(চুতিয়া শব্দটায় যাদের এলার্জির সমস্যা হয় তারা চুতিয়ার জায়গায় 'কুতিয়া' পড়বেন। অবশ্য কুতিয়া শব্দের অর্থ কি এটা আমি জানি না।)
হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে এক লেখায় লিখেছিলাম,
"এই দেশে যারা সাহিত্য চিবিয়ে খান তাঁরা হুমায়ূন আহমেদের লেখায় গভীরতা খুঁজে পান না। ...হুমায়ূন আহমেদের বই পড়ে অনেক কঠিন সময় পার করেছি, এর কী কোন মূল্য নাই? তাঁর কোনো বই হাতে নিয়েছি কিন্তু পড়ে শেষ করিনি এমনটা হয়নি, এখনো! এই যে এখনো আমাকে ধরে রাখার ক্ষমতা- কী বিপুল এক ক্ষমতা! কী এক অদ্ভুত ব্যাপার! পারলে মানুষটার হাত সোনা দিয়ে বাঁধাই করে দিতাম। হুমায়ূন আহমেদকে কোনো ইশকুলে পড়তে হয় না, তিনি নিজেই একটা ইশকুল..."।
কোনো এক বিচিত্র কারণে হুমায়ূন আহমেদকে এখন সবাই লাশ-মরদেহ বলছেন এবং হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে এখন একেকজন একেক কথা বলছেন, কেউ লেখার জাদুকর বলছেন তো কেউ বলছেন বাংলা সাহিত্যের ইত্যাদি ইত্যাদি।
সবাই তো সব বলেই ফেলেছেন এখন আমি বেচারা উপায় কী! তিনি কি ছিলেন আসলে এটা আমি জানি না তবে আমি হুমায়ূন আহমেদকে বলি, একজন দুর্ধর্ষ ড্রাগ ডিলার। রসো-রসো, হাতের আস্তির গোটাবার আবশ্যকতা নাই।
একজন যেমন নেশায় বুঁদ হয়ে থাকেন- যতক্ষণ নেশায় থাকেন ততক্ষণ তার বাহ্যেজ্ঞান লোপ পায়। মুশকিলটা হচ্ছে নেশা কেটে গেলেই নেশাখোর অহেতুক হইচই শুরু করেন, "...হুরু যা, কী খাইলাম, মুত"! এই নেশখোরেরা ভুলে যান এই নেশার জন্যই কী অস্থির হয়ে ছিলেন, তখন তিনি পারেন না এমন কোনো কাজ নাই।
হুমায়ূন আহমেদ ছিলেন ড্রাগের বড় কারিগর। অন্য এক রককম ড্রাগ- লেখা নামের এক নেশা ফেরি করতেন! অনেকে তাঁর লেখা যতক্ষণ পাঠ করেছে ততক্ষণ পুরোপুরি নেশাগ্রস্থ। যথারীতি অনেকেই বই শেষ করেছেন। নেশা কেটে গেছে। তখন চিঁ চিঁ করেছেন, ধুর, এইটা...। কিন্তু নেশাখোর এটা বিস্মৃত হয়েছেন তার দুঃসময় তিনি পার করেছেন অবলীলায়। এটা যে কী এক বিশাল ব্যাপার, দুঃসময় পার করা...।
এই বঙ্গাল দেশে যারা জাতে উঠেছেন তাঁরা যে হুমায়ূন আহমেদের লেখা পড়েন সঙ্গত কারণেই এটা কবুল করেন না। আমি জাতে উঠিনি বলেই হুমায়ূনের লেখা পড়া হয় এটা স্বীকার যেতে আমার পূর্বেও এটা বলতে সমস্যা ছিল না, আজও। এও সত্য, হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে কঠিন কিছু লেখা আমি লিখেছি। প্রয়োজন মনে করেছি বলেই লিখেছি। এই নিয়ে আমার কোনো অনুতাপ-পরিতাপ নেই, এ তাঁর পাওনা ছিল। পছন্দের মানুষের সব কিছুতেই লাফাতে হবে এতোটা হৃদয়বান আমি নই। প্রয়োজনে আবারও লিখব...।
এখন হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে বুদ্ধিজীবী ওরফে বুদ্ধির ঢেঁকিরা চিবিয়ে চিবিয়ে লম্বা-লম্বা বাতচিত করছেন, দেখতে ভালই লাগছে। তাঁরা যা বলবেন তাই আমরা হাঁ করে গিলব কারণ হুমায়ূন এর প্রতিবাদ করতে আসবেন না। ফাঁকতালে নিজের প্রচারণাটুকু সেরে ফেললে মন্দ কী! যেমন আনিসুল হক প্রথম আলোয় লিখেছেন,
" ...হুমায়ূন স্যারের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে খুব কম। কিন্তু যতবার দেখা হয়েছে, তিনি বলেছেন, 'শোনো, আমি কিন্তু তোমার লেখা পড়ি...।' তিনি যে পড়েন সেটা প্রমাণ দেয়ার জন্যই হয়তো বলতেন..."।
আরেক জায়গায় আমাদের আনিস মিয়া লিখছেন, "...আমি সরে গিয়ে অন্য টেবিলে বসলাম। সেখানে শাওন, খালাম্মা (স্যারের মা) বসেছেন। আমি বললাম, খালাম্মা, আমি আনিসুল হক...। তিনি বললেন, বাবা, তোমাকে চিনি তো, তোমার লেখা পড়ি..."। (প্রথম আলো, ২৪ জুলাই, ২০১২)
শাওন এবং তাঁর ছোট দুই বাচ্চা কি বলল, আনিস ভাইয়া? আনিসুল হক নামের এই লাজহীন মানুষটাকে নিয়ে নতুন করে বলার কিছু নাই, এ আরেক মিলন...[০]! ভাগ্যিস লিখে বসেননি, হুমায়ূন আহমেদ যখন বাকরুদ্ধ হয়েছেন, চিরকূট লিখেছেন 'লস্ট মাই ভয়েজ'; তখনও তিনি আমার লেখা পড়ছিলেন। শেষ শ্বাস নেয়ার আগেও তার বুকের উপর আমার বই উপুড় করা ছিল।
আচ্ছা যান তর্কের খাতিরে ধরে নিলাম এই তেলতেলে মানুষটা যা বলছেন তা সবই সত্য কিন্তু এই মানুষটাকে কে বোঝাবে সব লিখে ফেলতে হয় না, সব বলে ফেলা সমীচীন না রে পাপিষ্ঠ। কেই বা এই হতভাগাকে বোঝাবে, অনেকে তার এই চুটকির কলামে চোখ বুলিয়ে যান দায়ে পড়ে (প্রায়শ আমরা দেখি না এমন, কোনো একটা ওয়টিং রুমে টিভি চলছে- করার কিছুই নাই লোকজন হাঁ করে টিভির দিকে তাকিয়ে) এতে লেখকের চেয়ে এই দৈনিকটির অবদানই প্রবল।
অবশ্য আনিসুল হক মহোদয় পা গলে মাঝে-মাঝে যে আবার ফুটফুটে বাচ্চা প্রসব হয় আ মীন চমৎকার লেখা বেরিয়ে আসে তার একটা উদাহরণ, "ফেসবুকের ছায়াবন্ধু..."। [১]
এমনিতে আনিসুল হক কেমন করে 'কু-ঘুটা' দেন এর উদাহরণের অভাব কী [২]! এই নিয়ে সু-লেখক হিমুর চমৎকার একটা লেখা আছে:
"...আনিসুল ভাইয়ার বিজ্ঞাপনগুলি নীরব ঘাতক। রিলায়েন্স গ্রুপ স্পনসর্ড সিনেমায় দেখেছিলাম, নায়িকা রিলায়েন্সের নেট কানেকশন ব্যবহার করে নেটে ঢোকে, নায়ককে রিলায়েন্সের ফোন দিয়ে এসেমেস করে, রিলায়েন্সের জ্যুস-দুধ-তরকারি খায়। আমার মতো বদ লোকজন সেগুলির নিন্দেমন্দ করে আর কি।
দাঁড়া আমিও একটা পেমের বই লিখে পেত্যেক পোস্টে বিজ্ঞাপোন্দিবো আনিসুল ভাইয়ার স্টাইলে। আমার গল্পে নায়িকা আমার বই পড়বে। নায়ক আমার বই টেবিলের পায়ার নিচে দিয়ে টেবিল উঁচু করবে। খলনায়িকা আমার বই দিয়ে লজ্জা ঢাকবে। খলনায়ক আমার বই কেড়ে নিয়ে খলনায়িকাকে লজ্জায় ফেলবে। নায়কের বাবা নায়কের ছোটো ভাইকে আমার বই দিয়ে পিটাবে। নায়িকার ছোটো বোন বইমেলায় গিয়ে আমার বই কিনে দিতে বলবে বয়ফ্রেণ্ডকে। আইতাছি খাড়া..." [৩](http://www.sachalayatan.com/himu/42941)
বেশ, কিন্তু আমরা যারা সাধারণ মানুষ যাদের হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে জাঁক করে বলার মত কোনো স্মৃতি নাই আমাদের উপায় কী! এই বিষয়ে ফেসবুকে চমৎকার এক নোট লিখেছেন আরিফ জেবতিক:
"প্রভু বললেন, ''হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে ব্যক্তিগত স্মৃতি লেখার ধুম পড়েছে। স্যার আমার পিঠে হাত বুলায়া কইলেন...স্যার আমারে ডেকে নিয়া বললেন..স্যার খবর পাঠিয়ে জানালেন..ডাকপিয়ন স্যারের পাঠানো গিফট নিয়া আইল..হুমায়ূন আহমেদ মাঝরাতে ফোন করে জিজ্ঞেস করলেন...কত তামাশা! তোমার সঙ্গে হুমায়ূন আহমেদের স্মৃতি নেই?'
আমি বললাম, ' আছে তো! হাজার হাজার স্মৃতি। ঐ যে একবার ঝুম বৃষ্টি এলো, আমরা সবাই ক্লাস থেকে বেরিয়ে বৃষ্টিতে ভিজলাম; তারপর এক পূর্ণিমা রাতে আমরা ষোলজন একটা বাসের ছাদে চড়ে সিলেট থেকে শ্রীমঙ্গল গেলাম চাঁদ দেখতে দেখতে, ঐ যে একমুঠো আঁকাশ দেখার আমন্ত্রন জানিয়ে চিঠি লেখলাম মায়াবতী মেয়েটিকে...সবখানেই তো হুমায়ূন আমাদের সঙ্গেই ছিলেন। যারা মিডিয়ায় হুমায়ূন বন্দনা করছে তাঁরা সিজনাল-কিছু না কিছু লিখবেই। অথচ হুমায়ূন তাঁদের ছিলেন না, হুমায়ূন ছিলেন লাইনে দাঁড়িয়ে বই কেনা পাগল তরুণ তরুণীদের। হুমায়ূন বুদ্ধিজীবিদের জন্য ছিলেন পত্রিকার পাতায়, আমাদের জন্য ছিলেন নিশিজাগা রাতের দীর্ঘশ্বাসে'।" (http://www.facebook.com/jebtik)
যাই হোক, এবার আসি আমাদের মিডিয়ার কথায়। মিডিয়ার উত্থান কথাটা ঠিক হলো না। মিডিয়ার উত্থান তো হয়েই আছে, সময়ে সময়ে ইয়ের মত কেবল উত্থিত হয়। যে হারে ব্যবসায়িরা ইলেকট্রনিক মিডিয়ার প্রসার ঘটাচ্ছেন সেইদিন আর দূরে নাই যখন একজন কবরে শুয়েও শান্তি পাবেন না। এখন তো মিডিয়ার লোকজনেরা কোনো মৃত মানুষের স্বজনের মুখে 'বুম' ধরছেন, 'আপনার এখুন কেমুন লাগিতেছে'? আমি নিশ্চিত, এরা তখন কবর খুঁড়ে মৃতব্যক্তির মুখে বুম ধরে বলবেন, 'আপুনি এখুন কেমুন বোধ করিতেছেন'?
আমরা দেশবাসির অনেকের হয়তো এটা জানার আগ্রহ ছিল, হুমায়ূন আহমেদকে কোথায় সমাহিত করা হবে কিন্তু এই চুতিয়া মিডিয়ার কাছে কে জানতে চাইল এখনই নুহাশ পল্লীর গতি কী হবে! এরা শাওন এবং শিলাদের কাছে এটা এখনই জানতে চাইলেন কেন? এটা কি পরে হলে আসমান দু-হাত নিচে নেমে আসত! কে এইসব চুতিয়াদের এই ক্ষমতা দিয়েছে?
হুমায়ূন আহমেদের প্রস্থান নিয়ে কতশত ছবি ছাপা হয়েছে কিন্তু অসাধারণ এক ছবি সম্ভবত এটাই। কী হাহাকার করা এক ছবি! পরিমিতি বোধের চমৎকার এক উদাহরণও। ধন্যবাদ প্রথম আলো!
বলার জন্য বলা- অনেকে নিয়ম করে বলছেন, কেনো এই অকালে চলে যাওয়া?! ন্যাকা-ন্যাকা এই সব কথা, এটা স্রেফ বলার জন্য বলা- ৬৪ বছরে একজনের চলে যাওয়াকে অকালে বলার অবকাশ নাই। এটা আমার নিজস্ব মত, হুমায়ূন আহমেদ সময়ের প্রয়োজনেই চলে গেছেন। যেতে যখন হবেই তখন সময়ের হাত ধরে যাওয়াটাই উত্তম। ঠিক একই বোধটা কাজ করছিল আমার অসম্ভব পছন্দের একজন মানুষের প্রস্থানের বেলায়- মাত্র কয়েক মাস পূর্বের ঘটনা এটা।
হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে অন্য এক লেখা লিখেছেন রাসেল পারভেজ:
"...হয়তো পরবর্তী একটা প্রজন্ম তার ভাষারীতির আচ্ছন্নতা থেকে বের হয়ে ভিন্ন ধারার সাহিত্য রচনায় ব্রতী হবেন, উপন্যাসের প্রকাশক্ষমতা ও সম্ভাবনাকে হত্যা করে ফেলেছিলেন তিনি তার যাদুকরী ক্ষমতায়- তার মৃত্যু একদিক থেকে ভাবলে বাংলা উপন্যাসের একধরনের মুক্তির সংবাদও বটে"। [৪]
...
ছবিটার জন্য (২৪ জুলাই) প্রথম আলোর বেদম প্রশংসা করেছিলাম কিন্তু আজকের ছবিটার জন্য (২৮ জুলাই), এই সব ছবির জন্য খানিকটা নিন্দা করি।
একজন সেলিব্রেটির কাছের লোকজনের এই প্রাইভেসিটুকুও নাই যে এরা একান্তে খানিকটা কেঁদে বুক হালকা করতে পারেন! এরা কেমন করে কান্না করেন এটাও আমাদের দেখার বিষয়- বানর নাচ! হুমায়ূন আহমেদের স্বজনরা জুতা পায়ে দেন না নাকি! একটা মানুষের পায়েও জুতা ছিল না ছুঁড়ে মারার জন্য?
সহায়ক সূত্র:
০. মিলন, একজন ঢোলবাজ: http://www.ali-mahmed.com/2010/01/blog-post_29.html
১. ফেসবুকের ছায়াবন্ধু... : http://www.prothom-alo.com/detail/date/2012-08-07/news/279806
২. একজন আদর্শ সাহিত্যিক: http://www.ali-mahmed.com/2010/02/blog-post_07.html
৩. পত্রিকার দৈনিক দৈন্য...: http://www.sachalayatan.com/himu/42941
৪. পাঁড় পাঠকের হুমায়ূন-ব্যবচ্ছেদ: http://www.unmochon.com/2012/07/23/11986.html
হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে এক লেখায় লিখেছিলাম,
"এই দেশে যারা সাহিত্য চিবিয়ে খান তাঁরা হুমায়ূন আহমেদের লেখায় গভীরতা খুঁজে পান না। ...হুমায়ূন আহমেদের বই পড়ে অনেক কঠিন সময় পার করেছি, এর কী কোন মূল্য নাই? তাঁর কোনো বই হাতে নিয়েছি কিন্তু পড়ে শেষ করিনি এমনটা হয়নি, এখনো! এই যে এখনো আমাকে ধরে রাখার ক্ষমতা- কী বিপুল এক ক্ষমতা! কী এক অদ্ভুত ব্যাপার! পারলে মানুষটার হাত সোনা দিয়ে বাঁধাই করে দিতাম। হুমায়ূন আহমেদকে কোনো ইশকুলে পড়তে হয় না, তিনি নিজেই একটা ইশকুল..."।
কোনো এক বিচিত্র কারণে হুমায়ূন আহমেদকে এখন সবাই লাশ-মরদেহ বলছেন এবং হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে এখন একেকজন একেক কথা বলছেন, কেউ লেখার জাদুকর বলছেন তো কেউ বলছেন বাংলা সাহিত্যের ইত্যাদি ইত্যাদি।
সবাই তো সব বলেই ফেলেছেন এখন আমি বেচারা উপায় কী! তিনি কি ছিলেন আসলে এটা আমি জানি না তবে আমি হুমায়ূন আহমেদকে বলি, একজন দুর্ধর্ষ ড্রাগ ডিলার। রসো-রসো, হাতের আস্তির গোটাবার আবশ্যকতা নাই।
একজন যেমন নেশায় বুঁদ হয়ে থাকেন- যতক্ষণ নেশায় থাকেন ততক্ষণ তার বাহ্যেজ্ঞান লোপ পায়। মুশকিলটা হচ্ছে নেশা কেটে গেলেই নেশাখোর অহেতুক হইচই শুরু করেন, "...হুরু যা, কী খাইলাম, মুত"! এই নেশখোরেরা ভুলে যান এই নেশার জন্যই কী অস্থির হয়ে ছিলেন, তখন তিনি পারেন না এমন কোনো কাজ নাই।
হুমায়ূন আহমেদ ছিলেন ড্রাগের বড় কারিগর। অন্য এক রককম ড্রাগ- লেখা নামের এক নেশা ফেরি করতেন! অনেকে তাঁর লেখা যতক্ষণ পাঠ করেছে ততক্ষণ পুরোপুরি নেশাগ্রস্থ। যথারীতি অনেকেই বই শেষ করেছেন। নেশা কেটে গেছে। তখন চিঁ চিঁ করেছেন, ধুর, এইটা...। কিন্তু নেশাখোর এটা বিস্মৃত হয়েছেন তার দুঃসময় তিনি পার করেছেন অবলীলায়। এটা যে কী এক বিশাল ব্যাপার, দুঃসময় পার করা...।
এই বঙ্গাল দেশে যারা জাতে উঠেছেন তাঁরা যে হুমায়ূন আহমেদের লেখা পড়েন সঙ্গত কারণেই এটা কবুল করেন না। আমি জাতে উঠিনি বলেই হুমায়ূনের লেখা পড়া হয় এটা স্বীকার যেতে আমার পূর্বেও এটা বলতে সমস্যা ছিল না, আজও। এও সত্য, হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে কঠিন কিছু লেখা আমি লিখেছি। প্রয়োজন মনে করেছি বলেই লিখেছি। এই নিয়ে আমার কোনো অনুতাপ-পরিতাপ নেই, এ তাঁর পাওনা ছিল। পছন্দের মানুষের সব কিছুতেই লাফাতে হবে এতোটা হৃদয়বান আমি নই। প্রয়োজনে আবারও লিখব...।
এখন হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে বুদ্ধিজীবী ওরফে বুদ্ধির ঢেঁকিরা চিবিয়ে চিবিয়ে লম্বা-লম্বা বাতচিত করছেন, দেখতে ভালই লাগছে। তাঁরা যা বলবেন তাই আমরা হাঁ করে গিলব কারণ হুমায়ূন এর প্রতিবাদ করতে আসবেন না। ফাঁকতালে নিজের প্রচারণাটুকু সেরে ফেললে মন্দ কী! যেমন আনিসুল হক প্রথম আলোয় লিখেছেন,
" ...হুমায়ূন স্যারের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে খুব কম। কিন্তু যতবার দেখা হয়েছে, তিনি বলেছেন, 'শোনো, আমি কিন্তু তোমার লেখা পড়ি...।' তিনি যে পড়েন সেটা প্রমাণ দেয়ার জন্যই হয়তো বলতেন..."।
আরেক জায়গায় আমাদের আনিস মিয়া লিখছেন, "...আমি সরে গিয়ে অন্য টেবিলে বসলাম। সেখানে শাওন, খালাম্মা (স্যারের মা) বসেছেন। আমি বললাম, খালাম্মা, আমি আনিসুল হক...। তিনি বললেন, বাবা, তোমাকে চিনি তো, তোমার লেখা পড়ি..."। (প্রথম আলো, ২৪ জুলাই, ২০১২)
শাওন এবং তাঁর ছোট দুই বাচ্চা কি বলল, আনিস ভাইয়া? আনিসুল হক নামের এই লাজহীন মানুষটাকে নিয়ে নতুন করে বলার কিছু নাই, এ আরেক মিলন...[০]! ভাগ্যিস লিখে বসেননি, হুমায়ূন আহমেদ যখন বাকরুদ্ধ হয়েছেন, চিরকূট লিখেছেন 'লস্ট মাই ভয়েজ'; তখনও তিনি আমার লেখা পড়ছিলেন। শেষ শ্বাস নেয়ার আগেও তার বুকের উপর আমার বই উপুড় করা ছিল।
আচ্ছা যান তর্কের খাতিরে ধরে নিলাম এই তেলতেলে মানুষটা যা বলছেন তা সবই সত্য কিন্তু এই মানুষটাকে কে বোঝাবে সব লিখে ফেলতে হয় না, সব বলে ফেলা সমীচীন না রে পাপিষ্ঠ। কেই বা এই হতভাগাকে বোঝাবে, অনেকে তার এই চুটকির কলামে চোখ বুলিয়ে যান দায়ে পড়ে (প্রায়শ আমরা দেখি না এমন, কোনো একটা ওয়টিং রুমে টিভি চলছে- করার কিছুই নাই লোকজন হাঁ করে টিভির দিকে তাকিয়ে) এতে লেখকের চেয়ে এই দৈনিকটির অবদানই প্রবল।
অবশ্য আনিসুল হক মহোদয় পা গলে মাঝে-মাঝে যে আবার ফুটফুটে বাচ্চা প্রসব হয় আ মীন চমৎকার লেখা বেরিয়ে আসে তার একটা উদাহরণ, "ফেসবুকের ছায়াবন্ধু..."। [১]
এমনিতে আনিসুল হক কেমন করে 'কু-ঘুটা' দেন এর উদাহরণের অভাব কী [২]! এই নিয়ে সু-লেখক হিমুর চমৎকার একটা লেখা আছে:
"...আনিসুল ভাইয়ার বিজ্ঞাপনগুলি নীরব ঘাতক। রিলায়েন্স গ্রুপ স্পনসর্ড সিনেমায় দেখেছিলাম, নায়িকা রিলায়েন্সের নেট কানেকশন ব্যবহার করে নেটে ঢোকে, নায়ককে রিলায়েন্সের ফোন দিয়ে এসেমেস করে, রিলায়েন্সের জ্যুস-দুধ-তরকারি খায়। আমার মতো বদ লোকজন সেগুলির নিন্দেমন্দ করে আর কি।
দাঁড়া আমিও একটা পেমের বই লিখে পেত্যেক পোস্টে বিজ্ঞাপোন্দিবো আনিসুল ভাইয়ার স্টাইলে। আমার গল্পে নায়িকা আমার বই পড়বে। নায়ক আমার বই টেবিলের পায়ার নিচে দিয়ে টেবিল উঁচু করবে। খলনায়িকা আমার বই দিয়ে লজ্জা ঢাকবে। খলনায়ক আমার বই কেড়ে নিয়ে খলনায়িকাকে লজ্জায় ফেলবে। নায়কের বাবা নায়কের ছোটো ভাইকে আমার বই দিয়ে পিটাবে। নায়িকার ছোটো বোন বইমেলায় গিয়ে আমার বই কিনে দিতে বলবে বয়ফ্রেণ্ডকে। আইতাছি খাড়া..." [৩](http://www.sachalayatan.com/himu/42941)
বেশ, কিন্তু আমরা যারা সাধারণ মানুষ যাদের হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে জাঁক করে বলার মত কোনো স্মৃতি নাই আমাদের উপায় কী! এই বিষয়ে ফেসবুকে চমৎকার এক নোট লিখেছেন আরিফ জেবতিক:
"প্রভু বললেন, ''হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে ব্যক্তিগত স্মৃতি লেখার ধুম পড়েছে। স্যার আমার পিঠে হাত বুলায়া কইলেন...স্যার আমারে ডেকে নিয়া বললেন..স্যার খবর পাঠিয়ে জানালেন..ডাকপিয়ন স্যারের পাঠানো গিফট নিয়া আইল..হুমায়ূন আহমেদ মাঝরাতে ফোন করে জিজ্ঞেস করলেন...কত তামাশা! তোমার সঙ্গে হুমায়ূন আহমেদের স্মৃতি নেই?'
আমি বললাম, ' আছে তো! হাজার হাজার স্মৃতি। ঐ যে একবার ঝুম বৃষ্টি এলো, আমরা সবাই ক্লাস থেকে বেরিয়ে বৃষ্টিতে ভিজলাম; তারপর এক পূর্ণিমা রাতে আমরা ষোলজন একটা বাসের ছাদে চড়ে সিলেট থেকে শ্রীমঙ্গল গেলাম চাঁদ দেখতে দেখতে, ঐ যে একমুঠো আঁকাশ দেখার আমন্ত্রন জানিয়ে চিঠি লেখলাম মায়াবতী মেয়েটিকে...সবখানেই তো হুমায়ূন আমাদের সঙ্গেই ছিলেন। যারা মিডিয়ায় হুমায়ূন বন্দনা করছে তাঁরা সিজনাল-কিছু না কিছু লিখবেই। অথচ হুমায়ূন তাঁদের ছিলেন না, হুমায়ূন ছিলেন লাইনে দাঁড়িয়ে বই কেনা পাগল তরুণ তরুণীদের। হুমায়ূন বুদ্ধিজীবিদের জন্য ছিলেন পত্রিকার পাতায়, আমাদের জন্য ছিলেন নিশিজাগা রাতের দীর্ঘশ্বাসে'।" (http://www.facebook.com/jebtik)
যাই হোক, এবার আসি আমাদের মিডিয়ার কথায়। মিডিয়ার উত্থান কথাটা ঠিক হলো না। মিডিয়ার উত্থান তো হয়েই আছে, সময়ে সময়ে ইয়ের মত কেবল উত্থিত হয়। যে হারে ব্যবসায়িরা ইলেকট্রনিক মিডিয়ার প্রসার ঘটাচ্ছেন সেইদিন আর দূরে নাই যখন একজন কবরে শুয়েও শান্তি পাবেন না। এখন তো মিডিয়ার লোকজনেরা কোনো মৃত মানুষের স্বজনের মুখে 'বুম' ধরছেন, 'আপনার এখুন কেমুন লাগিতেছে'? আমি নিশ্চিত, এরা তখন কবর খুঁড়ে মৃতব্যক্তির মুখে বুম ধরে বলবেন, 'আপুনি এখুন কেমুন বোধ করিতেছেন'?
আমরা দেশবাসির অনেকের হয়তো এটা জানার আগ্রহ ছিল, হুমায়ূন আহমেদকে কোথায় সমাহিত করা হবে কিন্তু এই চুতিয়া মিডিয়ার কাছে কে জানতে চাইল এখনই নুহাশ পল্লীর গতি কী হবে! এরা শাওন এবং শিলাদের কাছে এটা এখনই জানতে চাইলেন কেন? এটা কি পরে হলে আসমান দু-হাত নিচে নেমে আসত! কে এইসব চুতিয়াদের এই ক্ষমতা দিয়েছে?
হুমায়ূন আহমেদের প্রস্থান নিয়ে কতশত ছবি ছাপা হয়েছে কিন্তু অসাধারণ এক ছবি সম্ভবত এটাই। কী হাহাকার করা এক ছবি! পরিমিতি বোধের চমৎকার এক উদাহরণও। ধন্যবাদ প্রথম আলো!
ছবি সূত্র: প্রথম আলো, ২৪ জুলাই, ২০১২ |
হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে অন্য এক লেখা লিখেছেন রাসেল পারভেজ:
"...হয়তো পরবর্তী একটা প্রজন্ম তার ভাষারীতির আচ্ছন্নতা থেকে বের হয়ে ভিন্ন ধারার সাহিত্য রচনায় ব্রতী হবেন, উপন্যাসের প্রকাশক্ষমতা ও সম্ভাবনাকে হত্যা করে ফেলেছিলেন তিনি তার যাদুকরী ক্ষমতায়- তার মৃত্যু একদিক থেকে ভাবলে বাংলা উপন্যাসের একধরনের মুক্তির সংবাদও বটে"। [৪]
...
ছবি ঋণ: প্রথম আলো, ২৮ জুলাই, ২০১২ |
একজন সেলিব্রেটির কাছের লোকজনের এই প্রাইভেসিটুকুও নাই যে এরা একান্তে খানিকটা কেঁদে বুক হালকা করতে পারেন! এরা কেমন করে কান্না করেন এটাও আমাদের দেখার বিষয়- বানর নাচ! হুমায়ূন আহমেদের স্বজনরা জুতা পায়ে দেন না নাকি! একটা মানুষের পায়েও জুতা ছিল না ছুঁড়ে মারার জন্য?
সহায়ক সূত্র:
০. মিলন, একজন ঢোলবাজ: http://www.ali-mahmed.com/2010/01/blog-post_29.html
১. ফেসবুকের ছায়াবন্ধু... : http://www.prothom-alo.com/detail/date/2012-08-07/news/279806
২. একজন আদর্শ সাহিত্যিক: http://www.ali-mahmed.com/2010/02/blog-post_07.html
৩. পত্রিকার দৈনিক দৈন্য...: http://www.sachalayatan.com/himu/42941
৪. পাঁড় পাঠকের হুমায়ূন-ব্যবচ্ছেদ: http://www.unmochon.com/2012/07/23/11986.html
8 comments:
শুভ ভাই কুতয়া শব্দের কুনু অর্থ আছে আমি শিউর
পোষ্টে হুমায়ুন স্যারের অসন্মান করেছেন।
লেখাটা যে আপনি মনোযোগ দিয়ে পড়েননি এটা জানার জন্য রকেটবিজ্ঞানী হওয়ার প্রয়োজন পড়ে না! আপনার পড়াটা আপনাকেই পড়তে হবে, কেউ-অন্য পড়ে দেবে না...! @Anonymous
কেউ-অন্য=অন্য কেউ
(অনেকদিন পর আপনার ব্লগে আসলাম)
আপনি আমার ওয়ার্ড প্রেস ব্লগে আখাঊড়া নিয়ে কমেন্ট করেছিলেন। ধন্যবাদ আলী মাহমেদ ভাই, সালাম। আপনার এই কমেন্ট দেখে আপনার জন্য একটা নুতন রেসিপি লিখে ফেললাম। আশা করি দেখে আসবেন। আখাউড়া নিয়ে আমার আরো কথা আছে, আমি লিখতে চাই। কিন্তু সাহসে কুলায় না। হা হা হা…
http://wp.me/p1KRVz-nP
আশা করি দেখে আসবেন। শুভেচ্ছা থাকল।
ফিরে আসব সময় নিয়ে।
আপনার লেখাটা পড়লাম। শুকরিয়া @shahadatudraji
আপনার সাইটে প্রায় সময় ঘুরান দিয়ে যাই নতুন কিছু আছে কিনা দেখার জন্য।একটা মজার ব্যাপার হচ্ছে,এই লেখাটা এই নিয়ে মোটামুটি পাঁচ কি ছয়বার পড়লাম।প্রায় প্রতিবারই লেখার মধ্যে নতুন কিছু লাইন পাচ্ছি।মানে হচ্ছে ঘটনাপ্রবাহের সাথে সাথে লেখাটাও এডিট করছেন।পড়ে বেশ ভাল লাগছে সেই সাথে ঢোলবাজদের কাজ কর্মে বিরক্ত হচ্ছি।
হুঁ
এবার অন্য প্রসঙ্গ:
হুমায়ূন আহমেদকে 'ড্রাগ ডিলার' বলায় কেউ-কেউ আমার উপর ক্ষুব্ধ হয়েছেন। এঁরা সম্ভবত লেখার সুরটা ধরতে পারেননি। এখানে বিব্রত হব ভেবে অনেকে কষ্ট করে আলাদা করে মেইলও করেছেন।
মন-টন ভাল না। বহুব্রীহি, আজ রবিবার দেখছিলাম। আমি বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ করলাম, আমার সন্তানেরা যেমন হা হা করে হাসছে, এদের সঙ্গে আমিও! এই যে দুই প্রজন্মকে ধরে রাখার ক্ষমতা, এ এক অভাবনীয়! এই নেশার ঘোরে রাখা কেবল একজন ড্রাগ ডিলারের পক্ষেই সম্ভব। ব্লগভুবনের ভাষায় "একটা বস পাব্লিক" :D ! @আবদুল্লাহ আল ইমরান
Post a Comment