সড়ক দুর্ঘটনায় তারেক মাসুদ এবং মিশুক মুনীরের মৃত্যুর পর একটি জাতীয় দৈনিকে জটিল এই প্রশ্নটা ছুড়ে দেয়া হয়েছে, "এভাবে যেতে হবে কেন"?
যদি আমি পাল্টা প্রশ্ন করি, কেন এভাবে যেতে হবে না? গর্ত করে রাখলে একেকজন একেক রকম করে গর্তে পড়ে নাকি?
যেখানে বাচ্চা গিজগিজ করে সেখানকার ছাদে আপনি রেলিং দিলেন না কেন? এই বাচ্চারা আপনার নিজের বাচ্চা না বলে? কোন-না-কোন দিন আপনার বাচ্চা ছাদ থেকে পড়ে গেলে এই প্রশ্ন করার পেছনে যুক্তি কোথায়, বিলাপ কেন, আমার বাচ্চা ছাদ থেকে পড়ে যাওয়ার তো কথা না, আমার বাচ্চার তো এভাবে চলে যাওয়ার কথা না! অন্যদের বাচ্চারা যখন রেলিংবিহীন ছাদ থেকে হরহামেশা টুপটুপ করে পড়ে যেত তখন বিকার হয়নি? এখন অতি অস্থির কেন, নিজের বাচ্চা পড়ে গেছে বলে?
আমরা সাধারণ মানুষেরা সবচেয়ে ভালবাসি নিজেকে তারপর আশেপাশের লোকজনকে। যতক্ষণ পর্যন্ত নিজের ঘাড়ে না-পড়ে ততক্ষণ আমরা মাথা ঘামাই না। খাসলত...!
আমার কেন যেন মনে হচ্ছে, লেখাপড়া জানা লোকজনেরা এখন দায়ে পড়ে নড়েচড়ে বসেছে। দায়ে পড়ে ঠিক না, এদের মধ্যে ভয় ঢুকে গেছে। এরা হয়তো ভুলে গিয়েছিলেন ষাড়ের মাংস না-খেলে ষাড় গুতাবে না এমনটা নিশ্চয়তা পাওয়া যায় না।
আমাদের মিডিয়া! এক ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় দেখছিলাম, ওখানে আরও কঠিন প্রশ্ন, "এই লাশ আমরা রাখব কোথায়"?
সরল উত্তর, সব লাশ যেখানে রাখা হয়। মাটির নীচে।
অনেকের কাছে এই সরল উত্তরটা হৃদয়হীন মনে হলেও করার কিছু নাই। প্রতি বছর সড়ক দুর্ঘটনায় হাজার-হাজার মানুষের মৃত্যু হয় তখন আমাদের টনক নড়েনি এখন আমরা সমস্ত জমানো প্রশ্ন একর পর এক ছুড়ে দিচ্ছি।
এটা সত্য যে এই দুইজন মানুষ প্রতিভাবান। এদের হারানো দেশের জন্যে এক বিরাট ক্ষতি। তারেক মাসুদ। এই মানুষটা কেবল 'মুক্তির গান' এই সৃষ্টির কারণেই মরতে পারবেন না, অমর হয়ে থাকবেন।
কিন্তু চোখের জল? এই একটা জায়গায় প্রতিভাবান, অ-প্রতিভাবান কোন কাজে আসে না। তারেক মাসুদের স্বজনরা যেমন কাঁদবেন তেমনি অন্যের স্বজনরাও। ভাগ্যিস, আমাদের মিডিয়া সুযোগ পায়নি নইলে ঠিকই তারেক মাসুদের দেড় বছরের সন্তানের মুখের সামনে মাইক্রোফোন ধরে তার অনুভূতি জানতে চাইত।
যেদিন তারেক মাসুদ এবং মিশুক মুনীরের মৃত্যু হলো ঠিক সেদিনই পাবনায় বাস খাদে পড়ে পাঁচ জনের মৃত্যু হয়েছে। এই পাঁচজনের মৃত্যু হওয়ার মাত্র চব্বিশ ঘন্টার মধ্যেই আমরা ভুলে গেছি। প্রথম আলোর মত পত্রিকায় আজ এই নিয়ে একটা শব্দও নাই! তবে আজ বিনোদন পাতায় ফলাও করে ছাপা হয়েছে সেলিব্রেটিদের কাঁদো-কাঁদো ক্লোজআপ ছবি। আজ 'সাহিত্যিক পাতা' নেই নইলে আমরা সাহিত্যিকদের ক্লোজআপ ছবি দেখতে পেতাম!
কেন আমরা ভুলে যাই একজনের মৃত্যু মানে কেবল একটা সংখ্যা না; একজনের সঙ্গে জড়িয়ে থাকে গোটা একটা পরিবার। আমাদের মিডিয়ার এখন জানার প্রয়োজন নাই ওই দিনই পাবনায় যে পাঁচজনের মৃত্যু হয়েছে সেইসব মৃতদের, তাঁদের পরিবারের খবর। আর যারা বেঁচে গেছেন? কেই-বা খবর রাখে যারা আহত হয়েছিলেন তাঁদের বর্তমান অবস্থার। তাঁরা ন্যূনতম চিকিৎসা সুবিধা পাচ্ছেন কি না? অবহেলায় কারও পা, কারও হাত কেটে ডাস্টবিনে ফেলে দেয়া হচ্ছে কি না? এঁদের ওষুধ কেনার মত টাকা আছে কি না? লাশগুলো কি ঠিক ঠিক স্বজনদের কাছে ফেরত গিয়েছিল? নাকি ওই সব লাশ পাওয়ার জন্য তাঁদের স্বজনরা থানায় থানায় চক্কর লাগাচ্ছেন। আমরা জানি না।
কারণ এই সব অভাগাদের পাশে আনিসুল হকের মত লেখক নাই যিনি নিজেদের পত্রিকায় প্রতিদিন প্রথম পাতায় লম্বা-লম্বা কলাম লিখবেন। আহা, পাবনার ওই বেচারারা এমন বড়ো মানুষদের মমতার ভাগা পান না বলেই তো 'অভাগা'!
আজ সব প্রশ্ন আমরা করে ফেলতে চাচ্ছি কিন্তু দুই বছর পূর্বে যখন পরীক্ষা ছাড়া ১০ হাজার লাইসেন্স দেয়া হয়েছিল তখন এই সব প্রশ্নকর্তারা কোথায় ছিলেন? কোন সভ্য দেশে পরীক্ষা ছাড়া লাইসেন্স দেয়া হয়? যে নৌপরিবহন মন্ত্রীর সুপারিশে এই খুন করার লাইসেন্সগুলো দেয়া হলো সেই নৌপরিবহন মন্ত্রীকে কেন খুনের দায়ে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হবে না? কেন তাকে খুনি বলা যাবে না?
এই দেশের প্রধানমন্ত্রী কি 'লাইসেন্স টু কিল' সম্বন্ধে অবগত ছিলেন না? কেন প্রধানমন্ত্রীকে এ নিয়ে জবাদিহিতা করতে হবে না?
যোগাযোগমন্ত্রী হাসপাতালে মরণাপন্ন কাউকে দেখতে গিয়ে এটা কেমন করে বলেন, "...আপনাদের ড্রাইভারের দোষ ছিল, সে ওভারটেক করতে গিয়েছিল..."। আচ্ছা, তিনি কি ওখানে উপস্থিত ছিলেন, নাকি! তা আমাদের যোগাযোগমন্ত্রী কী ওই সময় রাস্তায় মাপামাপি করছিলেন?
কী অসভ্য এক আচরণ! মন্ত্রী হলেই মনে হয় যা-খুশী বলে দেয়া যায়, না?
যোগাযোগমন্ত্রী যখন এই কথা বলছেন তখন রাস্তার বাজে অবস্থার কারণে উত্তরবঙ্গের ১২টি জেলার ঢাকার বাস যোগাযোগ বন্ধ। দিনের-পর-দিন লক্ষ-লক্ষ মানুষ সীমাহীন দুর্ভোগ পোহাচ্ছে। আমি যতটুকু জানি, দেশে যখন মুক্তিযুদ্ধ চলছিল তখনও ঢাকার সঙ্গে এতোগুলো জেলার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন ছিল না। যোগাযোগমন্ত্রী, কী লাজহীন একজন মানুষ!
পত্রিকায় আমরা নিয়ম করে পড়ি, পুলিশের ঈদ বানিজ্য। এ তো চোখ সওয়া। বিআরটিএ-তে কি হয় এটা আমরা সবাই জানি। টাকা দিয়ে ভাঙ্গা গাড়ি রাস্তায় নামানো যায়। ভুয়া লাইসেন্স পাওয়া যায়। এ তো আমাদের গা সওয়া।
সার্জেন্ট নামের একটা জিনিস, রাস্তায় এর দেখা মেলে। বাস-ট্রাক-মিনিবাস-মাইক্রোবাস যারা চালান এদের চোখ কোথায় থাকে? কোথায় আবার! এদের চোখ সার্জেন্টকে খুঁজে ফেরে। প্রায়শ বেপরোয়া গাড়ি চালাবার এটাও একটা কারণ। কেন-না, এই চালকরা ভাল করেই জানেন সার্জেন্টের খপ্পরে পড়লে গাড়ির কাগজপত্র যতই নিখুঁত থাকুক টাকা না-ফেলে বাঁচার উপায় নাই। টাকা না-দিলে সার্জেন্ট মামলা ঠুকে দেবে। বা গাড়ি রিক্যুজিশন করবে।
আমাদের দেশে এ এক অসভ্য কান্ড। দেশের কাজ বলে যখন-তখন গাড়ি রিক্যুজিশন করা। ভাড়ায়চালিত গাড়ীর চালকের জন্য এ এক ত্রাস! যার গাড়ি এই ফাঁদে পড়ে তার গাড়ির চৌদ্দটা বেজে যায়।
এই সবই আমরা সবাই জানি।
১৯৮৩ সালের মোটরযান অধ্যাদেশে বলা আছে [১], লাইসেন্সবিহীন গাড়ী চালালে চার মাসের কারাদন্ড বা ৫০০ টাকা জরিমানা বা উভয় দন্ড কার্যকর। সর্বোচ্চ গতিতে গাড়ী চালালে এক মাস কারাদন্ড বা ৩০০ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দন্ডে দন্ডিত করা হবে। যেখান ওভারটেকিং নিষিদ্ধ সেখানে ওভারটেকিং করলে চালককে ১০০ টাকা জরিমানা দিতে হবে।
বাহ, পকেটে ১০০ টাকা নিয়ে পাগলের মত ওভারটেকিং করলে আটকায় কে!
পথচারি ওভারব্রিজ, আন্ডারপাস ব্যবহার না-করলে পাঁচ টাকা জরিমানা। কারও পকেটে পাঁচ টাকা থাকলে সে মধ্য রাস্তা দিয়ে দৌড়াদৌড়ি করলেও কোন সমস্যা নাই! দুর্ঘটনা ঘটলে পাঁচ টাকা জরিমানা দিয়ে পার পাওয়া যবে তাহলে?
পোশাকপরা এই সব ভিক্ষুকদের [২] কি আমরা অহরহ দেখি না, দেখি। ছবিতে আমরা যে ভদ্রলোককে দেখছি ইনি বাস থেকে চালকের ছুড়ে দেয়া টাকা রাস্তা থেকে কুড়িয়ে নিচ্ছেন।
কোন বাসের ফিটনেস নাই, কোন ড্রাইভারের লাইসেন্স নাই, কোন ট্রাক পাগলের মত অন্য গাড়ীকে ওভারটেক করছে, কোন বাস ড্রাইভার না-চালিয়ে হেলপার চালাচ্ছে এই সব এদের দেখার সময় কোথায়?
রাস্তায় বাসের হেলপাররা অন্য ছোট গাড়ীকে যখন বলে, 'এই প্লাস্টিক সাইডে...' তখন আমরা দাঁত বের করে হাসি। ওই বাসের যাত্রী হলে আমরা বড়ই আমোদিত হই।
এই স্বচ্ছতাই আমাদের মাঝে নাই যে পুলিশ না-আসা পর্যন্ত দুর্ঘটনায় আহত-নিহতদের ছোঁয়া যাবে না কারণ উল্টো পুলিশ ওই সহৃদয় মানুষটাকে ফাঁসিয়ে দেবে। আর ইচ্ছা থাকলেও যিনি দুর্ঘটনা ঘটান তিনি কালবিলম্ব অপেক্ষা না-করে পালিয়ে যাবেন কারণ ফলাফল আমাদের জানা। স্রেফ ভর্তা হয়ে যাবেন। গণপিটুনি নামের একটা জিনিস আছে। ওখানে আমরা কেমন পশু হয়ে যাই তার এই একটা নমুনাই যথেষ্ঠ [৩]!
এই নিয়ে আজ আমরা হইচই করছি। ক্রমশ উৎসাহ ফিকে হয়ে আসবে। সব চলবে আগের মতই। কারণ আমরা বড়ো বিস্মৃতিপরায়ণ জাতি...।
(মিশুক মুনীরের স্ত্রী মঞ্জুলী কাজীর বক্তব্য। এটা তাঁর নিজস্ব বক্তব্য। অবশ্যই মঞ্জুলী কাজীকে ধন্যবাদ জানাই 'সাদাকে সাদা, কালোকে কালো' বলার জন্য।
এই ভিডিও ক্লিপিংস ফেসবুক থেকে নেয়া। কোন সহৃদয় ব্যক্তি এটা ফেসবুকে আপলোড করেছেন চেষ্টা করেও জানতে পারিনি। তাঁর নামটা কেউ জানালে কৃতজ্ঞতা।)
*ফেসবুকে অনেককে অনুরোধ করেও নামটা যোগাড় করতে পারিনি। জনাব, সায়ন জানাচ্ছেন যিনি এই ক্লিপিংসটা ফেসবুকে আপলোড করেছেন সেই মানুষটার নাম মাহমুদুল হাসান। সায়নের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি।
সহায়ক সূত্র:
১. ১৯৮৩ সালের মোটরযান অধ্যাদেশে: http://www.shokalerkhabor.com/online/archive_print.php?id=12740&&%20page_id=%20%2044&%20issue_date=%202011-07-03
২. ভিক্ষুক: http://www.ali-mahmed.com/2010/09/blog-post_03.html
৩. পশু...: http://www.ali-mahmed.com/2011/08/blog-post_11.html
*এই লেখাটা যখন পোস্ট করছি তখন রাত প্রায় সোয়া বারোটা। ইলেকট্রনিক মিডিয়া আরটিভিতে দেবাশীষ বিশ্বাসের একটা অনুষ্ঠান দেখাচ্ছে। তিনি স্বভাবসুলভ ফাজিল ভঙ্গিতে তারেক মাসুদকে নিয়ে বলছিলেন, অপদার্থের মত দাঁত বের করে, যেতে নাহি দেব, হেনতেন...। তার এই অনুষ্ঠানের ২জন অতিথিও এই প্রসঙ্গ বলার সময় দাঁত বের করে হাসছিলেন। মনে হচ্ছিল খুব একটা রসিকতার কথা হচ্ছে। এই সব ফাজিলরাই ঘুরেফিরে আসে। কখনও-কখনও কারও মৃত্যুও ব্যবসার কাজে লাগে...।
যদি আমি পাল্টা প্রশ্ন করি, কেন এভাবে যেতে হবে না? গর্ত করে রাখলে একেকজন একেক রকম করে গর্তে পড়ে নাকি?
যেখানে বাচ্চা গিজগিজ করে সেখানকার ছাদে আপনি রেলিং দিলেন না কেন? এই বাচ্চারা আপনার নিজের বাচ্চা না বলে? কোন-না-কোন দিন আপনার বাচ্চা ছাদ থেকে পড়ে গেলে এই প্রশ্ন করার পেছনে যুক্তি কোথায়, বিলাপ কেন, আমার বাচ্চা ছাদ থেকে পড়ে যাওয়ার তো কথা না, আমার বাচ্চার তো এভাবে চলে যাওয়ার কথা না! অন্যদের বাচ্চারা যখন রেলিংবিহীন ছাদ থেকে হরহামেশা টুপটুপ করে পড়ে যেত তখন বিকার হয়নি? এখন অতি অস্থির কেন, নিজের বাচ্চা পড়ে গেছে বলে?
আমরা সাধারণ মানুষেরা সবচেয়ে ভালবাসি নিজেকে তারপর আশেপাশের লোকজনকে। যতক্ষণ পর্যন্ত নিজের ঘাড়ে না-পড়ে ততক্ষণ আমরা মাথা ঘামাই না। খাসলত...!
আমার কেন যেন মনে হচ্ছে, লেখাপড়া জানা লোকজনেরা এখন দায়ে পড়ে নড়েচড়ে বসেছে। দায়ে পড়ে ঠিক না, এদের মধ্যে ভয় ঢুকে গেছে। এরা হয়তো ভুলে গিয়েছিলেন ষাড়ের মাংস না-খেলে ষাড় গুতাবে না এমনটা নিশ্চয়তা পাওয়া যায় না।
আমাদের মিডিয়া! এক ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় দেখছিলাম, ওখানে আরও কঠিন প্রশ্ন, "এই লাশ আমরা রাখব কোথায়"?
সরল উত্তর, সব লাশ যেখানে রাখা হয়। মাটির নীচে।
অনেকের কাছে এই সরল উত্তরটা হৃদয়হীন মনে হলেও করার কিছু নাই। প্রতি বছর সড়ক দুর্ঘটনায় হাজার-হাজার মানুষের মৃত্যু হয় তখন আমাদের টনক নড়েনি এখন আমরা সমস্ত জমানো প্রশ্ন একর পর এক ছুড়ে দিচ্ছি।
এটা সত্য যে এই দুইজন মানুষ প্রতিভাবান। এদের হারানো দেশের জন্যে এক বিরাট ক্ষতি। তারেক মাসুদ। এই মানুষটা কেবল 'মুক্তির গান' এই সৃষ্টির কারণেই মরতে পারবেন না, অমর হয়ে থাকবেন।
কিন্তু চোখের জল? এই একটা জায়গায় প্রতিভাবান, অ-প্রতিভাবান কোন কাজে আসে না। তারেক মাসুদের স্বজনরা যেমন কাঁদবেন তেমনি অন্যের স্বজনরাও। ভাগ্যিস, আমাদের মিডিয়া সুযোগ পায়নি নইলে ঠিকই তারেক মাসুদের দেড় বছরের সন্তানের মুখের সামনে মাইক্রোফোন ধরে তার অনুভূতি জানতে চাইত।
যেদিন তারেক মাসুদ এবং মিশুক মুনীরের মৃত্যু হলো ঠিক সেদিনই পাবনায় বাস খাদে পড়ে পাঁচ জনের মৃত্যু হয়েছে। এই পাঁচজনের মৃত্যু হওয়ার মাত্র চব্বিশ ঘন্টার মধ্যেই আমরা ভুলে গেছি। প্রথম আলোর মত পত্রিকায় আজ এই নিয়ে একটা শব্দও নাই! তবে আজ বিনোদন পাতায় ফলাও করে ছাপা হয়েছে সেলিব্রেটিদের কাঁদো-কাঁদো ক্লোজআপ ছবি। আজ 'সাহিত্যিক পাতা' নেই নইলে আমরা সাহিত্যিকদের ক্লোজআপ ছবি দেখতে পেতাম!
কেন আমরা ভুলে যাই একজনের মৃত্যু মানে কেবল একটা সংখ্যা না; একজনের সঙ্গে জড়িয়ে থাকে গোটা একটা পরিবার। আমাদের মিডিয়ার এখন জানার প্রয়োজন নাই ওই দিনই পাবনায় যে পাঁচজনের মৃত্যু হয়েছে সেইসব মৃতদের, তাঁদের পরিবারের খবর। আর যারা বেঁচে গেছেন? কেই-বা খবর রাখে যারা আহত হয়েছিলেন তাঁদের বর্তমান অবস্থার। তাঁরা ন্যূনতম চিকিৎসা সুবিধা পাচ্ছেন কি না? অবহেলায় কারও পা, কারও হাত কেটে ডাস্টবিনে ফেলে দেয়া হচ্ছে কি না? এঁদের ওষুধ কেনার মত টাকা আছে কি না? লাশগুলো কি ঠিক ঠিক স্বজনদের কাছে ফেরত গিয়েছিল? নাকি ওই সব লাশ পাওয়ার জন্য তাঁদের স্বজনরা থানায় থানায় চক্কর লাগাচ্ছেন। আমরা জানি না।
কারণ এই সব অভাগাদের পাশে আনিসুল হকের মত লেখক নাই যিনি নিজেদের পত্রিকায় প্রতিদিন প্রথম পাতায় লম্বা-লম্বা কলাম লিখবেন। আহা, পাবনার ওই বেচারারা এমন বড়ো মানুষদের মমতার ভাগা পান না বলেই তো 'অভাগা'!
আজ সব প্রশ্ন আমরা করে ফেলতে চাচ্ছি কিন্তু দুই বছর পূর্বে যখন পরীক্ষা ছাড়া ১০ হাজার লাইসেন্স দেয়া হয়েছিল তখন এই সব প্রশ্নকর্তারা কোথায় ছিলেন? কোন সভ্য দেশে পরীক্ষা ছাড়া লাইসেন্স দেয়া হয়? যে নৌপরিবহন মন্ত্রীর সুপারিশে এই খুন করার লাইসেন্সগুলো দেয়া হলো সেই নৌপরিবহন মন্ত্রীকে কেন খুনের দায়ে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হবে না? কেন তাকে খুনি বলা যাবে না?
এই দেশের প্রধানমন্ত্রী কি 'লাইসেন্স টু কিল' সম্বন্ধে অবগত ছিলেন না? কেন প্রধানমন্ত্রীকে এ নিয়ে জবাদিহিতা করতে হবে না?
যোগাযোগমন্ত্রী হাসপাতালে মরণাপন্ন কাউকে দেখতে গিয়ে এটা কেমন করে বলেন, "...আপনাদের ড্রাইভারের দোষ ছিল, সে ওভারটেক করতে গিয়েছিল..."। আচ্ছা, তিনি কি ওখানে উপস্থিত ছিলেন, নাকি! তা আমাদের যোগাযোগমন্ত্রী কী ওই সময় রাস্তায় মাপামাপি করছিলেন?
কী অসভ্য এক আচরণ! মন্ত্রী হলেই মনে হয় যা-খুশী বলে দেয়া যায়, না?
যোগাযোগমন্ত্রী যখন এই কথা বলছেন তখন রাস্তার বাজে অবস্থার কারণে উত্তরবঙ্গের ১২টি জেলার ঢাকার বাস যোগাযোগ বন্ধ। দিনের-পর-দিন লক্ষ-লক্ষ মানুষ সীমাহীন দুর্ভোগ পোহাচ্ছে। আমি যতটুকু জানি, দেশে যখন মুক্তিযুদ্ধ চলছিল তখনও ঢাকার সঙ্গে এতোগুলো জেলার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন ছিল না। যোগাযোগমন্ত্রী, কী লাজহীন একজন মানুষ!
পত্রিকায় আমরা নিয়ম করে পড়ি, পুলিশের ঈদ বানিজ্য। এ তো চোখ সওয়া। বিআরটিএ-তে কি হয় এটা আমরা সবাই জানি। টাকা দিয়ে ভাঙ্গা গাড়ি রাস্তায় নামানো যায়। ভুয়া লাইসেন্স পাওয়া যায়। এ তো আমাদের গা সওয়া।
সার্জেন্ট নামের একটা জিনিস, রাস্তায় এর দেখা মেলে। বাস-ট্রাক-মিনিবাস-মাইক্রোবাস যারা চালান এদের চোখ কোথায় থাকে? কোথায় আবার! এদের চোখ সার্জেন্টকে খুঁজে ফেরে। প্রায়শ বেপরোয়া গাড়ি চালাবার এটাও একটা কারণ। কেন-না, এই চালকরা ভাল করেই জানেন সার্জেন্টের খপ্পরে পড়লে গাড়ির কাগজপত্র যতই নিখুঁত থাকুক টাকা না-ফেলে বাঁচার উপায় নাই। টাকা না-দিলে সার্জেন্ট মামলা ঠুকে দেবে। বা গাড়ি রিক্যুজিশন করবে।
আমাদের দেশে এ এক অসভ্য কান্ড। দেশের কাজ বলে যখন-তখন গাড়ি রিক্যুজিশন করা। ভাড়ায়চালিত গাড়ীর চালকের জন্য এ এক ত্রাস! যার গাড়ি এই ফাঁদে পড়ে তার গাড়ির চৌদ্দটা বেজে যায়।
এই সবই আমরা সবাই জানি।
১৯৮৩ সালের মোটরযান অধ্যাদেশে বলা আছে [১], লাইসেন্সবিহীন গাড়ী চালালে চার মাসের কারাদন্ড বা ৫০০ টাকা জরিমানা বা উভয় দন্ড কার্যকর। সর্বোচ্চ গতিতে গাড়ী চালালে এক মাস কারাদন্ড বা ৩০০ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দন্ডে দন্ডিত করা হবে। যেখান ওভারটেকিং নিষিদ্ধ সেখানে ওভারটেকিং করলে চালককে ১০০ টাকা জরিমানা দিতে হবে।
বাহ, পকেটে ১০০ টাকা নিয়ে পাগলের মত ওভারটেকিং করলে আটকায় কে!
পথচারি ওভারব্রিজ, আন্ডারপাস ব্যবহার না-করলে পাঁচ টাকা জরিমানা। কারও পকেটে পাঁচ টাকা থাকলে সে মধ্য রাস্তা দিয়ে দৌড়াদৌড়ি করলেও কোন সমস্যা নাই! দুর্ঘটনা ঘটলে পাঁচ টাকা জরিমানা দিয়ে পার পাওয়া যবে তাহলে?
ছবি ঋণ: কালের কন্ঠ |
কোন বাসের ফিটনেস নাই, কোন ড্রাইভারের লাইসেন্স নাই, কোন ট্রাক পাগলের মত অন্য গাড়ীকে ওভারটেক করছে, কোন বাস ড্রাইভার না-চালিয়ে হেলপার চালাচ্ছে এই সব এদের দেখার সময় কোথায়?
রাস্তায় বাসের হেলপাররা অন্য ছোট গাড়ীকে যখন বলে, 'এই প্লাস্টিক সাইডে...' তখন আমরা দাঁত বের করে হাসি। ওই বাসের যাত্রী হলে আমরা বড়ই আমোদিত হই।
এই স্বচ্ছতাই আমাদের মাঝে নাই যে পুলিশ না-আসা পর্যন্ত দুর্ঘটনায় আহত-নিহতদের ছোঁয়া যাবে না কারণ উল্টো পুলিশ ওই সহৃদয় মানুষটাকে ফাঁসিয়ে দেবে। আর ইচ্ছা থাকলেও যিনি দুর্ঘটনা ঘটান তিনি কালবিলম্ব অপেক্ষা না-করে পালিয়ে যাবেন কারণ ফলাফল আমাদের জানা। স্রেফ ভর্তা হয়ে যাবেন। গণপিটুনি নামের একটা জিনিস আছে। ওখানে আমরা কেমন পশু হয়ে যাই তার এই একটা নমুনাই যথেষ্ঠ [৩]!
এই নিয়ে আজ আমরা হইচই করছি। ক্রমশ উৎসাহ ফিকে হয়ে আসবে। সব চলবে আগের মতই। কারণ আমরা বড়ো বিস্মৃতিপরায়ণ জাতি...।
(মিশুক মুনীরের স্ত্রী মঞ্জুলী কাজীর বক্তব্য। এটা তাঁর নিজস্ব বক্তব্য। অবশ্যই মঞ্জুলী কাজীকে ধন্যবাদ জানাই 'সাদাকে সাদা, কালোকে কালো' বলার জন্য।
এই ভিডিও ক্লিপিংস ফেসবুক থেকে নেয়া। কোন সহৃদয় ব্যক্তি এটা ফেসবুকে আপলোড করেছেন চেষ্টা করেও জানতে পারিনি। তাঁর নামটা কেউ জানালে কৃতজ্ঞতা।)
*ফেসবুকে অনেককে অনুরোধ করেও নামটা যোগাড় করতে পারিনি। জনাব, সায়ন জানাচ্ছেন যিনি এই ক্লিপিংসটা ফেসবুকে আপলোড করেছেন সেই মানুষটার নাম মাহমুদুল হাসান। সায়নের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি।
সহায়ক সূত্র:
১. ১৯৮৩ সালের মোটরযান অধ্যাদেশে: http://www.shokalerkhabor.com/online/archive_print.php?id=12740&&%20page_id=%20%2044&%20issue_date=%202011-07-03
২. ভিক্ষুক: http://www.ali-mahmed.com/2010/09/blog-post_03.html
৩. পশু...: http://www.ali-mahmed.com/2011/08/blog-post_11.html
*এই লেখাটা যখন পোস্ট করছি তখন রাত প্রায় সোয়া বারোটা। ইলেকট্রনিক মিডিয়া আরটিভিতে দেবাশীষ বিশ্বাসের একটা অনুষ্ঠান দেখাচ্ছে। তিনি স্বভাবসুলভ ফাজিল ভঙ্গিতে তারেক মাসুদকে নিয়ে বলছিলেন, অপদার্থের মত দাঁত বের করে, যেতে নাহি দেব, হেনতেন...। তার এই অনুষ্ঠানের ২জন অতিথিও এই প্রসঙ্গ বলার সময় দাঁত বের করে হাসছিলেন। মনে হচ্ছিল খুব একটা রসিকতার কথা হচ্ছে। এই সব ফাজিলরাই ঘুরেফিরে আসে। কখনও-কখনও কারও মৃত্যুও ব্যবসার কাজে লাগে...।
13 comments:
ভাই.... আমিও জিনিসটা অনেকটা এরকম করেই ভাবছিলাম........
কোনো সেলিব্রেটি মারা গেলে তাকে নিয়ে মিডিয়ায় অনেক হই-চৈ..... আর কোনো সাধারণ মানুষ মারা গেলে তার জায়গা হয় পত্রিকার ভিতরের পেজের ছোট একটা অংশে.........
দেবাশিষ দা কে ফাজিল বললেন কি মনে করে?
বাংলা সাহিত্যে মগের মুল্লুক শব্দটা তো আর এমনি তেই আসে নাই।
আর মরা নিজেরা যদি শুদ্ধ না হয় তো ান্য জনের দিকে আঙ্গুল তুলে লাভ কি?
Jodi amar sontaner mukh ar dekhte pari.....totokkhon porjonto jeno sustho thaki.
আপনি কি বলতে চান সেলিব্রেটিদের মৃত্যুর খবর হেড লাইনে আসবে না?
"দেবাশিষ দা কে ফাজিল বললেন কি মনে করে?"
এ কেবল ফাজিল না, এ একটা আপাদমস্তক ফাজিল। এর কেবল ভাব-ভঙ্গি, বডি ল্যাঙ্গুয়েজই ফাজিল না, এ চিন্তাভাবনাতেও ফাজিল। নইলে কোন সুস্থ মানুষ এটা বলে কেমন করে:
"...পৃথিবীতে সাতটা ধর্ম। আজ আরেকটা ধর্ম যোগ হলো। সেটা হলো, শাহরুখইজম!..."
http://www.ali-mahmed.com/2010/12/blog-post_11.html
"আপনি কি বলতে চান সেলিব্রেটিদের মৃত্যুর খবর হেড লাইনে আসবে না?"
আসবে। খবরের গুরুত্ব অনুসারেই আসবে। এতে তো সমস্যা নাই।
আশা করি, মাতম এবং মাতামতির মধ্যে পার্থক্যটা আপনাকে বুঝিয়ে বলতে হবে না। @Rahim akbar
"এই ভিডিও ক্লিপিংস ফেসবুক থেকে নেয়া। কোন সহৃদয় ব্যক্তি এটা ফেসবুকে আপলোড করেছেন চেষ্টা করেও জানতে পারিনি। তাঁর নামটা কেউ জানালে কৃতজ্ঞতা।"
এটা মাহমুদুল হাসান নামে একজন আপ্লোড করেছেন।
উনার প্রোফাইল লিংক এটা
একটা অনাকাঙ্খিত মৃত্যু মানে একটা পরিবারের দুঃসহ বেদনা!আফসোসের বিষয় নিজের উপরে না পড়লে এটা কেউ বুঝবে না।প্রতিদিন ই খবরে শোনা যায় হাসিমুখে এক মহিলা/পুরুষ বলছেন, ঢাকা সিলেট মহাসড়কে বাস উলটে খাদে পরে বিশজন নিহত পয়ত্রিশ জন আহত!এমনভাবে বলা হচ্ছে যেন মনে হয় এতে আশ্চর্য বা দুঃখিত হবার কিছু নেই।আমরা যখন শুনি তখন ও এমনভাব নিয়ে শুনি যে এগুলো কিছুই না!
কিন্তু ওই নিহত পরিবারগুলোর একটিতে গেলে বোঝা যাবে কি হচ্ছে!যে কিশোরের বাবা মারা গেছেন তার কাছে পুরো দুনিয়াটাই উলটে গেছে!মিডিয়া যদি এই মৃত্যুগুলো আর একটু ভালভাবে হাইলাইট করত তাহলে নিশ্চিত অবস্থার কিছু উন্নতি হত।মানুষের সচেতনতা বৃদ্ধি পেলে যতই দূর্নীতিবাজ সরকার হোক কিছু কাজ করতে বাধ্য।মানুষের আবেগ অনুভূতি এখন মিডিয়া নিয়ন্ত্রিত।তাই সিলেটের কোনায় রহিমা জরিনাদের যৌতুকের জন্য পুড়িয়ে মারা হলেও জাতীয় পত্রিকায় আসে না।কিন্তু এর চেয়ে ঢাবি শিক্ষিকাকে নির্যাতনের কাহিনী নিয়ে একমাস ধরে প্যাচাল চলতে থাকে!!
(আমি বলছি না ঢাবি শিক্ষিকার এটা আসবে না।আসবে।কিন্তু সাথে অন্যগুলো ও।রহিমা জরিনা ও নারী।তাদেরকে নির্যাতন করা হলেও নারী নির্যাতন।এই বোধ টা মিডিয়ার সৃষ্টি হোক)
ধন্যবাদ ভাই।
শুকরিয়া :)@সায়ন
এখনই পেস্টে মাহমুদুল হাসানের নাম যোগ করে দিচ্ছি @সায়ন
একমত @মুরাদুল ইসলাম
মাহমুদুল হাসান সাহেবকে এর জন্যও সালাম
Post a Comment