আগে এক লেখায় লিখেছিলাম, "ফেব্রুয়ারি মাসটা আমাদের জন্য বড়ো জরুরি কারণ এই মাস এলেই আমরা ভাষার জন্য ঝাপিয়ে পড়ি, চোখের জল ফেলার সুযোগ পাই। বিস্তর কান্নাকাটি করি। আমাদের দেশের বুদ্ধিজীবীরা তো কাঁদতে কাঁদতে অন্তর্বাস ভিজিয়ে ফেলেন! ফেব্রুয়ারি যাওয়ামাত্র যথারীতি আমরা সমস্ত কিছুই বিস্মৃত হই"! ...[১]
অনেকের কাছে এই বক্তব্য অতিশয়োক্তি মনে হবে। তাই বুঝি? বেশ-বেশ। তা আমাদের দেশের এতো বড়-বড় পন্ডিতগণ জীবিত থাকতে ২০১২ সাল পর্যন্ত অধিকাংশ আইনই বাংলায় করা হয়নি! "এখনও আমাদের অধিকাংশ আইন ব্রিটিশদের করা। নামও বলিহারি! ১৯২০ সালের 'বেঙ্গল পশু ক্লেশ আইন', ১৮৭১ সালের 'গবাধিপশু অনধিকার প্রবেশ আইন"!
আহা, নিজের ভাষার প্রতি কী দরদ, দায়িত্ব আমাদের। হবে না কেন! শ্লা, ব্রিটিশ প্রভুদের বোল-চাল, মুখের ভাষা, গায়ের পোশাক আমরা ছাড়ি কেমন করে!
গতকাল আমার ছেলেটাকে নিয়ে গেছি ব্রাক্ষণবাড়িয়ায়। ওকে স্কুল থেকে জেলা শহরে পাঠানো হয়েছে। কিন্তু স্মৃতিশক্তি নামের একটা পরীক্ষায় টিকে নাই বলে ওর মন অসম্ভব খারাপ। ওর চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে। আমি ওকে বললাম, ব্যাটা, জীবন একটা লম্বা দৌড়, এখানে থামাথামির কোনো সুযোগ নাই। কোনো সমস্যা নাই, পরেরবার চেষ্টা করবে।
ও কি বুঝল কে জানে ওর মনখারাপ ভাব আরো বেড়ে গেল। আমি ওর মন খানিকটা ভাল করার জন্য ওকে নিয়ে এদিক-ওদিক হাঁটছি। ব্রাক্ষণবাড়িয়ার এই স্মৃতিসৌধটা ও কখনো দেখিনি বলে নিয়ে গেছি ওকে দেখাতে কিন্তু এটার সামনে দাঁড়িয়ে আমি হতভম্ব!
হা ঈশ্বর, আমি একি দেখছি? এখানে জমিয়ে বেশ আড্ডা হচ্ছে। এর গায়ে দেখি আবার কুৎসিত কথাও লিখে রেখেছে! আমি ছবি উঠাতে পরছিলাম না কারণ আমার সন্তানের চোখে এটা পড়ুক, তারপর তার সঙ্গে আমার চোখাচোখি হোক এটা আমি চাচ্ছিলাম না। ওকে বুদ্ধি করে খানিকটা আড়ালে রেখে অতি দ্রুত এখান থেকে সরে আসছি।
আরেকটা কারণ। কী ঝকঝকে একটা দিন! তীব্র রোদ আমাকে আটকাবার চেষ্টা করছে। চোখ ধাঁধানো রোদের কারণে স্থাপনাটা হয়ে যাচ্ছে তমোময়, ছায়া-ছায়া।
কালে কালে আমরা কী হয়ে যাচ্ছি? বছরের ১১ মাস আমরা ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে কাটালেও অন্তত এই ফেব্রুয়ারি মাসটা আমরা জেগে কাটাই। নির্ঘুম! আজ ২০ ফেব্রুয়ারি আর মাত্র একদিন পরই ২১ ফেব্রুয়ারি। অন্তত এখন প্রশাসনযন্ত্রের সমস্ত মানুষ গায়ের ঘাম বিসর্জন দিচ্ছেন, ব্যস্ততায় মৌমাছিকেও হার মানাচ্ছেন।
কেউ-কেউ বলতে পারেন, কে কখন এই কান্ডটা করেছে এটা হয়তো প্রশাসনের চোখ এড়িয়ে গেছে। বা কেউ তাঁদের জানায়নি। তাই বুঝি? আপনাদের সদয় অবগতির জন্য বলি, এই স্তম্ভটা একটা পার্কের ঠিক মাঝখানটায়, এখানে শত-শত মানুষ আসাযাওয়া করছেন। এই পার্কের ঠিক উল্টোদিকে তিনটা ঢাউস ভবন। জাঁক করে বলা হয়, বাংলো। একটা বাংলো জেলা প্রশাসক মহোদয়ের, একটা পুলিশ সুপার সাহেবের অন্যটা জেলা জাজের। অন্তত এঁদের শহরে যেতে হলে এটার সামনে দিয়ে যাওয়া ব্যতীত অন্য কোনো উপায় নেই।
ঠিক একদিন পর আজ ২১ ফেব্রুয়ারি। আজ আরেক কান্ড। উপজেলা কর্তৃপক্ষ ২১শে ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে বাচ্চাদের নিয়ে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিলেন। আঁকাআঁকিতে যে বাচ্চাটা প্রথম হয়েছে তার জন্য অসাধারণ এক পুরস্কার, গায়েমাখা সাবান। ওয়াক!
বই-টই আর কিছু পাওয়া গেল না। অন্তত একটা কলম, হোক না ওটার দাম পাঁচ টাকা। যেটা একটা বাচ্চা বছরের-পর-বছর ধরে সংরক্ষণ করবে। ভাষা উপলক্ষে আয়োজিত এই অনুষ্ঠানে এই প্রজন্মের কাছে আমরা কি উদাহরণ সৃষ্টি করতে চাচ্ছি? এই গায়ে মাখার সাবান দিয়ে কি করা হবে, বাচ্চাদের মস্তিষ্ক ধৌত? হে মাবুদ, এমন অসাধারণ বুদ্ধি বেরিয়েছে কার মাথা থেকে? বরং সেই মাথাটাই ধুয়ে সাফ-সুতরো করে সংরক্ষণ করে রাখা আবশ্যক। বেচারা বাচ্চাদের কচি মাথা চিবানো শেষ হলে এই সাবান দিয়ে আমাদের বোধহীন মানুষগুলোকে বলব মাথা কামিয়ে ভাল করে মাথা ধুয়ে ফেলার জন্য।
আগেও লিখেছিলাম, "বিশ্বের ছয় হাজার ভাষার মধ্যে প্রায় আড়াই হাজার ভাষা হারিয়ে যাচ্ছে। লাটভিয়ায় ‘লিভোনিয়ান’ ভাষায় কথা বলেন এমন একজনই মাত্র জীবিত আছেন, তিনি মারা গেলে সেই ভাষারও মৃত্যু হবে। এটা ২০০৯ সালের কথা, এরিমধ্যে তিনি মারা গেছেন কিনা আমি জানি না। আলাস্কার ‘আইয়াক’ ভাষা জানা শেষ ব্যক্তিটি মারা যান ২০০৮ সালে। তাঁর সঙ্গেই মৃত্যু হয় ‘আইয়াক’ ভাষার..."।
একটি বর্ণ- একটি ভাষা- একটি যুদ্ধ- একটি পতাকা- একটি স্বাধীন দেশ। আমরা ভুলে যাই, এই মায়ের ভাষার জন্য নড়েচড়ে না বসলে হয়তো আজও আমরা তাইরে-নাইরে করে দিনযাপন করতাম। অন্যের মায়ের ভাষাকে নিজের ভাষা বলে লম্বা লম্বা দুঃখের শ্বাস ফেলতাম।
হায়, এই ভাষার জন্য যারা প্রাণ দিয়েছেন তাঁদের কথা আমরা কী অবলীলায়ই না বিস্মৃত হই। আসলে আমাদের অহংকারের শেষ নেই যে কারণ ইতিমধ্যে আমরা জেনে গেছি বাংলা ভাষায় কথা বলেন প্রায় ২৩ কোটি মানুষ অতএব আমাদের কী ভয়? আহা, এই ভাষার প্রতি ন্যূনতম শ্রদ্ধা বোধ না-থাকলেও আমাদের উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই যে। এই ভাষার গায়ে কেউ আঁচড়ও কাটতে পারবে না।
আমি কি তাদের স্মরণ করিয়ে দেব, এই গ্রহে ডায়নোসর নাই, রাশিয়া নাই, আদমজি জুটমিল নাই...।
*অসাধারণ এই ভিডিওটা ফেসবুকে আপলোড করেছেন, Moin Uddin Pathan.
Moin Uddin Pathan, তাঁর প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতা জানাই।
সহায়ক সূত্র:
১. ভাষার জন্য ভালোবাসা: http://www.ali-mahmed.com/2011/02/blog-post_16.html
অনেকের কাছে এই বক্তব্য অতিশয়োক্তি মনে হবে। তাই বুঝি? বেশ-বেশ। তা আমাদের দেশের এতো বড়-বড় পন্ডিতগণ জীবিত থাকতে ২০১২ সাল পর্যন্ত অধিকাংশ আইনই বাংলায় করা হয়নি! "এখনও আমাদের অধিকাংশ আইন ব্রিটিশদের করা। নামও বলিহারি! ১৯২০ সালের 'বেঙ্গল পশু ক্লেশ আইন', ১৮৭১ সালের 'গবাধিপশু অনধিকার প্রবেশ আইন"!
আহা, নিজের ভাষার প্রতি কী দরদ, দায়িত্ব আমাদের। হবে না কেন! শ্লা, ব্রিটিশ প্রভুদের বোল-চাল, মুখের ভাষা, গায়ের পোশাক আমরা ছাড়ি কেমন করে!
গতকাল আমার ছেলেটাকে নিয়ে গেছি ব্রাক্ষণবাড়িয়ায়। ওকে স্কুল থেকে জেলা শহরে পাঠানো হয়েছে। কিন্তু স্মৃতিশক্তি নামের একটা পরীক্ষায় টিকে নাই বলে ওর মন অসম্ভব খারাপ। ওর চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে। আমি ওকে বললাম, ব্যাটা, জীবন একটা লম্বা দৌড়, এখানে থামাথামির কোনো সুযোগ নাই। কোনো সমস্যা নাই, পরেরবার চেষ্টা করবে।
ও কি বুঝল কে জানে ওর মনখারাপ ভাব আরো বেড়ে গেল। আমি ওর মন খানিকটা ভাল করার জন্য ওকে নিয়ে এদিক-ওদিক হাঁটছি। ব্রাক্ষণবাড়িয়ার এই স্মৃতিসৌধটা ও কখনো দেখিনি বলে নিয়ে গেছি ওকে দেখাতে কিন্তু এটার সামনে দাঁড়িয়ে আমি হতভম্ব!
হা ঈশ্বর, আমি একি দেখছি? এখানে জমিয়ে বেশ আড্ডা হচ্ছে। এর গায়ে দেখি আবার কুৎসিত কথাও লিখে রেখেছে! আমি ছবি উঠাতে পরছিলাম না কারণ আমার সন্তানের চোখে এটা পড়ুক, তারপর তার সঙ্গে আমার চোখাচোখি হোক এটা আমি চাচ্ছিলাম না। ওকে বুদ্ধি করে খানিকটা আড়ালে রেখে অতি দ্রুত এখান থেকে সরে আসছি।
আরেকটা কারণ। কী ঝকঝকে একটা দিন! তীব্র রোদ আমাকে আটকাবার চেষ্টা করছে। চোখ ধাঁধানো রোদের কারণে স্থাপনাটা হয়ে যাচ্ছে তমোময়, ছায়া-ছায়া।
কালে কালে আমরা কী হয়ে যাচ্ছি? বছরের ১১ মাস আমরা ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে কাটালেও অন্তত এই ফেব্রুয়ারি মাসটা আমরা জেগে কাটাই। নির্ঘুম! আজ ২০ ফেব্রুয়ারি আর মাত্র একদিন পরই ২১ ফেব্রুয়ারি। অন্তত এখন প্রশাসনযন্ত্রের সমস্ত মানুষ গায়ের ঘাম বিসর্জন দিচ্ছেন, ব্যস্ততায় মৌমাছিকেও হার মানাচ্ছেন।
কেউ-কেউ বলতে পারেন, কে কখন এই কান্ডটা করেছে এটা হয়তো প্রশাসনের চোখ এড়িয়ে গেছে। বা কেউ তাঁদের জানায়নি। তাই বুঝি? আপনাদের সদয় অবগতির জন্য বলি, এই স্তম্ভটা একটা পার্কের ঠিক মাঝখানটায়, এখানে শত-শত মানুষ আসাযাওয়া করছেন। এই পার্কের ঠিক উল্টোদিকে তিনটা ঢাউস ভবন। জাঁক করে বলা হয়, বাংলো। একটা বাংলো জেলা প্রশাসক মহোদয়ের, একটা পুলিশ সুপার সাহেবের অন্যটা জেলা জাজের। অন্তত এঁদের শহরে যেতে হলে এটার সামনে দিয়ে যাওয়া ব্যতীত অন্য কোনো উপায় নেই।
ঠিক একদিন পর আজ ২১ ফেব্রুয়ারি। আজ আরেক কান্ড। উপজেলা কর্তৃপক্ষ ২১শে ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে বাচ্চাদের নিয়ে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিলেন। আঁকাআঁকিতে যে বাচ্চাটা প্রথম হয়েছে তার জন্য অসাধারণ এক পুরস্কার, গায়েমাখা সাবান। ওয়াক!
বই-টই আর কিছু পাওয়া গেল না। অন্তত একটা কলম, হোক না ওটার দাম পাঁচ টাকা। যেটা একটা বাচ্চা বছরের-পর-বছর ধরে সংরক্ষণ করবে। ভাষা উপলক্ষে আয়োজিত এই অনুষ্ঠানে এই প্রজন্মের কাছে আমরা কি উদাহরণ সৃষ্টি করতে চাচ্ছি? এই গায়ে মাখার সাবান দিয়ে কি করা হবে, বাচ্চাদের মস্তিষ্ক ধৌত? হে মাবুদ, এমন অসাধারণ বুদ্ধি বেরিয়েছে কার মাথা থেকে? বরং সেই মাথাটাই ধুয়ে সাফ-সুতরো করে সংরক্ষণ করে রাখা আবশ্যক। বেচারা বাচ্চাদের কচি মাথা চিবানো শেষ হলে এই সাবান দিয়ে আমাদের বোধহীন মানুষগুলোকে বলব মাথা কামিয়ে ভাল করে মাথা ধুয়ে ফেলার জন্য।
আগেও লিখেছিলাম, "বিশ্বের ছয় হাজার ভাষার মধ্যে প্রায় আড়াই হাজার ভাষা হারিয়ে যাচ্ছে। লাটভিয়ায় ‘লিভোনিয়ান’ ভাষায় কথা বলেন এমন একজনই মাত্র জীবিত আছেন, তিনি মারা গেলে সেই ভাষারও মৃত্যু হবে। এটা ২০০৯ সালের কথা, এরিমধ্যে তিনি মারা গেছেন কিনা আমি জানি না। আলাস্কার ‘আইয়াক’ ভাষা জানা শেষ ব্যক্তিটি মারা যান ২০০৮ সালে। তাঁর সঙ্গেই মৃত্যু হয় ‘আইয়াক’ ভাষার..."।
একটি বর্ণ- একটি ভাষা- একটি যুদ্ধ- একটি পতাকা- একটি স্বাধীন দেশ। আমরা ভুলে যাই, এই মায়ের ভাষার জন্য নড়েচড়ে না বসলে হয়তো আজও আমরা তাইরে-নাইরে করে দিনযাপন করতাম। অন্যের মায়ের ভাষাকে নিজের ভাষা বলে লম্বা লম্বা দুঃখের শ্বাস ফেলতাম।
হায়, এই ভাষার জন্য যারা প্রাণ দিয়েছেন তাঁদের কথা আমরা কী অবলীলায়ই না বিস্মৃত হই। আসলে আমাদের অহংকারের শেষ নেই যে কারণ ইতিমধ্যে আমরা জেনে গেছি বাংলা ভাষায় কথা বলেন প্রায় ২৩ কোটি মানুষ অতএব আমাদের কী ভয়? আহা, এই ভাষার প্রতি ন্যূনতম শ্রদ্ধা বোধ না-থাকলেও আমাদের উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই যে। এই ভাষার গায়ে কেউ আঁচড়ও কাটতে পারবে না।
আমি কি তাদের স্মরণ করিয়ে দেব, এই গ্রহে ডায়নোসর নাই, রাশিয়া নাই, আদমজি জুটমিল নাই...।
*অসাধারণ এই ভিডিওটা ফেসবুকে আপলোড করেছেন, Moin Uddin Pathan.
Moin Uddin Pathan, তাঁর প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতা জানাই।
সহায়ক সূত্র:
১. ভাষার জন্য ভালোবাসা: http://www.ali-mahmed.com/2011/02/blog-post_16.html
2 comments:
acha apni ki janen,16dec 21 feb k samme rekhe sorkare lokjonera chadabaje kore?
কাজের একটা তথ্য দিয়েছেন। একদম জানি না এমন না। আসলে বিষয়টা নিয়ে আলাদা করে কখন্ও ভাবিনি। @Anonymous
Post a Comment