আমরা এতো কষ্ট করে গাছ লাগিয়েছি, সযতনে পানি দিয়েছি, মমতায় লালন করেছি; এখন গাছ ভরে ফল ধরেছে। এতে অবাক হওয়ার কী আছে! ফলগুলো 'বিষফল' তাই? আহা, লাগাব বিষবৃক্ষ ধরবে কি রসালো কোন ফল?
প্রকারান্তরে ইভ টিজিং যে খুনের নামান্তর এটা কি আমরা অদ্য জানলাম? আমি জানি না, এর কোন সমীক্ষা করা হয়েছে কি না? অনুমান করি, এই দেশের লক্ষ-লক্ষ মেয়ে কেবল এই কারণেই অর্ধ-শিক্ষিত থেকে যাচ্ছে। এসএসসি পাশ করার পূর্বেই বিয়ে দিয়ে দেয়া হচ্ছে। বিয়ে হওয়া আগ পর্যন্ত এর ভুবনটা থাকে এলোমেলো- মানসিক বিকারগ্রস্ত।
ইভ টিজিং নিয়ে দেশ এখন উত্তাল। দেশ উত্তাল নাকি মিডিয়া? এই ঘটনাগুলো মিডিয়া লাইম লাইটে নিয়ে না-আসলে কি আর আমরা উত্তাল হই? এখানেও কিছু হিসাব-কিতাব আছে, প্রথম পাতায় কোথায় খবরটা ছাপা হবে, কোন ভঙ্গির কান্নার ছবিটা ভাল আসবে। গোল টেবিল আলোচনায় কারা কারা থাকবেন।
এমনিতে এই খবরগুলোই হেলাফেলা ভঙ্গিতে মফস্বলের পাতায় ছাপা হলে আমরা চোখ বুলিয়েই সারা। যারা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পত্রিকা পড়েন তাঁদের পক্ষেই সম্ভব কেবল এই খবরগুলো জানা। আমাদের দেশের বুদ্ধিজীবীদের এতো সময় কোথায় মফস্বলের সংবাদ পড়ার। আর কি দায় পড়েছে এ নিয়ে মাথা ঘামাবার? কোন এক গন্ডগ্রামে কে কাকে চাপা দিল, কেন দিল...।
কই, ব্র্যাক ব্যাংকের অত্যাচারে, শত-শত মানুষের সামনে একজন বয়স্ক মানুষের মৃত্যু হয় এই খবরটা দেখি অনেক দৈনিকে ছাপার যোগ্যতা অর্জন করে না [১]। গ্রামীন ব্যাংকের অপমানে একজন কিশোরী আত্মহত্যা করে এই খবর মফস্বলের পাতায় আসে [২] কিন্তু আমাদের দেশের সো-কলড বুদ্ধিজীবীদের দৃষ্টি কাড়ে না। এই কারণেই বলছিলাম ইভ টিজিং নিয়ে মিডিয়া উত্তাল তো আমরা উত্তাল।
এমন না এই ঘটনাগুলো সম্প্রতি ঘটছে। এটা চলে আসছে, চলেই আসছে। এটা চলে আসার জন্য ঝোপঝাড় কেটে রাস্তা আমরাই সুগম করে রেখেছি। এটা হুট করে হয়নি, এটার জন্য আমাদের দীর্ঘ সময় লেগেছে, এর পেছনে কঠোর সাধনা আছে। আগে ছেলেপেলেরা বখাটেপনা করলে মুরুব্বিরা কান ধরে চটকনা লাগালেই অনেক বড়ো বড়ো সমস্যার সমাধান হয়ে যেত। তারপরও সমস্যা না-মিটলে গ্রামে মুরুব্বিরা বসে সমাধান করে ফেলতেন।
এখন আর এটার চল নাই কারণ বখাটে কেন বখাটের বাবারও এই আচরণ-পদ্ধতি পছন্দ না। কারণ তাকেও এই সমাজে থাকতে হয়, পুতুপুতু ছেলে দিয়ে এখন আর চলে না, প্রয়োজন ক্ষমতাবান ছেলে। তারা মনে করছেন, অদৃশ্য এক ক্ষমতার বলয় প্রয়োজন কারণ এই সমাজব্যবস্থা এখন আর তাদেরকে যথেষ্ঠ নিরাপত্তা দিতে পারছে না। ছেলেকে ক্ষমতাবান হতে হলে তাকে কোন-না-কোন একটা রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জুড়ে যেতে হয়। কোন এক বড় ভাইয়ের বগলতলায় থাকতে হয়। তখন তাকে আর পায় কে, চরম বখাটেপনা করলেও কি আর হবে? ওসির সঙ্গে বসে যে বড় ভাই চা খান। এমপি সাহেবের একটা ফোন কলে দিন-রাত, রাত-দিন হয়ে যায়। উল্টো পুলিশ প্রতিবাদকারীকে কলার ধরে নিয়ে আসবে। বয়সের জন্য কোন ছাড় নাই, পুলিশ এমন আচরণ করবে ফিরে এসে নিজের বাড়িতে স্বইচ্ছায় কান ধরে উঠবস করবেন, কেন গিয়েছিলেন থানায়। তো, কার দায় পড়েছে, কার ঘাড়ে দুটা মাথা!
ফল যা হওয়ার তাই হয়, শত-শত মানুষের চোখের সামনে কোন মেয়েকে কেউ উত্যক্ত করলেও কেউ এখন আর এগিয়ে আসে না। জানে লাভ নাই। কেবল কালে কালে দেশে নপুংশকের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়।
অন্য প্রসঙ্গ। হালের একটা অভিজ্ঞতা শেয়ার করি। আমি যে স্কুল চালাই এটা দেখার জন্য একটা স্কুলের বেশ কিছু বাচ্চা এসেছে, এদের মধ্যে ফোর-ফাইভ পড়ুয়া বাচ্চাও আছে। আমাদের স্কুলে পড়াবার ধরাবাঁধা কোন নিয়ম নেই, যখন যেটা প্রয়োজন সেটাই পড়ানো-শেখাবার চেষ্টা করা হয়। আমি টিচারকে বললাম, বই বন্ধ থাকুক। সমস্ত বাচ্চাদের বললাম, এখন অন্য বিষয়। আচ্ছা, এক এক করে সবাই বলো তো তোমাদের দাদার নাম কি? অধিকাংশ বাচ্চাই দাদার নাম বলতে পারেনি। টিচার হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে। আমি স্বাভাবিক কারণ এমনটাই আমার অনুমান ছিল। আমরা সবাই মিলে বাচ্চাদেরকে বড়ো করছি একেকটা রোবট করে। শেকড় থেকে ক্রমশ আমরা দূরে সরে যাচ্ছি- দাদার নাম জানার প্রয়োজন নাই। অচিরেই আমরা বাপের নামও ভুলে যাব।
এর জন্য আমাদের মিডিয়ারও অনেক লম্বা হাত আছে। উদাহরণ দেই, ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় গানের একটা অনুষ্ঠান হয়। এখানে একেক দিন একেক শিল্পী আসেন। ওদিন এসেছিলে বাপ্পা মজুমদার। শিল্পীর সঙ্গে একজন অনুষ্ঠানে বসার সুযোগ পান। ওদিন অল্পবয়সী যে মানুষটা এসেছিলেন, বাপ্পার সঙ্গে বসার সুযোগ পেয়েছিলেন তিনি ২৫০০ এসএমএস করে এখানে এসেছেন। ২৫০০ এসএমএস, ভাবা যায়! অতি অল্প সময়ে এই বিপুল এসএমএস পাঠাবার জন্য এই মানুষটাকে ওনার অসংখ্য বন্ধু-বান্ধবকে নিয়ে এই 'এসএমএসযজ্ঞে' যোগ দিতে হয়েছিল এখানে আসার জন্য! তা এই গাধাটা পড়বে কখন? বাপ্পা মজুমদারসহ কেউ এই প্রশ্নটা করলেন না, একজন ছাত্রকে ২৫০০ এসএমএস করার জন্য কি বিপুল টাকাই না খরচ হয়েছে, লেখাপড়া শিকেয় উঠেছে। এমন অসংখ্য অসুস্থ প্রতিযোগিতা চালু করে অসংখ্য অসুস্থ মানুষ তৈরি হচ্ছে। এই দেশে এখন নাদুস-নুদুস জোঁক হচ্ছে ফোন কোম্পানিগুলো। অধিকাংশ সেলিব্রেটিরা এদের কাছে আত্মা বন্ধক রেখেছেন।
ইলেকট্রনিক মিডিয়ার কল্যাণে রাতারাতি অসংখ্য স্টার পয়দা হচ্ছে। হৃদয় খান [৩] নামের এক স্টারের এক অনুষ্ঠান দেখে আমার মনে হয়েছিল, ম্যানার-সহবত শেখার জন্য এর তো নতুন করে স্কুলে ভর্তি হওয়া প্রয়োজন।
হাসান নামের যে মানুষটা ঘান (!) করেন ওদিন ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় লাইভ ঘানের (!) অনুষ্ঠানে দেখলাম, যেসব শ্রোতা ফোন করছেন তাঁদেরকে তিনি অবলীলায় তুমি তুমি করে বলছেন। এই বেয়াদব স্টারেরও প্রয়োজন স্কুলে ভর্তি হয়ে নতুন করে...।
শ্লা, হরলিকস খেলে বাচ্চা লম্বা হয়! বাপ-মা পাঁচ ফুট বাচ্চা হবে আট ফুট! কী একেকটা বিজ্ঞাপন! ডানো খাওয়া বাচ্চাগুলো ছাতা নিয়ে এখন গাছের মগডাল থেকে লাফ দেয়, ক-দিন পর ছাদ থেকে লাফ দেবে [৪]।
ফোন কোম্পানিগুলো পারলে বাচ্চা জন্ম নেয়ার পর পরই হাতে মোবাইল ফোন ধরিয়ে দেয়। এখন ছয় কোটি সিম, আমি আশা করছি অচিরেই এটা ১৬ কোটি ছাড়িয়ে যাবে। চুলায় বেড়াল ঘুমায়, তাতে কী- আমাদের মোবাইল ফোন থাকাটা জরুরি! এই দেশের জন্য এখন সবচাইতে মায়া হচ্ছে ফোন কোম্পানিগুলোর। এদের সঙ্গে কাঁদেন এই দেশের বুদ্ধিজীবীরা, কাঁদতে কাঁদতে দেশে অকাল বন্যা নিয়ে আসেন।
আমাদেরকে শেখানো হচ্ছে, ডাব এবং সফট ড্রিঙ্কের মধ্যে কোন পার্থক্য নাই। রোবট বানাবার শিক্ষাটা আমরাই চালু রেখেছি, সানন্দে।
বাবা-মার চেয়ে টিভি বড়ো [৫]। ভাল টাকা দিলে অপি করিমের মত সেলিব্রেটিরা এটাও আমাদেরকে শিখিয়ে দেবেন।
ভাল টাকা পেলে আমরা উবু হয়ে পটিতেও বসার ভঙ্গি করব। টাকার অংকটাই আসল। প্রয়োজনে আমরা মাকেও বিক্রি করে দেব। বিক্রি করে দেব তাঁর ফুসফুস, কিডনি, লিভার।
তো, লাগাচ্ছি আমরা বিষবৃক্ষ গাছ এখন ফল ধরার মরসুম, ঝেপে ফল এসেছে এতে অবাক হওয়ার তো কিছু নাই।
সহায়ক লিংক:
১. ব্র্যাক: লাশ-পদক-বানিজ্য: http://www.ali-mahmed.com/2010/04/blog-post_23.html
২. গ্রামীন ব্যাংক, লাইফ...: http://www.ali-mahmed.com/2008/07/blog-post_3333.html
৩. হৃদয় খান: http://www.ali-mahmed.com/2009/07/blog-post_21.html
৪. শিশু হত্যার মারণাস্ত্র: http://www.ali-mahmed.com/2008/09/blog-post_22.html
৫. অপি করিম, এই অসভ্য বিজ্ঞাপন: http://www.ali-mahmed.com/2009/02/blog-post_19.html
4 comments:
এই হলো করপোরেট সংস্কুতি। এখানে পণ্যই সব । আমরা সবাই ফাউ । আমি ফাউ , তুমি ফাউ , মা ফাউ ,বাবা ফাউ ...ভাই-বোন-বিয়াই-বোনাই-জগাই -মাধাই সবাই ফাউ.......।
এখানে বেশ কিছু সমস্যা আছে, বাবা-মা এখন ছেলে-মেয়েকে স্টার বানতে ব্যস্ত অধিকাংশই, আর মধ্যবিত্ত বলে যারা ছিলো তারা এখন মোটামুটি উচ্চবিত্ত কালোটাকার বদৌলতে। এসব করতে গিয়ে সঠিক নৈতিক শিক্ষা আসছে না, বই মুখস্থ, টিভি-পিসি-গেমস, প্রপার সুস্থ বিনোদনের অভাব, অন্ধের মতন বিদেশি সাংস্কৃতি গেলা - অনেক বলা যায়।
"...ভাই-বোন-বিয়াই-বোনাই-জগাই -মাধাই সবাই ফাউ..."
:D @Omio Ujjal
সহমত @রাতমজুর
Post a Comment