'সশস্ত্রবাহিনীতে গণহত্যা' নামে একটি ডকুমেন্টারির কাজ করেছিলেন আনোয়ার কবির, যেটা গ্রন্থাকারেও প্রকাশিত হয়েছিল। ওই ডকুমেন্টারিতে তিনি অসংখ্য মানুষের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন, সেসময় যারা পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলেন। ওখানে হাবিলদার মেজর আবদুল হাই মজুদার (অব.)-এর একটি সাক্ষাৎকার আছে। তিনি সিপাহিবিদ্রোহের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত ছিলেন। এই মামলায় তাঁর এক বছর সশ্রম কারাদন্ডও হয়েছিল। তাঁর সাক্ষাৎকারের অংশবিশেষ:
এরপর জিয়াউর রহমান আমাদেরকে জড়িয়ে ধরলেন, হাত মেলালেন, চোখের পানি ফেললেন।
এরপর কর্নেল তাহের জিয়াকে বললেন, 'যা করেছে সৈনিকেরা করেছে, তারা কি বলে শোনেন'। আমরা 'বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার' পক্ষে ১১ জন আবারো একত্রিত হয়ে জিয়াউর রহমানের কাছে ১২ দফা দাবী উত্থাপন করলাম।
"আমরা কয়েকজন মিলে একটি সংগঠন 'বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা নামে' জাসদের গণবাহিনীর তৎকালীন ওই সংগঠনের সাথে ঐক্যবদ্ধ হই। এর ভেতর আমরা সবাই ছিলাম মুক্তিযোদ্ধা, এখানে অমুক্তিযোদ্ধা কেউ ছিল না। আমাদের সঙ্গে ছিলেন, এয়ারফোর্সের কর্পোরাল আলতাফ, কর্পোরাল মজিদ, কর্পোরাল শামসুল হক, আমাদের রেজিমেন্টের নায়েক সিদ্দিক, আর্মি হেডকোয়ার্টারে ছিলেন সুবেদার জালাল, সুবেদার মাহবুব, বেঙ্গল রেজিমেন্টে ছিলেন চান মিয়া, তারু মিয়া, সুবেদার মেজর শহীদ, সুবেদার নুরুল হক...।
...সিরাজুল আলম খানের নেতৃত্বে, উনি আমাদেরকে নির্দেশনা দিলেন, কিছু বই-পুস্তক দিলেন।...বিস্তারিত কর্মপন্থার নির্দেশনা উনিই দিতেন।
...১৫ অগস্টে জাতির জনককে হত্যা করা হয়। কার্যত দেশে কোনো নিয়ন্ত্রণ ছিল না। আমরা কোনোভাবেই এই হত্যাকান্ডকে মেনে নিতে পারিনি। ...সেনাবাহিনীর ভেতর যেভাবে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়েছিল এটা দেখে আমরা কোনো ভাবেই মানতে পারছিলাম না।
...আমরা আমাদের নেতাকে চয়েজ করলাম, কর্নেল আবু তাহের বীর উত্তমকে।
...জিয়াউর রহমানকে গৃহবন্দি করা হয়েছে।
...আমরা সবাই বিচলিত হয়ে কর্নেল তাহেরকে বললাম, 'স্যার, আজকে রাতের ভেতর যদি আমরা জিয়াউর রহমানকে মুক্ত না-করি তাহলে স্যার আমরাও বাঁচব না, জিয়াউর রহমানও বাঁচবেন না, তার ফ্যামেলির একটি সদস্য বাঁচবে না। আপনিও বাঁচতে পারবেন না...।
..এক জরুরি বৈঠকে সিরাজুল আলম খান আসলেন। কর্নেল তাহের বললেন, 'যে-কোনো ভাবে জিয়াউর রহমানকে উদ্ধার করতে হবে। এবং এই সেনাবাহিনীকে বাঁচাতে হবে, দেশকে বাঁচাতে হবে'।...জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করার পর তিনি কর্নেল তাহেরকে আলিঙ্গন করলেন। প্রাণ রক্ষা করার জন্য ধন্যবাদ দিলেন। কর্নেল তাহের আমাদেরকে দেখিয়ে বললেন, 'আমি যুদ্ধাহত, আমার একটি পা নেই, আমি কিই-বা করতে পারতাম। যা করেছে এরাই করেছে'।
এই কথার পর সিরাজুল আলম খান প্রশ্ন করলেন, 'Who is Zia'?
তাহের বললেন, '(চিন্তার কিছু নেই) আমি যা বলব জিয়া তাই করবে'।
আমরা আলোচনায় বসে পড়ি। কে কি করব এই দায়িত্ব নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করি। কিন্তু কিছুক্ষণেই মধ্যেই দেখলাম, সিরাজুল আলম খান রুমে নেই। আমরা ভাবলাম, তিনি বাথরুমে গেছেন। কিন্তু অনেকক্ষণ অপেক্ষা করার পরও দেখলাম তিনি কোথাও নেই। আমরা সিদ্ধান্ত নিতে না-পেরে হাসানুল হক ইনুকে দায়িত্ব দেওয়া হলো সিরাজুর রহমানের সঙ্গে এই বিষয়ে পাকাপোক্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য।
এরপর জিয়াউর রহমান আমাদেরকে জড়িয়ে ধরলেন, হাত মেলালেন, চোখের পানি ফেললেন।
এরপর কর্নেল তাহের জিয়াকে বললেন, 'যা করেছে সৈনিকেরা করেছে, তারা কি বলে শোনেন'। আমরা 'বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার' পক্ষে ১১ জন আবারো একত্রিত হয়ে জিয়াউর রহমানের কাছে ১২ দফা দাবী উত্থাপন করলাম।
...অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে বলছি, ৭ নভেম্বর স্বাধীনতা যুদ্ধের 'কে' ফোর্সের অধিনায়ক খালেদ মোশারফ, কর্নেল হুদাসহ চারজন অফিসারকে হত্যা করা হয়। কর্নেল তাহের বা আমাদের 'বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা'র কোনো লোক এর সঙ্গে জড়িত নন। আমি হলফ করে বলতে পারি, আমাদের কোনো সদস্য ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশারফ, কর্নেল হুদা, কর্নেল হায়দারকে গুলি করেনি। সেদিন কর্নেল তাহের আমাদেরকে এরকম কোনো নির্দেশ প্রদান করেননি।
'বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার' পক্ষ থেকে যদি কেউ খালেদ মোশারফদেরকে হত্যা করে থাকত তাহলে অন্তত আমি জানতাম। কারণ, কর্নেল তাহেরের সঙ্গে যতবারই আমরা আলোচনায় বসেছি সবগুলোতেই আমি উপস্থিত ছিলাম। সবার পক্ষ থেকে নির্দেশের সবগুলো কাগজে আমি স্বক্ষর করেছিলাম।'বাংলাদেশ: আ লিগ্যাসি অভ ব্লাড' বইয়ে অ্যান্থনি ম্যাসকারেনহাস লিখেছেন:
খালেদ মোশারফদের হত্যা করেছে পাকিস্তান প্রত্যাগত সৈনিকেরা। আমি বিশ্বাস করি, কোনো মুক্তিযোদ্ধা খালেদ মোশারফকে হত্য করতে পারে না। কারণ একজন যোদ্ধা তার সহযোদ্ধাকে কেমন করে হত্যা করবে! যারা মেরেছে তারা দেশের বাইরে পালিয়ে যায়নি। তাদের গ্রেফতার করা হোক, বিচার করা হোক।..."
"...সঙ্গে সঙ্গেই গোলযোগ ছড়িয়ে পড়ে। এর মাত্র কয়েক মিনিট পরেই ক্যাপ্টেন আসাদ আর ক্যাপ্টেন জলিল মিলে খালেদ মোশারফ, কর্নেল হুদা আর হায়দারকে কমান্ডিং অফিসারের কক্ষে গুলি করে হত্য করে...।"অধ্যাপক ড. আনোয়ার হোসেন, যিনি এই মামলায় ১০ বছর সশ্রম কারাভোগী। তাঁর কথায়:
"...জাসদ নেতৃত্ব এই অভ্যূত্থানে তাহেরকে নেতৃত্ব দেয়ার অনুমতি দিয়েছিল এবং সব ধরনের সহায়তার আশ্বাসও। ...কিন্তু প্রয়োজনের সময় জাসদ সেই কাজটি করেনি।
...আরেকটি কাজ করেনি জাসদ সেটা হচ্ছে, এই অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন তাহের সুতরাং এটা প্রথম সুযোগেই বেতারও টেলিভিশনে প্রচার করা প্রয়োজন ছিল। এই কাজটি করলে এই অভ্যূত্থানের পরিণতি হতো অন্য রকম হত...।"
No comments:
Post a Comment