তিনটা স্কুলের মধ্যে একটা স্কুল প্রায় তিন কিলোমিটার দূরে। হররোজ না-হলেও প্রায়ই আমার যাওয়া পড়ে কিন্তু স্কুটারে করে এই তিন কিলোমিটার রাস্তা যেতে আমার জান বেরিয়ে যায়। এবড়োখেবড়ো রাস্তা, আগে যাও বা একটা কিছু ছিল কিন্তু ঠিক করাবার নাম করে রাস্তা উল্টে-পাল্টে একাকার করে রাখা হয়েছে। এমন অবস্থা কবে থেকে? সে অনেক আগের কথা, এই রকম চলে আসছে মাসের-পর-মাস।
মাত্র সেদিন সবিস্ময়ে লক্ষ করলাম, রাস্তার কাজ নিয়ে তোড়জোড় শুরু হয়েছে। আমাদের দেশে কেন যেন আমরা ভালোটা দেখতে পারি না, পেট ভরা হিংসা যে আমাদের! আমাদের বলতে আমিও- আমারও পেট আছে, আমার পেটে যথারীতি হিংসা আছে।
স্কুটার চালককে জিজ্ঞেস করি, ঘটনা কি?
মানুষটা তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলেন, তাইজ্জব, এইটা জানেন না, মুন্ত্রী আইব। মুন্ত্রী মানে মন্ত্রী। আমি যে জায়গাটায় থাকি এখানে আলোড়ন তোলার মত তেমন কোন খবর থাকে না। সেখানে মন্ত্রী আসার খবর চমক লাগানো এতে সন্দেহ কী! না জানাটা অপরাধের পর্যায়ে পড়ে বটে।
আমি অবাক হই না, ওহ, এই তাহলে ঘটনা। এটা আমাদের দেশের পরিচিত দৃশ্য। মন্ত্রী টাইপের লোকজনরা যখন চলাচল করেন তখন চারদিকে শান্তি-শান্তি ভাব চলে আসে। কোথাও কোন সমস্যা নেই, কোথাও কোন রাস্তা ভাঙ্গাচোরা নেই। আগে-পেছনে শ খানেক গাড়ি ব্যতীত এঁরা চলাচল করতে পারেন না।
বেচারা ইউরোপিয়ান দেশের মন্ত্রীদের জন্য বড়ো দুঃখ হয়। এরা বড়ো গরীব দেশের মন্ত্রী- নিজেরা সাইকেল চালায়, শপিং মলে নিজেরাই শপিং করে। ছ্যাহ!
ভুলে গেছি কে ড্রাইভার ছিলেন আর কে আরোহী। বিল গেটস এবং বিল ক্লিনটনের মধ্যে কেউ একজন গাড়ি চালাচ্ছিলেন। এই নিয়ে খবর বের হলো, এই গ্রহের সবচেয়ে ধনী মানুষ ড্রাইভার এবং সবচেয়ে ক্ষমতাশালী মানুষ আরোহী! এরা বড়ো বেচারা, বড়ো গরীব!
যাই হোক, খোঁজ নিয়ে যে তথ্য পাওয়া গেল আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আগরতলা যাবেন। ওখানে তিনি 'ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী উদ্যান'-এর উদ্বোধন করবেন। এই কারণে রাস্তার দলাইমলাই চলছে। আরও জানা গেল, তাঁর এই যাওয়া উপলক্ষে এক সপ্তাহ স্থল-বন্দর বন্ধ থাকবে। মোদ্দা কথা, আমদানী-রফতানি এই এক সপ্তাহ পুরোপুরি বন্ধ। অথচ এই স্থল-বন্দরে দিয়ে প্রতিদিন শত-শত ট্রাক আসা-যাওয়া করে।
গতবছর এই বন্দরের মাধ্যমে বাংলাদেশ সরকার ২১৪ কোটি বৈদেশিক মুদ্রা আয় করেছিল। ওই হিসাবে এই সাত দিনে আনুমানিক ৪ কোটি টাকা বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন থেকে বঞ্চিত হলো। ব্যবসায়ীদের দূর্ভোগের কথা এখানে অনুল্লেখ্যই থাক।
এখানে মজার একটা তথ্য বেরিয়ে এসেছে, বন্দর বন্ধ রাখার এই উদ্ভট আইডিয়াটা এসেছে আগরতলা কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে। বন্দর বন্ধ রাখার জন্যে তাঁরাই অনুরোধ করেছেন বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষকে। কারণটা কি, দাদাদের এই অতি আগ্রহের কারণ কী!
উল্লেখ করার মত তেমন কিছু না, দাদাদের আগরতলার মাত্র ৪০০ মিটার রাস্তা মেরামত করতে হবে। ভাল-ভাল! যে রাস্তা দিয়ে হাজার-হাজার ট্রাক যেতে পারছে কোন সমস্যা হচ্ছে না সেখানে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর গাড়ি যেতে সমস্যা হবে! ফোর হুইল ড্রাইভ, বড়ো বড়ো চাকাওয়ালা গাড়িগুলোর? দাদারা কি ভেবেছেন আমরা তাদের মতো স্কুটারের চাকা সদৃশ অ্যামবেসেডর গাড়ি ব্যবহার করি?
বেশ-বেশ, এরাও কি আমাদেরকে দেখে দেখে শিখে গেছে কেমন করে উদ্ভট সব কাজ করতে হয়?
কিন্তু আজ সকালে যখন আমার বাসার উপর দিয়ে কানফাটানো শব্দে হেলিকপ্টার উড়ে গেল তখন কেন যেন আমার মনে হলো এই যন্ত্রটা পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে বয়ে নিয়ে এসেছে। অনুমান ভুল ছিল না, বাস্তবেও তাই হয়েছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী দিপু মনি হেলিকপ্টারে করে এখানকার হেলিপ্যাডে নেমেছেন।
সঙ্গে মিছিল করে চলে এসেছেন এই জেলার সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ কর্তারা।
যারা আমাদের দিককার রাস্তা-ঘাট ঠিকঠাক করছিলেন তাদের জন্য খানিকটা বিষাদগ্রস্তও হলাম। আহা, বেচারারা, রাস্তা চকচকে রাখার জন্য কী উদয়াস্ত পরিশ্রমই না করেছেন মন্ত্রীর গাড়ি যাবে বলে, পারলে বুক পেতে দেন। গব্বর সিং বেঁচে থাকলে ঠিকই বলে বসতেন, 'আব তেরা ক্যায়া হোগা রে বাঙ্গালিয়া'।
ভাগ্যিস, আকাশপথে এই সব নিয়ে তেমন হুজ্জত নাই। ওখানে বুক পেতে দিতে কেউ চেষ্টা করেন না।
... ... ...
যাদের ঔচিত্য বোধ প্রবল এঁরা লেখার এই অংশটুকু না পড়লেই ভাল করবেন। কারণ এখানে হয়তো তাঁরা অন্যায়ের গন্ধ খোঁজার অপচেষ্টা করবেন। এখানে এই ছবিটা দেয়াটা খানিকটা অসমীচীন। এই মাটার অনুমতি নেয়া সম্ভব হয়নি। আসলে অনুমতি চাওয়া-টাওয়ার মতো অবস্থায় তিনি ছিলেন না। তদুপরি ত্রাণ-ট্রাণ সামনে রেখে যে রকম ছবি উঠাতে আমরা যেরকম অভ্যস্ত অনেকটা এই ভঙ্গি এখানে চলে এসেছে। কসম, আমার অন্য উপায় ছিল না।
আমার এই লেখার জন্য ছবিটা জরুরি। তাছাড়া একদা আমি হয়তো থাকব না কিন্তু এই মা-টার প্রতি তীব্র অন্যায়ের ছবিটা থেকে যাবে। হয়তো-বা...।
আজ সকালেই এক জায়গায় আমার যাওয়া আগে থেকেই স্থির হয়ে আছে। এমন মুহূর্তে কেউ আসলে বিরক্তি চাপা মুশকিল হয়ে যায় আমার জন্যে। আমি তো আর হৃদয়বান রাজনীতিবিদ না যে সব সব সময় আমার মনটা দলদলে থাকবে! তো, যে মানুষটা আসেন তার কথায় জানলাম, একটা বাচ্চা মারা গেছে, মিলাদ করাতে হবে, মোল্লা খাওয়াতে হবে।
কিন্তু পুরো ঘটনা শুনে, মোল্লা খাওয়াবার কথা শুনে আমার গা শিরশির করে। মোল্লারা সম্ভবত শব সামনে নিয়েও অনায়াসে খেতে পারবেন। আমি কথা না-বাড়িয়ে বলি, পারলে ওই মানুষটাকে নিয়ে আসেন।
মানুষটার এতোটা খারাপ অবস্থা জানলে তাঁকে আসার জন্য বলতাম না। গতকাল এই মাটারই বাচ্চা হতে গিয়ে বাচ্চাটা মারা গেছে কিন্তু প্রসবকালীন সমস্যার কারণে তিনি প্রচন্ড রকম আহতও। স্বামী তাঁকে ফেলে উধাও। ঘরভাড়া বাকী। ঘরের মালিক ভাড়া না-দেয়ার কারণে পারলে আজই বের করে দেয়। কাল থেকে খাওয়া নেই, তাঁর এবং তাঁর এই সন্তানেরও।
এই মুহূর্তে সব সমস্যা ছাপিয়ে যায় যেটা, তাঁর চিকিৎসা। যা কেবল একজন গাইনির পক্ষেই সম্ভব। হাসপাতালে গিয়েছিলেন, হাসপাতালে সবেধন নীলমনি এই বিষয়ে একজনই ডাক্তার। ওই ডাক্তার নামের মহিলা তাঁর চিকিৎসা দূরের কথা প্রসবকালীন আহত স্থান দেখেনওনি।
এই সব ডাক্তারদের জন্যই কত মা-বাচ্চা মৃত্যুবরণ করে, আত্মহত্যা করেন [১] ক-টার খবর আমরা রাখি?
কখনও কখনও আমার মুখে কিছুই আটকায় না। একবার ইচ্ছা করছিল, গিয়ে ডাক্তার নামের ওই মহিলাকে জিজ্ঞেস করি, আপনি এইবার আমাকে বলেন, আপনি যে ডাক্তার হয়েছেন, এর পেছনে আপনার বাপ কতো টাকা খরচ করেছেন আর কতো টাকা সরকার খরচ করেছে? সরকার তো তালুক বিক্রি করে আপনাকে পড়ায়নি। টাকাটা এসেছে এই সব রোগিদের কাছ থেকে। এই মা-রোগীটা হতদরিদ্র এ সত্য কিন্তু তিনি বছরের-পর-বছর ধরে যে সমস্ত নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য কিনেছেন তার পরোক্ষ ট্যাক্স জমা হয়েছে সরকারের টাঁকশালে।
ভেবে দেখলাম, এতে লাভের লাভ কিছুই হবে না প্রকারান্তরে এই মা-টার ক্ষতি হবে।
বড়ো অসহায় লাগে নিজেকে। আপাতত প্রচন্ড ব্যথা কমাবার জন্য ওষুধ দেয়া ব্যতীত কিছুই করার নেই। তার আগে জরুরি তাঁকে কিছু একটা খাওয়ানো- এমনিতেও ব্যথা কমাবার ওষুধ খালি পেটে খাওয়ানোটা উচিত না। অন্য কিছু না-হয় পাওয়া গেল কিন্তু এক গ্লাস গরম দুধ কোথায় পাই? এ দোকান-ও দোকান খোঁজা সার। এখন আর কেউ গরুর দুধে চা বানায় না, সব কনডেন্স মিল্ক (আধুনিকতার ছোঁয়া)! অনেক খুঁজে একটা দোকান পাওয়া গেল। এই হারামজাদা আবার আলাদা করে দুধ বিক্রি করবে না, চা বানাতে নাকি ওর এই দুধ লাগবে। আমি রাগ চেপে বললাম, ঠিক আছে, দেন, বিশ কাপ চা দেন।
দোকানদার খানিকটা ভড়কায়, বিশ কাপ চা দেয়ার মত কাপ তো আমার কাছে নাই।
এবার আমি চোয়াল শক্ত করে বলি, কাপ লাগবে না। বিশ কাপ চার দুধগুলো এই গ্লাসে জমান আর দুধ ছাড়া চা আপনি বসে বসে খান। যাই হোক, দোকানদার এরপর আর ঝামেলা করেনি, দুধ সমস্যার সমাধান হয়।
কাল ঢাকা থেকে একজন ডাক্তার আসবেন। মা-টার চিকিৎসার একটা গতি হবে। আমি চাতক পাখির মত মানুষটার জন্য অপেক্ষা করছি।
... ... ...
এনজিওর এক পালা কুত্তা তাদের পোষা পত্রিকায় আবার ঘটা করে কলাম লিখেছে, ঋণ দিয়ে এরা দেশটায় আলোয় ভরিয়ে দিচ্ছে, দেশটা উন্নয়নে ভেসে যাচ্ছে। আগে চুভাইদের মিটিংয়ে লোকজন খালি পায়ে আসত এখন জুতা পায়ে দিয়ে আসে। এতেই চুভাইরা প্রমাণ করার চেষ্টায় লিপ্ত, দেশ এগিয়ে গেছে।
অর্থমন্ত্রী থাকার সময় সাইফুর রহমান তো বলেই বসেছিলেন, দেশের লোকজনরা আরামে আছে কারণ এখন ফকিরের হাতেও মোবাইল। ফকিরভাবনা!
আপাতত দৃষ্টিতে মনে হবে, বাঁকের পরেই রেললাইন মিশে একাকার হয়ে গেছে। চর্ম চক্ষুতে তাই মনে হয়। তাই কি?
কিন্তু আমরা জানি, এ হয় না, এই-ই নিয়ম। তেমনি এই গ্রহে ন্যায়-অন্যায়ও পাশাপাশি চলবে, এটা-ই নিয়ম।
সহায়ক লিংক:
১. ডাক্তার নামের খুনিটা: http://www.ali-mahmed.com/2010/08/blog-post_24.html
No comments:
Post a Comment