৩১ জানুয়ারি। এই দিনটার সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত কিছু ঝামেলা আছে, এর কাছ থেকে আমার পরিত্রাণ নাই। মৃত্যুর আগ অবধি। কপাল। বেছে বেছে ঠিক এই দিনটাই আমার কাটে আদালতে। কান্ডটা গত বছরও হয়েছে [১]।, এ বছরও। কী কাকতালীয়!
আপাতত দৃষ্টিতে মনে হবে আমি একজন মামলাবাজ হয়ে যাচ্ছি বিষয়টা এমন না আমার সঙ্গে ড্রেনেরও যেন কী একটা ঝামেলা আছে, হুটহাট করে ড্রেন রাস্তার মাঝখানে চলে আসে।
আমার কেবল মনে হয় আদালতে মানুষ আসে ন্যায়ের জন্য কিন্তু সবচেয়ে বেশি অন্যায় হয় এখানেই। সমস্ত অন্যায়ের কথা বলা শুরু করলে মহাভারত টাইপের আস্ত একটা বই হয়ে যাবে। এখানে এসে নিজেকে বড়ো অসহায় লাগে কিন্তু এই জায়গাটায় যখন দরিদ্র মহিলা-বাচ্চাদের চরম দূর্গতি দেখি তখন নিজের কষ্ট তুচ্ছ মনে হয়। এদের তুলনায় আমার বেদনা কিছুই না।
টিআইবি (বাংলাদেশ) প্রধান চার জন আজ দায়েরকৃত মামলায় জামিন পেয়েছেন। উকিল সাহেব অপমানিত হয়ে তাঁদের বিরুদ্ধে মামলা করেছিলেন। হায় উকিল! এদের অনেকের কারণে কত মানুষ যে বিনা দোষে জেল খাটছে এর প্রকৃত হিসাব কে রাখে!
টিআইবির জরিপ অনুযায়ী এবার যে তথ্যটা দেয়া হয়েছে এর মধ্যে বিচার বিভাগে দুর্নীতির হার অন্য খাতগুলো ছাড়িয়ে, ৮৮%! এই নিয়ে বিচার বিভাগের উষ্মার শেষ নেই। আদালত প্রথমে টিআইবির কাছে জরিপের প্রশ্ন-উত্তরের সফট কপি চান। এটা দেখার জন্য প্রয়োজনীয় সফটওয়্যার না-থাকায় পরে আদালত হার্ড কপি চান। তারপর টিআইবিকে আদালত চা-চক্রে আমন্ত্রন জানান বিস্তারিত আলোচনা করার জন্যে। সবই ভাল, আদালতের এই ভঙ্গি অপছন্দ করার কিছু নেই। কিন্তু...।
পরিশেষে আদালত এই সিদ্ধান্ত দেন, টিআইবির জরিপ ভ্রান্ত ধারণার ভিক্তিতে করা। এখানটায় আমার ভাবনাও ভ্রান্ত হয় কারণ আদালত কেবল এটুকু বলেই ক্ষান্ত দিয়েছেন কিন্তু এই দিকনির্দেশনা দেননি এই জরিপটা কেমন করে করলে ভ্রান্ত হবে না।
আদালত কেন টিআইবি জরিপের কালিমার সবটুকু নিজেদের গায়ে মেখে বসে আছেন এই নিয়ে আমার বিস্ময়ের শেষ নেই। আমি নিজে টিআইবির এই জরিপের সঙ্গে একমত, এটা আমার নিজস্ব মত। জজ সাহেবরা ফেরেশতা না [২], প্রধান বিচারপতি নিজেও এটা স্বীকার করেছেন [৩] [৪]। অবশ্য টিআইবি জরিপে জজ সাহেবদের বিষয়টা তেমন আসেনি! টিআইবির এই জরিপে কোথাও বলা নেই কেবল জজ সাহেবরাই দায়ী। গোটা সিস্টেমটাকে বোঝানো হয়েছে।
যদিও সুপ্রিম কোর্টের বক্তব্য, "...টিআইবির তথ্যের উপর নির্ভর করে বিচার বিভাগের সঙ্গে সম্পৃক্ত কেউ ঘুষ অথবা হয়রানির সঙ্গে জড়িত বলে সনাক্ত করা সম্ভব হয়নি...।"
মাননীয় আদালত সবিনয়ে বলি, এটা আমার কাছে জোকস অভ দ্য ইয়ার। আদালত চলাকালীন কোন একদিন যদি এই দেশের সমস্ত বিচার বিভাগের অংশ পেশকারদের পকেট সার্চ করা হয় তাহলে দেখবেন গাদা-গাদা টাকা বের হবে।
আচ্ছা, জজ সাহেবরা কি আমার একটা প্রশ্নের উত্তর দেবেন, এই সিস্টেমের জন্য তাঁরা নিজেরা কী একটুও দায়ী না? আদালতের একটা নোটিশ এক বছরেও প্রাপককে বিলি করা হয় না, কেন? এই প্রশ্নটা কি তাঁরা কখনও জানতে চেয়েছেন?
আদালতে যখন শুনানি হয় যেসব আইনের বই থেকে উদ্ধৃতি দেয়া হয় সেইসব বই জজ সাহেবরা দেখতে চান, এটাই স্বাভাবিক। এই বইগুলো সরকারের টাকায় কেনা, বইগুলো আদালত লাইব্রেরিতেই থাকে কিন্তু এই বইগুলো লাইব্রেরি থেকে জজ সাহেব পর্যন্ত পৌঁছে দিতে বাদী বা বিবাদীর গাঁট থেকে ২০০ টাকা বেরিয়ে যায়! এমন কতশত উদাহরণ!
বিচার বিভাগের উপর বনবন করে ছড়ি ঘোরাবার জন্য সংসদ মুখিয়ে আছে। আমি এর ঘোর বিরোধিতা করি। যেদিন এই ব্যবস্থা চালু হবে সেদিনই সব ধসে পড়বে, আমাদের দাঁড়াবার আর জায়গা থাকবে না। কিন্তু আদালতের কোন সমালোচনা করা যাবে না এটার আমি ঘোর বিরোধী। একজন বিচারপতি যখন ট্রফিক কনস্টেবলকে কান ধরান সে কেন সিগন্যালের লালবাতি জ্বলে উঠার পর হাত উঠিয়েছিল। যে কারণে শত-শত গাড়ির সঙ্গে বিচারপতির গাড়িও আটকা পড়ে স্রেফ এই কারণে।
ভাগ্যিস এটা উন্নত দেশ না, হলে উল্টা এই বিচারপতিরই বিচার হতো। যে বিচারপতিরা নিজেদের ঈশ্বর ভাবেন তাঁদেরকে কি আমি মনে করিয়ে দেব অন্য দেশ হলে কি হতো? অষ্ট্রেলীয় পুলিশ তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বব হককে জরিমানা করেছিল। প্রধানমন্ত্রীর অপরাধ তিনি সিটবেল্ট বাঁধেননি। প্রধানমন্ত্রী এই ভুলের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেন এবং ১০০ ডলার জরিমানা পরিশোধ করেন। কিন্তু এর পূর্বেই ট্রাফিক অথরিটির চিফ মিডিয়ায় বলেন, 'DOES NOT MATTER YOU ARE PRIME MINISTER OR POST MASTER, YOU HAVE TO PAY THE FINE.
একজন মাহমুদুর রহমানকে আদালত অবমাননার শাস্তি দেয়াটা কতটুকু যৌক্তিক এই প্রশ্ন উত্থাপন করব না কিন্তু তাঁকে ছয় মাসের সাজা না-দিয়ে ছয় দিনের সাজা দিলে আকাশ তো আর ভেঙ্গে পড়ত না। প্রতীক এইটা দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করতে তো কেউ আটকাচ্ছিল না! কিন্তু তাঁকে আপিল করার সুযোগ কেন দেয়া হলো না?
এখানে প্রধান বিচারপতির বক্তব্য স্মর্তব্য: "...স্মরণ রাখতে হবে আমাদের কারোরই স্বাধীন ক্ষমতা নেই। যেমন চাঁদের নিজের কোন আলো নেই, ...সংবিধান জনগণের ইচ্ছায় প্রতিফলিত...তাদের ক্ষমতাই প্রকৃত ক্ষমতা।...বিচার বিভাগের নিজেদের মত জবাবদিহি রয়েছে। বিচার বিভাগ প্রকৌশলী, চিকিৎসক বা অন্যদের জবাবদিহির মত নয়। জবাবদিহি ব্যক্তি থেকে ব্যক্তিতে আলাদা হয়। কবির জবাবদিহি তাঁর পাঠকের কাছে। বিচারকদের জবাবদিহি রায়ের যুক্তির মধ্যে...।" (প্রথম আলো, ১৬.০১.১১)
আমার স্পষ্ট কথা, বিচারক যেহেতু দেবতা না তাঁরও ভুল হতে পারে, হয় এবং ভুল হলে আমরা এটা অবশ্যই বলব, আপনি ভুল করেছেন। এটা যদি আদালত অবমাননা হয় তাহলে তাই সই।
পরিশিষ্ট: আমাকে প্রাণে মেরে ফেললেও অন্তত আমি নিজে আদালতে ন্যায় চাইতে যাব না।
সহায়ক সূত্র:
১. জাস্টিস: http://www.ali-mahmed.com/2010/02/blog-post_08.html
২. জজ সাহেব: http://www.ali-mahmed.com/2008/07/blog-post_03.html
৩. প্রধান বিচারপতি: http://www.ali-mahmed.com/2010/11/blog-post_13.html
৪. তালার চাবি...: http://www.ali-mahmed.com/2010/11/blog-post_25.html
1 comment:
আমি কৃতজ্ঞ , কারণ আমি খুঁজে পাওয়া যায় ঠিক কি আমি খুঁজছিলাম. আপনি আমার 4 দিনের দীর্ঘ মৃগয়া শেষ করেছি ! ঈশ্বর আপনার মানুষ আশীর্বাদ করা . হ্যাভ এ নাইস ডে . Bye চান ভাগ্য আপনার !
Post a Comment