আজকের অতিথি ফারাজানা আফরোজ। তিনি লিখেছেন ভিন্ন এক ভুবন নিয়ে। যে ভুবনটা আমাদের পুরুষদের কাছে ছায়া-ছায়া, তমোময়! এই ভুবনটা স্পষ্ট হতে হতে আমাদের চুলে পাক ধরে, মেঘে মেঘে বেলা বয়ে যায়। অথচ একটাই জীবন আমাদের এবং বড়ো স্বল্প এ জীবন! আহ, জীবন! সামান্য এই বিষয়টা বোঝার জন্য বাবা হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করাটা বোকামী, একধরনের অন্যায়! ফারজানা আফরোজ লিখছেন:
"প্রথমদিকে বিয়ের পর বাবার বাড়ি যাওয়ার সৌভাগ্য আমার কমই হয়েছে। তখন আমাদের বাড়িতে যাওয়াটা খুব ঝক্কির ছিল। রিকশা-ট্রেন-বাস। দেখা গেছে, যেদিন গেছি সেদিন সন্ধ্যায়ই
ফিরে আসতে হয়েছে। এর জন্য অনেকটা আমার স্বামী দায়ী। ট্রেন, বাসে করে আমাদের বাড়িতে যাওয়ার অনেক ঝক্কির তাই সে গাড়ি ছাড়া যাবে না। তার আবার নিজের গাড়ি নাই। গাড়ি ভাড়া করতে হয়। তার কাছে গাড়ি ভাড়ার আবার সব সময় টাকা থাকে না, এইসব। লাটসাহেব আর কী! তবে এই লাটসাহেবের বদৌলতে একেবারে যে থাকিনি এটা বললে মিথ্যাচার হবে।
একদম যে থাকিনি এমনও না, অনেক সময় সপ্তাহ, ১০ দিনও থাকতাম। তো, একবার বাড়ি গেলাম। সপ্তাহখানেক থাকলাম। অনেক, অনেক আনন্দ করলাম। যেন কোন পিছু টান নেই, কোত্থেকে যেন আমার দুটা পাখা গজিয়েছে, কেবল উড়ি আর উড়ি! কিভাবে যে দিনগুলো চলে যাচ্ছিল বুঝতেই পারছিলাম না। আহা, মনে হচ্ছিল আবার যেন শৈশবে ফিরে গেছি। তখন আমার এও মনে হতো, আচ্ছা, মানুষ বিয়ে করে কেন!
হুট করে ও হঠাৎ না বলেকয়ে চলে আসল। ওর আবার সারপ্রাইজ দেয়ার বাতিক আছে। সারপ্রাইজকুমার। আমি আকাশ থেকে ধপ করে মাটিতে পড়লাম। একেক করে আমার ডানা খসে পড়ছে। যথারীতি ও একটা গাড়ি ভাড়া করে নিয়ে এসেছে, এই গাড়ি দিয়েই ফেরা হবে। আমি ওকে বলতেও পারছি না আর কয়েকটা দিন থাকি কারণ ওকে আবার একগাদা টাকা খরচ করে গাড়ি নিয়ে আসতে হবে। লাটসাহেবের আবার টাকার টানাটানি!
কি আর করা, মন খারাপ করে সব গোছগাছ করছি। পারতপক্ষে আমার মা, বোনদের চোখের দিকে তাকাচ্ছি না। আরে, এতে যে মন দুর্বল হয়ে যায়! তখন এদের ছেড়ে যেতে ইচ্ছা করবে না কিন্তু যেতে তো হবে! হায় সংসার!
আমরা চলে আসছি। আব্বু আমাদের সাথে এগিয়ে দিতে আসছেন, সামনের রাস্তায় নেমে যাবেন। মেয়ের সঙ্গে আরও কিছুক্ষণ থাকার লোভ। কী তীব্র লোভ! আব্বুর ফিরতে কষ্ট হবে ভেবে আমার স্বামী বলল, বাবা, আপনার কষ্ট হবে ফিরতে, আপনি এখানেই নেমে যান। আব্বুর চোখে কেমন ঘোরলাগা দৃষ্টি! গাড়ি যখন ব্রেক করল আমার বুকটা ধক করে উঠল। আমার চোখে কান্না জমছে।
আব্বু কি যেন ভাবতে ভাবতে নেমে গেলেন। আমার চোখে মেঘ দেখে তিনি এপাশ ওপাশ উদভ্রান্তের মত তাকাচ্ছেন। তাকে কি অসহায়ই না লাগছিল। রাস্তার পাশের দোকানে এক দৌড়ে গিয়ে আবার ফিরে এলেন। আব্বুর দুহাত ভরা চুইংগাম। আমার হাতে দিয়ে বললেন, মামনি, চুইংগাম খাও।
ঝপ করে আমার চোখে অন্ধকার নেমে এলো, এইবার জমে থাকা মেঘ ঝরে পড়ল। আমার চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছা করছিল।
ওরে আব্বু, আমার বোকা আব্বু, তুমি কি ভেবেছ, এখনও তোমার এই মেয়েটি সেই ছোট্ট খুকিটিই আছে? যার হাতে চুইংগাম ধরিয়ে দিলে সে কান্না ভুলে যাবে? আমার আব্বু, কী বোকা আমার আব্বু! আব্বুকে রেখে গাড়ি এগুচ্ছে। আমার বোকা আব্বুটা ছোট হতে হতে পুতুলের মত হয়ে হারিয়ে গেলেন। আমিও কী বোকা, ঘাড় ব্যাথা হয়ে গেছে তবু্ও ফিরে ফিরে আব্বুকে দেখার চেষ্টা করি। চোখের পানি কী বাঁধ মানে...।
আমার স্বামী বলল, আহ, কি করো, ড্রাইভার তাকিয়ে আছে। আর কি কান্ড, তোমার বাবা কি মনে করে এতগুলো চুইংগাম কিনে দিলেন?
আমি কান্না চাপতে চাপতে বললাম, এটা তুমি এখন বুঝবে না!
ও চুইংগাম চিবুতে চিবুতে বলল, তাই, তা কখন বুঝব?
আমি চোখে আঁচল চাপা দিয়ে বললাম, যখন বাবা হবে, তখন...।"
9 comments:
কেন জানি আমার চোখ দু'টো ভিজে গেলো...
দরকার নাই আমার বাবা হবার! বোকা চোখ দুটো এমনিতেই কারণে অকারণে চশমার গ্লাস ঝাপসা করে দেয়।
হালার চোক্খে আবার কি পরল,,,,
বিষাদের সঙ্গে বলতে বাধ্য হচ্ছি আপনার স্বামী নামের মানুষটা একটা অমানুষ! এমন একজন মানুষের সঙ্গে বসবাস করার চেয়ে কঠিন কিছু আর এই গ্রহে নাই। @ফারজানা আফরোজ
মাহমেদ ভাই, আপনি মানুষ্টা খ্রাপ! খুব খ্রাপ!
আমার এই মন্তব্যর জন্য দুঃখ প্রকাশ করি। এই মন্তব্য করার পেছনে অকাট্য যুক্তি দেখাতে পারি কিন্তু এমন একটা পাবলিক প্লেসে এমন মন্তব্য অশালীনতার পর্যায়ে পড়ে।
খুবই দুঃখিত এবং লজ্জিত। মন্তব্যটা ইচ্ছা করেই ডিলিট করলাম না। আমার কর্মকান্ডের নমুনা না-থাকাটাও যুক্তিযুক্ত না...
প্রচন্ড ভাল লাগায় আক্রান্ত হলাম। আবেগের উচ্ছাসে ভরা, অথচ কি অদ্ভুত পরিমিতি। ফারজানা আপনি এত ভাল লেখেন!!!!!
ভালো, দারুণ ভালো লাগল ।
Post a Comment