Search

Saturday, January 21, 2012

মুখোশ!

­আমার বারবার বলে আসছি আমাদের দেশটা বড় বিচিত্র, ততোধিক বিচিত্র এই দেশের মানুষ। মাছের পচন শুরু হয় নাকি মাথা থেকে, হবে হয়তো। কিন্তু গোটা মাছটাই যে পচে গেছে, এখানে মাথা না লেজ এই কুতর্ক করে লাভ কী!
এখন এখানে প্রতিভা বিক্রি হয় কেজি দরে। একজন এই কথাটাই শুনে শ্লেষভরা কন্ঠে বলেছিলেন, কেনে কে? আপনি নিশ্চিত, হরেদরেও তাহলে বিক্রি করা যায়? আসলে ক্রমশ আমরা হয়ে উঠছি একেকটা যন্ত্রমানব হয়ে। ক্যারিয়ার, বড় হওয়ার জন্য শর্টকাট রাস্তা ব্যতীত অন্য কোনো রাস্তায় আমরা হাঁটতে চাই না। এই জন্য আত্মা বন্ধক রাখতে হলেও কোনো সমস্যা নাই। প্রয়োজনে আমরা বিক্রি করে দেব প্রিয়মানুষের লিভার-কিডনি।
বিক্রির জন্যে শরীরটা যে কেমন মূল্যবান তা 'বেচা-বিক্রি, ব্যবসা-বাণিজ্য' [১] নামে অতিথি কলামে অসাধারণ একটা লেখা লিখেছিলেন সু-ব্লগার জনাব, শামীম।

আমরা কেবল ভাল পারি দলবাজি করতে। এই একটা কাজে আমাদের কোনো পিছপা নেই। দলের জন্য কাছের মানুষকে ছুঁরি মারতে পারি, অবলীলায় আমরা প্রাণটাও বিলিয়ে দিতে পারি।
নেতারা যা বলেন আমরা তাই বিশ্বাস করি। একটা নমুনা দেই। গত নির্বাচনে, হলফনামা দেখে আমরা অবলীলায় বিশ্বাস করেছিলাম। নির্বাচনে ব্যয় করেছেন খালেদা জিয়া, ফেনী-১ আসনে ৫ লাখ টাকা আর শেখ হাসিনা বাগেরহাট-১ আসনে ১১ লাখ টাকা! আজকাল সাধারণ একটা মেয়র নির্বাচনও যদি এই টাকায় করা যায় তাহলে আমি লেখালেখি ছেড়ে দেব।
হলফনামা অনুযায়ী খালেদার মাসিক ব্যয় ২৫ হাজার টাকা এবং শেখ হাসিনার ১৭ হাজার টাকা। এর মধ্যে খাওয়া-দাওয়া, গাড়ির তেল-গ্যাস, বিয়ে-শাদীর খরচ সবই যুক্ত। এই নিয়ে আমার কোনো মন্তব্য নেই কারণ আমার মত যারা লেখালেখি করার চেষ্টা করে তাদের হাওয়া খেয়ে দিন পার করে দিলেই চলে।

গাড়ী প্রসঙ্গে মনে পড়ল, এখন রাজনীতিতে নতুন একটা মাত্রা যুক্ত হয়েছে, গাড়ী নিয়ে গাড়ী মার্চ করা। আমার নিজের গাড়ি নাই তাই অনুমান করতে পারি না ৩৫০০ সিসির একেকটা গাড়ীর জন্য কত টাকার তেল-গ্যাস লাগে। তবুও শুনতে পাই খালেদা জিয়ার রোড-মার্চের নামে 'গাড়ী-মার্চে' নাকি কোটি-কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। গাড়ী নিয়ে কেমন খেলা দেখানো যায় এর আরেকটা নমুনা:
ট্রানজিট নিয়ে, বাংলাদেশ পেশাজীবী পরিষদের নামে মাহমুদুর রহমান প্রতীকী প্রতিবাদের নামে তিতাস নদীর উপর বাঁধে [২] কোদালের একটা কোপ দিয়ে দায় সেরেছিলেন।
পূর্বের লেখায়, বলা যেতে পারে তাঁর নাম না-আসাটা অনুচিত হয়েছে। বিষয়টা নিয়ে মাথা ঘামাবার জন্য তাঁকে হাত লম্বা করে ধন্যবাদ দেই। কিন্তু... তাঁর এই উৎসাহ আমাকে খুব একটা টানেনি কারণ এখানে প্রাণের কোনো যোগ ছিল না, ছিল স্রেফ রাজনীতি! সরকারকে বেকায়দায় ফেলার এক চেষ্টা।

ভঙ্গিটা আমার পছন্দ হয়নি। এটা বোঝার জন্য রকেটবিজ্ঞানী হওয়ার প্রয়োজন পড়ে না ফটোসেশনের জন্য এটার প্রয়োজন ছিল। মাহমুদুর রহমান সাথে নিয়ে এসেছিলেন বিশাল এক গাড়ির বহর।

কেন, এতোগুলো গাড়ী না এনে কয়েকটা বাসে করে এলে কি মূল কাজ সমাধা হতো না? না, হতো না কারণ আমাদের চোখ ধাঁধিয়ে অন্ধ না-হয়ে গেলে সমস্যা আছে! স্রেফ আমরা অন্ধের মত গিয়ে ভোট দিয়ে গণতন্ত্রকে রক্ষা করব। বেচারা গণতন্ত্র, বড়ই নাজুক!

আমরা রাজনীতিবিদদের খুঁত বের করতে আরাম পাই কিন্তু ভাল টাকা পেলে কী মিডিয়া [৩] কী বুদ্ধিজীবী, কী লেখক নিজের বিবেককে বিক্রি করে দেন অনায়াসে। খুব একটা পেছনে যাওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। ইমদাদুল হক মিলন যখন দু-হাতে আবর্জনা ঘষেন [৪] তখন আমরা নিরাপদ দুরত্বে থাকি বলে গন্ধটা নাকে লাগে না।

আর আমরা, আমরা নিজেরা কী?
পত্রিকায় কত বড়-বড় সংবাদ। এত সব ঝাঁ-চকচকে বিষয়ের মধ্যে 'গরীব-গুবরা' একটা গুলিবিদ্ধ শিশু ক্রমশ নিস্তেজ হয়ে আসে এই সংবাদের আবেদন কোথায়? এটা যে প্রথম আলোর মত পত্রিকার প্রথম পাতায় জায়গা করে নিতে পেরেছে এটাই তো আমার কাছে বিস্ময়, এদের দামি স্পেস! গতকাল প্রথম আলো ছাপা হয়েছে, 'শিশুটিকে হাসপাতালে নিতে কেউ এগিয়ে এল না' [৪]

সূত্র: প্রথম আলো, ২০ জানুয়ারি, ২০১২

আহা, আহারে মাটা, সন্তান হারিয়েও বেচারির মুক্তি নেই। কতশত ক্যামেরা কী আপ্রাণ চেষ্টাই না করেছে চমৎকার একটা ছবি উঠাবার জন্য, একটা কান্নারত ছবি।

আমাদের দুঁদে সাংবাদিক সাহেবরা নিশ্চয়ই অপেক্ষায় ছিলেন কখন মা বুক ভেঙ্গে কাঁদবেন। নইলে মাইক্রোফোন সহ অসংখ্য হাত এগিয়ে এই প্রশ্ন করতে সমস্যা কোথায়, 'আইচ্ছা, সন্তান হারিয়ে আপনে এখন কেমন বোধ করতাছেন'।
আমি নিশ্চিত, অনেকে আমার উপর ঝাপিয়ে পড়ার জন্য হাতের আস্তিন ঠিকঠাক করছেন, দাঁতে দাঁত পিষে বলছেন, মিয়া, ঘটনার গভীরতা বোঝাতে হইব না!
অবশ্যই হবে।

কোনো এক পত্রিকায় একটা ছবি ছাপা হয়েছিল। কাটিংটা কেটেও রেখেছিলাম, এখন খুঁজে পাচ্ছি না। হাসপাতালের মর্গে তাঁর সন্তান। কলাপসিবল গেট ধরে মাটা শূণ্যদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। ওই দৃশ্যটার কথা ভাবলে এখনও বুকটা কেমন ধক করে উঠে। কেবল মনে হয় ওই মর্গে আমি শুয়ে আছি। নিথর দেহটার দিকে আমার মা তাকিয়ে আছেন, তাঁর চোখের পলক পড়ছে না।
তিনি কি ভাবছেন? এটা জানার ক্ষমতা আমার নাই বলে এখানে লিখে বোঝাবার চেষ্টায় গেলাম না।

যাই হোক, গুলিবিদ্ধ একটা শিশু হাঁ করে শ্বাস নিচ্ছে। এই গ্রহে এতো বাতাস অথচ ক্রমশ তার বাতাস কমে আসছে। ঘন্টা পার হচ্ছে কিন্তু আমাদের সময় কোথায়, আমরা যে তাকিয়ে তাকিয়ে তামাশা দেখছি। ওখানে আমি থাকলেও হয়তো আমিও তাই করতাম, তামাশা দেখতাম। আমিও যে এই সিষ্টেমে বড় হয়ে উঠা মানুষ।

এই একটা সংবাদের পেছনে যে কী অসামান্যতা তা কী আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে বলার চেষ্টা করছে? আমরা বিভিন্ন মুখোশ পরে থাকি- হরেক রকম মুখোশ আছে আমাদের কাছে। কিন্তু এই মুখোশের পেছনে আমাদের সবার চেহারা এক। এক নির্দয়-নিষ্ঠুর-চালবাজ-স্বার্থপর মানুষের (মতান্তরে যন্ত্রমানব) ছবি...।

সহায়ক সূত্র:
১. বেচা-বিক্রি...: http://www.ali-mahmed.com/2011/09/blog-post_18.html
২. তিতাস...: http://www.ali-mahmed.com/2012/01/blog-post_07.html
৩. মিডিয়া...: http://www.ali-mahmed.com/2012/01/blog-post_15.html
৪. মিলন...: http://www.ali-mahmed.com/2012/01/blog-post_14.html
৫. প্রথম আলো: http://www.eprothomalo.com/index.php?opt=view&page=1&date=2012-01-20

2 comments:

Anonymous said...

আইজু পাগলা এইটা নিয়া একটা লিখা দিসে পইরা দেইখেন,ভাল্লাগবhttp://www.amarblog.com/doctor/posts/142726

আলী মাহমেদ - ali mahmed said...

আপনার লিংকে গিয়ে পড়লাম। চমৎকার একটা লেখা, আমি মুগ্ধ! @Anonymous