Search

Friday, May 31, 2013

এক নব্য মুক্তিযোদ্ধার সাক্ষাৎকার!

(এটা একটা কাল্পনিক সাক্ষাৎকার। জীবিত দূরের কথা, তোতলা লাশ বা গলিত শবের সঙ্গেও যার মিল খোঁজা বৃথা।)

গেলাম আমি, ওই ...নামধারীর সাক্ষাৎকার নিতে।
সেখানে তখন অন্য একজন একটা কেলাশ নিচ্ছিলেন। 'কমরেডস (গালি), ডান পা তোল (গালি), বাঁ পা তোল (গালি), এবার দু-পা তুলে ফেলো (বাপ-মা তুলে গালি)। আমি কেলাশের নমুনা দেখে যারপর নাই মুগ্ধ। মুখ দিয়ে অজান্তেই বেরিয়ে এলো, 'উই মা'।
লাফাংগা টাইপের ওই পোলাকে আমি বললাম, 'তোমার বাবাকে ডেকে দাও। ওঁর একটা সাক্ষাৎকার নেবো।'
চ্যাংড়া পোলা দুর্দান্ত রাগে লাফিয়ে উঠলো, 'ওই, মুখ সামলাইয়া কথা বইলেন, কারে কি কইতাছেন, আমিই সেই মুক্তিযোদ্ধা।'

আমি তো তো করে বললাম, 'সরি, অ আচ্ছা, আপনিই তাহলে সেই ব্যক্তি, নব্য মুক্তিযোদ্ধা। আমি বুঝতে পারিনি! আসলে আপনার বয়স দেখে ধন্ধে ছিলাম।'
চ্যাংড়া মুক্তিযোদ্ধা, 'বয়স দিয়া কি হইবো, যুদ্ধ করার জন্য বয়স কোনো বিষয় না। যে-কোনো বয়সেই যুদ্ধ করা যায়।'
আমি চোখ কপাল থেকে নামিয়ে বললাম, 'না মানে, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল তো, এটা ২০১৩। আপনার বয়সটা ঠিক মিস খাচ্ছে না।'
চ্যাংড়া মুক্তিযোদ্ধা, 'আরে কী মুসিবত, আপনে আমার বয়সের পেছনে লাগছেন ক্যান? আপনি কি ঘটক পক্ষিভাই? আমার বিবাহের জন্য আসছেন, যে বয়স নিয়া ফালাফালি করতাছেন। শোনেন, আমি ওই সময় 'ছুট্টু' ছিলাম, তাতে কী হইছে! এখন যুদ্ধ মাঠ-ঘাটে হয় না, অনলাইনে হয়।'
এটা বলেই তিনি তার এক চ্যালাকে বললেন, 'অমার পিঠটা চুলকায়া দে।'
চ্যালাকে পিঠ চুলকাতে দেখা গেল না কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে ওই চ্যালা বলে উঠল, 'দেখেন না, ভাইয়ের পায়ের আংঙুলগুলো ক্ষয় হয়ে গেছে। কী-বোর্ডের উপর লাফিয়ে লাফিয়ে এই অবস্থা।'

আমার মাথা ঘুরছিল, 'বলেন কি, কীবোর্ডের উপর লাফিয়ে-লাফিয়ে তিনি অনলাইনে যুদ্ধ করেন?'
নব্য মুক্তিযোদ্ধা বিরক্ত, 'ইয়েস, আপনের কুনু অসুবিধা?'
আমি টলে উঠে বললাম, 'না, মানে দয়া করে বলবেন কি, ঠিক কি ভাবে যুদ্ধটা করেন, মানে আপনার পদ্ধতিটা...।'
নব্য মুক্তিযোদ্ধা বললেন, 'দেখেন, আমার সবচেয়ে বড়ো অস্ত্র হচ্ছে, "ছাগু"। এটা আমার আবিষ্কার, যাকে খুশি তাকে ছাগু বলে শুইয়ে দেই। ছাগু মানে জানেন তো? 'ছালায় গু'।'

আমি খানিক থমকে গেলাম, 'না, ছাগুর এই মানে আমি জানি না তবে ছালা আর বস্তা এক জিনিস বলেই মনে পড়ছে, গুন্টার গ্রাস একবার বলেছিলেন, 'নোবেল হচ্ছে এক বস্তা গু'।'
'গুন্টার গ্রাস, এ আবার কোন গুন্ডা, এ কী আমার দল করে?
'জ্বী না।'
'তাইলে বাদ। কুনু লুক আমার দল না-করলে হে খেলা থিক্যা বাদ।'

আমি এবার বললাম, 'আপনি সব সময় কেবল বিশেষ মানুষকেই নিয়ে লেখেন কিন্ত এ দেশ স্বাধীন করার পেছনে এমন অনেক আগুনপুরুষ আছেন যাদের নিয়ে লিখতে আপনাকে দেখা যায় না, কেন?'
তিনি বললেন, 'আরে, আপনি তো বড়ো যন্ত্রণা করেন! হুনেন, দেশের চাইতে, মানুষের চাইতে দল বড়ো। মানুষ থাকল কি থাকল না এইটা কোনো বিষয় না, দল থাকলেই হইল। তাই আমি একজন 'দলবাজ, ছলবাজ'। এইটা আমার লেখাতেও পাইবেন।'
আমি বললাম, 'এবার অন্য একটা বিষয়, আজ যে আপনার খুবই আপনজন তাকেই কাল আপনি নগ্ন করে দেন, এটা কেন?'
তিনি এবার খেপে গিয়ে বললেন, 'আরে মিয়া দেখেন নাই, আমেরিকা লাদেন সৃষ্টি করে। কিন্তু পুত্র যখন বাপের জুতা পায়ে গলায় তখন তারেই আমেরিকা মাইরা ফালায়। আমিও তাই করি, করছি, হে হে হে...।'

তিনি আর সময় দিতে পারলেন না কারণ তখন জোরেশোরে কেলাশ চলছে, কমরেডস, ডান পা...।

Friday, May 24, 2013

বোতল-ব্যবসা এবং...!

[এই লেখাটা এখানে আগেও পোস্ট করা হয়েছে কিন্তু এর সঙ্গে আরও কিছু বিষয় জুড়ে দিতে হচ্ছে]
আগাম সতর্কতা: (অতি সূক্ষ রুচির লোকজনেরা, রুচিবাগীশ, যারা অল্পতেই  গা দোলান বা মনিটেরের পর্দা নড়লেই যাদের গা গুলায় তারা লেখাটা না-পড়লেই ভাল করবেন।)

পত্রিকার একটা খবর ছিল এমন, "ঢাকায় ৫৫ লক্ষ মানুষের জন্য ৪৫টি পাবলিক টয়লেট"
আমি অংকে বড়ো কাঁচা! তবুও একটা আঁক কষি, আনুমানিক ১ লক্ষ মানুষের জন্য প্রায় ১টা টয়লেট। ঢাকায় আমি যদি মূত্র-বিসর্জনের গোপন ইচ্ছা নিয়ে লাইনে দাঁড়াই তাহলে ক-দিন পর উক্ত কর্ম সম্পাদন করিতে পারিব? যারা অংকে ভাল তারা যদি দয়া করে আমাকে এই হিসাবটা করে দিতেন তাহলে সুবিধে হতো। কারণ ঢাকায় একবার মুত্রবিসর্জন করার জন্য আমাকে ক-দিন ঢাকায় থাকতে হবে সেই মতে আমার গাট্টি-বোঁচকা গোছাতাম আর কী!

ঢাকার মানুষেরা মূত্র বিসর্জন দেন কোথায় এই নিয়ে গভীর চিন্তায় ছিলাম। কিন্তু সৈয়দ আবুল মকসুদের 'নরমূত্র' লেখাটা পড়ে খানিকটা ধারণা হয়েছিল ঢাকার লোকজনেরা কেমন বেতমিজ! উহারা নাকি প্রকাশ্যে রাস্তায় মূত্র বিসর্জন করে। রাম-রাম! ঢাকা শহরের 'লুকজন এতো 'খ্রাপ'! মকসুদ স্যারের শ্বেতশুভ্র বসনে 'নরমুত্র' লেগে গেলে উপায় আছে!
এ অন্যায়-এ অন্যায়! সৈয়দ আবুল মকসুদ স্যারের শ্বেতশুভ্র বসন বাঁচাতে গোটা ঢাকা শহর এই সাইনবোর্ড লাগিয়ে ভাসিয়ে দিতে হবে 'এখানে প্রস্রাব করিবেন না' নইলে যে ঢাকা শহর মূত্রে ভেসে যাবে! চুজ হেলথ অর টব্যাকো- এখন থেকে ঢাকায় ভাসবে হয় এমন সাইনবোর্ড যে 'এখানে মূত্রবিসর্জন করিবেন না'। সোজা কথা, ঢাকা ভাসবে এই সাইনবোর্ডে নইলে মূতে।

যাই হোক, অচিরেই ঢাকার লোকজন যদি বহুতল ভবনের ছাদে উঠে এই কর্ম করা শুরু করে দেন এতে অন্তত আমি অবাক হব না। ঢালিউডের বৃষ্টির একটা গতি হবে বটে কিন্তু মূত্রবৃষ্টিতে ভিজে এই সব দৃশ্য অবলোকন করে সূক্ষরূচির লোকজনের ব্লাডপ্রেসার বেড়ে গেলে এর দায় কার উপর বর্তাবে? নাহ, এ চলতে দেয়া যায় না। এর একটা উপায় বের না-করলে চলছে না আর।

ভাবছি... দেখো দিকি কান্ড, আজকাল আমার মত লোকজনেরা ভাবাও শুরু করে দিয়েছে! আচ্ছা, এই নিয়ে একটা ব্যবসা ফাঁদলে কেমন হয়? আরে না, পাবলিক টয়লেটের ব্যবসা না। লোকজন বেরুবার পর জিজ্ঞেস করতে হবে, ভাইজানের কি বড়োডা, না ছোডোটা? ওই ব্যাটা ফাঁকি দেতে চাইলে এই নিয়ে কিছু কায়দা-কানুন করে তাকে হাতেনাতে ধরতে হবে। ছ্যা-ছ্যাঁ!

চিন্তা করছে, এখন থেকে 'বঙ্গাল'-দের অভ্যাস খানিকটা বদলাবার চেষ্টা করতে হবে। এই যে এক হাতে বা বগলে পানির বোতল, এই 'কলচর'টা আর কদ্দিনের? ক-বছর হলো লোকজনেরা পানির বোতল নিয়ে ঘুরে বেড়ায়? আমরা তো চাপাকলের মুখে মুখ লাগিয়েই পানি খেয়ে-খেয়েই বড়ো হলুম। কিন্তু এখন হাতে একটা পানির বোতল না-থাকলে কেমন ফাঁকা-ফাঁকা, নিজেকে কেমন অরক্ষিত-অরক্ষিত মনে হয়! অহেতুক গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যায়!
কালে কালে এটা একটা ভাবও হয়ে গেছে বটে। কোনো গোলটেবিল, ত্রিকোনা টেবিলের আলোচনায় পানির বোতল না-থাকলে আলোচনা আর জমেই উঠে না! শ্লা, 'মাম' তো মিনিস্টারের পানি হিসাবে খ্যাতি পেল!

যাগগে, আমার প্ল্যানটা হচ্ছে, এক হাতে পানির বোতল নাহয় থাকল কিন্তু অন্য হাত তো মুক্ত। ওই হাতে আরেকটা খালি বোতল ধরিয়ে দিলে অসুবিধা কোথায়, বাপু! কারও সূক্ষ রূচি আহত হলে বোতলের রঙ কালো করে দিলুম নাহয়! মনে হয় না বাংলাদেশের আইনে আটকাবে। আরে বাহে, যেখানে নিষেধ থাকার পরও আমাদের মিনিস্টার সাহেবরা গাড়িতে কালো কাঁচ ব্যবহার করেন সেখানে 'নরমূত্রবোতল' কালো হলে পুলিশ লাঠি মেরে মাথা বা বোতল ফাটাবে এটা অন্তত আমি বিশ্বাস করি না। আর কাজ শেষ হয়ে যাওয়ার পর পুলিশ 'নরমূত্রবোতল' বাজেয়াপ্ত করলে চাইলে তাদের সঙ্গে হুজ্জতে যাওয়ার প্রয়োজন কী, বাপু; 'নরমূত্রবোতল'-টা দিয়ে দিলেই তো ল্যাঠা চুকে যায়।
যাই হোক, তাহলে আর মুত্র বিসর্জন নিয়ে বাড়তি কোনো চাপ নেই। ঢাকাবাসী গাড়িতে থাকুক বা খেলার মাঠে, পার্কে, ফেসবুকে মুত্র বিসর্জনে আটকাচ্ছে কে!

আরেকটা জরুরি বিষয়। কেবল সরকারকে গালি দিয়ে লাভ নাই। আমরা নিজেরা কী! কলা খেয়ে রাস্তায় কলার খোসা ফেলি, বাড়ির সমস্ত আবর্জনা ফেলি। আবার এই আমরাই রাস্তা নোংরা কেন এই নিয়ে সরকার, মেয়রের ফরটিনথ জেনেরেশনের বাপ-বাপান্ত করি!
আমি বিস্মিত হয়ে লক্ষ করি, আমাদের দেশে কোটি টাকা খরচ করে ঝাঁ চকচকে একটা মার্কেট করবে কিন্তু একটা টয়লেট রাখবে না। খোদা-না-খাস্তা টয়লেট থাকলেও তা থাকবে তালাবদ্ধ।

এ আমার বড়ো দূর্ভাগ্য, ড্রেনটা রাস্তার মাঝখানে চলে আসে, বিনা নোটিশে। এই বিষয়ে আমার বেশ কিছু তিক্ত অভিজ্ঞতা আছে। স্টেশনের ওয়েটিং রুমের ওয়শরুম যথারীতি তালাবদ্ধ। আমি অনেক যন্ত্রণা করে স্টেশন মাস্টারকে খুঁজে বের করলাম। বাড়িয়ে বলছি না, ঠিক এই বাক্যটাই বলেছিলাম, 'আপনার বাড়িতে চলেন, আমি পেসাব করব'।
তিনি চোখ লাল-টাল করলেন, তাতে আমার বয়েই গেছে। পরে যেটা বললেন, বদনা নাকি চুরি হয়ে যায়। শোনো কথা, একটা প্লাস্টিকের বদনা চুরি হয়ে যায় এই অজুহাতে টয়লেটে তালা সেরে রাখবেন!

একবার হলো কি, গ্রামে ঘুরছি। ব্লাডার খালি করা আবশ্যক। গেলাম এক মসজিদের এস্তেঞ্জাখানায়। কাজ সেরে ফিরে এসেই পড়লাম বাঘের মুখে! আমার জিন্স, লেবাস দেখে ইমাম সাহেব ভারী গলায় বললেন, 'আপনে কি ওখন নোয়াজ পরবেন'।
আমি অমায়িক ভঙ্গিকে বললাম, 'জ্বে না, আমি একজন মুসাফির মানুষ। এখনই চলে যাব'।
তিনি এবার বললেন, 'এইটা মুসুল্লিদের জন্য, সবার জন্য না'।
আমি শুরু করলাম, 'আচ্ছা হুজুর, আপনে কি জানেন, একবার এক বদু মসজিদের কোনায় বসে পেসাব করছিল। নবীজী তখন বয়ান করছিলেন। সাহাবিরা ক্ষেপে গেলেন, পারলে গলা কেটে ফেলেন। কিন্তু নবীজী পেসাবে বাঁধা না-দেওয়ার জন্য নিষেধ করলেন। পরে বদুকে বুঝিয়ে দিলেন। বদু তার ভুল বুঝতে পারল। পরে তিনি নিজেই সেই পেসাব পানি এনে পরিষ্কার করলেন।...তা নবীজী যেখানে এই রকম মায়া দেখিয়েছেন সেখানে আপনি এমন কঠিন আচরণ করছেন কেন। কাজটা কি ঠিক, হুজুর...'।

আরেকবার। এটা ঢাকার ঘটনা। নামকরা এক ফোন কোম্পানির সার্ভিসিং সেন্টার। 'পশ' একটা অফিস। ওয়ারেন্টি ছিল তাই আমার ফোন সার্ভিসিং করাতে এসেছি। আমি এদের জিজ্ঞেস করলাম, 'আমি একটু...'।
এরা বললেন, 'সরি স্যার, আমাদের এখানে তো ওয়শরুম নাই'।
আমি চিন্তা করলাম, এরা তো সারাদিনই অফিসে থাকে তাহলে ব্যাটারা যায় কোথায়? এটাই যখন জিজ্ঞেস করলাম তখন আমাকে জানালো, স্টাফদের জন্য আলাদা ওয়শরুম আছে।
এবার আমি অসহ্য, অদম্য রাগ সামলে অন্য প্রসঙ্গে চলে গেলাম। হঠাৎ করেই শান্ত গলায় বললাম, 'ইয়ে, আচ্ছা, আপনাদের ছাদে যাওয়া যায়'?
তিনি বিস্মিত হয়ে বললেন, 'যায় তো, এভাবে গেলেই যেতে পারবেন। কিন্তু কেন?
আমার সংক্ষিপ্ত উত্তর ছিল, 'মুতব'।

এই হচ্ছে আমার নিয়তি, এই 'মুতামুতি' নিয়ে একটা-না-একটা ঝামেলা বাঁধবেই, কপালের ফের। ... 
...
অন্যত্র এই লেখাটা দেওয়ার পর একজন রসিকতা করে মন্তব্য করলেন, মেয়েদের বেলায় কী হবে? এর উত্তরে আমি লিখেছিলাম:
"লেখাটা আসলে আমি লিখেছিলাম ফান করে। কিন্তু বিষয়টা আসলে ফানের না। এ এক অন্যায়, ভযাবহ অন্যায়- মানুষের শারীরিক কষ্ট! আমরা জাতি হিসাবে বড়ো অভাগা, এই সমস্ত ছোট-ছোট অথচ ভয়ানক বিষয়গুলোর সমাধান দূরের কথা, ভাবতেও চাই না।

আমার ধারণা, এই দেশের অধিকাংশ নারী ইউরিন ইনফেকশনে ভোগেন কেবল ওয়শরুমের স্বল্পতার কারণে। আমি ডাক্তার নই বলে বলতে পারছি না এই যে দিনের-পর-দিন, বছরের-পর-বছর, যুগের-পর যুগ ধরে ইউরিন ইনফেকশনে ভোগার কারণে একজন নারীর উপর কতটা প্রভাব ফেলে?
আমি এও অনুমান করি, ঝামেলা এড়াবার ভয়ে অনেক নারী পর্যাপ্ত পানিও পান করেন না! তাঁর কিডনি বা অন্যান্য উপসর্গের কারণে তার উপর এর কতটুকু প্রভাব পড়ে, এই নিয়ে ভাবার সময় কোথায় আমাদের! কারণ আমাদের সব ধরনের চেষ্টা থাকে কেমন করে এই জাতিকে একটা বিকলাঙ্গ জাতি হিসাবে পরিণত করা যায়...।"

Thursday, May 23, 2013

জিয়া-মঞ্জুর-এরশাদ

"...(জেনারেল মঞ্জুর ছিলেন গরম মেজাজের লোক! ১৯৭১ সাল। তখন তিনি একজন মেজর। তৎকালীন মেজর আবু তাহের এবং জিয়াউদ্দিনের সঙ্গে পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসে ভারত যাচ্ছিলেন।)
...ভারতীয় সরকারের একজন অফিসার মঞ্জুর এবং সঙ্গীদের অভ্যর্থনা জানান এবং ট্রেনে তুলে দেন। ট্রেনে থালায় করে যে খাবার পরিবেশন করা হয় মজ্ঞুর সে খাবারের থালা হাতে নিয়ে চলন্ত ট্রেনের জানালা দিয়ে বাইরে ছুঁড়ে ফেলেন এবং তার চাহিদামত খাবার পরিবেশন করতে বাধ্য করেন। যে কারণে ট্রেনটির বিলম্বে যাত্রা করেছিল।..."
"...জেনারেলর শফিউল্লাহ শাফায়েত জামিলকে ফোন করলেন। কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে জেনারেল শফিউল্লাহ [*] জামিলকে জানান, 'শেখ মুজিব আর বেঁচে নেই'। এমনকী সেনাবাহিনীর প্রধান, শাফায়েত জামিলকে বিদ্রোহ দমনের নির্দেশটি পর্যন্ত দিলেন না!
...এরপর শাফায়েত জামিল, জেনারেল জিয়ার বাসায় হাজির হলেন। তিনি দেখলেন, জেনারেল জিয়া দাঁড়ি কামাচ্ছেন। জামিল জিয়াকে বললেন, 'স্যার প্রেসিডেন্ট ইজ ডেড। এখন আমার করণীয় কী'?
জিয়াকে তখন অত্যন্ত শান্ত দেখাচ্ছিল। তিনি উত্তর দিলেন, 'প্রেসিডেন্ট যদি বেঁচে না-থাকেন, ভাইস প্রেসিডেন্ট তো আছেন...'।..."
"...চার নেতাকে জেলে গুলি করে মেরে ফেলা হয়। ১৯৭৫ সালের নভেম্বর। তিনজন সুপ্রিম কোর্টের জজকে নিয়ে একটি বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন গঠন করা হয়। কিন্তু জেনারেলর জিয়া তাঁর শাসনামলে এই তদন্ত কমিশনকে কাজ করতে দেননি, সুতরা এই কমিশনের কোনো অস্তিত্বই ছিল না। এই ঘটনাটি জেনারেল জিয়ার স্মৃতিকে কলঙ্কিত করে রাখবে।..."
(বাংলাদেশ: 'আ লিগেসি অভ ব্লাড'/ অ্যান্থনি মাসকারেনহাস)।

মেজর রেজাউল করিম চট্টগ্রামে সেনাবিদ্রোহ মামলার ১০ বছর সাজাভোগী। আনোয়ার কবির তাঁর এক সুদীর্ঘ সাক্ষাৎকার নেন। মেজর রেজাউল অকপটে বলেন:
"...আমি ঘুমাচ্ছিলাম। আমার রানার খুব ভোরে আমাকে জাগায়। ...কর্নেল মতিউর রহমান আমাকে বললেন, 'সার্কিট হাউজে জিয়াউর রহমানের ডেডবডি আছে। ডেডবডি পাহাড় এলাকায় নিয়ে যাবে। নিয়ে কোথাও কবর দিয়ে আসবে'।
আমি সরাসরি না বলে বললাম, 'স্যার, আমাকে অন্য কাজ দিন,। কর্নেল আমার উপর চটে গেলেন।
...(মঞ্জুরের নির্দেশে লে. কর্নেল মতি জিয়ার শরীর ঝাঁঝড়া করে ফেলেন) অফিস বারান্দায় মঞ্জুর পায়চারী করছিলেন। তিনি আমাকে দেখে বললেন, 'রাতের কিলিংয়ে তুমিও কি সার্কিট হাউজে গিয়েছিলে'?
আমি বললাম, 'না স্যার, আমি বাসায় ঘুমাচ্ছিলাম'।
তখন তিনি আমাকে বললেন, 'ওদের তো মাথা গরম, তোমার মাথা তাহলে ঠান্ডা আছে। এখন থেকে তুমি আমার চিফ সিকিউরিটির দায়িত্ব পালন করবে, ওকে'।
আমি বললাম, 'রাইট স্যার'।
এরপর আমি জেনারেল মজ্ঞুরের সব কাজ তদারকি শুরু করি। এক পর্যায়ে ঢাকা থেকে ফোন আসল, জেনারেল মঞ্জুর ফোনে কথা বললেন। জেনারেল মঞ্জুরকে বারবার অনুরোধ করা হচ্ছিল জেনারেল এরশাদের সঙ্গে কথা বলতে। কিন্তু মঞ্জুর বললেন, '...Bloody Ershad, i cannot talk to him. He is a thief, he is a corrupt person'.

শেষপর্যন্ত তিনি এরশাদের সঙ্গে কথা বলেননি। এটাই ছিল তার কফিনে শেষ পেরেক। কারণ এরশাদ এরপরই সরাসরি জিয়ার মৃত্যুর জন্য মঞ্জুরকে অভিযুক্ত করে সব ধরনের কলকাঠি নাড়া শুরু করলেন। টিভি-রেডিওতে বারবার ঘোষণা আসতে লাগল, চট্টগ্রামের সবাইকে বলা হলো বিদ্রোহী এবং যারা পক্ষ ত্যাগ করবে তাদেরকে ক্ষমা করা হবে এবং তাদেরকে কুমিল্লা ক্যান্টম্যান্টে যোগ দেওয়ার জন্য বলা হলো্।

...আমার (রেজাউল করিম) স্ত্রী বলল, 'চলো, আমরা কুমিল্লায় যাই। আমি তাকে বললাম, 'দেখো, আমি জিওসির নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করছি। এটাই আমার ডিউটি। এই মুহূর্তে আমার পক্ষে যাওয়া সম্ভব না'। আমি স্ত্রী চিৎকার করে কাঁদতে লাগল। আমি তার হাত ছাড়িয়ে বাসা থেকে বের হয়ে এলাম।

...জেনারেল মঞ্জুর ক্যান্টনম্যান্ট ছেড়ে হাটহাজারির দিকে রওয়ানা দিলেন। পরে...বললেন, 'নো, আমি স্কেপ করব না। আমি সেরেন্ডার করব'।
আমাকে বললেন, 'রেজা, তুমি পালাও'।
আমি বললাম, 'স্যার, আমি তো আপনার নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করছি। আপনি না-গেলে আমিও যাব না। আপনার সঙ্গে আমিও সেরেন্ডার করব'।
জেনারেল মঞ্জুর বললেন, 'Reza, Why you have surrender, my boy. ওরা তো আমাকে মেরে ফেলবে। তুমিও যদি সেরেন্ডার করো, (তুমিও মরবে) তাহলে আমার কথা দেশবাসীকে কে জানাবে'?
অমি বললাম, 'স্যার, ওরা আপনাকে মেরে ফেললে আমিও আপনার সাথে মরব, And I want to die with you. একথা বলার পরই তিনি আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। তখন তিনি সিগারেট খাচ্ছিলেন। আধ-খাওয়া সিগারেটটা আমার ঠোঁটে গুঁজে দিয়ে দিয়ে বললেন, 'ওহ, মাই কমরেড-মাই কমরেড। ইউ স্মোক দিস। ইউ আর মাই অনলি কমরেড'।

জেনারেলর মঞ্জুর আত্মসমর্পণ করেছিলেন পুলিশের কাছে এবং বারবার বলছিলেন তাঁকে যেন আর্মির হাতে তুলে না-দেওয়া হয়। "...মঞ্জুর আত্মসমর্পণ করেছিলেন একজন হাবিলদারের কাছে। এরপর তাঁকে ওসির রুমে নেওয়া হয়। সেখানে খাবার এনে বিভিন্ন অজুহাতে দেরি করিয়ে দেওয়া হয় যেন আর্মি চলে আসে। তখন থানায় চলে এসেছিলেন চট্টগ্রামের তৎকালীন ডিআইজি শাহজাহান।
যিনি পরবর্তীকালে সচিব হয়েছিলেন এবং ২০০১ সালে তত্ত্ববধায়ক সরকারের  উপদেষ্টা হয়েছিলেন।


এই মানুষটাকে (ডিআইজি শাহজাহান) মঞ্জুর বারবার বলছিলেন,
"আমি পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করেছি। আমাকে আর্মির কাছে দেবেন না, I should get an opportunity to face the trail. আমি সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলতে চাই। আমার অনেক কথা বলার আছে এবং সেটি বলব আমি। দেশবাসির জানা প্রয়োজন। আমাকে তাড়াতাড়ি সেফ কাস্টডিতে পাঠান। আমাকে জেলে পাঠান"।
ডিআইজি শাহজাহান বিভিন্ন ছল করে কালক্ষেপণ করেছিলেন এবং ঠিকই মঞ্জুরকে আর্মির হাতে তুলে দিয়েছিলেন।


...পরে আর্মি এসে জেনালের মঞ্জুর এবং আমাকে হাত, চোখ বেঁধে আলাদা আলাদা জায়গায় নিয়ে গেল। আমাকে যেখানে নিয়ে যাওয়া হলো সেখানে মেজর মুজিব আমার দায়িত্বে ছিলেন। তাঁর কাছে আমি মঞ্জুরের খবর জানতে চাইলে তিনি বললেন, 'গতরাতে আর্মি চিফের নির্দেশে তাঁকে গুলি করে মেরে ফেলা হয়েছে। তখন আর্মি চিফ হচ্ছেন এরশাদ'।"
... ... ...
* তৎকালীন ডিআইজি শাহজাহান নামের মানুষটাও একজন কাপুরুষ! আর [*] তৎকালীন সেনাপ্রধান, শফিউল্লাহ নামের কাপুরুষ ভেউভেউ করে কাঁদছিলেন। একজন সৈনিক হয়ে এখনও তিনি পেট চিরে আত্মহত্যা করেননি এটা দেখে আমি বিস্মিত হই! লজ্জায় মরে যাই!
আমার মনে হয়, আমাদের দেশে কাপুরুষদের জন্য একটা আলাদা গোরস্তান থাকাটাই সমীচীন। যেখানে আমরা ঘটা করে ধুতুরা ফুল দিতে যাব। সঙ্গে থাকবে এই প্রজন্ম, আমাদের ছেলেপুলে। তাঁদেরকে আমরা বলব, ব্যাটা, ওই দেখ, এখানে শুয়ে আছে সব কাপুরুষেরা...!

 **ছবি সূত্র:তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের পোস্টমর্টেমের রিপোর্টটা নেওয়া হয়েছে, 'বাংলাদেশ: আ লিগ্যাসি অভ ব্লাড' থেকে।

Sunday, May 19, 2013

বিবিধ: তাহের এবং খালেদ মোশারফ।

'সশস্ত্রবাহিনীতে গণহত্যা' নামে একটি ডকুমেন্টারির কাজ করেছিলেন আনোয়ার কবির, যেটা গ্রন্থাকারেও প্রকাশিত হয়েছিল। ওই ডকুমেন্টারিতে তিনি অসংখ্য মানুষের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন, সেসময় যারা পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলেন। ওখানে হাবিলদার মেজর আবদুল হাই মজুদার (অব.)-এর একটি সাক্ষাৎকার আছে। তিনি সিপাহিবিদ্রোহের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত ছিলেন। এই মামলায় তাঁর এক বছর সশ্রম কারাদন্ডও হয়েছিল। তাঁর সাক্ষাৎকারের অংশবিশেষ:
"আমরা কয়েকজন মিলে একটি সংগঠন 'বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা নামে' জাসদের গণবাহিনীর তৎকালীন ওই সংগঠনের সাথে ঐক্যবদ্ধ হই। এর ভেতর আমরা সবাই ছিলাম মুক্তিযোদ্ধা, এখানে অমুক্তিযোদ্ধা কেউ ছিল না। আমাদের সঙ্গে ছিলেন, এয়ারফোর্সের কর্পোরাল আলতাফ, কর্পোরাল মজিদ, কর্পোরাল শামসুল হক, আমাদের রেজিমেন্টের নায়েক সিদ্দিক, আর্মি হেডকোয়ার্টারে ছিলেন সুবেদার জালাল, সুবেদার মাহবুব, বেঙ্গল রেজিমেন্টে ছিলেন চান মিয়া, তারু মিয়া, সুবেদার মেজর শহীদ, সুবেদার নুরুল হক...।
...সিরাজুল আলম খানের নেতৃত্বে, উনি আমাদেরকে নির্দেশনা দিলেন, কিছু বই-পুস্তক দিলেন।...বিস্তারিত কর্মপন্থার নির্দেশনা উনিই দিতেন।
...১৫ অগস্টে জাতির জনককে হত্যা করা হয়। কার্যত দেশে কোনো নিয়ন্ত্রণ ছিল না। আমরা কোনোভাবেই এই হত্যাকান্ডকে মেনে নিতে পারিনি। ...সেনাবাহিনীর ভেতর যেভাবে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়েছিল এটা দেখে আমরা কোনো ভাবেই মানতে পারছিলাম না।
...আমরা আমাদের নেতাকে চয়েজ করলাম, কর্নেল আবু তাহের বীর উত্তমকে।
...জিয়াউর রহমানকে গৃহবন্দি করা হয়েছে।
...আমরা সবাই বিচলিত হয়ে কর্নেল তাহেরকে বললাম, 'স্যার, আজকে রাতের ভেতর যদি আমরা জিয়াউর রহমানকে মুক্ত না-করি তাহলে স্যার আমরাও বাঁচব না, জিয়াউর রহমানও বাঁচবেন না, তার ফ্যামেলির একটি সদস্য বাঁচবে না। আপনিও বাঁচতে পারবেন না...।
..এক জরুরি বৈঠকে সিরাজুল আলম খান আসলেন। কর্নেল তাহের বললেন, 'যে-কোনো ভাবে জিয়াউর রহমানকে উদ্ধার করতে হবে। এবং এই সেনাবাহিনীকে বাঁচাতে হবে, দেশকে বাঁচাতে হবে'।
এই কথার পর সিরাজুল আলম খান প্রশ্ন করলেন, 'Who is Zia'?
তাহের বললেন, '(চিন্তার কিছু নেই) আমি যা বলব জিয়া তাই করবে'।
আমরা আলোচনায় বসে পড়ি। কে কি করব এই দায়িত্ব নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করি। কিন্তু কিছুক্ষণেই মধ্যেই দেখলাম, সিরাজুল আলম খান রুমে নেই। আমরা ভাবলাম, তিনি বাথরুমে গেছেন। কিন্তু অনেকক্ষণ অপেক্ষা করার পরও দেখলাম তিনি কোথাও নেই। আমরা সিদ্ধান্ত নিতে না-পেরে হাসানুল হক ইনুকে দায়িত্ব দেওয়া হলো সিরাজুর রহমানের সঙ্গে এই বিষয়ে পাকাপোক্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য।
...জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করার পর তিনি কর্নেল তাহেরকে আলিঙ্গন করলেন। প্রাণ রক্ষা করার জন্য ধন্যবাদ দিলেন। কর্নেল তাহের আমাদেরকে দেখিয়ে বললেন, 'আমি যুদ্ধাহত, আমার একটি পা নেই, আমি কিই-বা করতে পারতাম। যা করেছে এরাই করেছে'।
এরপর জিয়াউর রহমান আমাদেরকে জড়িয়ে ধরলেন, হাত মেলালেন, চোখের পানি ফেললেন।
এরপর কর্নেল তাহের জিয়াকে বললেন, 'যা করেছে সৈনিকেরা করেছে, তারা কি বলে শোনেন'। আমরা 'বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার' পক্ষে ১১ জন আবারো একত্রিত হয়ে জিয়াউর রহমানের কাছে ১২ দফা দাবী উত্থাপন করলাম।
...অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে বলছি, ৭ নভেম্বর স্বাধীনতা যুদ্ধের 'কে' ফোর্সের অধিনায়ক খালেদ মোশারফ, কর্নেল হুদাসহ চারজন অফিসারকে হত্যা করা হয়। কর্নেল তাহের বা আমাদের 'বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা'র কোনো লোক এর সঙ্গে জড়িত নন। আমি হলফ করে বলতে পারি, আমাদের কোনো সদস্য ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশারফ, কর্নেল হুদা, কর্নেল হায়দারকে গুলি করেনি। সেদিন কর্নেল তাহের আমাদেরকে এরকম কোনো নির্দেশ প্রদান করেননি।
'বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার' পক্ষ থেকে যদি কেউ খালেদ মোশারফদেরকে হত্যা করে থাকত তাহলে অন্তত আমি জানতাম। কারণ, কর্নেল তাহেরের সঙ্গে যতবারই আমরা আলোচনায় বসেছি সবগুলোতেই আমি উপস্থিত ছিলাম। সবার পক্ষ থেকে নির্দেশের সবগুলো কাগজে আমি স্বক্ষর করেছিলাম।
খালেদ মোশারফদের হত্যা করেছে পাকিস্তান প্রত্যাগত সৈনিকেরা। আমি বিশ্বাস করি, কোনো মুক্তিযোদ্ধা খালেদ মোশারফকে হত্য করতে পারে না। কারণ একজন যোদ্ধা তার সহযোদ্ধাকে কেমন করে হত্যা করবে! যারা মেরেছে তারা দেশের বাইরে পালিয়ে যায়নি। তাদের গ্রেফতার করা হোক, বিচার করা হোক।..."‌
'বাংলাদেশ: আ লিগ্যাসি অভ ব্লাড' বইয়ে অ্যান্থনি ম্যাসকারেনহাস লিখেছেন:
"...সঙ্গে সঙ্গেই গোলযোগ ছড়িয়ে পড়ে। এর মাত্র কয়েক মিনিট পরেই ক্যাপ্টেন আসাদ আর ক্যাপ্টেন জলিল মিলে খালেদ মোশারফ, কর্নেল হুদা আর হায়দারকে কমান্ডিং অফিসারের কক্ষে গুলি করে হত্য করে...।"
অধ্যাপক ড. আনোয়ার হোসেন, যিনি এই মামলায় ১০ বছর সশ্রম কারাভোগী। তাঁর কথায়:
"...জাসদ নেতৃত্ব এই অভ্যূত্থানে তাহেরকে নেতৃত্ব দেয়ার অনুমতি দিয়েছিল এবং সব ধরনের সহায়তার আশ্বাসও। ...কিন্তু প্রয়োজনের সময় জাসদ সেই কাজটি করেনি।
...আরেকটি কাজ করেনি জাসদ সেটা হচ্ছে, এই অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন তাহের সুতরাং এটা প্রথম সুযোগেই বেতারও টেলিভিশনে প্রচার করা প্রয়োজন ছিল। এই কাজটি করলে এই অভ্যূত্থানের পরিণতি হতো অন্য রকম হত...।"

Saturday, May 18, 2013

লরেনন্স লিফশুলজের চোখে কর্নেল তাহেরের বিচারপর্ব

"...যখন আগের চারটি সরকার একের-পর-এক ক্ষমতায় এসেছিল অস্ত্রের বলে পূর্ববর্তি সরকারকে হটিয়ে। অধিকন্তু যে সমস্ত কর্মকর্তা খালেদ মোশারফের অভ্যুত্থানে অংশ নিয়েছিলেন এবং সরকারি সংবাদপত্রে যাদেরকে 'ভারতের এজেন্ট' বলে তিরস্কার করা হয়েছিল, তাদের সবাইকে মুক্তি দেওয়া হয়েছিল। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেন, ব্রিগেডিয়ার শাফায়াত জামিল। যিনি জিয়াউর রহমানকে গৃহবন্দি করে রেখেছিলেন।
সুতরাং বিষয়টা দাঁড়ালো এমন, যেসব কর্মকর্তা ৩ নভেম্বর জিয়াবিরোধী অভ্যুত্থানের পেছনে ছিলেন তারা ছিলেন মুক্ত আর যেসব ব্যক্তি ৭ নভেম্বর সাধারণ অভ্যুত্থান ঘটিয়েছিলেন, যে ঘটনায় জিয়া মুক্ত হয়েছিলেন, তাঁরা বিচারে মৃত্যুদন্ডের মুখোমুখি!

বিচার চলাকালে পুরো মাসে এ মামলাসংক্রান্ত অথবা বিচার নিয়ে রিপোর্ট করার চেষ্টা করার কারণে আমাকে বাংলাদেশ থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল এমন একটা খবরও এই দেশের পত্র-পত্রিকায় দেখা যায়নি! অথচ প্রত্যেক সম্পাদক ভাল করেই জানতেন কারাগারের প্রাচীরের ভেতর কী হচ্ছে!

তাহের একদমই চাননি প্রেসিডেন্টের কাছে প্রাণভিক্ষার আবেদন করতে [*] কিন্তু তাঁর আইনজীবীরা রাষ্ট্রপতি সায়েমের কাছে প্রাণদন্ড রদ করার  জন্য আবেদন করেন। রাষ্ট্রপতি সায়েম এই আবেদনে কর্ণপাত করলেন না। এ অভূতপূর্ব, তাহেরের দন্ডাদেশ দেওয়ার ২৪ ঘন্টার মধ্যে মৃত্যুদন্ড কার্যকর করার সিদ্ধান্ত দেন।
অথচ এই রাষ্ট্রপতি সায়েম যখন সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি ছিলেন তখন তিনি পূর্ণচন্দ্র মন্ডলের বিরুদ্ধে মামলায় অভিযুক্তকে দেওয়া এক মৃত্যুদন্ডাদেশ রহিত করেন।
ওই মামলায় (পূর্ণচন্দ্র মন্ডল) বিচারপতি সায়েম তার জাজমেন্টে লেখেন:
"'...প্রাণদন্ডাদেশ অপরাধে অভিযুক্ত একজন বন্দির আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য শেষ মুহূর্তে একজন আইনজীবী নিয়োগ রিমেমবেরান্স ম্যানুয়ালের ১২ অনুচ্ছেদের ধারাই কেবল লঙ্ঘন করে না। ওই অনুচ্ছেদের বিস্তৃত ধারাগুলোর পেছনের উদ্দেশ্যও বাধাগ্রস্ত করে'।
অথচ তাহের তাঁর বিচারকাজ শুরু হওয়ার আগ পর্যন্ত কোনো আইনজীবীর পরামর্শ নেওয়ার সুযোগই পাননি!
(২০০৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দেওয়া লরেনন্স লিফশুলজের বক্তব্য থেকে)

লরেনন্স লিফশুলজ হাইকোর্টে তাঁর হলফনামা দাখিল করে লিখেছিলেন:
"...ওই দিন কারাগারে একমাত্র নিরেপেক্ষ প্রত্যক্ষদর্শী হিসাবে আমি বিশ্বাস করি, এটা আমার দায়িত্ব সবাইকে জানানো, আমি কী দেখেছি এবং ঘটনাগুলো কীভাবে ঘটেছে।
৩০ বছরের বেশি সময় ধরে আমি এই ডাকটির জন্য অপেক্ষা করে থেকেছি। হাইকোর্টের সামনে দাঁড়ানোর সুয়োগকে আমি জীবনের অন্যতম সম্মানজনক ঘটনা হিসাবে মনে করি।
...তখন আমি জেনারেল জিয়ার সাক্ষাৎকার নেওয়ার চেষ্টা করি।...কিন্তু আমাকে সাক্ষাৎকার গ্রহণের অনুমতি দেননি জেনারেল জিয়া।...বরং আমাকে এই দেশ থেকে বের করে দিয়েছিলেন।
...নির্মোহ ভাবে আমি বিশ্বাস করি, বিচার শুরুর আগেই এ রায় নির্ধারিত হয়ে গিয়েছিল। ...বিচারের আগেই জিয়া তাহেরকে ফাঁসি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।
...তাহের ওই ট্রাইব্যুনালে দাঁড়িয়ে তাঁর শেষ ভাষণে যা বলেছিলেন তা যদি পরের দিন খবরের কাগজে প্রকাশিত হতো, তাহলে জনগণের মধ্যে তাহেরের পক্ষে ভয়ানক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হতো। (কিন্তু কোথাও এটা প্রকাশিত হয়নি!)
আমার দৃষ্টিতে, এখনই সময় রাষ্ট্র ও বিচার বিভাগের, প্রকাশ্যে এ ঘোষণা দেওয়া যে আবু তাহেরের বিচার ভুল ছিল এবং তার মৃত্যুদন্ডও ভুল ছিল।"

লরেন্স লিফশুলজ যে হলফনামা হাইকোর্টে দাখিল করেছিলেন, সেখানে তিনি লিখেছিলেন:
"...তাঁর (মঞ্জুর) আশঙ্কা ছিল, তাহেরকে বিচারের মুখোমুখি করার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের চেষ্টা করবেন জিয়া। মঞ্জুর এবং মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া অন্য সামরিক কর্মকর্তারা জিয়াকে এ ধরনের পদক্ষেপ (তাহেরের বিচার) থেকে বিরত করার চেষ্টা করেন। কিন্তু জুনের শুরুতে মঞ্জুর অনিশ্চিত হয়ে পড়েন, তিনি এই বিচার-প্রক্রিয়া থামাতে পারবেন কি না। কারণ সেনাবাহিনীতে তখন মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তির বিপুল প্রভাব।...

মঞ্জুর আমাকে (লিফশুলজ) জানাতে চেয়েছেন, তিনি ওই বিচার ঠেকাতে চেয়েছিলেন, কিন্তু স্পষ্টতই সেটি করার কোনো ক্ষমতা তাঁর ছিল না। যদিও তিনি ওই সময় নেতৃত্বের দিক থেকে তৃতীয় শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা ছিলেন। তাহেরের বিচার নিয়ে তাঁর অবস্থান তাঁকে সামরিক বাহিনীতে চিহ্নিত করে ফেলেছিল ওই সব ব্যক্তির কাছে, যারা তাহেরের মৃত্যু চেয়েছিলেন।...। 
হায় লিফশুলজ, আপনি ৩০ বছর ধরে আপনার এই স্বপ্নকে লালন করেছেন। অথচ আমরা কী বিস্মৃতপরায়ণ জাতি, ৩০ দিনেই সব ভুলে যাই!

তাহেরের বেলায় প্রত্যেকটা জায়গায়ই আইন ভঙ্গ করা হয়েছিল। মেজর জিয়াউদ্দিন, যিনি সেসময় বিচারে অভিযুক্ত হয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন:
"...যেদিন তাহেরকে ফাঁসি দেয়া হয় সেদিন রাতের বেলায় বিডিআর অস্ত্র নিয়ে জেলখানায় ঢুকে পড়ল। এটা আন্তর্জাতিক জেল আইনের বিরোধী! জেলখানার ভেতর কোনো সশস্ত্র পাহারা ঢুকতে পারবে না। কেবল ঢুকলই না, প্রত্যেকটা সেলের সামনে একজন করে অটোমেটিক রাইফেলধারী সিপাহি দাঁড়িয়ে গেল। পুরো জেলখানা তারা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নিল...।"
তখন জেলখানায় আটক ছিলেন অধ্যাপক ড. আনোয়ার হোসেন। তাঁর বক্তব্য:
"...জেনারেল মীর শওকত একদিন কারাগারের ভেতরে এসে পরীক্ষা করে গেলেন ফাঁসির দড়ি, ফাঁসির মঞ্চ ঠিকঠাক আছে নাকি! এটা বলার অপেক্ষা রাখে না এটি কোনো ভাবেই মীর শওকতের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না। কিন্তু তারপরও সেনাবাহিনীর উর্ধ্বতন যারা জিয়াউর রহমানের সঙ্গে জড়িত ছিলেন তারা তখন মরিয়া হয়ে গিয়েছিলেন কত দ্রুত তাহেরকে এই পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেয়া যায়।..."
আমার নিজস্ব মত, জেনারেল মীর শওকতের এই আচরণ অস্বাভাবিক! এটা কোনো প্রকারেই একজন মুক্তিযোদ্ধা দূরের কথা; একজন যোদ্ধা, একজন সাধারণ মানুষের সুস্থ আচরণ হতে পারে না! এখানে এসে এই মানুষটা জেনারেল মীর শওকতকে আমার পোকা-পোকা মনে হয়...।
আর আমার কাছে তো এমনটা মনে হচ্ছে, তখন জেলখানা বলে বা জেল-কোড বলে কোনো জিনিস বাংলাদেশে ছিল না! যা খুশি, যার যখন খুশি এখানে আসছেন-যাচ্ছেন। যেনো জেলখানা- এটা একটা খেলার জায়গা বা এদের বাপের তালুক!
 
আমার স্পষ্ট অভিমত, রাষ্ট্রপতি সায়েম, ট্রাইব্যুনালের প্রধান বিচারক কর্নেল ইউসুফ হায়দার (যিনি একজন রাজাকারও ছিলেন), জেনারেল মীর শওকত বা অন্য যারা এই খুনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন তাদের প্রত্যেককে খুনের অভিযোগে খুনি অভিযুক্ত করাটাই ন্যায়, জাস্টিস। মৃত্যুর পরও খুনি চিহ্নিত করতে হবে...।

*আইনজীবীরা বলেছিলেন, তাহেরের আপিল করার সুযোগ নেই। একটিমাত্র পথ খোলা আছে সেটা হচ্ছে, রাষ্ট্রপতি জাস্টিস সায়েমের কাছে মার্সিপিটিশন প্রাণভিক্ষার আবেদন করা। তাহের সঙ্গে-সঙ্গে তা ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি বলেছিলেন,
'জিয়াউর রহমানকে আমি ক্ষমতায় বসিয়েছি। (সে) একজন মীরজাফর ছিল ব্রিটিশ আমলে (একজন) আর এই হচ্ছে দ্বিতীয় মীরজাফর, জিয়াউর রহমান! তার কাছে আমি প্রাণভিক্ষা চাইব? কিংবা তার ক্রীড়ানক প্রেসিডেন্টের কাছে, প্রশ্নই আসে না'।
তাহের প্রাণভিক্ষা চাইলেন না।

**"...সামরিক আদালতে বিচারের ঘটনা এবং এর প্রেক্ষাপট খতিয়ে দেখার জন্য আদালত সরকারকে একটি তদন্ত কমিটি গঠনেরও নির্দেশ দিয়েছে।...[১]"
এই নির্দেশের গতি কী!


*** Faruk Abdullah চমৎকার এক পর্যবেক্ষণ করেছেন:
"...আর একটা জিনিস স্মরণ রাখাটা খুব জরুরি, মিলেটারি একাডেমিগুলোতে মূলত যে শিক্ষা দেয়া হতো, অর্থাৎ পাকিস্তান মিলেটারি একাডেমিতে। তাঁদের অনেকের মধ্যো 'উগ্র ভারত বিদ্বেষ' শিক্ষাটা, যেটা পরবর্তীকালে শত্রুর শত্রু, পাকিস্তানমুখি করেছিল...।

সহায়ক সূত্র:
১. হাইকোর্টের রায়:
http://www.bbc.co.uk/bengali/news/2011/03/110322_mk_taher_verdict.shtml

Friday, May 17, 2013

লং লিভ মাই কান্ট্রিম্যান: তাহের

এটাই ছিল তাহেরের শেষ কথা। এরপরই তার স্বরযন্ত্র ভেঙ্গে দেয়া হয়। এই অগ্নিপুরুষকে ১৯৭৬ সালের ২১ জুলাই ভোরে যখন ফাঁসি দেয়া হয়, ফাঁসির মঞ্চে রশিতে ঝোলার ৩০ সেকেন্ড আগে ঠিক এই কথাটাই তাহের উচ্চারণ করে গিয়েছিলেন।
তাহেরের গোপন বিচারের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করা নিয়ে রিট আবেদনে হাইকোর্টে তৎকালীন ম্যাজিষ্ট্রেট খন্দকার ফজলুল রহমান, যিনি তাহেরের ফাঁসির সময় উপস্থিত ছিলেন; তিনি এই তথ্যটি জানান।

তিনি আরও বলেন, "...ওই সময় তাহের একটি কবিতা এবং ২টি সিগারেট পাইপ আমার হাতে দিয়ে বলেন, তাঁর বড় ভাইয়ের কাছে পৌঁছে দিতে। তাহের আমাকে আরও বলেছিলেন, 'দেখেন, (ফাঁসির) রশি ঠিক আছে কি না, ভ্যাসলিন দেওয়া হয়েছে কি না'।
ফাঁসির মঞ্চে নিয়ে যাওয়ার সময় তাহের বললেন, 'আমি মাস্ক পরব না'। (যে কালো কাপড়ে দিয়ে মুখ ঢেকে দেয়া হয়)
আমি বলি, 'আইনে আছে মাস্ক পরে যেতে হয়'। ..."

'লং লিভ মাই কান্ট্রিম্যান', মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়েও তাহের দেশ, দেশের মানুষের কথা ভোলেননি! আমার একটা কথা আমি লেখায় প্রায়শ ব্যবহার করি, 'মৃত্যু এসে গা ছুঁয়ে বলে, পাগল তোকে ছুঁয়ে দিলাম'। তাহেরের বেলায় হবে উল্টোটা। তিনি মৃত্যুর গা ছুঁয়ে হা হা করে হাসেন। এমন একজন মানুষের মুখোমুখি হয়ে মৃত্যু কী খানিকটা বিমর্ষ, কুন্ঠিত-লজ্জিত হয়, কে জানে!

তাহেরের স্ত্রী মিসেস লুৎফা তাহের বলেছিলেন:
"...তাহেরের সঙ্গে দেখা করতে গেছি। জেলখানায় থাকাকালীন এত মজার মজার ঘটনা আমাদের বলল। ...আমরাও হাসতে হাসতে বিদায় নিলাম। আমরা চিন্তাই করতে পারিনি আজকে রাতেই ফাঁসি হবে। (পরে জেনেছি আজকে রাতেই যে ফাঁসি হবে এটা তাহের জানত)
...জেলখানা থেকে টেলিফোন আসল লাশ নেয়ার জন্য। আমরা বললাম, ঢাকায় কবর দেব। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয় বলল, না। তখন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আমার শাশুড়ি অনেক ঝগড়া করলেন। কিছুতেই তারা ঢাকায় কবর দিতে দেবে না।

অবশেষে সিদ্ধান্ত হলো তাহেরের কাজলা গ্রামে লাশ হেলিকপ্টারে করে নিয়ে যাওয়া হবে। হেলিকপ্টারে উঠে এই প্রথম আমি তাহেরের লাশ দেখলাম। আমি চেয়ে চেয়ে দেখলাম, একজন শীর্ষস্থানীয় মুক্তিযোদ্ধার আজ এই পরিণতি! জেলখানার একটা ছেঁড়া চাদর দিয়ে তাঁর শরীর ঢাকা। তাঁর পা ও মাথা বের হয়ে আছে! তাহেরের মাথার চুল উড়ছে!
তাহেরের মা চিৎকার করে বললেন, 'আমার ছেলের জন্য একটা কফিনও হলো না'।...।"

কথিত আছে, নিষ্ঠুর আইয়ুব খান একবার তার সৈন্য-সামন্ত নিয়ে যাচ্ছিলেন। পেছনে পেছনে একটি বেসরকারী লাশবাহী গাড়ি আসছিল কিন্তু আইয়ুব খানের গাড়িকে অতিক্রম করার সাহস পাচ্ছিল না। আইয়ুব খান বিষয়টি লক্ষ করলেন এবং খোঁজ নিয়ে যখন জানলেন এই গাড়িতে লাশ আছে, তখন তিনি নিজের গাড়ি থামালেন, লাশবাহী গাড়িকে আগে যেতে বললেন এবং স্যালুট করলেন।

কেবল যে তাহেরের সঙ্গে ঘোরতর অন্যায় করা হয়েছিল তাই না, তাহের নামের লাশের প্রতিও চরম অবজ্ঞা দেখানো হয়েছিল। আমরা ভুলে যাই কিন্তু ইতিহাস ভোলে না। প্রকৃতির শোধ বলে একটা কথা আছে। হিস্ট্রি রিপিট...।


* আইয়ুব খানের বিষয়টা সম্বন্ধে আমার খানিক সংশয় ছিল কারণ এটা আমি শুনেছিলাম এক আর্মি অফিসারের মুখ থেকে। কেবল শুনেই তো লিখে দেওয়া যায় না। তাই আমি লিখেছিলাম, 'কথিত আছে'।
কিন্তু এই বিষয়ে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন Abdullah Al Imran
"তবে মোটামুটি বছর ছয় কি সাত আগে 'ছুটির দিনে' ম্যাগাজিনের কাভার স্টোরি করা হয়েছিল 'আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলাম'-কে নিয়ে। আমার স্পষ্ট মনে আছে সেখানে একেবারে শুরুর লাইনটাই ছিল এটা। আইয়ুব খান যে লাশের গাড়িটাকে স্যালুট করেছিলেন সেটা ছিল আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলামের লাশ বহনকারী ঘোড়ার গাড়ি। লাশটা থেকে নাকি পঁচা দুর্গন্ধ ও বের হচ্ছিল...।" Abdullah Al Imran


তেলাপোকা টিকে আছে, তার নিজস্ব অবয়বে...।

পুরনো বিষয়টা সামনে চলে এলো যে কারণে, আমার এটা জানার খুব কৌতুহল ছিল, গ্রেফতার হওয়ার পর কার্টুনিস্ট আরিফকে তখন প্রথম আলোর তরফ থেকে অন্তত আইনি সহায়তাটা দেওয়া হয়েছিল কিনা?

আমি এটা বুঝতে পারি কখনও-কখনও আমাদেরকে ইচ্ছার বিরুদ্ধে পরিস্থিতির কারণে সমঝোতা করতে হয়। সেই সমঝোতা কতটা গ্রহণযোগ্য এটা নির্ভর করে অনেক কিছুর উপর। কখনও-বা আমরা খানিক নরোম দৃষ্টিতে তাকাতেও বাধ্য হই, অনিচ্ছায়।


সেই কার্টুন নিয়ে যখন সময়টা উত্তাল তখন প্রথম আলোর সম্পাদক যে ভঙ্গিতে আত্মসমর্পণ করেছিলেন তা নিয়ে অনেকের ঘোর আপত্তি আছে কিন্তু এ বিষয়টাও মাথায় রাখা উচিত কেবল মতিউর রহমানই এখানে বিবেচ্য বিষয় না, তার সঙ্গে জড়িয়ে ছিল একটি বিশাল প্রতিষ্ঠান। যে প্রতিষ্টানের সঙ্গে আবার জড়িয়ে ছিলেন অসংখ্য মানুষ, তাদের পরিবার। এই প্রতিষ্ঠানের প্রধান হিসাবে এর অনেকটাই দায়দায়িত্ব মতিউর রহমানের উপর বর্তায়। তিনি হয়তো তার প্রতিষ্ঠান, প্রতিষ্ঠানের লোকজনকে রক্ষা করার চেষ্টা করেছিলেন। এই দিকটা একেবারে উড়িয়ে দেয়া চলে না। কিন্তু...।

একটা কিন্তু রয়ে যায়। কার্টুনিস্ট আরিফ তো এই পত্রিকার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। (আমরা এও জানি, তিনি কেবল নির্দোষ কার্টুনই এঁকেছিলেন কিন্তু কার্টুনের সঙ্গে সংলাপগুলো তাঁর ছিল না) তার প্রতি অন্তত ন্যূনতম দায় তো থেকেই যায়। একটা কুৎসিত পোষা প্রাণীর প্রতিও তো আমাদের মায়া পড়ে যায়, অজান্তেই দায়ও চলে আসে। আর কার্টুনিস্ট আরিফ তো কেবল আঁকাআঁকির একজন শিল্পীই না, একজন মানুষও! মতিউর রহমানের মত একজন, যিনি ঘটা করে বিভিন্ন মানবিক বিষয়গুলো বিভিন্ন সময়ের লোকজনকে শেখাবার চেষ্টা করেছেন, এখনো করেন। তিনি আরিফকে অন্তত আইন সহায়তা দেবেন এ তো অস্বাভাবিক কিছু না।

তর্কের খাতিরেও নাহয় ধরে নিলাম, সেইসময় আরিফের সঙ্গে কোনো প্রকার যোগসূত্র রাখা তার জন্য কঠিন হয়ে পড়েছিল। বেশ! কিন্তু তিনি তো আর অগাবগা মানুষ নন, তার একটা ফোনে দশজন মানুষ ছুটে আসবে সাহায্য করার জন্য।

পূর্বে কিছু সূত্র থেকে জেনেছিলাম, মতিউর রহমান কোনো প্রকার আইনি সহায়তা আরিফকে দেননি। সত্য বলি, আমি এটা বিশ্বাস করিনি। করার কথা না, এটা আমি বিশ্বাস করতে চাচ্ছিলাম না।
অনেক দিন থেকে আমি চাচ্ছিলাম, আরিফের নিজের মুখ থেকে এটার সত্যতা যাচাই করতে। অবশেষে এই মানুষটার সঙ্গে যোগসূত্র স্থাপন করা সম্ভব হয়েছে। তিনি স্পষ্ট করে বলেছেন, কোনো ধরনের সহায়তা দূরের কথা মতিউর রহমান বিন্দুমাত্র আইনি সহায়তাও দেননি। আরিফ জেলে যাওয়ার পর প্রথম যে মানুষটি ২ মাস পর খোঁজখবর নিয়েছিলেন তিনি হচ্ছেন সারা হোসেন।

আমরা এ তো সবাই জানি আরিফের মা দীর্ঘদিন রোগাক্রান্ত ছিলেন। সপ্তাহে দুবার কিডনি ডায়ালিসিস করতে হতো অথচ আরিফের পক্ষে এই ব্যয়ভার চালিয়ে যাওয়া সম্ভব ছিল না। তখন ব্লগাররা এবং তাঁর কিছু বন্ধু এগিয়ে এসেছিলেন। আরিফ তাদের কথা এখনও কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করেন।
পরে আরিফ নরওয়েতে চলে যান এবং পত্রিকার সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে বলেও ছিলেন, খুব চেষ্টা করছিলেন তাঁর মাকে নরওয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য। আমি ওই সাক্ষাৎকারের সূত্র ধরে জানতে চেয়েছিলাম, তাঁর মা এখন কেমন আছেন? অজান্তেই আমি একটা জঘন্য অপরাধ করে ফেলেছিলাম যেটা বুঝতে পারলাম তার এই উত্তরে, "...মা গত বছর ১২ এপ্রিল ২০১২-এ মারা গেছেন, বাঁচাতে পারলাম না...আজ এক বছর ২০ দিন..."।

কারো দাম্ভিক আচরণ, অহংকারের পরিপ্রেক্ষিতে আমি পূর্বে অসংখ্যবার লিখেছি, এই গ্রহে ডায়নোসর নাই, রাশিয়া নাই, আদমজি জুটমিল নাই।
বাক্যটা আসলে অসম্পূর্ণ! আজ এর সঙ্গে যোগ করে দিচ্ছি, কিন্তু তেলাপোকা আছে, অবিকল...।

Thursday, May 16, 2013

একটি রুপকথা!

আজকের অতিথি-লেখক আরিফুর রহমান। যিনি কার্টুনিস্ট আরিফ নামেই অধিক পরিচিত। দৈনিক প্রথম আলোতে একটি কার্টুন আঁকার জন্য এই দৈনিকটি তাঁর সঙ্গে যা করেছিল তা কেবল অন্যায়ই না, ঘোর অন্যায় [১]! তিনি লিখছেন:
"(আগাম সতর্কীকরণঃ মনের ভুলেও সত্য মনে করবেন না )

আজ থেকে হাজার-হাজার বছর আগের কথা। এই পৃথিবীর কোনো এক প্রান্তে এক দেশ ছিল। সেই দেশে বাস করত আবুল নামের এক লোক, সহজ-সরল তবে একটু বোকা টাইপের । কোনো কাজ-কাম করত না কেবল সারাদিন বড়শি নিয়ে পুকুর ধারে বসে থাকতো । কেননা বড়শি দিয়ে মাছ ধরা ছিল তার নেশা । সে মাছ মেরে বিক্রি করত না তবে মাছ গুলোকে শুটকি করে রাখত। শুটকিগুলো সে তার ঘরের দেয়ালে ঝুলিয়া রাখতো আর প্রতিবেশি সবাইকে দেখাত । কারণ সে সবাইকে দেখিয়ে খুব আনন্দ পেত আর সবাই তার মাছ মারার বাহাদুরি দেখে খুব প্রসংশা করতো। 

 

এক দিন হল কি, মাছ মারতে মারতে তার বাড়ির পাশের সব পুকুরের সমস্ত মাছ ফুরিয়ে গেল, কিন্তু মাছ মারা যে তার নেশা । মাছ না-মারা পর্যন্ত তার শান্তি নেই, মাছ যে তাকে মারতেই হবে । তাই সে বের হল পুকুরে খোঁজে।

 

হাঁটতে হাঁটতে তার পাশের গ্রামে একটা পুকুর খুঁজে পেলো, কিন্তু পুকুর এর কাছে গিয়ে দেখে এক বাউন্ডুলে টাইপে এক লোক বড়শি দিয়া মাছ মারছে। সে দূর থেকে দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে দেখছিল।

 

বাউন্ডুলে টাইপের লোকটা তাকে কাছে ডেকে নিয়ে জিঙ্গাসা করল, 'কি হে ! তোমার প্রশংসা তো সারা গ্রামে, সবাই বলে তুমি নাকি খুব ভালো মাছ মারতে পারো, মাছ মারবে আমার সঙ্গে? তোমার মত একজন লোক আমার ভীষণ দরকার। আমি এখানকার এক মাছের আড়তে চাকুরি করি। তোমাকে টাকা দেবো, কি মাছ মারবে আমার সাথে'?

 

আবুল মিয়া এ কথা শুনে খুশিতে গদগদ! এটা যেন তার কাছে মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি। কত টাকা দেবে কী সমাচার সে কিছুই জিজ্ঞাসা করল না কারণ তার ধারণা সে ভালই টাকা পাবে। বাউন্ডুলে টাইপের ওই লোকটির মুখের কথা শুনে এক বুক আশা নিয়ে সে বাড়ী ফিরে এলো। এর পর থেকে দুজনে মিলে মাছ মারতে শুরু করল । এ ভাবে বেশ কিছু দিন কেটে গেল।

 

পুকুর পারের সরা গাছে যে ভুত থাকতো সে কথা কেউ জানতো না । একদিন হলো কি মাছের কাঁচা গন্ধে থাকতে না পেরে সরা গাছ থেকে একটা ভুত বের হয়ে এলো । ভুতটা বের হয়েই, মাছ খাব-মাছ খাব বলে চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করে দিল । ভয়ে বাউন্ডুলে লোকটা ভুতের সামনে আবুলকে এগিয়ে দিয়ে মাছগুলো নিয়ে মারলো এক দৌড় । পিছন থেকে আবুল মিয়া হাহাকার করতে লাগল কিন্তু কেউই তার ডাকে সাড়া দিল না, এমন কি বাউন্ডুলেও না, সে যে কোথায় গিয়া পালাল সেটা কেউ জানে না ।

 

আবুল মিয়া তখন ভূতের ভয়ে থরথর কাঁপছিল । ভূতটা তখন চিৎকার করছিল আর মুখ দিয়ে আগুন হচ্ছিল, সজোরে এক হুঙ্কার দিতেই আবুল মিয়া পুকুরের গভীর গর্তে পা ফস্কে পড়ে গেলো। পুকুরটা এতোটাই গভীর ছিল যে কেউ একবার পড়ে গেলে তার আর রক্ষা নাই। নির্ঘাত তাকে মরতেই হবে, এতটাই গভীর যে পুকুরটা অনেকটা কুয়োর মত। এদিকে আবার আবুল মিয়া ঠিক মত সাঁতারও জানেনা, পুকুরের পচা পানিতে হাবুডুবু খাচ্ছিল।

কারণ পুকুরে এতোই পানি ছিল যে সেখানে দাঁড়ানোর জন্য তার ঠাঁই হচ্ছিল না। এখন সে উভয় সংকটে পড়েছে। উপরে ভূত আর নিচে মানুষখেকো মাছ। কোনোটা নীচ থেকে তাঁকে কামড়াচ্ছিল, কোনোটা আবার শিং ফুটিয়ে দিচ্ছিল আবার কোনোটা তাকে প্রাণে মেরে ফেলার ভয় দেখাচ্ছিল ।

তার এই বিপদের সময় সে তার আড়তদার সবাইকেই ডাকছিল কিন্তু সবাই তখন ব্যস্ত ছিল। তার বিপদের সময় কেউ পাশে এসে দাড়ায়নি । সে খুব কান্নাকাটি করছিল তখন। পানিতে সাঁতার কাটতে কাটতে কিছুক্ষণ পর পায়ের নিচে এক টুকরো মাটি খুঁজে পেলো এটিই ছিল তাঁর বেঁচে থাকার শেষ ভরসা ।
 

অন্যদিকে ভূতটা রেগে গিয়ে হইচই করে সারা দেশ মাথায় তুললো! ভূতের অভিযোগ মাছের গন্ধে তার ঘুমের ব্যাঘাত ঘটানো হয়েছে। চাচা আপন প্রাণ বাঁচা বলে আড়তদার মহাজন ভূতের পা ধরে ক্ষমা চাইল। এবং ভূতকে খুশি করার জন্য তারা ঘোষণা দিলো যে আবুল মিয়াকে তারা আর কখনও তাদের পুকুরে মাছ মারতে দেবে না এবং তাকে বহিস্কার করা হলো। ভূতকে খুশি করার জন্য তাঁরা আরও বহু প্রতিশ্রুতি দিল।

 

এদিকে আবুল বেচারার আবস্থা কাহিল। চিন্তায় চিন্তায় সে শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। ঠিকমত তার খাওয়াদাওয়াও হয় না, বিপদ থেকে সে কখনও রক্ষা পাবে কি না সেটা সে নিজেও জানে না, সব সময় শুধু আকাশের দিকে সে তাকিয়ে থাকে আর কাঁদে ।

কিছু দিন পর পুকুরের পাশ দিয়ে যাচ্ছিল কালো পোষাক পরা একদল মানুষ, আবুলকে দেখে তাদের খুব মায়া হলো, তাই তারা পুকুরে একটা লম্বা দড়ি নামিয়ে দিলো, আবুল সেই দড়ি ধরেই উপরে উঠে এলো। ছয় মাস দুই দিন পর সে জল থেকে ডাঙ্গায় উঠলো। সে নতুন জীবন ফিরে পেল । কিন্তু আবুলের মন থেকে ভূতের ভয় দূর হয় না, ভূতগুলো তাকে সবসময় তাড়া করে ফেরে।

 

এদিকে কঠোর বাস্তবতা। কাজের খোঁজে আবুল রাস্তায় রাস্তায় ঘোরে, কিন্তু কেউ তাকে কোনো কাজ দেয় না, সবাই ভয় পায়, চাকরি দিলে ভূত যদি তাদের উপর আক্রমণ করে।

 

এদিকে যাদের সঙ্গে কাজ করতো তাদের কেউ আর তার কোনো খোঁজ খবর নেয় না। প্রয়োজনও মনে করে না।
একদিন আড়তদারের ম্যানেজার চক্রবর্তী সাহেবের সাথে আবুলের দেখা, চক্রবর্তী সাহেব তাকে কাছে বসিয়ে বললেন, 'আবুল, আমরা তো তোমার সঙ্গে অন্যায় করে ফেলেছি, তা কি করলে তুমি আমাদের ক্ষমা করবে বলো? কি করলে তুমি খুশি হবে?
আমরা তো ঘোষণা দিয়েছি আমরা তোমাকে দিয়ে আর কখনও মাছ ধরাবো না। ঠিক আছে, তুমি কোনো চিন্তা কোরো না আমরা তোমাকে একটা নতুন কাজ জোগাড় করে দেব। পুকুরে থাকতে তো অনেক শাপলা-শালুক খেয়েছো, এই নাও আমার হাতের কোক আর বিরিয়ানি খাও। পরে তোমার সাথে যোগাযোগ করব'।

এটা বলে চক্রবর্তী সাহেব আর কোক-বিরিয়ানি তার সামনে রেখে চলে গেলেন। পরে তিনি আর কখনও যোগাযোগ করেননি! আবুল নিজ থেকেও চেষ্টাও করেছে বহুবার কিন্তু সে মানুষটার নাগাল পায়নি। কারণ তারা অতি বড়লোক, উপরতলার মানুষ, তারা সব সময় ব্যস্ত থাকেন। তাছাড়া প্রয়োজন মনে না-করলে সবার সঙ্গে তারা কথাও বলেন না।

 

এভাবে অনেক দিন কেটে গেল এক সময় চক্রবর্তী সাহেব তাঁর দেয়া কথাও ভুলে গেল ।
 

বহুদিন আবুলের কারও সঙ্গে কোনো যোগাযোগ নাই তাই সে নিজে থেকেই বাউন্ডুলেকে একটা ফোন করল। উত্তরে বাউন্ডুলে বললেন, 'ভাই আমি খুব অসুস্থ সকালে হাসপাতালে ভর্তি হইছি'।

শুনে আবুল বলল, 'আমি আপনাকে দেখতে আসি'?
বাউন্ডুলে বললেন, 'আসেন'!
তার বিপদে বাউন্ডুলে তাকে দেখতে আসেনি তাতে কি হয়েছে, সে তাকে দেখতে যাবে, তার বিপদে পাশে গিয়ে দাঁড়াবে কারণ তার মধ্যে যে এখনও মানবতা অবশিষ্ট আছে। তার জন্য কে কি করল সেটা তো তার দেখার বিষয় নয়।
আবুল তার সাধ্য মত ফল কিনে হাসপাতালে বাউন্ডুলেকে দেখতে গেল।
বাউন্ডুলে হাসপাতালে আবুলকে দেখে তাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলেন।


একদিন দেশে রাজার মৃত সন্তানদের স্মরনে এক মেলার আয়োজন করা হল । মেলা সবার জন্য উন্মুক্ত ছিল, সেখানে দেশ-বিদেশ থেকে বহু লোক জন আসতো, আবুলও সেখানে গিয়ে হাজির হলো। মেলায় ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ বাউন্ডুলেকে সে দেখতে পেলো । লম্বা একটা সালাম দিয়ে সে বাউন্ডুলের সামনে গিয়ে হাজির হল, সঙ্গে সঙ্গে বাউন্ডুলে বলে উঠলেন, 'আরে আপনি? আপনাকে খুব চেনা-চেনা লাগছে, আপনাকে কোথায় যেন দেখেছি? ঠিক মনে পড়ছে না! আপনাকে কোথায় দেখেছি বলুনতো'?
 

বাউন্ডুলের মুখে এরকম কথা শুনে সে খুব অবাক হচ্ছিলো, সে বলল, 'ভাইয়া আমাকে চিন্তে পারছেন না? আমি আবুল'! (মনে মনে সে বলল, এক সঙ্গে এতদিন কাজ করলাম, হাসপাতালে দেখতে গেলাম সব কিছু সে এত তাড়াতাড়ি ভুলে গেল?)
উত্তরে বাউন্ডুলে বলল, 'আরে, আবুল আপনি? আপনি ভাল আছেন? কি করছেন এখন? কখন এসেছেন? তা চক্রবর্তী সাহেবের সাথে দেখা হয়েছিল আপনার? সেও তো এই মেলাতে এসেছে! দেখা হয়েছে'?
আবুল এতগুলো প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে ছোট্ট করে বলল, 'না, দেখা হয়নি!

 

বাউন্ডুলে আবুলকে নিয়ে চক্রবর্তী সাহেবের কাছে এলো। কফি শপের সামনে দাড়িয়ে তিনি কিছু লোকের সাথে গল্প করছিল।
বাউন্ডুলে বললেন, 'চক্রবর্তী ভাই, দেখছেন কে এসেছে'?
উত্তরে চক্রবর্তী, 'কে যেন? ঠিক চিন্তে পারছি না'?
বাউন্ডুলে এবার বললেন, 'চিনতে পারেননি! ও আবুল, আমাদের সেই আবুল'।
মুখভরা হাসি নিয়ে চক্রবর্তী বললেন, 'ওহ, আবুল ! ভাল আছ? এই দোকানদার আবুলকে কফি দাও! নাও, আবুল কফি খাও'!

কফি শেষ হতে না হতেই আবুল আবিষ্কার করল নিজেকে, সে একা দাঁড়িয়ে আছে কফি শপের সামনে, সবাই যার যার মত কাজে চলে গেছে। কফির কাপটা হাতে নিয়ে আবুল মনে মনে ভাবছিল, কত সহজেই না মানুষ বদলে যায়, মানুষ কত অদ্ভুত !

 

একবুক কষ্ট নিয়ে সে হেঁটে বেড়ায় রাস্তায় রাস্তায়, একটি নিরাপদ জীবন এবং কাজের সন্ধানে...।"

 

সহায়ক সূত্র:

১. তেলাপোকা টিকে আছে, তার নিজস্ব অবয়বে...: http://www.ali-mahmed.com/2013/05/blog-post_17.html

Wednesday, May 15, 2013

কর্নেল তাহেরের নিধনপর্ব

আমাদের মুক্তিযুদ্ধে কর্নেল তাহেরের পাটা কেটে ফেলতে হয়, না-কেটে উপায় ছিল না কারণ পচন সমস্ত শরীরে ছড়িয়ে যাচ্ছিল।
এমন একজন অকুতোভয় শারীরিক অসুবিধাসম্পন্ন মানুষকে, একজন দুর্ধর্ষ মুক্তিযোদ্ধাকে, একটা স্বপ্নকে, সামরিক আদালতে (জেলখানার ভেতরেই যে আদালত) বিচারের প্রহসনের (যে আইনে কর্নেল তাহেরের মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছিল অথচ ওই অপরাধে আইনের বিধানে কোন মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার বিধান ছিল না।) নামে ফট করে মেরে ফেলা আমাদের দেশেই সম্ভব।
 
আসলে ভীরু, কাপুরুষদের এটা করা ব্যতীত উপায় ছিল না। তাহেরকে বাঁচিয়ে রাখাটা ছিল কাপুরুষদের জন্য খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। আফসোস, এই দেশ তার সেরা সন্তানদের কখনই ধরে রাখতে পারে না- অভাগা এক দেশ!
যে খন্দকার মোশতাকের সঙ্গে তিন বাহিনীর প্রধান তেলেতলে ভাষায় কথা বলতেন সেই মোশতাকের দিকে ক্রাচ তুলে রেডিও স্টেশনে কর্নেল তাহের বলেছিলেন:
'আপনি এখানে কেন...গেট আউট'।
এই হচ্ছেন তাহের!
 
হাবিলদার মেজর আবদুল হাই মজুমদার (অব.), যিনি সিপাহি বিদ্রোহে এক বছর সশ্রম কারাভোগী। তাঁর বর্ণনা থেকে:
"...নিজের ব্যাটিলিয়নে এসে দেখি জিয়াউর রহমান পুরো ব্রিগেড ফল-ইন করালেন। জিয়াইর রহমান ৮ নভেম্বর দুপুর ১২টায় ফার্স্ট বেঙ্গল গ্রাউন্ডের পূর্বদিকে একটা স্টেজে উঠলেন। সেখানে তিনি বললেন, '...আমি সৈনিক, আমি রাজনীতি বুঝি না। ৯০ দিনের মধ্যে জনগণের ক্ষমতা জনগণকে ফিরিয়ে দেব...'।
জিয়াউর রহমান সেখানে কোরান শরীফের উপর হাত রেখে শপথও করেছিলেন। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে ধড়পাকড় শুরু হয়ে গেল...।"
তাহেরকে যেভাবে ফাঁসি দেয়া হয় প্রকারন্তরে এ খুনেরই নামান্তর। রাষ্ট্রের সমস্ত শক্তি ব্যয় করা হয়েছিল এই খুনকে বৈধতা দেয়ার জন্য।
"যে ট্রাইব্যুনালে তাহেরের বিচার হয়েছিল ওটার প্রধান বিচারক ছিলেন কর্নেল ইউসুফ হায়দার। তিনি ছিলেন পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর একজন কোলাবরেটর। জিয়াউর রহমানের সঙ্গে বিশেষ সখ্যতাই ছিল এই বিচারকাজের জন্য নিযুক্ত হওয়ার তার একমাত্র যোগ্যতা! যখন এই ট্রাইব্যুনাল তাহেরের ফাঁসির আদেশ শোনায় তখন অন্যরা সবাই স্তম্ভিত, চিৎকার করে কাঁদছেন কিন্তু তাহের হাসছিলেন...।"
(মেজর জিয়াউদ্দিন আহমেদ (অব.) মামলায় ১২ বছর সশ্রম কারাভোগী)
এই প্রধান বিচারকের (যিনি একজন কর্নেল মাত্র) মেজর জলিল  প্রথম দিনই বলেছিলেন: 'You are a colonel or Dummy'? (আদালতের ৯ ধারাতে বলা আছে, এই আদালতের যিনি চেয়ারম্যান থাকবেন তার যোগ্যতা হতে হবে ন্যূনতম হাইকোর্টের একজন বিচারকের সমান)।
 
মামলা চলাকালীন সময়ে তাহের, জিয়াউর রহমান প্রসঙ্গে যখন বলেন, "There is only one example of such treachery in our history and that is of MIRJAFAR". কোর্ট একথা লিপিবদ্ধ করতে অস্বীকার করলে তাহের বিচারককে উদ্দেশ্য করে বলেন, 'I have seen many small people in my life but never one smaller than you.
 
১৭ জুলাই বিকেলবেলা মামলার রায় হয় আর ২১ জুলাই তাহেরের ফাঁসি কার্যকর করা হয়। মাত্র ২৪ ঘন্টার মধ্যে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি সায়েম মৃত্যুদন্ড অনুমোদনের কাগজে সই করেন। এমন উদাহরণ আর নেই!
"...যেসব কর্মকর্তা ৩ নভেম্বর জিয়া বিরোধী অভ্যুত্থানের পেছনে ছিলেন, তারা ছিলেন মুক্ত। আর যেসব ব্যক্তি ৭ নভেম্বর সাধারণ অভ্যূত্থান ঘটিয়েছিল, যে ঘটনায় জিয়া মুক্তি পেয়েছিলেন তারা বিচারে মৃত্যুদন্ডের সম্মুখীন।" (লরেন্স লিফশুলৎস)
বলার আর অপেক্ষা রাখে না সব কলকাঠিই নাড়ছিলেন জিয়াউর রহমান। যে জিয়াউর রহমানকে তাহের প্রাণে বাঁচিয়ে ছিলেন। জিয়া এর প্রতিদান এমন করেই দিয়েছিলেন!
 
কর্নেল তাহেরকে গ্রেফতার করার মাত্র ৭ দিনের মাথায় ছোট-ছোট তিন বাচ্চাকে সহ তাহেরের স্ত্রী লুৎফা তাহেরকে তাঁদের নারায়নগঞ্জ অফিসের বাসাটি ছেড়ে দিতে বলা হয়। তাহেরের কোনো পেনশন ছিল না, টাকা-পয়সাও রেখে যাননি। লুৎফা তাহের দিনের-পর-দিন কেবল সন্তানদের আলুভর্তা খাইয়ে বড় করেছেন মোহাম্মদপুরের আজম রোডের স্যাঁতস্যাঁতে দু-কামরার একটি বাড়িতে। 

তাহেরের ডেথ ওয়ারেন্ট ইস্যু করার মাত্র ৩ দিনের মাথায় তাহেরের ফাঁসি কার্যকর করা হয়। অথচ জেল কোড অনুযায়ী ডেথ ওয়ারেন্ট ইস্যুর ২১ দিন আগে মৃত্যুদন্ড কার্যকর করার বিধান নেই! জেল কোডে স্পষ্ট বলা আছে, "The date of the execution not less than 21 days, or more than 28 days."
আসলে এটা ছিল স্রেফ একটা খুন! কর্নেল তাহেরকে খুন করা হয়েছিল। এবং এই খুন করার ধরন, নমুনা দেখে আমি বিস্মিত হই! গা বাঁচিয়ে কী চমৎকার ভঙ্গিতেই না খুন করা যায়! অনর্থক আমরা সিরিয়াল কিলার রসু খাঁকে দোষ দেই!

তাহেরের বিচার প্রসঙ্গে প্রখ্যাত এডভোকেট গাজিউল হক ক্ষোভে ফেটে পড়েছিলেন:
"...কিলিং, এটা একটা কিলিং হলো। ...মৃত্যুর ক্ষণ, তারিখ ঠিক করে একটা লোককে জবাই করা হলো...।"
একজন কথিত জল্লাদ জনাব মোঃ সিরাজউদ্দিনের সাক্ষৎকার নেয়া হয়েছিল, মিনার মাহমুদের বিচিন্তা পত্রিকায়:
"প্রশ্ন: ফাঁসির মঞ্চের কোনও ব্যক্তির আচরণ কি আপনার হৃদয় ছুঁয়ে গেছে? যদি যায়, তবে সেই ব্যক্তিটি কে?
জল্লাদ সিরাজউদ্দিন: কর্নেল তাহের। ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়াইয়া তিনি সহজভাবে কথা বলেছেন। একটা বিপ্লবী কবিতা পইড়া শোনাইছেন ('...জন্মেছি, মৃত্যুকে পরাজিত করব বলে/ করেই গেলাম...' এই কবিতাটি লিখেছিলেন মেজর জিয়াউদ্দিন)। আশ্চর্য! তিনি নিজের হাতে যমটুপি পরছেন। নিজেই ফাঁসির দড়ি নিজের গলায় লাগাইছেন। আমার মনে হয় ফাঁসির মঞ্চে এমন সাহস দুনিয়ার আর কেউ দেখাইতে পারে নাই।"
৪২ মিনিট লেগেছিল তাহের নামের অগ্নিপুরুষের মৃত্যু হতে! ৪২ মিনিট ধরে ফাঁসির দড়িটা কাঁপছিল। জেলার, ডাক্তার উপস্থিত অন্যরা পর্যন্ত কেঁদে ফেলেছিলেন।

এডভোকেট জেড আই খান পান্না, সেসময় একই কারাগারে বন্দি ছিলেন। তাঁর জবানিতে:
"...এই বিচারকার্যের আইনজীবীদের শপথ করানো হয়েছিল বিচারকার্য সম্পর্কে তারা বাইরে মুখ খুলতে পারবেন না। এবং বিচারকার্য সমাধা হয়েছিল জেলখানার ভেতরে। এমন উদাহরণ পৃথিবীর কোথাও নেই।
...জেলের যে ডাক্তার ছিলেন তাহেরের ফাঁসির পূর্বে ব্লাডপ্রেশার মেপে দেখেন, প্রেশার একেবারেই নরমাল। ডাক্তার  প্রথমে ভেবেছিলেন তার কোথাও ভুল হচ্ছে, তখন কর্নেল তাহের সেই ডাক্তারকে হেসে বলেছিলেন, 'ডাক্তার, আমি একজন যোদ্ধা, একজন মুক্তিযোদ্ধা। ১৯৭১ সালেই আমার মৃত্যু হয়ে গেছে। তুমি আমার রক্তে কোনো ধরনের অ্যাবনর্মালিটি পাবে না...'।"
আমার কখনো কখনো সন্দেহ হয় তাহের নামের মানুষটা আসলে মানুষ ছিলেন কিনা, নাকি ছিলেন হয়তো-বা একটা রোবট! কারণ মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়ে অনেক বড়-বড় বীরপুরুষও কাবু হয়ে পড়েন বাহ্যজ্ঞান লোপ পায় অথচ তিনি কেবল অবিচলই থাকেননি, মৃত্যুকে নিয়ে রসিকতাও করেছেন।
অথচ এই মানুষটাই তাঁর স্ত্রীর কাছে চিঠি লেখেন, 'আমার আদরের লুৎফা...'। বা একটুখানি স্পর্শের জন্য স্ত্রীকে লেখা এই মানুষটারই কী হাহাকারভরা চিঠি, '...তোমার স্পর্শ, তোমার মৃদু পরশ শান্ত করুক আমাকে...'।

 
বা তাঁর এমন ছবি দেখে খানিকটা সংশয় কেটে যায়:
তাহেরের আপন বোন সালেহাও এই কারাগারেই বন্দি ছিলেন। তাহেরের ফাঁসির রায় হওয়ার পর তাহের লিখেছিলেন:
"বোন সালেহা হঠাৎ করে টয়লেটে গিয়ে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল। আমি সালেহাকে ডেকে এনে বললাম, 'তোমার কাছ থেকে এমন দুর্বলতা কখনই আশা করি না'।
সালেহা সামলে নিয়ে বলল, 'ভাইজান, আমি কাঁদি নাই। এই দেখো, আমি হাসছি'।
হাসিকান্নায় আমার এই বোনটি অপূর্ব। জেলখানার এই বিচারকক্ষে এসে এই প্রথম তার সাথে আমার দেখা। এই বোনটিকে আমার ভীষণ ভাল লাগে। কোন জাতি এর মত বোন সৃষ্টি করতে পারে?।"

(এটাই ছিল পরিবারকে লেখা কর্নেল তাহেরের শেষ চিঠি)
*মানুষ দেবতা না, সে ভুল করতেই পারে। তাহেরের ভুল বা মতাদর্শ নিয়ে আলোচনা, হতেই পারে। আমার কাছে সেটা এই লেখায় গুরুত্বপূর্ণ না, সেটা ভিন্ন, ভিন্ন তর্কের বিষয়। কিন্তু কর্নেল তাহের নামের আগুনমানুষটাকে স্পর্শ করার ক্ষমতা আমাদের নেই!
 
কর্নেল তাহেরের যে বিষয়টা আমাকে প্রচন্ড আলোড়িত করে সেটা হচ্ছে তাঁকে খুন করার ভঙ্গিটা! এমন না কেউ ফট করে গুলি করে মেরে ফেলল। ঠান্ডা মাথায় খুন- রসিয়ে রসিয়ে খুন; এটা কোনো মানুষের পক্ষে সম্ভব না, সম্ভব কেবল দানবের পক্ষে।
এবং এই খুনটা করার জন্য রাষ্ট্রযন্ত্রের যত ধরনের শক্তি আছে সবই প্রয়োগ করা হয়েছিল। তারচেয়েও যেটা আরও ভয়ংকর সেটা হচ্ছে, সত্যটা ইরেজার দিয়ে মুছে ফেরার চেষ্টা করা হয়েছিল। যথারীতি হিস্ট্রি রিপিট...। এবং খুনের দাগ মুছে ফেলা যায় না। সময় এখানে কোনো বিষয় না।
 

আর আমি এই প্রজন্মের প্রতি অসম্ভব মুগ্ধ এই কারণে, এরা বাপকে ছাড়ে না, খুনি কোন ছার!  

Wednesday, May 8, 2013

এ এক ঘোরতর অন্যায়...

শাপলা চত্বরের মত অতি ব্যস্ত এলাকায় সমাবেশ করার অনুমতি দিয়েছে নাকি ডিএমপি। কিন্তু ডিএমপিকে এখানে সভার করতে দেওয়ার অনুমতি কে দিল?
এমন একটি অতি ব্যস্ত রাস্তা, বাংলাদেশ ব্যাংকসহ অসম্ভব গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা যেখানে; সবচেয়ে বড়ো কথা হলো এমন অসম্ভব ব্যস্ত রাস্তা বন্ধ করে সভা-সমাবেশ করার অনুমতি দেওয়ার বৈধতা এই দেশে কারো আছে কি না! আইন এটা সমর্থন করে কি না? এমন কোনো আইন দেশে থেকেও থাকলে তা একটা কালো আইন। যথাসম্ভব দ্রুত বদলাতে হবে সে আইন।
এটা কী এই দেশের একটা 'কলচর' হয়ে যাচ্ছে, যত ব্যস্ত রাস্তা আছে সেই রাস্তার চারপাশ বন্ধ করে লোকজনেরা দেশউদ্ধার-ধর্মউদ্ধার করবেন? সেটা আবার সরকার বৈধতাও দেবে! আশ্চর্য...!

তারচেয়ে আমি বলি কি, আমরা জনগণ সরকারকে চাঁদা তুলে দেব নে, আপনারা স্টেডিয়ামের মত একটা জিনিস বানিয়ে দিন। ওখানে কেউ দেশউদ্ধার করবেন, করুন। কেউ ধর্মউদ্ধার করবেন, করুন। কেউ নাচবেন, নাচুন। কেউ বাজনা বাজাবেন, বাজান। ওখানে গলাবাজি, কোলাকুলি, চুলাচুলি, কস্তাকস্তি, ধস্তাধস্তি করেন, কথা দিচ্ছি আমরা আটকাতে যাব না।
প্রয়োজন মনে করলে ওখানে ফ্লাডলাইটের ব্যবস্থাও থাকবে তবে লাইটের মূল স্তম্ভটা আমরা স্টেডিয়ামের বাইরে রাখব। আপনারা ঝাঁকাঝাঁকি করে ফেলে দেবেন তা হবে না। কারণ এটা রানা প্লাজা না, জনগণ প্লাজা...

ওহ, গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয় ভুলে গিয়েছি! আমাদের আইনপ্রণেতা সংসদ সদস্যদের কথা। মহান সংসদকে এঁদের অনেকে যে প্রকারে (অ)মহান করেন তার প্রেক্ষিতে এঁদের জন্যও এই জায়গাটি কাজে লাগবে।
৫ মার্চ ২০১০ সালের ঘটনা। আমাদের বর্তমান প্রেসিডেন্ট সাহেব তখন স্পিকার পদে। তিনি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছিলেন, "...আমি একটা কথা বলে দিতে চাই, অসংসদীয় ও আক্রমণাত্মক ভাষা ব্যবহার করলে মাইক বন্ধ হয়ে যাবে। আর ফাইটিং বা রেসলিং করতে চাইলে পল্টনে চলে যান। সংসদের বাইরেও মাঠ আছে। গায়ে তেল মেখে আন্ডারওয়্যার পরেও সেখানে চলে যেতে পারেন...।"

পল্টন-ফল্টন না, এই স্টেডিয়ামের মত জায়গাটায় সেই সমস্ত সংসদ সদস্য এসে গায়ে তেল মেখে আন্ডারওয়্যার পরে কুস্তি করছেন। এমন একটা দৃশ্য কল্পনা করে মনটা এমনিতেই ভাল হয়ে যায়। টিকেটের ব্যবস্হাও যদি করা হয়, অন্যদের কথা জানি না তবে আমি টিকেট কেটে হলেও যাব। আহ, সে এক দৃশ্য হবে বটে...!

Tuesday, May 7, 2013

এই দেশের বিপুল সংখ্যক মানুষদের বঞ্চিত, দূরে রেখে...

আজকের আমার লেখার বিষয়টা ভিন্ন। অনেক দিন থেকে লিখব লিখব করে বিষয়টা নিয়ে লেখা হয়ে উঠছিল না। আজও লিখতাম না কিন্তু...। এখন এটা নিয়ে লেখা বোকামি ব্যতীত আর কিছুই না। লোকজন তো আজকাল ট্যাগের নামে বিভিন্ন সার্টিফিকেট বিলি করে বেড়ান। যাগ গে, ট্যাগের সার্টিফিকেট দিয়ে কী করব, জুকারবার্গ কেনে কিনা কে জানে!

দুধে পানি মেশানো চাবুক মেরেও বন্ধ করা যায় না, দুধের যোগান বাড়িয়ে দিতে হয়। নইলে পানির পরিমাণ কেবল বাড়তেই থাকে। তেমনি যেমনটা এই দেশের বিপুল সংখ্যক মানুষদের বঞ্চিত, দূরে রেখে...।

হুজুরদের নিয়ে আলোচনায় যে সুখ তা অন্যত্র কোথায়। অবশ্য আমরা হুজুর কমই বলি। বলি মোল্লা বা কাঠমোল্লা। কিন্তু আমি কখনই এদেরকে ধর্মীয় শিক্ষক বলতে শুনিনি। কেন, কে জানে! অথচ এই মানুষটাকেই আমাদের অনেকের জন্ম-মৃত্যুর পর প্রয়োজন হয়। তখন আবার আমরা মাখনের মত গলে যাই।

ভাল কথা, আমরা কি এটা জানি, আমাদের দেশের অধিকাংশ ইমাম-মোয়াজ্জিনের (সম্মানি বা বেতন যে নামই বলা হোক না কেন) বেতন কত? আমি বায়তুল মোকারমের মত মসজিদের কথা বলছি না। অধিকাংশ মসজিদের, বিশেষ করে গ্রাম, মফঃস্বলের? ১৫০০/ ২০০০/ ২৫০০। এর উপর খুব কম উদাহরণই আছে।

আচ্ছা, আমাকে কী কেউ অন্য যে-কোনো পেশার মানুষকে এনে দিতে পারবেন যিনি এই টাকায় সারাটা মাস কাজ করবেন? তো, এই টাকায় একালে একজন মানুষ চলেন কেমন করে? কেবল চাউল কিনে কাচা চিবিয়ে খেলেও তো চলার কথা না! অনেকে বলবেন, হুজুররা তো তিন বেলা অন্যের বাড়িতে খান। তা খান। পনেরো দিন এখানে তো পনেরো ওখানে। কেন রে ভাই, মানুষটা কী ভিক্ষুক!
এটা সত্য, মিলাদ পড়িয়ে বা খতম পড়িয়ে তিনি টাকা পান। এও সত্য, স্বজনের চোখের জল শুকিয়ে যায় কিন্তু হুজুরের চোখ তখন চাপকল।
এই সব অধিকাংশ সফেদ মানুষকে আমরা কালে কালে ধূর্ত বানিয়ে ফেলি। তখন তিনি আবার ফতোয়া ঝাড়েন।

কয়জন হুজুরকে দেখেছেন তাঁর পরিবার-পরিজন নিয়ে বসবাস করতে? কয়েক মাস পর সুযোগ পেলে তিনি বাড়িতে যাবেন। ধর্মীয় পুস্তকে বলা হবে, সমস্যা হলে বিবির কাছে যান কিন্তু বিবি কোথায়? একজন কবি, একজন আঁতেল বিবি না-থাকলে 'টিবির' কাছে যেতে সমস্যা নেই। তিনি অতি আধুনিক হলে সেটা আবার জনে জনে বলে বেড়াবেন কিন্তু হুজুরের সে সুযোগ কোথায়? ফল যা হওয়ার তাই হয়- তখন সাত গ্রামে ঢিঢি পড়ে যায়। ছ্যা-ছ্যা-ছ্যা, হুজুর এই কাম করছে! আহা, হুজুর তো মানুষ না, অন্য ভুবন থেকে এসেছেন ধর্মউদ্ধার করতে।
এই উদাহরণগুলো দিলাম এই কারণে- আমরা ইচ্ছা করে, জেনেশুনে এই সমস্ত মানুষকে অন্ধকারে ঠেলে দেই আবার এই আমরাই হইচই করি।
কয়জন হুজুরকে দেখেছেন পত্রিকা পড়তে, রেডিও শুনতে? যে মানুষটার দিনদুনিয়ার খবরই নাই সেই মানুষটা সংশোধন করবেন আমাদেরকে, এই আশায় থাকি আমরা! আবার রমজানে হুজুর মুড়ি বিক্রি করতে পারবেন না কারণ এতে আমাদের যে আঁতে লাগে বড়।

মাদ্রাসার ছেলেদের নিয়ে আমরা খুব রসিয়ে রসিয়ে আলোচনা করি। এরা এই, এরা সেই- এরা হেন, এরা তেন! কিন্তু আমরা কি খানিক খোঁজ নিয়ে দেখেছি অধিকাংশ মাদ্রাসায় এঁরা কী মানবেতর জীবন-যাপন করে? খাবারের কী কষ্ট করে! এ সত্য, দাওয়াতে এরা ভালমন্দ খায় কিন্তু অন্য দিনগুলো? তারউপর ছিনতাই হয়ে যায় এদের শৈশব। অধিকাংশ মাদ্রাসায় এদের খেলার কোনো সুযোগ নেই। আমার নিজের চোখে দেখা, স্পঞ্জের স্যান্ডেল দিয়ে চুরি করে ব্যাডমিন্টন খেলার অপচেষ্টা করছিল!
লাখ টাকা দামের প্রশ্ন, এরা মাদ্রাসায় কেন পড়ে? ওটা বৃহৎ পরিসরের আলোচনা। কেবল ছোট্ট করে বলি, কেউ শেক্সপিয়র পড়েন, কেউ কোরান শরীফ, যার যার অভিরুচি। কোরান শরীফ পড়া নিয়ে কারো আপত্তি থাকতেই পারে, আবার কারো শেক্সপীয়র নিয়ে! লিও তলস্তয়ের ভাষায়, "শেক্সপিয়র পড়ে আমি ক্রমাগত, ক্রমাগত বিতৃষ্ণা আর বিরক্তির মুখোমুখি হয়েছি"।

সবচেয়ে বড়ো কথা হচ্ছে, ঢাকার একটি অংশ যেমন সমগ্র ঢাকা না তেমনি সমগ্র বাংলাদেশও ঢাকা না, যে গোটা দেশের লোকজনেরা কেবল তাদের মত করেই ভাববে। (ঢাকার উদাহরণটা এখানে এই কারণে- আমরা মনে করি, গোটা দেশ ঘুরপাক খায় ঢাকাকে কেন্দ্র করে। সত্যটা হচ্ছে, এটা সমগ্র বাংলাদেশের চিত্র না। সেই কারণে ভোটের সময় হিজাব লাগে, টুপি লাগে।)

আজ ভোরে মামলার একটা কাজে আমি যাচ্ছিলাম জেলা শহরে। ঝুম বৃষ্টি। শেয়ারের স্কুটারে আমার সহযাত্রী মাদ্রাসার এক ছেলে। আমার ঔচিত্য বোধ কম। আগ্রহ বোধ করলে যে-কারো সঙ্গে আলাপ চালিয়ে যেতে সমস্যা নাই, কেবল মানুষটা অতিরিক্ত জ্ঞানী না-হলেই হয়! এই ছেলে যাচ্ছে হুজুর তাকে একটা দায়িত্ব দিয়েছেন এটার কারণে। দায়িত্বের বিস্তারিত ও আমাকে বলেনি।

আমি তার কাছে জানতে চাইলাম, তোমাদের আসলে সমস্যা কোথায়?
সে আমাকে বলল, আমাদের ধর্ম নিয়ে খুব খারাপ কাজ করার চেষ্টা হয়েছে।
আমি জানতে চাইলাম, কেমন?
সে বলল, একজন বলেছে, মসজিদ ভেঙ্গে নাকি বাথরুম (এখানে আঞ্চলিক ভাষাটা আমি খানিক বদলে দিলাম) করা হবে।
আমি এমন হতবাক হলাম। সামলে উঠতে খানিক সময় লাগল। বললাম, এটা তো খুবই খারাপ, জঘণ্য কথা। কে বলেছে এই খারাপ কাজটা করবে?
সে আমাকে একটা নাম বলল। আমি বুঝে গেলাম ওর তথ্যের বিভ্রান্তি কোথায়। হাবিজাবি আরও অনেক কথাই হলো তার সঙ্গে এখন এখানে এই সব বলাটা জরুরি না। তো, এই হচ্ছে অবস্থা...।

অনেকে বলেন, মাদ্রাসাখাতে সরকারের বিনিয়োগ কমিয়ে বা বন্ধ করে দেয়া হোক। আমি উল্টো মত পোষণ করি। আমি মনে করি, এই বিনিয়োগ কয়েক গুণ বাড়িয়ে দেয়া হোক। প্রতিটি মাদ্রাসা এমপিও ভুক্ত হবে, ধর্মীয় শিক্ষক সরকারের কাছ থেকে বেতন পাবেন। ওখানে কেবল আরবিই শেখানো হবে না। কম্পিউটার থাকবে। এরা ইন্টারনেট ব্যবহার করবে- এরা নিজেরাই জানবে ধর্ম নিয়ে যেমন কুৎসিত কথা বলা হয় তেমনি চমৎকার কথাও লেখা হয়। এরা চোখ বড় বড় করে মাল্টিমিডিয়ায় মুক্তিযুদ্ধের অসাধারণ সব বীরত্বের প্রামাণ্যচিত্র দেখবে। লাইব্রেরিতে শিক্ষামূলক বই থাকবে। এরা অতি অখ্যাত প্রকাশনীর সূত্রবিহীন জয়ীফ হাদিসই কেবল পড়বে না। সহীহ এমন হাদীসও পড়বে:
"আমি যখন কোনো ধর্মীয় বিষয়ে তোমাদের জন্য কোনো বক্তব্য রাখি, তোমরা তদনুসারে ধর্মের কাজ করবে কিন্তু আমি যখন দুনিয়াদারীর ব্যাপারে তোমাদের কোনো কথা বলি, তখন মনে রাখবে যে, দুনিয়াদারীর ব্যাপারে তোমাদের নিকটেই উত্তম জ্ঞান রয়েছে"। -প্রিন্সিপলস (আল-ওসুল), আল সারাকসী

নইলে যেটা হবে, এই হুজুর, মাদ্রাসার ছাত্ররা কখনও জামায়েতে ইসলামীর পক্ষে, কখনও হেফাজতি ইসলামের ঢাল হিসাবে বা আগামীতে 'ইসলাম বাঁচাও' এমন কোনো সংগঠনের নামে ব্যবহৃত হবেন, হতেই থাকবেন। আজ চাঁদে কোন মহাপুরুষকে(!) দেখা গেছে বলে এরা লাফিয়ে বেরিয়ে আসেন আগামীতে সূর্যে কাউকে দেখা গেলে মুক্তকচ্ছে ছুটবেন। সঙ্গে থাকবে নাঙ্গা তরবারি, গজারি লাঠি।
আর এমনিতে এদের শরীর থেকে যে রক্ত বের হয়, এদের যে নিথর প্রাণহীন দেহটা পড়ে থাকে; হতে পারত এটা আমার স্বজনের রক্ত, ঠান্ডা শরীর। কোনো-না-কোনো প্রকারে এরা তো আমাদেরই স্বজন, এই দেশেরই সন্তান। এদের মা যখন হাহাকার করে কাঁদেন তখন কান্নাটা অন্য রকম হয় বুঝি! নাকি আমাদের মা অন্য ভঙ্গিতে কাঁদেন?

সরকারের আজ তিন উল্লাস করছেন যে এদেরকে হঠিয়ে দেয়া গেছে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে জড়শুদ্ধ এদেরকে হঠানো যাবে না। এদের খাটো করে দেখার অবকাশ নাই কারণ আমাদের সবার প্রাণের মায়া আছে কিন্তু এদের নাই। কেন নাই এটা বলার আবশ্যকতা আছে বলে মনে করি না। কালে কালে এরা হবে একেকটা চলমান হিউম্যান বম্ব- তখন এদের রুখে দেয় এই সাধ্য কার...।


সহায়ক সূত্র:
১. ইমাম সাহেব, আমাদের বাতিওয়ালা: http://www.ali-mahmed.com/2009/06/blog-post_4503.html      

Wednesday, May 1, 2013

মা এবং তাঁর বাবুটা!

মা-র বুকটা কেমন ভার হয়ে আছে। শ্বাস নিতে পারছেন না। আহ, পৃথিবীতে এতো বাতাস, এতো বাতাস! ও খোদা, খোদো রে, একটুখানি বাতাস দিলে কী হয়? রহম করো খোদা, রহম করো, আমার এই বাবুটা যে এই 'পিতিবীটা' এখনও দেখে নাই; আল্লা, তারে তুমি বাঁচায়া রাখো। মা বাতাসের জন্য হাঁ করছেন কিন্তু বাতাস কোথায়? কিন্তু তবুও মা তাঁর অদেখা বাবুটার সঙ্গে কথা চালিয়ে যান, 'কষ্ট হচ্ছে, সোনা'?
বাবুটা কষ্টের কী বোঝে! ও তো তার প্রয়োজনের সব কিছু নিংড়ে নিচ্ছে মার শরীর থেকে। বাবুটা মার কথার ধারেকাছেও গেল না। মার পেটে আলতো এক লাথি মেরে বলল, 'মা-মা, অ মা, দেখো তোমায় কেমন ছুঁয়ে দিচ্ছি'।

হাসিখুশি মা-টার মন আজ ভারী বিষণ্ন, তিনি জেনে গেছেন সময় ফুরিয়ে আসছে, দ্রুত। অন্য সময় খোকার এই চক্রাকারে ঘুরপাক খাওয়ার চেষ্টা করা বা লাথি মারার নামে ছুঁয়ে দেয়ার তার জন্য কষ্টকর খেলাটা কী উপভোগ্যই না মনে হতো। কিন্তু আজ মোটেও ভাল লাগছে না! ক্ষণে-ক্ষণে অচেনা, অজানা এক কষ্ট পাক খেয়ে উঠছে।

বাবুটা এমন অবুঝ হয়েছে কেন! আহারে-আহারে, বাবুরই বা কী দোষ, কীই বা বয়স ওর, ও তো এখনও এই পৃথিবীর মুখই দেখেনি! মা কঠিন কিছু কথা বলতে গিয়ে নিজেকে সামলে নিলেন। প্রাণপণ চেষ্টায় গলার স্বর স্বাভাবিক রেখে বললেন, 'বাবু, যাও, তোমার খেলা খেলো, কিন্তু ব্যথা দিও না, সোনা। আমি শ্বাস নিতে পারছি নারে সোনা, সোনা রে। শ্বাস না-নিলে তোকে বাঁচাব কেমন করে'?
খোকা খানিক স্থির হয়ে ঝলমলে মুখে বলল, 'উহুঁ, আমার যে কেবল তোমার সাথে এমন খেলা খেলতেই ভাল লাগে, তুমি যে আমার লক্ষী মামইন্যা। খোকা এবার তার স্বরচিত ছড়া ক্রমাগত সুর করে বলতে থাকল, মামইন্না-মামইন্না, পিঁড়ি থেকে নামইন্না'।

খোকা আজকাল বড়ো ছড়াকার হয়েছে। তার এইসব স্বরচিত ছড়ার কোনো আগামাথা নাই। অন্য সময় হলে মা হাঁ করে খোকার এইসব ছড়া শোনেন। কিন্তু আজ মোটেও এসব টানছে না। মা রাগ-রাগ গলায় বললেন, বাবু, তোমাকে একবার একটা কথা বললে কানে যায় না, বললাম না, খেলা করো। আর শোনো, তোমাকে বলিনি, যেখানে আমি কাজ করতাম এটা ভেঙ্গে পড়েছে। আমরা আটকে গেছি।

খোকার এতক্ষণে হুঁশ হলো। মার বিবর্ণ মুখটা আঁচ করার চেষ্টা করছে। আহা-আহা, মার কীসের কষ্ট! ইশ, কি করলে মার কষ্ট কমে এটা জানলে বেশ হতো কিন্তু খোকা তো এটা জানেই না ছাই! কথা ঘুরাবার জন্য বলল, 'মা, আমাদেরকে কী কেউ উদ্ধার করতে আসবে'?
মা অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে বললেন, 'জানি না। মনে হয় না। পাগলা তুই বুঝবি না, ক-পয়সাই বা আমাদের দাম'!
খোকা এই সব জটিল বিষয় বোঝে না কিন্তু অজান্তেই শিউরে উঠে বলল, 'ইশ, মানুষেরা কী নিষ্ঠুর, না মা'?
মা হাহাকার করে বললেন, 'নারে সোনা, এভাবে বলিস না, সবাই না। কেউ-না-কেউ আমাদের জন্য কাঁদবে ঠিকঠিক, আসবে দেখিস'।
মা এই মিথ্যাচারের জন্য আল্লাহর কাছে মাফ চাইলেন। তিনি জানেন তাদেরকে বাঁচাতে কেউ আসবে না।

এক্ষণ মার বুকে কেমন চাপ চাপ ব্যথা। দৃষ্টি কেমন অস্বচ্ছ হয়ে আসছে। তাঁর হাতে...এটা কী চোখের ভুল, পানি ...? এমন হচ্ছে কেন, নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে কেন? মা নিমিষেই বুঝে ফেললেন, বোঝার আর বাকি রইল না। এটা তাঁর নিজের গায়ের রক্ত। খোকা বেরিয়ে আসছে তাঁর নিষেধ উপেক্ষা করে। মা অবশিষ্ট শক্তি জড়ো করে চিৎকার করলেন, 'না বাবু, না, তুই পেটের ভেতরেই থাক রে, বাপ। এখানে বাতাস নাই-বাতাস নাই, বাইরে এলে তুই নিজে-নিজে শ্বাস নিতে পারবি না'।

মা বুঝতে পারছেন, অনেক দেরি হয়ে গেছে! খোকা এসেছে ঠিকই কিন্তু চলেও যাচ্ছে অজানার দেশে, যে দেশ থেকে কেউ আর ফেরে না। দেখো দেখি বাবুটার কান্ড, পাগলুটা কেমন বারবার পিটপিট তাকাচ্ছে, এই বুঝি মা পিছু ডাকল। বাবুটা একদম একটা পাগলু হয়েছে! মা পিছু ডাকলেই তুই থেকে যাবি বুঝি!

মার যেটুকু প্রাণশক্তি অবশিষ্ট ছিল তা ধরে রাখার কোনো আগ্রহই আর তাঁর থাকল না। হাল ছেড়ে দিলেন, ক্রমশ নিস্তেজ হয়ে আসছে তাঁর চোখ। চারপাশ কেমন আচ্ছন্ন। এরমধ্যেই খানিক চেতনা দিয়ে বুঝতে পারলেন, মানুষের সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছে, তাঁকে উদ্ধারের আপ্রাণ চেষ্টা করছে এরা। মাটা এবার ছোট-ছোট শ্বাস নিচ্ছেন, দ্রুত। তিনি বুঝতে পারছেন তাঁর নিজেরও সময় ফুরিয়ে আসছে। কষ্ট, বড় কষ্ট! কিন্তু তীব্র অমানুষিক, অন্য ভুবনের কষ্ট নিমিষেই লোপ পেল। কী এক ভাল লাগা ছড়িয়ে পড়ল সমস্ত শরীরে...তিনি তাঁর সন্তানকে মিথ্যা আশ্বাস দেননি যে, তাদেরকে উদ্ধার করতে কেউ আসবে না...।

তাঁর মাথা খারাপের মতো হয়ে গেল, একই শব্দ বারবার আউড়ে যাচ্ছেন। অ সোনা, অ পাগলু, ফিরে আয়-ফিরে আয়, শুনে যা তোকে বলেছিলাম না কেউ-না-কেউ আমাদের জন্য আসবে। দেখলি-দেখলি আমি মিথ্যা বলিনি...


*এই লেখাটি আমি উৎসর্গ করছি তাঁদের, যে দুজন মা ধসেপড়া ভবন রানাপ্লাজায় আটকে ছিলেন এবং ওখানেই সন্তানের জন্ম দিয়েছিলেন। অবশেষে অবশ্য মা-সন্তান এঁরা সবাই মারা যান...।