট্রাকটার দিকে তাকিয়ে থাকি।
এই সব ক্ষেত্রে যা নিয়ম, ট্রাক ড্রাইভার এবং তার আত্মীয়-স্বজনকে জড়িয়ে কুৎসিত গালি দেয়া। আমি দেবতা না যে আমার গালি জানা নেই কিন্তু আমার মাথা কাজ করছিল না। আমার কেবল মনে হচ্ছিল, মৃত্যু আমার গা ছুঁয়ে বলে গেছে, এই পাগল তোকে ছুঁয়ে দিলাম! এটা কি আমার জন্য কোন ম্যাসেজ? যা করার তাড়াতাড়ি করে ফেল, সময় নাই রে পাগলা, সময় নাই।
জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আমার মস্তিষ্ক কি ভেবেছিল আমি জানি না কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, আমাদের জীবনটা কী ঠুনকো! এই ঠুনকো জিনিসটা নিয়ে আমাদের কত অন্যায়-অনাচার-লোভ-অহংকার, এর কোন মানে হয় না আসলে!
এই রাস্তাটা যথেষ্ঠ কুখ্যাতি আছে যদিও এটার জাঁকালো নাম আন্তর্জাতিক রাস্তা কারণ এই রাস্তা দিয়ে বাস-ট্রাক ভারতে যায়। 'ছাল উঠা কুত্তা, বাঘা তার নাম'- এমন সরু রাস্তা আন্তর্জাতিক রাস্তা হয় কেমন করে এটা অবশ্য গবেষণার বিষয়।
ট্রাক ড্রাইভারকে আমি খুব একটা দোষ দেই না। তার সরে যাওয়ার পর্যাপ্ত জায়গা ছিল না, হর্নও দিয়েছিল। আমার অন্যমনস্কতাই এর জন্য দায়ী। ঢাকার রাস্তায় [৩] হাঁটার বিষয়ে আমার উপর লোকজনের কঠিন নিষেধাজ্ঞা আছে, এখন কি এখানেও এটা প্রযোজ্য হবে!
ব্লেসিং কাজ করে কি করে না এটা আমি জানি না। আমার জন্য কি এই গ্রহের কোথাও-না-কোথাও, কোন-না-কোন জায়গায়, কেউ-না-কেউ, কখনও-না-কখনও কি কোন কলকাঠি নেড়ে ছিলেন? কারও ব্লেসিং কি আমার পিছু তাড়া করেছে? জানি না আমি।
ফিরে আসার পথে আব্দুল মিয়া নামের এই মানুষটাকে পেয়ে যাই। এই মানুষটাকে আমি চিনি, ঈশ্বরের বিশেষ সন্তানদের স্কুল [৪] করার সুবাদে। এই রাস্তা ধরেই তিনি হেঁটে যাচ্ছেন, গতি স্লথ কিন্তু যানবাহনকে ঠিকই পাশ কাটাচ্ছেন!
আমি খানিকটা বিভ্রান্ত, এই মানুষটা চোখে দেখতে পান না এমনটাই জানা ছিল। তাহলে কি মানুষটা মিথ্যাবাদী? আমি এঁর পিছু পিছু খানিকটা দূর যাই। কাছে গেলে মানুষটা আমাকে চিনতে পারেন আমি এই ফাঁকে মানুষটার চোখের দিকে তাকাই, নষ্ট চোখ। এই চোখ দিয়ে দেখার প্রশ্নই আসে না।
আমার অসম্ভব মন খারাপ হয়। আমার এই ভাল চোখ কোন কাজের...!
সহায়ক লিংক:
১. ন্যানো ক্রেডিট: http://tinyurl.com/39dkbhh
২. মন মিয়া: http://www.ali-mahmed.com/2010/07/blog-post_4248.html
৩. ঢাকা: http://www.ali-mahmed.com/2010/02/blog-post_27.html
৪. ঈশ্বরের বিশেষ: http://tinyurl.com/2fs9j4p
No comments:
Post a Comment