ড. ইউনূসকে নিয়ে এখন কোন লেখা খানিকটা জটিলতার পর্যায়ে চলে যায়। অনেকের আবেগের গোপন জায়গাটি হচ্ছে, বেচারা আমাদের জন্য নোবেল পুরস্কার এনে দিয়েছেন। কথা সত্য। এই অভাগা দেশটিকে এই গ্রহে কে চেনে? চেনে হাভাতের দেশ হিসাবে, চেনে চোর-চোট্টার দেশ হিসাবে; সেখানে একজন ইউনূসের আমাদের একটা নোবেল এনে দেয়াটা তো চাট্টিখানি কথা না।
৭০০ কোটি টাকা স্থানান্তর করায় ড. ইউনূসকে নিয়ে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে হইচই হওয়ার পর হৃদয়বান মানুষের পাল্লা ড. ইউনূসের প্রতি ভারী। আহা বেচারা, আহা-আহা। জনপ্রিয় এই গানটি থেকে খানিকটা ধার করে বলি, "...এক-টু সহানুভূতি-ই-ই কি ইউনূস-স-স, পেতে পারে না...ও বন্ধু, আ-আ-আ"?
এমনিতে পূর্বেও ইউনূস সাহেবকে নিয়ে দেশে বিপুল হইচই হয়েছে কিন্তু কেউ গা করেননি কারণ এই বিপুল মানুষদের মধ্যে কোন সাদা চামড়ার মানুষ ছিলেন না, আফসোস। আমাদের তো আবার সাদা চামড়া ব্যতীত নড়াচড়া করতে ইচ্ছা করে না, কোন তথ্য বিশ্বাসযোগ্য মনে হয় না।
ওয়েল, এই সব হৃদয়বান মানুষদের বলি, একটা খুন করলেও ড. ইউনূস একজন নোবেল লরিয়েট বলে কি আমাদের বলতে হবে তিনি দায়ে পড়ে খুন করেছেন বা তাঁর করা গুলিটা সফট নোজের ছিল? নোবেল পেলেই কি তাঁর অপরাধ লঘু হয়ে যাবে?
আজকের আমার এই লেখার বিষয় এটা না কোন মিডিয়া (সেটা সাদা চামড়ার নাকি কালো চামড়ার সেটাও আমার আলোচ্য বিষয় না) ইউনূস সাহেবকে নিয়ে কি বলেছে, লিখেছে। টাকা নিয়ে তিনি কেমন জাগলিং খেলেছেন সেটাও না।
আমি এক লেখায় [১] জানতে চেয়েছিলাম, প্রসটিটিউশন-ড্রাগস-আর্মস ব্যতীত কোন ব্যবসা আছে যেখানে ২১ পার্সেন্ট সুদ দিয়ে এবং ক্রমশ পুঁজি শূন্য করেও বহাল তবিয়তে ব্যবসা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব, আমি সেই ব্যবসার নাম জানতে চাই। এই প্রশ্নটা ছিল ব্র্যাক ব্যাংক নিয়ে। আর গ্রামীন ব্যাংক তো কয়েক পা এগিয়ে।
"...প্রকৃতপক্ষে গ্রামীন ব্যাংকের সুদ হচ্ছে ৩৮ শতাংশ..."। (সূত্র: খোন্দকার ইব্রাহিম খালিদ, সাবেক ডেপুটি গভর্নর, বাংলাদেশ ব্যাংক)
এখন আমি জানতে চাই ৩৮ শতাংশ সুদ দিয়েও কোন ব্যবসায় লাভ করা যায়? এটা যদি মেথরগিরিও হয় আমি সানন্দে করব, আমার লেখালেখির কসম। এটা আমি ইউনূস সাহেবের কাছে জানতে চাই। তিনি আমাকে এই ভাগ্য বদলাবার দিকনির্দেশনা দিলে আমি এখুনি লেখালেখি ছেড়ে পুরোদস্তুর মেথর হয়ে যাব। ব্যবস্থাটা আজ রাতে হলে আজ রাতেই মেথরগিরি করতে বের হব। সয়্যার অন মাই ...। না-না, সয়্যার অন...ইউনূস সাহেবের...।
ইউনূস সাহেবের যে কেবল সুদের হার ৩৮ শতাংশ এমনই না, এখানে সবচেয়ে ভয়াবহ বিষয়টি হচ্ছে, গ্রামীন ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়ার পর থেকেই প্রতি সপ্তাহে কিস্তির টাকা পরিশোধ করতে হয়।
ন্যানো ক্রেডিটের [২] আওতায় কিছু কাজ করার সুবাদে এই নিয়ে খানিকটা ধারণা হয়েছে আমার। আমি এখান থেকে বিচিত্র বিষয় শিখছি। ন্যানো ক্রেডিট দেয়া হয়েছে এমন অনেককে নিয়ে লেখা হয়ে উঠেনি কিন্তু যাদেরকে এই ঋণ দেয়া হয়েছে তাদের অধিকাংশের পক্ষেই ঠিক পরের সপ্তাহ থেকে কিস্তি দেয়া সম্ভব না।
এখানে সরল উদাহরণ দেয়ার চেষ্টা করি। যেমন ধরা যাক, এই মহিলার কথা [৩]। ইনি যদি কিস্তি পরিশোধ করেনও তবুও তাঁর পক্ষে মাস শেষ হওয়া ব্যতীত টাকা দেয়া সম্ভব না। তাহলে? এখন আমি যদি খুব চাপাচাপি করি তাহলে যেটা হবে কিস্তি শোধ করার জন্য চড়া সুদে অন্য কারও কাছ থেকে তিনি টাকা নেবেন। যেটা ইউনূস সাহেব এবং তার শিষ্য, অন্য ব্যাংকের বেলায় হচ্ছে।
ইউনূস সাহেবের ঋণ নিয়ে যে ভদ্রমহিলা হাস-মুরগি-ছাগল কিনবেন সেই হাস-মুরগি পরের দিন থেকেই ডিম্ব প্রসব করবে আর ছাগল প্রসব করবে ছাগশিশু। ব্যস, ওই ছাগশিশু ঘন্টায়-ঘন্টায় বাড়বে। বাড়তে হবে, ছাড়াছাড়ি নাই কারণ সপ্তাহ শেষ হওয়ার পূর্বেই এটাকে বাজারে বিক্রি করে টাকা ক্যাশ করতে হবে এবং গ্রামীন ব্যাংকের কিস্তি শোধ দিতে হবে। কী সোন্দর সিস্টেম! এই গরীব মানুষরা কিস্তি পরিশোধ করতে গিয়ে এমন তালগোল পাকায় যে ওই ব্যাংকের অত্যাচার এড়াতে অন্য একটা এনজিও থেকে ঋণ নেয়। এভাবে বেশ-ক'টা এনজিও থেকে ঋণ নেওয়ার পর রাতারাতি টিন-খড়ের ভাড়াবাড়ি ছেড়ে উধাও হয়ে যায়! ছোট-ছোট বাচ্চারাও অভ্যস্থ হয়ে পড়ে একদা রাতে মাথায় করে গাট্টি নিয়ে...!
আচ্ছা, কুতর্কে যেতে চাচ্ছি না, তাঁকে নোবেল দিতে গিয়ে কোন কূটচাল চালা হয়েছিল। ক্ষুদ্রঋণ দিয়ে তিনি নাকি দেশময় শান্তি আনয়ন করেছেন। শান্তি প্রসঙ্গে পরে আসি। এই যে ক্ষুদ্রঋণের ভাবনা এটা কিন্তু একেবারে মৌলিক কোন ভাবনা না। তাঁর পূর্বেও অনেকে এই ভাবনা ভেবেছেন, এটা নিয়ে কাজ করেছেন। এটা সত্য, ইউনূস এটাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছেন মাত্র।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে ইউনূসের গ্রামীন ব্যাংক এতো জনপ্রিয় হয়েছিল কেন? কারণ একটাই, বাইরে সুদের হার আরও অসহনীয় ছিল! তো, এদের ভাষায় গ্রামীন ব্যাংক নাকি ৮০ লক্ষ মানুষকে ঋণ দিয়ে এদের ভাগ্যের চাকা ঘুরিয়ে দিয়েছে। যাদের অধিকাংশই নারী!
এর অর্থ দাঁড়াচ্ছে, উপকৃত হয়েছে ৮০ লক্ষ পরিবার! নিম্নবিত্তদের আবার বাচ্চাকাচ্চা বেশি, এরা আবার মায়ায় বুড়াবুড়িকেও ফেলে দিতে পারে না, মানে একেকটা পরিবারে কমপক্ষে গড়ে ৬ জন ধরলেও প্রায় ৫ কোটি মানুষ। ওয়াল্লা, একা ইউনূস সাহেবই পাঁচ কোটি মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন করে ফেলেছেন! ইয়া রব, ব্র্যাক এবং তাঁর শিষ্য অন্য ব্যাংকগুলো ধরলে দেখা যাবে আমি ব্যতীত সবাই এদের দ্বারা উপকৃত হয়েছেন। ব্র্যাক থেকে একটা ঋণ আমিও নিয়েছিলুম বটে সেটার ফয়সালা আদালত পর্যন্তও গড়িয়েছিল; এর গল্প অন্য কোন দিন। এখন দেখছি, সবাই 'চিনিহারাম' কেবল আমিই নিমকহারাম-লবনহারাম'! বেচারা আমি!
এখন এক দফা এক দাবী, ইউনূস সাহেবকে দেশের প্রেসিডেন্ট বানিয়ে আবেদ সাহেবকে প্রধানমন্ত্রী এবং সমমনাদেরকে যত দ্রুত সম্ভব মন্ত্রী বানানো হোক। আমি ভাবতেই পারছি না এঁরা না থাকলে দেশের কী হাল হতো!
ইউনূস সাহেব, বেচারা, সবাইকে জুতা পরাবার জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠেছেন! আমি ড. ইউনূসের সামাজিক ব্যবসা নামের লেখায় লিখেছিলাম [৪], আমি বড়ো আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষায় আছি ইউনূস আমাদের বাচ্চাদের জন্য এমন জুতা নিয়ে আসবেন যে জুতা পায়ে দিলে ক্ষিধা লাগবে না। তিনি এডিডাসকে নিয়ে যখন সামাজিক জুতা নিয়ে আসবেন এই জুতায় নিশ্চয়ই চমক একটা থাকবে, থাকবেই। কারণ তিনি এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন:
"...আমাদের লক্ষ্য হলো, যারা জুতো পরে না তাদের জুতো পরার সুযোগ দেওয়া। ...গরিব মানুষ যদি সস্তা দামে আরো ভালো জিনিস পায় তাহলে ত সেটাকে স্বাগত জানানো দরকার..."।
বটে রে! ইউনূস সাহেবের কী ধারণা আছে, আমাদের দেশে জুতার দাম কত? একটা স্পঞ্জ স্যান্ডেল বিশ টাকায় পাওয়া যায়। আপুনি (!) ইউনূস সাহেব কি বিশ টাকার কম দামে সামাজিক জুতা দেবেন নাকি কেবল এই আইডিয়াটা আমাদেরকে খাওয়াবেন, আ মীন 'গরিবা জুতা' খাওয়াবেন?
আমার স্পষ্ট বক্তব্য হচ্ছে, ইউনূস সাহেব গরীবদের নিয়ে ন্যাকামোটা না-করলে তাঁকে নিয়ে বা তার বিপক্ষে আমি একটা বাক্য দূরের কথা একটা শব্দও ব্যয় করব না। কারণ তখন সেটা হবে শব্দের অপচয়! স্রেফ তিনি গরীবদের নিয়ে আহা-উহু করাটা বন্ধ করবেন, ব্যস, তাঁর কাছে আর কিচ্ছু চাই না। চোখে চোখ রেখে স্পষ্ট করে বলবেন, আমি ব্যবসা করতে এসেছি, ব্যবসা করব, কারও কোন সমস্যা? না, তখন আমরাও বলব, কোন সমস্যা নাই।
ইউনূস নামের মানুষটা কিন্তু সেই পথ মাড়াচ্ছেন না তিনি ২০১০ পর্যন্ত এক পয়সা কর দেননি [৫], এমনকি আগামীতেও গ্রামীন ব্যাংকের জন্য করমুক্তি চেয়েছেন। কারণ তিনি নাকি গরীবদের জন্য সব বিলিয়ে (!) দিচ্ছেন। গ্রামীন ব্যাংকের প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে তিনি এটার প্রতিষ্ঠাতা ব্যবস্থাপনা পরিচালক। এই কারণে গ্রামীন ব্যাংক থেকে বেতন-ভাতা নেন- কত নেন এটা অবশ্য আমাদের জানা নেই। আচ্ছা, তিনি কি আমৃত্যু এটা থেকে বেতন-ভাতা নেবেন? যে মানুষটা গরীবের জন্য করে-করে, বলে-বলে মুখে ফেনা তুলে ফেলছেন তাঁর কি লজ্জা করে না এই গরীবদের ব্যাংক থেকে বেতন-ভাতা নিতে? এই টাকা থেকে কেনা খাবার তাঁর মুখে রোচে কেমন করে, পেটুক পেটটা এই খাবার ধরে রাখে কেমন করে? ওয়াক, বমি আসে না বলছেন, আপনি ইউনূস।
এমন না তাঁর দিন আনি দিন খাই টাইপের অবস্থা। ভাল কথা, আপনি ক-দিন পরপর হিল্লি-দিল্লি বক্তৃতা দিয়ে বৈদেশিদের কাছ থেকে যে ইউরো-ডলার আয় করেন তা কি দান করে দেন?
এটা আমার নিজস্ব মত। আমি মনে করি, ড. ইউনূস নামের এই মানুষটার মধ্যে গোলমাল লুকিয়ে আছে, এঁর পেটভরা ঝামেলা! সততার খোলসে অসৎ একজন মানুষ। এমন মানুষ নোবেল পেলেই তাঁকে নিয়ে কোলে করে ঘুরতে হবে এমনটা অন্তত আমি মনে করি না।
আমার স্পষ্ট বক্তব্য, মুখে গরীব-গরীব করলে ঋণ দিতে হবে বিনা সুদে (আমাদের এই কুৎসিত সময়ে [৬] বিনা সুদেই একজনের দারিদ্র হটানো অসম্ভব সেখানে ৩৭ পার্সেন্ট সুদ!) নইলে ভানবাজি, লম্বা-লম্বা বাতচিত বন্ধ। আপনি ইউনূস হোন বা ফজলে আবেদ ঠোঁট একেবারে সেলাই করে রাখুন। খবরদার, ভুলেও দারিদ্র বিমোচন, এই সব বাছাল উচ্চারণ করবেন না। বললে আমরাও:
সাদাকে সাদা বলিব, কালো না
ইউনূস-আবেদকে সুদখোর বলিব, ভাল না...।
*লেখাটা যখন শুরু করেছিলাম এরিমধ্যে এক কান্ড হয়েছে। আমাদের ইশকুল, তিন [৭] এটা যেখানে অবস্থিত এই বিল্ডিংটা রেলওয়ের হলেও মূলত উদীচীর অফিস।
যখন এই স্কুলটা শুরু করি তখন কোন জায়গা পাওয়া যাচ্ছিল না বলে উদীচীর লোকজনকে ধরাধরি করে এই জায়গাটা নিতে হয়েছিল। এরা আমাদেরকে বিনে ভাড়ায় স্কুল চালাবার জন্য বিল্ডিংটা দিয়েছিলেন। তাঁদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি। কিন্তু...।
আজ দেখছি এই বিল্ডিং-এর গায়ে এই পোস্টার সাঁটানো। ছোট-ছোট বাচ্চারা বানান করে করে পড়ছে।
অনুমান করি, এমন হাজার-হাজার পোস্টার ছাপিয়ে দিয়েছে ব্র্যাক ব্যাংক, বিনে পয়সায়। কেমন করে এই সব দানবরা সমস্ত কিছু গ্রাস করে ফেলে তার নমুনা দেখে আমি শিউরে উঠি।
সহায়ক সূত্র:
১. পদক...: http://www.ali-mahmed.com/2010/04/blog-post_23.html ৩. আনোয়ারা বেগম: http://www.ali-mahmed.com/2010/12/blog-post_9184.html
৪. আসে মহাপুরুষ: http://www.ali-mahmed.com/2010/11/blog-post_04.html
৫. মামা বাড়ির আবদার: http://www.ali-mahmed.com/2010/11/blog-post_12.html
৬. কুৎসিত সময়: http://www.ali-mahmed.com/2010/11/blog-post_06.html
৭. আমাদের ইশকুল, তিন: http://tinyurl.com/327aky3