মা-র বুকটা কেমন ভার হয়ে আছে। শ্বাস নিতে পারছেন না। আহ, পৃথিবীতে এতো
বাতাস, এতো বাতাস! ও খোদা, খোদো রে, একটুখানি বাতাস দিলে কী হয়? রহম করো
খোদা, রহম করো, আমার এই বাবুটা যে এই 'পিতিবীটা' এখনও দেখে নাই; আল্লা,
তারে তুমি বাঁচায়া রাখো। মা বাতাসের জন্য হাঁ করছেন কিন্তু বাতাস কোথায়?
কিন্তু তবুও মা তাঁর অদেখা বাবুটার সঙ্গে কথা চালিয়ে যান, 'কষ্ট হচ্ছে,
সোনা'?
বাবুটা কষ্টের কী বোঝে! ও তো তার প্রয়োজনের সব কিছু নিংড়ে নিচ্ছে মার শরীর থেকে। বাবুটা মার কথার ধারেকাছেও গেল না। মার পেটে আলতো এক লাথি মেরে বলল, 'মা-মা, অ মা, দেখো তোমায় কেমন ছুঁয়ে দিচ্ছি'।
হাসিখুশি মা-টার মন আজ ভারী বিষণ্ন, তিনি জেনে গেছেন সময় ফুরিয়ে আসছে, দ্রুত। অন্য সময় খোকার এই চক্রাকারে ঘুরপাক খাওয়ার চেষ্টা করা বা লাথি মারার নামে ছুঁয়ে দেয়ার তার জন্য কষ্টকর খেলাটা কী উপভোগ্যই না মনে হতো। কিন্তু আজ মোটেও ভাল লাগছে না! ক্ষণে-ক্ষণে অচেনা, অজানা এক কষ্ট পাক খেয়ে উঠছে।
বাবুটা এমন অবুঝ হয়েছে কেন! আহারে-আহারে, বাবুরই বা কী দোষ, কীই বা বয়স ওর, ও তো এখনও এই পৃথিবীর মুখই দেখেনি! মা কঠিন কিছু কথা বলতে গিয়ে নিজেকে সামলে নিলেন। প্রাণপণ চেষ্টায় গলার স্বর স্বাভাবিক রেখে বললেন, 'বাবু, যাও, তোমার খেলা খেলো, কিন্তু ব্যথা দিও না, সোনা। আমি শ্বাস নিতে পারছি নারে সোনা, সোনা রে। শ্বাস না-নিলে তোকে বাঁচাব কেমন করে'?
খোকা খানিক স্থির হয়ে ঝলমলে মুখে বলল, 'উহুঁ, আমার যে কেবল তোমার সাথে এমন খেলা খেলতেই ভাল লাগে, তুমি যে আমার লক্ষী মামইন্যা। খোকা এবার তার স্বরচিত ছড়া ক্রমাগত সুর করে বলতে থাকল, মামইন্না-মামইন্না, পিঁড়ি থেকে নামইন্না'।
খোকা আজকাল বড়ো ছড়াকার হয়েছে। তার এইসব স্বরচিত ছড়ার কোনো আগামাথা নাই। অন্য সময় হলে মা হাঁ করে খোকার এইসব ছড়া শোনেন। কিন্তু আজ মোটেও এসব টানছে না। মা রাগ-রাগ গলায় বললেন, বাবু, তোমাকে একবার একটা কথা বললে কানে যায় না, বললাম না, খেলা করো। আর শোনো, তোমাকে বলিনি, যেখানে আমি কাজ করতাম এটা ভেঙ্গে পড়েছে। আমরা আটকে গেছি।
খোকার এতক্ষণে হুঁশ হলো। মার বিবর্ণ মুখটা আঁচ করার চেষ্টা করছে। আহা-আহা, মার কীসের কষ্ট! ইশ, কি করলে মার কষ্ট কমে এটা জানলে বেশ হতো কিন্তু খোকা তো এটা জানেই না ছাই! কথা ঘুরাবার জন্য বলল, 'মা, আমাদেরকে কী কেউ উদ্ধার করতে আসবে'?
মা অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে বললেন, 'জানি না। মনে হয় না। পাগলা তুই বুঝবি না, ক-পয়সাই বা আমাদের দাম'!
খোকা এই সব জটিল বিষয় বোঝে না কিন্তু অজান্তেই শিউরে উঠে বলল, 'ইশ, মানুষেরা কী নিষ্ঠুর, না মা'?
মা হাহাকার করে বললেন, 'নারে সোনা, এভাবে বলিস না, সবাই না। কেউ-না-কেউ আমাদের জন্য কাঁদবে ঠিকঠিক, আসবে দেখিস'।
মা এই মিথ্যাচারের জন্য আল্লাহর কাছে মাফ চাইলেন। তিনি জানেন তাদেরকে বাঁচাতে কেউ আসবে না।
এক্ষণ মার বুকে কেমন চাপ চাপ ব্যথা। দৃষ্টি কেমন অস্বচ্ছ হয়ে আসছে। তাঁর হাতে...এটা কী চোখের ভুল, পানি ...? এমন হচ্ছে কেন, নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে কেন? মা নিমিষেই বুঝে ফেললেন, বোঝার আর বাকি রইল না। এটা তাঁর নিজের গায়ের রক্ত। খোকা বেরিয়ে আসছে তাঁর নিষেধ উপেক্ষা করে। মা অবশিষ্ট শক্তি জড়ো করে চিৎকার করলেন, 'না বাবু, না, তুই পেটের ভেতরেই থাক রে, বাপ। এখানে বাতাস নাই-বাতাস নাই, বাইরে এলে তুই নিজে-নিজে শ্বাস নিতে পারবি না'।
মা বুঝতে পারছেন, অনেক দেরি হয়ে গেছে! খোকা এসেছে ঠিকই কিন্তু চলেও যাচ্ছে অজানার দেশে, যে দেশ থেকে কেউ আর ফেরে না। দেখো দেখি বাবুটার কান্ড, পাগলুটা কেমন বারবার পিটপিট তাকাচ্ছে, এই বুঝি মা পিছু ডাকল। বাবুটা একদম একটা পাগলু হয়েছে! মা পিছু ডাকলেই তুই থেকে যাবি বুঝি!
মার যেটুকু প্রাণশক্তি অবশিষ্ট ছিল তা ধরে রাখার কোনো আগ্রহই আর তাঁর থাকল না। হাল ছেড়ে দিলেন, ক্রমশ নিস্তেজ হয়ে আসছে তাঁর চোখ। চারপাশ কেমন আচ্ছন্ন। এরমধ্যেই খানিক চেতনা দিয়ে বুঝতে পারলেন, মানুষের সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছে, তাঁকে উদ্ধারের আপ্রাণ চেষ্টা করছে এরা। মাটা এবার ছোট-ছোট শ্বাস নিচ্ছেন, দ্রুত। তিনি বুঝতে পারছেন তাঁর নিজেরও সময় ফুরিয়ে আসছে। কষ্ট, বড় কষ্ট! কিন্তু তীব্র অমানুষিক, অন্য ভুবনের কষ্ট নিমিষেই লোপ পেল। কী এক ভাল লাগা ছড়িয়ে পড়ল সমস্ত শরীরে...তিনি তাঁর সন্তানকে মিথ্যা আশ্বাস দেননি যে, তাদেরকে উদ্ধার করতে কেউ আসবে না...।
তাঁর মাথা খারাপের মতো হয়ে গেল, একই শব্দ বারবার আউড়ে যাচ্ছেন। অ সোনা, অ পাগলু, ফিরে আয়-ফিরে আয়, শুনে যা তোকে বলেছিলাম না কেউ-না-কেউ আমাদের জন্য আসবে। দেখলি-দেখলি আমি মিথ্যা বলিনি...
*এই লেখাটি আমি উৎসর্গ করছি তাঁদের, যে দুজন মা ধসেপড়া ভবন রানাপ্লাজায় আটকে ছিলেন এবং ওখানেই সন্তানের জন্ম দিয়েছিলেন। অবশেষে অবশ্য মা-সন্তান এঁরা সবাই মারা যান...।
বাবুটা কষ্টের কী বোঝে! ও তো তার প্রয়োজনের সব কিছু নিংড়ে নিচ্ছে মার শরীর থেকে। বাবুটা মার কথার ধারেকাছেও গেল না। মার পেটে আলতো এক লাথি মেরে বলল, 'মা-মা, অ মা, দেখো তোমায় কেমন ছুঁয়ে দিচ্ছি'।
হাসিখুশি মা-টার মন আজ ভারী বিষণ্ন, তিনি জেনে গেছেন সময় ফুরিয়ে আসছে, দ্রুত। অন্য সময় খোকার এই চক্রাকারে ঘুরপাক খাওয়ার চেষ্টা করা বা লাথি মারার নামে ছুঁয়ে দেয়ার তার জন্য কষ্টকর খেলাটা কী উপভোগ্যই না মনে হতো। কিন্তু আজ মোটেও ভাল লাগছে না! ক্ষণে-ক্ষণে অচেনা, অজানা এক কষ্ট পাক খেয়ে উঠছে।
বাবুটা এমন অবুঝ হয়েছে কেন! আহারে-আহারে, বাবুরই বা কী দোষ, কীই বা বয়স ওর, ও তো এখনও এই পৃথিবীর মুখই দেখেনি! মা কঠিন কিছু কথা বলতে গিয়ে নিজেকে সামলে নিলেন। প্রাণপণ চেষ্টায় গলার স্বর স্বাভাবিক রেখে বললেন, 'বাবু, যাও, তোমার খেলা খেলো, কিন্তু ব্যথা দিও না, সোনা। আমি শ্বাস নিতে পারছি নারে সোনা, সোনা রে। শ্বাস না-নিলে তোকে বাঁচাব কেমন করে'?
খোকা খানিক স্থির হয়ে ঝলমলে মুখে বলল, 'উহুঁ, আমার যে কেবল তোমার সাথে এমন খেলা খেলতেই ভাল লাগে, তুমি যে আমার লক্ষী মামইন্যা। খোকা এবার তার স্বরচিত ছড়া ক্রমাগত সুর করে বলতে থাকল, মামইন্না-মামইন্না, পিঁড়ি থেকে নামইন্না'।
খোকা আজকাল বড়ো ছড়াকার হয়েছে। তার এইসব স্বরচিত ছড়ার কোনো আগামাথা নাই। অন্য সময় হলে মা হাঁ করে খোকার এইসব ছড়া শোনেন। কিন্তু আজ মোটেও এসব টানছে না। মা রাগ-রাগ গলায় বললেন, বাবু, তোমাকে একবার একটা কথা বললে কানে যায় না, বললাম না, খেলা করো। আর শোনো, তোমাকে বলিনি, যেখানে আমি কাজ করতাম এটা ভেঙ্গে পড়েছে। আমরা আটকে গেছি।
খোকার এতক্ষণে হুঁশ হলো। মার বিবর্ণ মুখটা আঁচ করার চেষ্টা করছে। আহা-আহা, মার কীসের কষ্ট! ইশ, কি করলে মার কষ্ট কমে এটা জানলে বেশ হতো কিন্তু খোকা তো এটা জানেই না ছাই! কথা ঘুরাবার জন্য বলল, 'মা, আমাদেরকে কী কেউ উদ্ধার করতে আসবে'?
মা অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে বললেন, 'জানি না। মনে হয় না। পাগলা তুই বুঝবি না, ক-পয়সাই বা আমাদের দাম'!
খোকা এই সব জটিল বিষয় বোঝে না কিন্তু অজান্তেই শিউরে উঠে বলল, 'ইশ, মানুষেরা কী নিষ্ঠুর, না মা'?
মা হাহাকার করে বললেন, 'নারে সোনা, এভাবে বলিস না, সবাই না। কেউ-না-কেউ আমাদের জন্য কাঁদবে ঠিকঠিক, আসবে দেখিস'।
মা এই মিথ্যাচারের জন্য আল্লাহর কাছে মাফ চাইলেন। তিনি জানেন তাদেরকে বাঁচাতে কেউ আসবে না।
এক্ষণ মার বুকে কেমন চাপ চাপ ব্যথা। দৃষ্টি কেমন অস্বচ্ছ হয়ে আসছে। তাঁর হাতে...এটা কী চোখের ভুল, পানি ...? এমন হচ্ছে কেন, নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে কেন? মা নিমিষেই বুঝে ফেললেন, বোঝার আর বাকি রইল না। এটা তাঁর নিজের গায়ের রক্ত। খোকা বেরিয়ে আসছে তাঁর নিষেধ উপেক্ষা করে। মা অবশিষ্ট শক্তি জড়ো করে চিৎকার করলেন, 'না বাবু, না, তুই পেটের ভেতরেই থাক রে, বাপ। এখানে বাতাস নাই-বাতাস নাই, বাইরে এলে তুই নিজে-নিজে শ্বাস নিতে পারবি না'।
মা বুঝতে পারছেন, অনেক দেরি হয়ে গেছে! খোকা এসেছে ঠিকই কিন্তু চলেও যাচ্ছে অজানার দেশে, যে দেশ থেকে কেউ আর ফেরে না। দেখো দেখি বাবুটার কান্ড, পাগলুটা কেমন বারবার পিটপিট তাকাচ্ছে, এই বুঝি মা পিছু ডাকল। বাবুটা একদম একটা পাগলু হয়েছে! মা পিছু ডাকলেই তুই থেকে যাবি বুঝি!
মার যেটুকু প্রাণশক্তি অবশিষ্ট ছিল তা ধরে রাখার কোনো আগ্রহই আর তাঁর থাকল না। হাল ছেড়ে দিলেন, ক্রমশ নিস্তেজ হয়ে আসছে তাঁর চোখ। চারপাশ কেমন আচ্ছন্ন। এরমধ্যেই খানিক চেতনা দিয়ে বুঝতে পারলেন, মানুষের সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছে, তাঁকে উদ্ধারের আপ্রাণ চেষ্টা করছে এরা। মাটা এবার ছোট-ছোট শ্বাস নিচ্ছেন, দ্রুত। তিনি বুঝতে পারছেন তাঁর নিজেরও সময় ফুরিয়ে আসছে। কষ্ট, বড় কষ্ট! কিন্তু তীব্র অমানুষিক, অন্য ভুবনের কষ্ট নিমিষেই লোপ পেল। কী এক ভাল লাগা ছড়িয়ে পড়ল সমস্ত শরীরে...তিনি তাঁর সন্তানকে মিথ্যা আশ্বাস দেননি যে, তাদেরকে উদ্ধার করতে কেউ আসবে না...।
তাঁর মাথা খারাপের মতো হয়ে গেল, একই শব্দ বারবার আউড়ে যাচ্ছেন। অ সোনা, অ পাগলু, ফিরে আয়-ফিরে আয়, শুনে যা তোকে বলেছিলাম না কেউ-না-কেউ আমাদের জন্য আসবে। দেখলি-দেখলি আমি মিথ্যা বলিনি...
*এই লেখাটি আমি উৎসর্গ করছি তাঁদের, যে দুজন মা ধসেপড়া ভবন রানাপ্লাজায় আটকে ছিলেন এবং ওখানেই সন্তানের জন্ম দিয়েছিলেন। অবশেষে অবশ্য মা-সন্তান এঁরা সবাই মারা যান...।
No comments:
Post a Comment