আমাদের দেশে মনন-প্রতিভা বিক্রি হয় কেজি দরে! আমরা প্রতিভাবানদের মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করি। মৃত্যু হলেই নড়েচড়ে বসি। তখন কাঁদতে কাঁদতে অন্তর্বাস ভিজিয়ে ফেলি।
আবদুর রহমান বয়াতি মৃত্যুর পূর্বে বিভিন্ন জটিল অসুখে ছটফট করতেন আর এই কথাটা বিড়বিড় করতেন, '...দেশে আর কেউ যেন নামের পূর্বে বয়াতি শব্দটা যোগ না করেন। তাহলে তাঁকেও আমার মত বিনাচিকিৎসায় মৃত্যুবরণ করতে হবে...'।
শাহ আবদুল করিম 'খোয়াব' নামের এক কাগজের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, '...জীবিত করিম আসলে কেউ না। কিন্তু মৃত করিমের হাড্ডি নিয়েও একদিন ব্যবসা হবে...'।
এই কথাটাও সম্ভবত শাহ আবদুল করিম বলেছিলেন, 'আমার সমস্ত পদক-ক্রেস্ট বিক্রি করেও পাঁচ কেজি চাউল আসবে না...'।
'দুস্থ-শিল্পী' বলতে চালু একটা কথা আছে। এই সব শিল্পীদের জন্য আমরা 'নাচাগানা'-নেচেকুঁদে চিকিৎসার জন্য টাকা যোগাড় করার এক ধরনের অশ্লীলতা করি, উল্লসিত হই। আমরা এই দেশের প্রতিভাবানদের ভিক্ষুকের পর্যায়ে নামিয়ে এনে এক ধরনের বিমল আনন্দ বোধ করি। এটা কেন করি?
আজকের অতিথি লেখক, জার্মানি থেকে আরাফাতুল ইসলাম। তাঁর লেখায় এর একটা সমাধানের উপায় বের হয়ে এসেছে,
"মুক্তিযোদ্ধা, সংগীতশিল্পী, ক্রিকেটার আজম খানকে আর 'পপগুরু' ডাকব কিনা বুঝতে পারছি না। দিনকয়েক আগে এটিএন নিউজ আজম খান এর একটি সাক্ষাৎকার প্রচার করেছিল। সেখানে পপগুরু নিজেই বলেছিলেন, '...গুরু শব্দটায় শুরুতেই আপত্তি ছিল তাঁর। তারচেয়ে বরং আজম ভাই ডাকলেই খুশি তিনি'।
যাহোক, পপগুরু বা পপসম্রাট খেতাবটি তিনি নিজেই নিজের নামের সঙ্গে জুড়ে দেননি। বরং জনগণের ভালোবাসা এই 'খেতাব' এনে দিয়েছে তাঁকে। সেই জনগণের হয়ে তাই আমিও নিদ্বির্ধায় পপগুরুই বলব। ভাই বলতে গেলে কেমন যেন একটা দূরত্ব তৈরি হয়ে যাচ্ছে। তারচেয়ে গুরু অনেক কাছের।
সেই গুরু চলে গেলেন। গণমাধ্যমের কল্যাণে জার্মানি বসেই জানলাম, পপসম্রাট খ্যাত সংগীতশিল্পী ও মুক্তিযোদ্ধা আজম খান আর নেই (ইন্নালিল্লাহি…রাজিউন)। তিনি আজ রোববার সকাল ১০টা ২০ মিনিটে ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) ইন্তেকাল করেন। (সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো)
পপগুরুর গানের সঙ্গে পরিচয় সেই আশির দশক থেকে। মাঝে মাঝে রেডিওতে শুনতাম তাঁর গান। তখন ঠিক কোন কোন গান শুনেছিলাম এখন বলা মুশকিল৷ তবে, মনে আছে ‘'রেললাইনের ওই বস্তিতে' গানটি শুনে খানিকটা বেদনা অনুভব করেছি। তখন সাবিনা ইয়াসমিনের ‘'খোকা ফিরবে ঘরে ফিরবে' গানটিও বেশ পছন্দ ছিল।
বাংলাদেশের সংগীতাঙ্গন সবসময়ই রঙিন। কিন্তু পপগুরু অসুস্থ হওয়ার পর এই অঙ্গনের করুণ দশা কিছুটা হলেও আরেকবার ফুটে উঠল। গত বছর ক্যান্সার ধরে পড়ার পর পপগুরুর চিকিৎসার জন্য অর্থ সহায়তার প্রয়োজন পড়ে। তাঁর সহায়তায় এগিয়ে এসেছিল গণমাধ্যম, বেসরকারি ব্যাংক, সরকার। সিংগাপুরে গিয়ে চিকিৎসা নিয়েছিলেন গুরু। যদিও সে চিকিৎসা শেষ না করেই দেশে ফিরতে হয় তাঁকে।
আজম খানকে নিয়ে মনে একটা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে, এই সংগীতস্রষ্টার সৃষ্টি নিয়ে আমরা সবাই গর্ব করি। বাংলাদেশ, আলাল ও দুলাল, ওরে সালেকা ওরে মালেকা, অভিমানী, আমি যারে চাইরে, হাইকোর্টের মাজারে, এত সুন্দর দুনিয়ায়, জীবনে কিছু পাব নারে, পাঁপড়ি কেন বুঝে না, চার কলেমা সাক্ষী দিবে, ও চাঁদ সুন্দর রূপ তোমারসহ তাঁর অনেকগুলো গান ব্যাপক জনপ্রিয়। কিন্তু এসব গানের কপিরাইট কার কাছে?
ইন্টারনেট ঘেঁটে পপগুরুর গানের কপিরাইট বিষয়ক কোন কিছু পেলাম না। আমার মনে হয়, এতগুলো জনপ্রিয় গানের ন্যায্য কপিরাইট পেলে আজম খানকে চিকিৎসার জন্য অন্যের সহায়তার প্রয়োজন হতো না। অপেক্ষা করে ক্যান্সারের প্রকোপও বাড়াতে হতো না।
একটি আন্তর্জাতিক রেডিওতে কাজের সুবাদে সংগীত কপিরাইটের নানা দিক সম্পর্কে সরাসরি জানার সুযোগ হয়েছে আমার। সেই অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, ইন্টারনেটে, রেডিওতে, টিভিতে যেহারে আজম খানের গান ব্যবহার করা হচ্ছে, তাতে কপিরাইটের ন্যায্য হিস্যা পেলে পপগুরু নিঃসন্দেহে আর্থিকভাবে ব্যাপক সচ্ছল থাকতেন।
আমাদের দেশে এখন কপিরাইট নিয়ে আইন হয়েছে। ইন্টারনেটের সুবাদে মানুষের মধ্যে কপিরাইট নিয়ে সচেতনতাও তৈরি হচ্ছে৷ তাই, আমি মনে করি পপগুরুর সৃষ্টিগুলোর কপিরাইটের বিষয়টি সুরাহা করা উচিত। তাঁর পরিবারকে এসব গানের ন্যায্য হিস্যা দেওয়া উচিত। সরকার এই উদ্যোগ নিতে পারে, নামজাদা সংগীতশিল্পীরাও এই বিষয়ে চাপ সৃষ্টি করতে পারেন।
কেউ কেউ বলতে পারেন, কয়েক দশক আগের গানের আবার কপিরাইট! তাদের জন্য একটা ছোট্ট উদাহরণ, জর্জ হ্যারিসন কিংবা জন লেননকে একনামে সবাই চেনেন। তাঁদের ব্যান্ড ‘বিটলস’ এর গান অবৈধভাবে বিক্রি শুরু করে BlueBeat.com ৷ ২০০৯ সালে এই ওয়েবসাইটের মাধ্যমে বিটলসের গান বিক্রি শুরু হয়৷ একেকটি গানের দাম ২৫ সেন্ট৷ বিষয়টি গড়ায় আদালতে৷ আদালতের রায় যায় সেই ওয়েবসাইটের বিরুদ্ধে৷ এরপর মিলিয়ন ডলার জরিমানা দিয়ে মিমাংসা৷ সংগীত কপিরাইট বিষয়ক মামলার একটি ছোট্ট উদাহরন এটি৷ এরকম উদাহরণ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ভুরিভুরি।"
তথ্য সহায়তা:
১. অনুবাদঃ কপিরাইট / মেধাস্বত্ব: http://www.sachalayatan.com/hussainuzzaman/1577
২. পপসম্রাট আজম খান আর নেই: http://www.prothom-alo.com/detail/date/2011-06-05/news/159975
৩. অবৈধভাবে বিটলসের গান বিক্রির অর্থদন্ড সাড়ে ৯ লক্ষ ডলার!: http://www.dw-world.de/dw/article/0,,14950768,00.html
আবদুর রহমান বয়াতি মৃত্যুর পূর্বে বিভিন্ন জটিল অসুখে ছটফট করতেন আর এই কথাটা বিড়বিড় করতেন, '...দেশে আর কেউ যেন নামের পূর্বে বয়াতি শব্দটা যোগ না করেন। তাহলে তাঁকেও আমার মত বিনাচিকিৎসায় মৃত্যুবরণ করতে হবে...'।
শাহ আবদুল করিম 'খোয়াব' নামের এক কাগজের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, '...জীবিত করিম আসলে কেউ না। কিন্তু মৃত করিমের হাড্ডি নিয়েও একদিন ব্যবসা হবে...'।
এই কথাটাও সম্ভবত শাহ আবদুল করিম বলেছিলেন, 'আমার সমস্ত পদক-ক্রেস্ট বিক্রি করেও পাঁচ কেজি চাউল আসবে না...'।
'দুস্থ-শিল্পী' বলতে চালু একটা কথা আছে। এই সব শিল্পীদের জন্য আমরা 'নাচাগানা'-নেচেকুঁদে চিকিৎসার জন্য টাকা যোগাড় করার এক ধরনের অশ্লীলতা করি, উল্লসিত হই। আমরা এই দেশের প্রতিভাবানদের ভিক্ষুকের পর্যায়ে নামিয়ে এনে এক ধরনের বিমল আনন্দ বোধ করি। এটা কেন করি?
আজকের অতিথি লেখক, জার্মানি থেকে আরাফাতুল ইসলাম। তাঁর লেখায় এর একটা সমাধানের উপায় বের হয়ে এসেছে,
"মুক্তিযোদ্ধা, সংগীতশিল্পী, ক্রিকেটার আজম খানকে আর 'পপগুরু' ডাকব কিনা বুঝতে পারছি না। দিনকয়েক আগে এটিএন নিউজ আজম খান এর একটি সাক্ষাৎকার প্রচার করেছিল। সেখানে পপগুরু নিজেই বলেছিলেন, '...গুরু শব্দটায় শুরুতেই আপত্তি ছিল তাঁর। তারচেয়ে বরং আজম ভাই ডাকলেই খুশি তিনি'।
যাহোক, পপগুরু বা পপসম্রাট খেতাবটি তিনি নিজেই নিজের নামের সঙ্গে জুড়ে দেননি। বরং জনগণের ভালোবাসা এই 'খেতাব' এনে দিয়েছে তাঁকে। সেই জনগণের হয়ে তাই আমিও নিদ্বির্ধায় পপগুরুই বলব। ভাই বলতে গেলে কেমন যেন একটা দূরত্ব তৈরি হয়ে যাচ্ছে। তারচেয়ে গুরু অনেক কাছের।
সেই গুরু চলে গেলেন। গণমাধ্যমের কল্যাণে জার্মানি বসেই জানলাম, পপসম্রাট খ্যাত সংগীতশিল্পী ও মুক্তিযোদ্ধা আজম খান আর নেই (ইন্নালিল্লাহি…রাজিউন)। তিনি আজ রোববার সকাল ১০টা ২০ মিনিটে ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) ইন্তেকাল করেন। (সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো)
পপগুরুর গানের সঙ্গে পরিচয় সেই আশির দশক থেকে। মাঝে মাঝে রেডিওতে শুনতাম তাঁর গান। তখন ঠিক কোন কোন গান শুনেছিলাম এখন বলা মুশকিল৷ তবে, মনে আছে ‘'রেললাইনের ওই বস্তিতে' গানটি শুনে খানিকটা বেদনা অনুভব করেছি। তখন সাবিনা ইয়াসমিনের ‘'খোকা ফিরবে ঘরে ফিরবে' গানটিও বেশ পছন্দ ছিল।
বাংলাদেশের সংগীতাঙ্গন সবসময়ই রঙিন। কিন্তু পপগুরু অসুস্থ হওয়ার পর এই অঙ্গনের করুণ দশা কিছুটা হলেও আরেকবার ফুটে উঠল। গত বছর ক্যান্সার ধরে পড়ার পর পপগুরুর চিকিৎসার জন্য অর্থ সহায়তার প্রয়োজন পড়ে। তাঁর সহায়তায় এগিয়ে এসেছিল গণমাধ্যম, বেসরকারি ব্যাংক, সরকার। সিংগাপুরে গিয়ে চিকিৎসা নিয়েছিলেন গুরু। যদিও সে চিকিৎসা শেষ না করেই দেশে ফিরতে হয় তাঁকে।
আজম খানকে নিয়ে মনে একটা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে, এই সংগীতস্রষ্টার সৃষ্টি নিয়ে আমরা সবাই গর্ব করি। বাংলাদেশ, আলাল ও দুলাল, ওরে সালেকা ওরে মালেকা, অভিমানী, আমি যারে চাইরে, হাইকোর্টের মাজারে, এত সুন্দর দুনিয়ায়, জীবনে কিছু পাব নারে, পাঁপড়ি কেন বুঝে না, চার কলেমা সাক্ষী দিবে, ও চাঁদ সুন্দর রূপ তোমারসহ তাঁর অনেকগুলো গান ব্যাপক জনপ্রিয়। কিন্তু এসব গানের কপিরাইট কার কাছে?
ইন্টারনেট ঘেঁটে পপগুরুর গানের কপিরাইট বিষয়ক কোন কিছু পেলাম না। আমার মনে হয়, এতগুলো জনপ্রিয় গানের ন্যায্য কপিরাইট পেলে আজম খানকে চিকিৎসার জন্য অন্যের সহায়তার প্রয়োজন হতো না। অপেক্ষা করে ক্যান্সারের প্রকোপও বাড়াতে হতো না।
একটি আন্তর্জাতিক রেডিওতে কাজের সুবাদে সংগীত কপিরাইটের নানা দিক সম্পর্কে সরাসরি জানার সুযোগ হয়েছে আমার। সেই অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, ইন্টারনেটে, রেডিওতে, টিভিতে যেহারে আজম খানের গান ব্যবহার করা হচ্ছে, তাতে কপিরাইটের ন্যায্য হিস্যা পেলে পপগুরু নিঃসন্দেহে আর্থিকভাবে ব্যাপক সচ্ছল থাকতেন।
আমাদের দেশে এখন কপিরাইট নিয়ে আইন হয়েছে। ইন্টারনেটের সুবাদে মানুষের মধ্যে কপিরাইট নিয়ে সচেতনতাও তৈরি হচ্ছে৷ তাই, আমি মনে করি পপগুরুর সৃষ্টিগুলোর কপিরাইটের বিষয়টি সুরাহা করা উচিত। তাঁর পরিবারকে এসব গানের ন্যায্য হিস্যা দেওয়া উচিত। সরকার এই উদ্যোগ নিতে পারে, নামজাদা সংগীতশিল্পীরাও এই বিষয়ে চাপ সৃষ্টি করতে পারেন।
কেউ কেউ বলতে পারেন, কয়েক দশক আগের গানের আবার কপিরাইট! তাদের জন্য একটা ছোট্ট উদাহরণ, জর্জ হ্যারিসন কিংবা জন লেননকে একনামে সবাই চেনেন। তাঁদের ব্যান্ড ‘বিটলস’ এর গান অবৈধভাবে বিক্রি শুরু করে BlueBeat.com ৷ ২০০৯ সালে এই ওয়েবসাইটের মাধ্যমে বিটলসের গান বিক্রি শুরু হয়৷ একেকটি গানের দাম ২৫ সেন্ট৷ বিষয়টি গড়ায় আদালতে৷ আদালতের রায় যায় সেই ওয়েবসাইটের বিরুদ্ধে৷ এরপর মিলিয়ন ডলার জরিমানা দিয়ে মিমাংসা৷ সংগীত কপিরাইট বিষয়ক মামলার একটি ছোট্ট উদাহরন এটি৷ এরকম উদাহরণ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ভুরিভুরি।"
তথ্য সহায়তা:
১. অনুবাদঃ কপিরাইট / মেধাস্বত্ব: http://www.sachalayatan.com/hussainuzzaman/1577
২. পপসম্রাট আজম খান আর নেই: http://www.prothom-alo.com/detail/date/2011-06-05/news/159975
৩. অবৈধভাবে বিটলসের গান বিক্রির অর্থদন্ড সাড়ে ৯ লক্ষ ডলার!: http://www.dw-world.de/dw/article/0,,14950768,00.html
4 comments:
Great!
আপনি কি বলতে চান, সরকার কি আজম খানদের কোলে বসিয়ে খাওয়াবে?
সহমত, চমৎকার একটা লেখা লিখেছেন আরাফাতুল ইসলাম! @Masud
"সরকার কি আজম খানদের কোলে বসিয়ে খাওয়াবে?"
সরকার কাকে খাওয়াবে, সরকারকে তো আমরাই খাওয়াই! কঠিন ভাষায়, সরকারকে আমরা, জনগণরা বেতন দিয়ে পুষি। 'সরকার কোলে বসিয়ে খাওয়াবে', এই সব 'ফাজিলিয়া' কথা বলার কোন অর্থ নাই। তেমনি লেখা না-বুঝলে পড়ারও কোন অর্থ নাই!
আজকাল আমার এখানে অজ্ঞাত নামধারী লোকজনের 'পদকাদা' বড়ো বেড়ে গেছে। @Anonymous
Post a Comment