আমাদের মুক্তিযুদ্ধে কর্নেল তাহেরের পাটা কেটে ফেলতে হয়, না-কেটে উপায় ছিল না কারণ পচন সমস্ত শরীরে ছড়িয়ে যাচ্ছিল।
এমন একজন অকুতোভয় শারীরিক অসুবিধাসম্পন্ন মানুষকে, একজন দুর্ধর্ষ মুক্তিযোদ্ধাকে, একটা স্বপ্নকে, সামরিক আদালতে (জেলখানার ভেতরেই যে আদালত) বিচারের প্রহসনের (যে আইনে কর্নেল তাহেরের মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছিল অথচ ওই অপরাধে আইনের বিধানে কোন মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার বিধান ছিল না।) নামে ফট করে মেরে ফেলা আমাদের দেশেই সম্ভব।
আসলে ভীরু, কাপুরুষদের এটা করা ব্যতীত উপায় ছিল না। তাহেরকে বাঁচিয়ে রাখাটা ছিল কাপুরুষদের জন্য খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। আফসোস, এই দেশ তার সেরা সন্তানদের কখনই ধরে রাখতে পারে না- অভাগা এক দেশ!
যে খন্দকার মোশতাকের সঙ্গে তিন বাহিনীর প্রধান তেলেতলে ভাষায় কথা বলতেন সেই মোশতাকের দিকে ক্রাচ তুলে রেডিও স্টেশনে কর্নেল তাহের বলেছিলেন:
'আপনি এখানে কেন...গেট আউট'।
এই হচ্ছেন তাহের!
হাবিলদার মেজর আবদুল হাই মজুমদার (অব.), যিনি সিপাহি বিদ্রোহে এক বছর সশ্রম কারাভোগী। তাঁর বর্ণনা থেকে:
"...নিজের ব্যাটিলিয়নে এসে দেখি জিয়াউর রহমান পুরো ব্রিগেড ফল-ইন করালেন। জিয়াইর রহমান ৮ নভেম্বর দুপুর ১২টায় ফার্স্ট বেঙ্গল গ্রাউন্ডের পূর্বদিকে একটা স্টেজে উঠলেন। সেখানে তিনি বললেন, '...আমি সৈনিক, আমি রাজনীতি বুঝি না। ৯০ দিনের মধ্যে জনগণের ক্ষমতা জনগণকে ফিরিয়ে দেব...'।তাহেরকে যেভাবে ফাঁসি দেয়া হয় প্রকারন্তরে এ খুনেরই নামান্তর। রাষ্ট্রের সমস্ত শক্তি ব্যয় করা হয়েছিল এই খুনকে বৈধতা দেয়ার জন্য।
জিয়াউর রহমান সেখানে কোরান শরীফের উপর হাত রেখে শপথও করেছিলেন। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে ধড়পাকড় শুরু হয়ে গেল...।"
"যে ট্রাইব্যুনালে তাহেরের বিচার হয়েছিল ওটার প্রধান বিচারক ছিলেন কর্নেল ইউসুফ হায়দার। তিনি ছিলেন পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর একজন কোলাবরেটর। জিয়াউর রহমানের সঙ্গে বিশেষ সখ্যতাই ছিল এই বিচারকাজের জন্য নিযুক্ত হওয়ার তার একমাত্র যোগ্যতা! যখন এই ট্রাইব্যুনাল তাহেরের ফাঁসির আদেশ শোনায় তখন অন্যরা সবাই স্তম্ভিত, চিৎকার করে কাঁদছেন কিন্তু তাহের হাসছিলেন...।"(মেজর জিয়াউদ্দিন আহমেদ (অব.) মামলায় ১২ বছর সশ্রম কারাভোগী)
এই প্রধান বিচারকের (যিনি একজন কর্নেল মাত্র) মেজর জলিল প্রথম দিনই বলেছিলেন: 'You are a colonel or Dummy'? (আদালতের ৯ ধারাতে বলা আছে, এই আদালতের যিনি চেয়ারম্যান থাকবেন তার যোগ্যতা হতে হবে ন্যূনতম হাইকোর্টের একজন বিচারকের সমান)।
মামলা চলাকালীন সময়ে তাহের, জিয়াউর রহমান প্রসঙ্গে যখন বলেন, "There is only one example of such treachery in our history and that is of MIRJAFAR". কোর্ট একথা লিপিবদ্ধ করতে অস্বীকার করলে তাহের বিচারককে উদ্দেশ্য করে বলেন, 'I have seen many small people in my life but never one smaller than you.
১৭ জুলাই বিকেলবেলা মামলার রায় হয় আর ২১ জুলাই তাহেরের ফাঁসি কার্যকর করা হয়। মাত্র ২৪ ঘন্টার মধ্যে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি সায়েম মৃত্যুদন্ড অনুমোদনের কাগজে সই করেন। এমন উদাহরণ আর নেই!
"...যেসব কর্মকর্তা ৩ নভেম্বর জিয়া বিরোধী অভ্যুত্থানের পেছনে ছিলেন, তারা ছিলেন মুক্ত। আর যেসব ব্যক্তি ৭ নভেম্বর সাধারণ অভ্যূত্থান ঘটিয়েছিল, যে ঘটনায় জিয়া মুক্তি পেয়েছিলেন তারা বিচারে মৃত্যুদন্ডের সম্মুখীন।" (লরেন্স লিফশুলৎস)বলার আর অপেক্ষা রাখে না সব কলকাঠিই নাড়ছিলেন জিয়াউর রহমান। যে জিয়াউর রহমানকে তাহের প্রাণে বাঁচিয়ে ছিলেন। জিয়া এর প্রতিদান এমন করেই দিয়েছিলেন!
কর্নেল তাহেরকে গ্রেফতার করার মাত্র ৭ দিনের মাথায় ছোট-ছোট তিন বাচ্চাকে সহ তাহেরের স্ত্রী লুৎফা তাহেরকে তাঁদের নারায়নগঞ্জ অফিসের বাসাটি ছেড়ে দিতে বলা হয়। তাহেরের কোনো পেনশন ছিল না, টাকা-পয়সাও রেখে যাননি। লুৎফা তাহের দিনের-পর-দিন কেবল সন্তানদের আলুভর্তা খাইয়ে বড় করেছেন মোহাম্মদপুরের আজম রোডের স্যাঁতস্যাঁতে দু-কামরার একটি বাড়িতে।
তাহেরের ডেথ ওয়ারেন্ট ইস্যু করার মাত্র ৩ দিনের মাথায় তাহেরের ফাঁসি কার্যকর করা হয়। অথচ জেল কোড অনুযায়ী ডেথ ওয়ারেন্ট ইস্যুর ২১ দিন আগে মৃত্যুদন্ড কার্যকর করার বিধান নেই! জেল কোডে স্পষ্ট বলা আছে, "The date of the execution not less than 21 days, or more than 28 days."
আসলে এটা ছিল স্রেফ একটা খুন! কর্নেল তাহেরকে খুন করা হয়েছিল। এবং এই খুন করার ধরন, নমুনা দেখে আমি বিস্মিত হই! গা বাঁচিয়ে কী চমৎকার ভঙ্গিতেই না খুন করা যায়! অনর্থক আমরা সিরিয়াল কিলার রসু খাঁকে দোষ দেই!
তাহেরের বিচার প্রসঙ্গে প্রখ্যাত এডভোকেট গাজিউল হক ক্ষোভে ফেটে পড়েছিলেন:
তাহেরের ডেথ ওয়ারেন্ট ইস্যু করার মাত্র ৩ দিনের মাথায় তাহেরের ফাঁসি কার্যকর করা হয়। অথচ জেল কোড অনুযায়ী ডেথ ওয়ারেন্ট ইস্যুর ২১ দিন আগে মৃত্যুদন্ড কার্যকর করার বিধান নেই! জেল কোডে স্পষ্ট বলা আছে, "The date of the execution not less than 21 days, or more than 28 days."
আসলে এটা ছিল স্রেফ একটা খুন! কর্নেল তাহেরকে খুন করা হয়েছিল। এবং এই খুন করার ধরন, নমুনা দেখে আমি বিস্মিত হই! গা বাঁচিয়ে কী চমৎকার ভঙ্গিতেই না খুন করা যায়! অনর্থক আমরা সিরিয়াল কিলার রসু খাঁকে দোষ দেই!
তাহেরের বিচার প্রসঙ্গে প্রখ্যাত এডভোকেট গাজিউল হক ক্ষোভে ফেটে পড়েছিলেন:
"...কিলিং, এটা একটা কিলিং হলো। ...মৃত্যুর ক্ষণ, তারিখ ঠিক করে একটা লোককে জবাই করা হলো...।"একজন কথিত জল্লাদ জনাব মোঃ সিরাজউদ্দিনের সাক্ষৎকার নেয়া হয়েছিল, মিনার মাহমুদের বিচিন্তা পত্রিকায়:
"প্রশ্ন: ফাঁসির মঞ্চের কোনও ব্যক্তির আচরণ কি আপনার হৃদয় ছুঁয়ে গেছে? যদি যায়, তবে সেই ব্যক্তিটি কে?৪২ মিনিট লেগেছিল তাহের নামের অগ্নিপুরুষের মৃত্যু হতে! ৪২ মিনিট ধরে ফাঁসির দড়িটা কাঁপছিল। জেলার, ডাক্তার উপস্থিত অন্যরা পর্যন্ত কেঁদে ফেলেছিলেন।
জল্লাদ সিরাজউদ্দিন: কর্নেল তাহের। ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়াইয়া তিনি সহজভাবে কথা বলেছেন। একটা বিপ্লবী কবিতা পইড়া শোনাইছেন ('...জন্মেছি, মৃত্যুকে পরাজিত করব বলে/ করেই গেলাম...' এই কবিতাটি লিখেছিলেন মেজর জিয়াউদ্দিন)। আশ্চর্য! তিনি নিজের হাতে যমটুপি পরছেন। নিজেই ফাঁসির দড়ি নিজের গলায় লাগাইছেন। আমার মনে হয় ফাঁসির মঞ্চে এমন সাহস দুনিয়ার আর কেউ দেখাইতে পারে নাই।"
এডভোকেট জেড আই খান পান্না, সেসময় একই কারাগারে বন্দি ছিলেন। তাঁর জবানিতে:
"...এই বিচারকার্যের আইনজীবীদের শপথ করানো হয়েছিল বিচারকার্য সম্পর্কে তারা বাইরে মুখ খুলতে পারবেন না। এবং বিচারকার্য সমাধা হয়েছিল জেলখানার ভেতরে। এমন উদাহরণ পৃথিবীর কোথাও নেই।আমার কখনো কখনো সন্দেহ হয় তাহের নামের মানুষটা আসলে মানুষ ছিলেন কিনা, নাকি ছিলেন হয়তো-বা একটা রোবট! কারণ মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়ে অনেক বড়-বড় বীরপুরুষও কাবু হয়ে পড়েন বাহ্যজ্ঞান লোপ পায় অথচ তিনি কেবল অবিচলই থাকেননি, মৃত্যুকে নিয়ে রসিকতাও করেছেন।
...জেলের যে ডাক্তার ছিলেন তাহেরের ফাঁসির পূর্বে ব্লাডপ্রেশার মেপে দেখেন, প্রেশার একেবারেই নরমাল। ডাক্তার প্রথমে ভেবেছিলেন তার কোথাও ভুল হচ্ছে, তখন কর্নেল তাহের সেই ডাক্তারকে হেসে বলেছিলেন, 'ডাক্তার, আমি একজন যোদ্ধা, একজন মুক্তিযোদ্ধা। ১৯৭১ সালেই আমার মৃত্যু হয়ে গেছে। তুমি আমার রক্তে কোনো ধরনের অ্যাবনর্মালিটি পাবে না...'।"
অথচ এই মানুষটাই তাঁর স্ত্রীর কাছে চিঠি লেখেন, 'আমার আদরের লুৎফা...'। বা একটুখানি স্পর্শের জন্য স্ত্রীকে লেখা এই মানুষটারই কী হাহাকারভরা চিঠি, '...তোমার স্পর্শ, তোমার মৃদু পরশ শান্ত করুক আমাকে...'।
বা তাঁর এমন ছবি দেখে খানিকটা সংশয় কেটে যায়:
তাহেরের আপন বোন সালেহাও এই কারাগারেই বন্দি ছিলেন। তাহেরের ফাঁসির রায় হওয়ার পর তাহের লিখেছিলেন:
তাহেরের আপন বোন সালেহাও এই কারাগারেই বন্দি ছিলেন। তাহেরের ফাঁসির রায় হওয়ার পর তাহের লিখেছিলেন:
"বোন সালেহা হঠাৎ করে টয়লেটে গিয়ে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল। আমি সালেহাকে ডেকে এনে বললাম, 'তোমার কাছ থেকে এমন দুর্বলতা কখনই আশা করি না'।*মানুষ দেবতা না, সে ভুল করতেই পারে। তাহেরের ভুল বা মতাদর্শ নিয়ে আলোচনা, হতেই পারে। আমার কাছে সেটা এই লেখায় গুরুত্বপূর্ণ না, সেটা ভিন্ন, ভিন্ন তর্কের বিষয়। কিন্তু কর্নেল তাহের নামের আগুনমানুষটাকে স্পর্শ করার ক্ষমতা আমাদের নেই!
সালেহা সামলে নিয়ে বলল, 'ভাইজান, আমি কাঁদি নাই। এই দেখো, আমি হাসছি'।
হাসিকান্নায় আমার এই বোনটি অপূর্ব। জেলখানার এই বিচারকক্ষে এসে এই প্রথম তার সাথে আমার দেখা। এই বোনটিকে আমার ভীষণ ভাল লাগে। কোন জাতি এর মত বোন সৃষ্টি করতে পারে?।"
(এটাই ছিল পরিবারকে লেখা কর্নেল তাহেরের শেষ চিঠি)
কর্নেল তাহেরের যে বিষয়টা আমাকে প্রচন্ড আলোড়িত করে সেটা হচ্ছে তাঁকে খুন করার ভঙ্গিটা! এমন না কেউ ফট করে গুলি করে মেরে ফেলল। ঠান্ডা মাথায় খুন- রসিয়ে রসিয়ে খুন; এটা কোনো মানুষের পক্ষে সম্ভব না, সম্ভব কেবল দানবের পক্ষে।
এবং এই খুনটা করার জন্য রাষ্ট্রযন্ত্রের যত ধরনের শক্তি আছে সবই প্রয়োগ করা হয়েছিল। তারচেয়েও যেটা আরও ভয়ংকর সেটা হচ্ছে, সত্যটা ইরেজার দিয়ে মুছে ফেরার চেষ্টা করা হয়েছিল। যথারীতি হিস্ট্রি রিপিট...। এবং খুনের দাগ মুছে ফেলা যায় না। সময় এখানে কোনো বিষয় না।
আর আমি এই প্রজন্মের প্রতি অসম্ভব মুগ্ধ এই কারণে, এরা বাপকে ছাড়ে না, খুনি কোন ছার!
আর আমি এই প্রজন্মের প্রতি অসম্ভব মুগ্ধ এই কারণে, এরা বাপকে ছাড়ে না, খুনি কোন ছার!
No comments:
Post a Comment