আজকের অতিথি লেখক, আবদুল্লাহ-আল-ইমরান (http://www.facebook.com/netpoke)। মানুষটার দেখি কিছুই চোখ এড়ায় না- 'ঈগলচক্ষু! তিনি লিখছেন:
"১৯৯৬ সালে নিখোঁজ হন পাহাড়ি নারীদের নেত্রী কল্পনা চাকমা। পাহাড়িদের দাবি, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী অপহরণ করেছে তাঁকে। আর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দাবি তিনি ভারত চলে গেছেন। গত কিছুদিন যাবত আবারও পত্রিকার পাতায় খবর হয়ে এসেছেন এই নারী। তাঁর ব্যাপারে দেওয়া তদন্ত প্রতিবেদন নিয়ে নানা অভিযোগ পাহাড়িদের। কিন্তু সত্য ঘটনা হচ্ছে, তিনি আসলে এক নভোযান দুর্ঘটনায় মারা গেছেন। ২০০৩ সালে নভোযান কলম্বিয়া বিধ্বস্ত হওয়ার সময় বাকি ছয়জনের সাথে তিনিও নিহত হন!
ছবিটা মনোযোগ দিয়ে দেখলে এর সুরাহা পাওয়া যাবে। সুত্রঃ ১লা ফেব্রুয়ারি,পৃষ্ঠা-১০, প্রথম আলো।
(বিঃদ্রঃ একজন নিখোঁজ মানুষকে নিয়ে এমন রসিকতা করার ইচ্ছা আমার ছিল না। কিন্তু গত শুক্রবার এটা ছাপা হওয়ার পরও যখন এই ব্যাপারে উক্ত পত্রিকার কোনো সংশোধনী আসেনি যখন তখন কল্পনা চাওলাকে কল্পনা চাকমা হিসেবেই ধরে নিতেই আমরা বাধ্য হবো!)
...
অন্য প্রসঙ্গ। একটি সংবাদের প্রস্তুতপ্রণালীঃ
২০০৬ সালের মাঝামাঝি রৌদ্রজ্জ্বল এক সকাল। আর অন্য সব দিনের মত সেদিনও আমি স্কুলে গিয়েছি। ক্লাসে ব্যাগ রেখে স্কুলের খেলার মাঠে নামার কিছুক্ষণ পরেই দেখি ক্যামেরা গলায় ঝোলানো, চোখে কালো চশমা, পুরু গোঁফওয়ালা মধ্যবয়স্ক একজন ভদ্রলোক ঘুরে বেড়াচ্ছেন। মানুষটাকে কেমন যেন চেনা মনে হচ্ছিল। একটু কাছে যেতেই দেখি প্রথম আলোর এক সাংবাদিক (তার পরদিনই জানলাম এই ভদ্রলোকের নাম মাসুদ মিলাদ)।
পরপর দুই বছর প্রথম আলো-এইচএসবিসি জাতীয় ভাষা প্রতিযোগে অংশগ্রহণের সুবাদে এই ভদ্রলোককে আমি চিনি। কখনো-সখনো মোটর বাইকে করে নগরীর মাঝেও ছুটতে দেখেছি।
নিজেই আগ বাড়িয়ে কাছে গিয়ে কথা শুরু করি:
'আঙ্কেল, কেমন আছেন'?
(তিনি একটু ইতস্তত করে) 'হ্যাঁ,ভালোই। তুমি কে? তোমাকে ঠিক চিনলাম না'।
তাকে চেনার বৃত্তান্তটা জানালাম। শুনে ঠোঁটের কোণায় খানিক হাসি ফুটে উঠলো। কিছুক্ষণের মধ্যে ক্লাস ফাইভ-সিক্সের কিছু ছোটভাইও এসে যোগ দিল। স্কুলে আসার কারণ জিজ্ঞেস করতেই জানালেন, কিছুদিন যাবত চলা পানি আর টয়লেট সমস্যা নিয়ে রিপোর্ট করতেই তিনি স্কুলে এসেছেন। এরমধ্যে আমাকে বললেন, চল তো তোমাদের ক্লাসরুমটা দেখে আসি। ততক্ষণে তিনি ক্লাসের উদ্দেশ্যে হাঁটা দিয়েছেন। আমিও সঙ্গ দিলাম। তখন ক্লাসে টেবিলের উপর বসে আমার বন্ধু-ক্লাসমেটরা বসে আড্ডা দিচ্ছিল। এর মধ্যে ড্রেস ছাড়া একজন ছিল যে আমাদের স্কুলে পড়ে না। ও আমাদের বন্ধুদের বন্ধু (এর ব্যাপারে আরও কিছু কথা কিছুক্ষণ পরে আবার বলছি)।
'তোমাদের ক্লাস কেমন চলছে', জিজ্ঞেস করেই সাংবাদিক মহোদয় বললেন, 'দেখি তোমাদের ক্লাসের কয়েকটা ছবি তুলি'।
আমার সরলমনা বন্ধু-ক্লাসমেটরা হাসিমুখে নিজ অবস্থান থেকে পোজ দিল। ছবি তুলে মাসুদ মিলাদ আমাদের কাছ থেকে বিদায় নিলেন।
পরদিন স্কুলে এসেই দেখি বন্ধুরা খুব উত্তেজিত। কারণ জিজ্ঞেস করতেই জানলাম, আজকের প্রথম আলোতে নাকি আমাদের স্কুল নিয়ে বেশ আপত্তিজনক একটা প্রতিবেদন ছাপানো হয়েছে। এক বন্ধুর কাছ থেকে পেপার নিয়েই দেখলাম একেবারে শেষ পাতায় তিন কলামে একটা ছবি সহ প্রতিবেদন। প্রতিবেদনের শিরোনাম, ‘চট্টগ্রাম মুসলিম হাইস্কুলে ক্লাসে পাঠদান করে শিবিরকর্মীরা’ (শিরোনামটা ঠিক এরকমই বা কাছাকাছি কিছু একটা ছিল)।
প্রতিবেদনে যা লেখা ছিল তার সারমর্ম এরকম: আমাদের স্কুলে শিবিরের ছেলেরা ক্লাস শুরু হওয়ার আগে শিক্ষকদের ডায়াসে দাঁড়িয়ে দাওয়াতি কার্যক্রম চালায় এবং শিক্ষকদের এই ব্যাপারে মৌন সম্মতি আছে। ছবিটা আমাদের ক্লাসের যে ছবি তোলা হয়েছিল ঠিক সেটাই। ক্লাসে ছাত্ররা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে দাঁড়ানো। একটা টেবিলে সেই বহিরাগত ছেলেটা সাথে আমার বন্ধুরা। ছেলেটার মুখের উপর লাল বৃত্ত আর ছবিতে ক্যাপশন-এই ছেলেটাই শিবির কর্মী যে কিনা ক্লাসে শিবিরে যোগদান করতে উদ্বুদ্ধ করে!
পুরো খবরটা পড়ে আমার মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ল। কেউ যেন প্রথম আলোর প্রতি আমার বিশ্বাস-আস্থার জায়গাটায় ক্রমাগত ছুঁরি চালাচ্ছে। সেদিন কেমন লাগছিল আমি ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না। এমন নির্জলা মিথ্যা প্রথম আলো কিভাবে ছাপল আমি ভেবে পাচ্ছিলাম না। স্কুলের তরফ থেকে পরদিন এই ঘটনা নিয়ে প্রথম আলোতে প্রতিবাদলিপি পাঠানো হলেও প্রথম আলো কর্তৃপক্ষ সম্ভবত তা ছাপানোর প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেননি। বা ছাপাতে চাননি!
পূর্বকথাঃ
স্কুলের পোশাক সাদা শার্ট-সাদা প্যান্ট সেই সাথে সাদা টুপি। স্কুলের নামটাও সরকারি মুসলিম উচ্চ বিদ্যালয়। নাম থেকেই বোঝা যাচ্ছে এই স্কুলে শুধুমাত্র ইসলাম ধর্মাবলম্বিরাই পড়তে পারে। হাজি মুহাম্মদ মহসিনের ইচ্ছা এরকমই ছিল। স্বভাবতই শিবির এইসব সুযোগ নিজেদের অনুকূলে ব্যবহারের চেষ্টা করছিল। স্কুলে ক্লাস শুরু হওয়ার আগে ছেলেদের দলে টানার চেষ্টা করতো তারা। তবে সেটা অবশ্যই স্কুল কম্পাউন্ডের বাইরে এবং স্কুলে ঢুকলেও শিবির নামে নয় বরং ‘ফুলকুঁড়ি’ কিংবা ‘অঙ্কুর’ নামের সমমনা সংগঠনের প্যাড ব্যবহার করতো। সেটাও ক্লাস রুমের বাইরে। সর্বোচ্চ চেষ্টা সত্ত্বেও তারা ৭০ জন ছেলের মধ্যে ১০ জনকেও শিবিরে রিক্রুট করতে পেরেছিল কিনা তাতে আমি ঘোর সন্দিহান। অধিকাংশ ছাত্রই ছিল শিবির বিরোধী।
আগেই উল্লেখ করেছি, সেদিন ঘটনাস্থলে আরেকটা ছেলেও ছিল। তার নামটা আমি ঠিক জানিনা। বাসা স্কুলের কাছেই কোথাও ছিল। আমাদের স্কুলে ফেল করেছিল বিধায় চিটাগং মিউনিসিপ্যাল মডেল স্কুল নামে কাছের অন্য এক স্কুলে ভর্তি হয়েছিল (ওই স্কুলে বালতিতে করে টিফিন দেওয়া হত বলে এর আরেক নাম ছিল বালতি স্কুল)। এই ছেলে সরাসরি ভাবেই ছাত্রলীগের সঙ্গে জড়িত ছিল এবং সেইদিন তার সাথে আমাদের স্কুলের প্রাক্তন বড়ভাইও এসেছিলেন যিনি ছিলেন স্থানীয় ছাত্রলীগ নেতা। আমি নিজে সাংবাদিক মাসুদ মিলাদ সহ এই দুই ছাত্রলীগারকে এবং আমাদের স্কুলের ছাত্রলীগ কমিটির সভাপতিকে দাঁড়িয়ে আলাপ করতে দেখেছি। এবার কিছু ব্যাপার পরিস্কার করে দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছি:
১. পুরো চিটাগং শহর জুড়ে প্রায় সব স্কুলেই শিবিরের কার্যক্রম আছে সেটা গোপন হোক বা প্রকাশ্য হোক। এই কথা কলেজিয়েট স্কুলের জন্য যেমন প্রযোজ্য তেমনি কোনো অফিসিয়াল কলোনির ভেতর থাকা স্কুলের জন্যও প্রযোজ্য। আমাদের স্কুলেও আধিপত্য বিস্তার নিয়ে ছাত্রলীগ-শিবিরের মধ্যে বেশ একটা ঠান্ডা যুদ্ধ চলছিল। ভিত শক্ত করার জন্য ছাত্রলীগ কাউন্সিলের মাধ্যমে স্কুলে একটা ছাত্রলীগের কমিটিও তৈরি করে দেয়! শিবির তখন ক্ষমতায় বিধায় ছাত্রলীগ বিশেষ সুবিধা করতে পারছিল ফলে আমার ধারণা, ছাত্রলীগ উপায় না-দেখে এই রিপোর্ট ছাপানোর ব্যবস্থা করেছিল। আরেকটা ব্যাপারও হতে পারে। সেই সময়টাতে মৌলবাদ বিরোধিতার বেশ ভালো একটা জোয়ার উঠেছিল। হয়তো এই রিপোর্ট ছাপানোর মাধ্যমে প্রথম আলো তাদের নিজস্ব অবস্থান আরেকটু শক্ত করেছিল।
২. আমাদের স্কুলের প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই একটা ধারা চলে আসছিল যে, মহিলা শিক্ষক নিয়োগ না-দেওয়া যা অনেকটা অলিখিত নিয়ম কিংবা ঐতিহ্য হয়ে দাঁড়িয়েছিল। অথচ প্রথম আলোর সেই প্রতিবেদনে এই ব্যাপারটাকে এভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছিল যে স্কুলে জামাত লবি শক্তিশালী হওয়ার কারণে কোন মহিলা শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয় না। অবশ্য শেষমেশ প্রথম আলোর ইচ্ছারই জয় হয়েছে। ২০০৯ সালে দীর্ঘ ১০০ বছরের ট্র্যাডিশন ভেঙ্গে বেশ কয়েকজন মহিলা শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয় এবং সম্প্রতি এদের একজনের বেধড়ক মারের শিকার হয়ে আমার স্কুলের ছোট ভাইদের রাস্তা অবরোধেও নামতে হয়েছিল। সে ভিন্ন প্রসঙ্গ।
শেষ কথা:
ছয় বছর আগে ঘটা এই ঘটনা আমার মনে এখনও স্পষ্টভাবে দাগ কেটে আছে এবং আমার ধারণা, আমি যতদিন সুস্থ থাকবো ততদিন এই ঘটনা আমি ভুলতে পারবো না। এতদিন এই ঘটনা খণ্ড-খণ্ড ভাবে নানাজনের সঙ্গে শেয়ার করলেও এবারই পুরো ঘটনার সবটুকু লিখলাম। কারণ এই বছর প্রথম আলো তাদের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর সংখ্যায় সংবাদের পেছনের ঘটনা তুলে ধরেছে। আমিও তাই একটা খবরের পেছনের খবর তুলে ধরলাম। তবে আমার জোর বিশ্বাস, আমি একদিন প্রথম আলোর মতিউর রহমান, আবুল মোমেন এবং মাসুদ মিলাদের কাছে এই মিথ্যা প্রতিবেদনের ব্যাখ্যা চাইব। জানতে চাইব একদল সরলমনা কিশোরকে প্রতারিত করে তারা কিভাবে লাভবান হয়েছিলেন?"
প্রথম আলো: http://tinyurl.com/3yadh4k
ছবি সূত্র: প্রথম আলো, ০১.০২.২০১৩ |
"১৯৯৬ সালে নিখোঁজ হন পাহাড়ি নারীদের নেত্রী কল্পনা চাকমা। পাহাড়িদের দাবি, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী অপহরণ করেছে তাঁকে। আর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দাবি তিনি ভারত চলে গেছেন। গত কিছুদিন যাবত আবারও পত্রিকার পাতায় খবর হয়ে এসেছেন এই নারী। তাঁর ব্যাপারে দেওয়া তদন্ত প্রতিবেদন নিয়ে নানা অভিযোগ পাহাড়িদের। কিন্তু সত্য ঘটনা হচ্ছে, তিনি আসলে এক নভোযান দুর্ঘটনায় মারা গেছেন। ২০০৩ সালে নভোযান কলম্বিয়া বিধ্বস্ত হওয়ার সময় বাকি ছয়জনের সাথে তিনিও নিহত হন!
ছবিটা মনোযোগ দিয়ে দেখলে এর সুরাহা পাওয়া যাবে। সুত্রঃ ১লা ফেব্রুয়ারি,পৃষ্ঠা-১০, প্রথম আলো।
(বিঃদ্রঃ একজন নিখোঁজ মানুষকে নিয়ে এমন রসিকতা করার ইচ্ছা আমার ছিল না। কিন্তু গত শুক্রবার এটা ছাপা হওয়ার পরও যখন এই ব্যাপারে উক্ত পত্রিকার কোনো সংশোধনী আসেনি যখন তখন কল্পনা চাওলাকে কল্পনা চাকমা হিসেবেই ধরে নিতেই আমরা বাধ্য হবো!)
...
অন্য প্রসঙ্গ। একটি সংবাদের প্রস্তুতপ্রণালীঃ
২০০৬ সালের মাঝামাঝি রৌদ্রজ্জ্বল এক সকাল। আর অন্য সব দিনের মত সেদিনও আমি স্কুলে গিয়েছি। ক্লাসে ব্যাগ রেখে স্কুলের খেলার মাঠে নামার কিছুক্ষণ পরেই দেখি ক্যামেরা গলায় ঝোলানো, চোখে কালো চশমা, পুরু গোঁফওয়ালা মধ্যবয়স্ক একজন ভদ্রলোক ঘুরে বেড়াচ্ছেন। মানুষটাকে কেমন যেন চেনা মনে হচ্ছিল। একটু কাছে যেতেই দেখি প্রথম আলোর এক সাংবাদিক (তার পরদিনই জানলাম এই ভদ্রলোকের নাম মাসুদ মিলাদ)।
পরপর দুই বছর প্রথম আলো-এইচএসবিসি জাতীয় ভাষা প্রতিযোগে অংশগ্রহণের সুবাদে এই ভদ্রলোককে আমি চিনি। কখনো-সখনো মোটর বাইকে করে নগরীর মাঝেও ছুটতে দেখেছি।
নিজেই আগ বাড়িয়ে কাছে গিয়ে কথা শুরু করি:
'আঙ্কেল, কেমন আছেন'?
(তিনি একটু ইতস্তত করে) 'হ্যাঁ,ভালোই। তুমি কে? তোমাকে ঠিক চিনলাম না'।
তাকে চেনার বৃত্তান্তটা জানালাম। শুনে ঠোঁটের কোণায় খানিক হাসি ফুটে উঠলো। কিছুক্ষণের মধ্যে ক্লাস ফাইভ-সিক্সের কিছু ছোটভাইও এসে যোগ দিল। স্কুলে আসার কারণ জিজ্ঞেস করতেই জানালেন, কিছুদিন যাবত চলা পানি আর টয়লেট সমস্যা নিয়ে রিপোর্ট করতেই তিনি স্কুলে এসেছেন। এরমধ্যে আমাকে বললেন, চল তো তোমাদের ক্লাসরুমটা দেখে আসি। ততক্ষণে তিনি ক্লাসের উদ্দেশ্যে হাঁটা দিয়েছেন। আমিও সঙ্গ দিলাম। তখন ক্লাসে টেবিলের উপর বসে আমার বন্ধু-ক্লাসমেটরা বসে আড্ডা দিচ্ছিল। এর মধ্যে ড্রেস ছাড়া একজন ছিল যে আমাদের স্কুলে পড়ে না। ও আমাদের বন্ধুদের বন্ধু (এর ব্যাপারে আরও কিছু কথা কিছুক্ষণ পরে আবার বলছি)।
'তোমাদের ক্লাস কেমন চলছে', জিজ্ঞেস করেই সাংবাদিক মহোদয় বললেন, 'দেখি তোমাদের ক্লাসের কয়েকটা ছবি তুলি'।
আমার সরলমনা বন্ধু-ক্লাসমেটরা হাসিমুখে নিজ অবস্থান থেকে পোজ দিল। ছবি তুলে মাসুদ মিলাদ আমাদের কাছ থেকে বিদায় নিলেন।
পরদিন স্কুলে এসেই দেখি বন্ধুরা খুব উত্তেজিত। কারণ জিজ্ঞেস করতেই জানলাম, আজকের প্রথম আলোতে নাকি আমাদের স্কুল নিয়ে বেশ আপত্তিজনক একটা প্রতিবেদন ছাপানো হয়েছে। এক বন্ধুর কাছ থেকে পেপার নিয়েই দেখলাম একেবারে শেষ পাতায় তিন কলামে একটা ছবি সহ প্রতিবেদন। প্রতিবেদনের শিরোনাম, ‘চট্টগ্রাম মুসলিম হাইস্কুলে ক্লাসে পাঠদান করে শিবিরকর্মীরা’ (শিরোনামটা ঠিক এরকমই বা কাছাকাছি কিছু একটা ছিল)।
প্রতিবেদনে যা লেখা ছিল তার সারমর্ম এরকম: আমাদের স্কুলে শিবিরের ছেলেরা ক্লাস শুরু হওয়ার আগে শিক্ষকদের ডায়াসে দাঁড়িয়ে দাওয়াতি কার্যক্রম চালায় এবং শিক্ষকদের এই ব্যাপারে মৌন সম্মতি আছে। ছবিটা আমাদের ক্লাসের যে ছবি তোলা হয়েছিল ঠিক সেটাই। ক্লাসে ছাত্ররা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে দাঁড়ানো। একটা টেবিলে সেই বহিরাগত ছেলেটা সাথে আমার বন্ধুরা। ছেলেটার মুখের উপর লাল বৃত্ত আর ছবিতে ক্যাপশন-এই ছেলেটাই শিবির কর্মী যে কিনা ক্লাসে শিবিরে যোগদান করতে উদ্বুদ্ধ করে!
পুরো খবরটা পড়ে আমার মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ল। কেউ যেন প্রথম আলোর প্রতি আমার বিশ্বাস-আস্থার জায়গাটায় ক্রমাগত ছুঁরি চালাচ্ছে। সেদিন কেমন লাগছিল আমি ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না। এমন নির্জলা মিথ্যা প্রথম আলো কিভাবে ছাপল আমি ভেবে পাচ্ছিলাম না। স্কুলের তরফ থেকে পরদিন এই ঘটনা নিয়ে প্রথম আলোতে প্রতিবাদলিপি পাঠানো হলেও প্রথম আলো কর্তৃপক্ষ সম্ভবত তা ছাপানোর প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেননি। বা ছাপাতে চাননি!
পূর্বকথাঃ
স্কুলের পোশাক সাদা শার্ট-সাদা প্যান্ট সেই সাথে সাদা টুপি। স্কুলের নামটাও সরকারি মুসলিম উচ্চ বিদ্যালয়। নাম থেকেই বোঝা যাচ্ছে এই স্কুলে শুধুমাত্র ইসলাম ধর্মাবলম্বিরাই পড়তে পারে। হাজি মুহাম্মদ মহসিনের ইচ্ছা এরকমই ছিল। স্বভাবতই শিবির এইসব সুযোগ নিজেদের অনুকূলে ব্যবহারের চেষ্টা করছিল। স্কুলে ক্লাস শুরু হওয়ার আগে ছেলেদের দলে টানার চেষ্টা করতো তারা। তবে সেটা অবশ্যই স্কুল কম্পাউন্ডের বাইরে এবং স্কুলে ঢুকলেও শিবির নামে নয় বরং ‘ফুলকুঁড়ি’ কিংবা ‘অঙ্কুর’ নামের সমমনা সংগঠনের প্যাড ব্যবহার করতো। সেটাও ক্লাস রুমের বাইরে। সর্বোচ্চ চেষ্টা সত্ত্বেও তারা ৭০ জন ছেলের মধ্যে ১০ জনকেও শিবিরে রিক্রুট করতে পেরেছিল কিনা তাতে আমি ঘোর সন্দিহান। অধিকাংশ ছাত্রই ছিল শিবির বিরোধী।
আগেই উল্লেখ করেছি, সেদিন ঘটনাস্থলে আরেকটা ছেলেও ছিল। তার নামটা আমি ঠিক জানিনা। বাসা স্কুলের কাছেই কোথাও ছিল। আমাদের স্কুলে ফেল করেছিল বিধায় চিটাগং মিউনিসিপ্যাল মডেল স্কুল নামে কাছের অন্য এক স্কুলে ভর্তি হয়েছিল (ওই স্কুলে বালতিতে করে টিফিন দেওয়া হত বলে এর আরেক নাম ছিল বালতি স্কুল)। এই ছেলে সরাসরি ভাবেই ছাত্রলীগের সঙ্গে জড়িত ছিল এবং সেইদিন তার সাথে আমাদের স্কুলের প্রাক্তন বড়ভাইও এসেছিলেন যিনি ছিলেন স্থানীয় ছাত্রলীগ নেতা। আমি নিজে সাংবাদিক মাসুদ মিলাদ সহ এই দুই ছাত্রলীগারকে এবং আমাদের স্কুলের ছাত্রলীগ কমিটির সভাপতিকে দাঁড়িয়ে আলাপ করতে দেখেছি। এবার কিছু ব্যাপার পরিস্কার করে দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছি:
১. পুরো চিটাগং শহর জুড়ে প্রায় সব স্কুলেই শিবিরের কার্যক্রম আছে সেটা গোপন হোক বা প্রকাশ্য হোক। এই কথা কলেজিয়েট স্কুলের জন্য যেমন প্রযোজ্য তেমনি কোনো অফিসিয়াল কলোনির ভেতর থাকা স্কুলের জন্যও প্রযোজ্য। আমাদের স্কুলেও আধিপত্য বিস্তার নিয়ে ছাত্রলীগ-শিবিরের মধ্যে বেশ একটা ঠান্ডা যুদ্ধ চলছিল। ভিত শক্ত করার জন্য ছাত্রলীগ কাউন্সিলের মাধ্যমে স্কুলে একটা ছাত্রলীগের কমিটিও তৈরি করে দেয়! শিবির তখন ক্ষমতায় বিধায় ছাত্রলীগ বিশেষ সুবিধা করতে পারছিল ফলে আমার ধারণা, ছাত্রলীগ উপায় না-দেখে এই রিপোর্ট ছাপানোর ব্যবস্থা করেছিল। আরেকটা ব্যাপারও হতে পারে। সেই সময়টাতে মৌলবাদ বিরোধিতার বেশ ভালো একটা জোয়ার উঠেছিল। হয়তো এই রিপোর্ট ছাপানোর মাধ্যমে প্রথম আলো তাদের নিজস্ব অবস্থান আরেকটু শক্ত করেছিল।
২. আমাদের স্কুলের প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই একটা ধারা চলে আসছিল যে, মহিলা শিক্ষক নিয়োগ না-দেওয়া যা অনেকটা অলিখিত নিয়ম কিংবা ঐতিহ্য হয়ে দাঁড়িয়েছিল। অথচ প্রথম আলোর সেই প্রতিবেদনে এই ব্যাপারটাকে এভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছিল যে স্কুলে জামাত লবি শক্তিশালী হওয়ার কারণে কোন মহিলা শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয় না। অবশ্য শেষমেশ প্রথম আলোর ইচ্ছারই জয় হয়েছে। ২০০৯ সালে দীর্ঘ ১০০ বছরের ট্র্যাডিশন ভেঙ্গে বেশ কয়েকজন মহিলা শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয় এবং সম্প্রতি এদের একজনের বেধড়ক মারের শিকার হয়ে আমার স্কুলের ছোট ভাইদের রাস্তা অবরোধেও নামতে হয়েছিল। সে ভিন্ন প্রসঙ্গ।
শেষ কথা:
ছয় বছর আগে ঘটা এই ঘটনা আমার মনে এখনও স্পষ্টভাবে দাগ কেটে আছে এবং আমার ধারণা, আমি যতদিন সুস্থ থাকবো ততদিন এই ঘটনা আমি ভুলতে পারবো না। এতদিন এই ঘটনা খণ্ড-খণ্ড ভাবে নানাজনের সঙ্গে শেয়ার করলেও এবারই পুরো ঘটনার সবটুকু লিখলাম। কারণ এই বছর প্রথম আলো তাদের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর সংখ্যায় সংবাদের পেছনের ঘটনা তুলে ধরেছে। আমিও তাই একটা খবরের পেছনের খবর তুলে ধরলাম। তবে আমার জোর বিশ্বাস, আমি একদিন প্রথম আলোর মতিউর রহমান, আবুল মোমেন এবং মাসুদ মিলাদের কাছে এই মিথ্যা প্রতিবেদনের ব্যাখ্যা চাইব। জানতে চাইব একদল সরলমনা কিশোরকে প্রতারিত করে তারা কিভাবে লাভবান হয়েছিলেন?"
প্রথম আলো: http://tinyurl.com/3yadh4k
2 comments:
ভাল লাগল লেখা,আলু পত্রিকা নিয়ে বলার ইচ্ছা নাই এই পত্রিকায় এখন পড়ার কিছু থাকে না।
হাহাহা, আলু পত্রিকা, মতিচুরের লাড্ডু,,,,
Post a Comment