একটা দেশ কতটা এগিয়ে এর একটা মাপকাঠি এটাও হতে পারে অন্য দেশের লোকজনরা কতটা আগ্রহ নিয়ে সেই দেশটা বোঝার জন্য, দেখার জন্য আসেন। একবার এক অস্ট্রেলিয়ানের সঙ্গে আমার কথা হচ্ছিল। মানুষটা দুবাই যাচ্ছেন ঘুরতে। আমি তাকে বললাম, তুমি দুবাইয়ে কী দেখবে, সাজানো-গোছোনো কাঁচের ঘর! এমন কাঁচের ঘরের তো তোমার দেশেও অভাব নাই। দেখতে হলে তুমি বাংলাদেশে আসো।
ব্যাটা বাংলাদেশের নাম শুনেছে। অবশ্য তখন মনে হচ্ছিল না-শুনলেই ভাল হত। প্লেনে সবে সে লার্জ জিন সাবড়ে আরেকটা নিয়েছে বলেই সম্ভবত মুখে কিছু আটকাচ্ছিল না। ফড়ফড় করে বলে যাচ্ছিল বলেই হয়তো আমার ভুলভাল ইংরাজিতে কথা চালিয়ে যেতে সমস্যা হচ্ছিল না।
তার সাফ কথা, ঘোরার জন্য বাংলাদেশ সেফ না। সে তার পরিচিত লোকজনের কার সঙ্গে কখন বাংলাদেশে বিচ্ছিরি কী হয়েছে একের-পর-এক এর ফিরিস্তি দেয়া শুরু করল।
আমি চিঁ চিঁ করে বলেছিলাম, দেখো, তুমি দু-চারজনের উদাহরণ দিয়ে বললে এদের সঙ্গে সমস্যা হয়েছে কিন্তু দেখবে তোমার দেশেরই শত-শত মানুষ বাংলাদেশ ঘুরে গেছে, সঙ্গে নিয়ে গেছে চমৎকার সব স্মৃতি। আচ্ছা, এই সব বাদ দাও, তুমি যদি বাংলাদেশে ঘুরতে আসো আমি নিজে তোমার গাইড হবো। সমস্ত কাজকাম ফেলে তোমাকে সময় দেব।
এটা কোন বানানো কথা ছিল না- আমার মনের কথা। আমি যদি একজনের ধারণা পাল্টে দিতে পারি তাহলে সে দেশে গিয়ে শতমুখে রসিয়ে রসিয়ে এই গল্প করবে, হেই ম্যান, গেসিলাম বেংলাদেশে...।
কোন একটা দেশে কেউ হুট করে চলে আসেন না, তাঁকে নিয়ে আসতে হয়। আনার জন্য অনেক কায়দা-কানুন আছে। ওই দেশে দেখতে আসার জন্য কী কী আছে তা ফলাও করে জানানো। সবচেয়ে জরুরি হচ্ছে তাদের মধ্যে এই বিশ্বাসটা তৈরি করা, এই দেশে প্রচলিত আইনের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে এঁরা নির্বিঘ্নে ঘুরে বেড়াতে পারবেন। আইনের প্রতি শ্রদ্ধার প্রসঙ্গটা এই কারণে উল্লেখ করলাম একজন শাহরুখ খান [১] যখন প্রকাশ্যে সিগারেট হাতে মহড়া দেন তখন আমাদের দেশের দায়িত্বশীল লোকদের মধ্যে একজনও শিরদাঁড়া সোজা করে দাঁড়াতে পারেনি এটা নিয়ে কথা বলার জন্য!
২০০৮ সালে আমাদের দেশে পর্যটক এসেছেন ৪ লাখ ৬৭ হাজার ৩৩২ জন। এরপর, ২০০৯, ২০১০? এটা পত্রিকার খবর কিন্তু কেউ কী বিশ্বাস করবে, আমাদের দেশের পর্যটন বিভাগের কাছে বিগত দুই বছরে কতজন পর্যটক এসেছেন তার কোন হিসাব নেই! দোষটা অবশ্য পর্যটন বিভাগের না। এই হিসাবটা রাখে পুলিশের বিশেষ শাখা (এসবি)। এসবির কাছে পর্যটন বিভাগ চিঠির পর চিঠি দিয়ে হাল ছেড়ে দিয়েছে কিন্তু আমাদের পুলিশ মহোদয়গণ এর উত্তর দেননি!
কেন? পুলিশ মহোদয়গণের বক্তব্য, 'নরোম তারের' জটিলতার কারণে এই তথ্য দেয়া যাচ্ছে না। না, তারা 'নরোমতার' বলেননি বলেছেন, সফটওয়্যার। তাদের সফটওয়্যারের থেকে এ তথ্য দিতে গেলে নাকি নতুন প্রোগ্রাম বানাতে হবে। বিদেশ থেকে লোকজন না-আসা পর্যন্ত ইত্যাদি ইত্যাদি। ভাগ্যিস, এরা বলে বসেননি, তারটা নরোম হয়ে যাওয়ায় তথ্যসব গলে যাবে বিধায় দিতে সমস্যা হচ্ছে! আমি নিজে খুব ভাল সফটওয়্যার সম্বন্ধে বুঝি না কিন্তু অল্প জ্ঞান নিয়েই জোর দিয়ে বলতে পারব এখনকার সময়ে এটা ফালতু একটা যুক্তি। আর কিছু না হোক অন্তত এরা যেখান থেকে এন্ট্রি দিচ্ছে সেখান থেকে নামধাম নিয়ে এক্সেল শিটে চলনসই একটা কিছু দাঁড় করিয়ে ফেলা যায়।
এই হচ্ছে আমাদের দেশের পর্যটন নিয়ে আমাদের ভাবনা। ৫০ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করে নতুন এয়ারপোর্ট বানাবার জন্য আমাদের উল্লাসে ক্লান্তি নেই অথচ যে আর্ন্তজাতিক এয়ারপোর্টটা আছে এটাকে জবরজং বানাতে আমরা পিছপা হই না। কেন এই এয়ারপোর্টটা আনাচে কানাচে আমাদের সমুদ্রসৈকত, সুন্দরবন, চা-বাগানের ছবি দিয়ে আমরা ভরে দিচ্ছি না? একটা দেশকে বুঝতে হলে প্রথমেই দেখতে হয় তার এয়ারপোর্ট, একজন বিদেশি এসে দেখবেটা কী, ঘন্টা! কমলাপুর, বিমানবন্দর স্টেশনে আমাদের দর্শনীয় স্থানের কয়টা নমুনা পাওয়া যাবে? আমাদের ভাবনার কী দৈন্যতা!
আর আমরা বিদেশী কাউকে দেখলে যেভাবে হামলে পড়ি বেচারা নিজেকে সম্ভবত চিড়িয়াখানার চিড়িয়া মনে করে।
একবার কি একটা কাজে স্টেশনে গেছি, লোকজনকে দেখি গোল হয়ে দাঁড়িয়ে তামাশা দেখছে। একজনকে জিজ্ঞেস করে জানা গেল, আগরতলা থেকে কেনিয়ার একজন পর্যটক এসেছেন। সবাই তাঁকে দেখছে।
আমি হতভম্ব, একজন মানুষকে এমন অসভ্যের মত দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখা কেমন করে সম্ভব!
যে দেশের যে চল- একজন রেল পুলিশকে নাস্তা-পানির পয়সা দিয়ে পাঠানো হয়েছিল জনতাকে হটিয়ে দিতে। বীর জনতা কী আর হটে! পরে স্টেশন সুপারিনটেনডেন্টের কামরায় বসার ব্যবস্থা করায় অনেকখানি রক্ষা! মানুষটা বিব্রত বোধ করবেন বলে অনেক দূর থেকে ছবিটা উঠানো হয়েছিল।
অন্য এক লেখায় আমি লিখেছিলাম [২]:
"এই দেশে একটা ডকুমেন্টরি বানালেও দেখবেন, কত ভাবে দেশকে ছোট করা যায় তার প্রাণান্তকর চেষ্টা। যেন বন্যা-সিডর, মাদ্রাসা, অভাব এসব ব্যতীত আর দেখাবার কিছু নেই।
প্রবাসে এক বাঙ্গালি মহিলা জুতা কেনবার জন্য এ দোকান-ও দোকান ছুটে বেড়াচ্ছিলেন, ঠিক পছন্দসই জুতাটা চোখে লাগছিল না। তার এই অস্থিরতা দেখে একজন সেলস-গার্ল বলল, 'তোমার সমস্যাটা কী, জুতা নিয়ে তুমি এত চুজি কেন? তোমাদের দেশের মহিলারা তো জুতাই পায়ে দেয় না'!
আমার ওই সেলস-গার্লকে চাবকাতে ইচ্ছা করে না, কারণ সে দেখেছে নগ্ন পায়ের মহিলাদের। এই দেশের তথাকথিত বুদ্ধিজীবীদের পশ্চাদদেশে গদাম করে লাথি মারতে সুতীব্র ইচ্ছা জাগে। কারণ, এরা পৃথিবীর কাছে আমাদের দেশটাকে এভাবেই তুলে ধরেন- খালি পায়ের মা, তাঁর অপুষ্ট শরীর, কোলে ততোধিক অপুষ্ট দু-চারটা শিশুসহ। টাকা কামাবার ধান্দায় এরা পারলে মাকেও বিক্রি করে দেবেন, অবলীলায় ।
যাই হোক, তারপরও দেশকে তুলে ধরার চেষ্টা হয়। কেউ-না-কেউ এগিয়ে আসেন। যেমনটা ক্রিকেটকে উপলক্ষ করে 'বিউটিফুল বাংলাদেশ' নামে সাড়ে তিন মিনিটের অসাধারণ এই প্রামাণ্যচিত্র বানানো হয়েছে। এর নির্মাতা গাজী শুভ্র, ক্যামেরায় জনাব খসরু। যা ক্রমশ চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে। আমি আশায় বুক বাঁধি এমন অজস্র প্রামাণ্যচিত্র বানাবে এই দেশেরই দামাল ছেলেরা। যার সৌন্দর্য ছড়িয়ে পড়বে দেশ থেকে দেশান্তরে। ভিনদেশি কারও সঙ্গে অন্যত্র কোথাও দেখা হয়ে গেলে সে ঝলমলে মুখে বলবে, হেই ম্যান, গেসিলাম টোমাডের ডেসে...। আমি তখন কিচ্ছু বলব না কেবল জলভরা চোখে সামনের অস্পষ্ট মানুষটার দিকে তাকিয়ে থাকব।
সহায়ক সূত্র:
১. শাহরুখ...: http://www.ali-mahmed.com/2010/12/blog-post_11.html
২. কষ্ট-মনন-দারিদ্রতা এবং ছফা পুরান: http://www.ali-mahmed.com/2009/05/blog-post_15.html
4 comments:
মাহমেদ ভাই, নেট এ ঘুরাঘুরির সুবাধে অনেক রকম ভিডিও চিত্র দেখা হয়েছে। বিশ্বাস করুন এই ভিডিও টা দেখে বুকের ভেতর একটা অন্যরকম শূণ্যতা অনুভব করলাম। চোখ ভিজে উঠলো। আমাদের মধ্যেই কিছু বিষধর সাপ ঘুরে বেড়াচ্ছে, কিছু অপদার্থ দেশ দাপিয়ে বেড়ায়, আর নীরবে কী বিপ্লবই না হয়ে যাচ্ছে শুভ্র আর খসরুদের হাত ধরে!দুনিয়াময় ঘুরে বেড়ানো একজন পর্যটক এই অসাধারন প্রামাণ্যচিত্র দেখার পর ও বাংলাদেশে আসবেনা এ স্রেফ অবিশ্বাস্য!
"...দুনিয়াময় ঘুরে বেড়ানো একজন পর্যটক এই অসাধারন প্রামাণ্যচিত্র দেখার পরও বাংলাদেশে আসবেনা এ স্রেফ অবিশ্বাস্য!...।"
আসবে, অবশ্যই আসবে, বানের জলের মত আসবে। ক্যামেরার আমি কিছুই বুঝি না তবুও আমার নিজেরই ইচ্ছা করছে, একটা ক্যামেরা নিয়ে ঝাপিয়ে পড়ি...। @Shameem
শেষ লাইনটা পড়ে চোখে পানি চলে এল কেন বলুন তো?
কী জানি, হয়তো আপনার মন দুর্বল, তাই! @Anonymous
Post a Comment