একটি রুপকথা!
আজকের অতিথি-লেখক আরিফুর রহমান। যিনি কার্টুনিস্ট আরিফ নামেই অধিক পরিচিত। দৈনিক প্রথম আলোতে একটি কার্টুন আঁকার জন্য এই দৈনিকটি তাঁর সঙ্গে যা করেছিল তা কেবল অন্যায়ই না, ঘোর অন্যায় [১]! তিনি লিখছেন:
"(আগাম সতর্কীকরণঃ মনের ভুলেও সত্য মনে করবেন না )
আজ থেকে হাজার-হাজার বছর আগের কথা। এই পৃথিবীর কোনো এক প্রান্তে এক
দেশ ছিল। সেই দেশে বাস করত আবুল নামের এক লোক, সহজ-সরল তবে একটু বোকা
টাইপের । কোনো কাজ-কাম করত না
কেবল সারাদিন বড়শি নিয়ে পুকুর ধারে বসে থাকতো । কেননা বড়শি দিয়ে মাছ ধরা
ছিল তার নেশা । সে মাছ মেরে বিক্রি করত না তবে মাছ
গুলোকে শুটকি করে রাখত। শুটকিগুলো সে তার ঘরের দেয়ালে ঝুলিয়া রাখতো আর
প্রতিবেশি সবাইকে দেখাত । কারণ সে সবাইকে দেখিয়ে খুব আনন্দ পেত আর সবাই
তার মাছ মারার বাহাদুরি দেখে খুব প্রসংশা করতো।
এক দিন
হল কি, মাছ মারতে মারতে তার বাড়ির পাশের সব পুকুরের সমস্ত মাছ
ফুরিয়ে গেল, কিন্তু মাছ মারা যে তার নেশা । মাছ না-মারা পর্যন্ত তার শান্তি
নেই, মাছ যে তাকে মারতেই হবে । তাই সে বের হল পুকুরে খোঁজে।
হাঁটতে হাঁটতে তার
পাশের গ্রামে একটা পুকুর খুঁজে পেলো, কিন্তু পুকুর এর কাছে গিয়ে দেখে এক
বাউন্ডুলে টাইপে এক লোক বড়শি দিয়া মাছ মারছে। সে দূর থেকে দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে
দেখছিল।
বাউন্ডুলে
টাইপের লোকটা তাকে কাছে ডেকে নিয়ে জিঙ্গাসা করল, 'কি হে ! তোমার প্রশংসা
তো সারা গ্রামে, সবাই বলে তুমি নাকি খুব ভালো মাছ মারতে পারো, মাছ মারবে
আমার সঙ্গে? তোমার মত একজন লোক আমার ভীষণ দরকার। আমি এখানকার এক মাছের আড়তে
চাকুরি করি। তোমাকে টাকা দেবো, কি মাছ মারবে আমার সাথে'?
আবুল মিয়া এ কথা শুনে খুশিতে গদগদ! এটা যেন তার কাছে মেঘ না চাইতেই
বৃষ্টি। কত টাকা দেবে কী সমাচার সে কিছুই জিজ্ঞাসা করল না কারণ তার ধারণা
সে ভালই টাকা পাবে। বাউন্ডুলে
টাইপের ওই লোকটির মুখের কথা শুনে এক বুক আশা নিয়ে সে বাড়ী ফিরে এলো। এর
পর থেকে দুজনে মিলে মাছ মারতে শুরু করল । এ ভাবে বেশ কিছু দিন কেটে গেল।
পুকুর পারের সরা গাছে যে ভুত থাকতো সে কথা কেউ জানতো না । একদিন হলো কি
মাছের কাঁচা গন্ধে থাকতে না পেরে সরা গাছ থেকে একটা ভুত বের হয়ে এলো ।
ভুতটা বের হয়েই, মাছ খাব-মাছ খাব বলে চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করে দিল । ভয়ে
বাউন্ডুলে লোকটা ভুতের সামনে আবুলকে এগিয়ে দিয়ে মাছগুলো নিয়ে মারলো এক
দৌড় । পিছন থেকে আবুল মিয়া হাহাকার করতে লাগল কিন্তু কেউই
তার ডাকে সাড়া দিল না, এমন কি বাউন্ডুলেও না, সে যে কোথায় গিয়া পালাল সেটা কেউ
জানে না ।
আবুল
মিয়া তখন ভূতের ভয়ে থরথর কাঁপছিল । ভূতটা তখন চিৎকার করছিল আর মুখ
দিয়ে আগুন হচ্ছিল, সজোরে এক হুঙ্কার দিতেই আবুল মিয়া পুকুরের গভীর
গর্তে পা ফস্কে পড়ে গেলো। পুকুরটা এতোটাই গভীর ছিল যে কেউ একবার পড়ে গেলে
তার আর রক্ষা নাই। নির্ঘাত তাকে মরতেই হবে, এতটাই গভীর যে পুকুরটা অনেকটা
কুয়োর মত। এদিকে আবার আবুল মিয়া ঠিক মত সাঁতারও জানেনা, পুকুরের পচা
পানিতে হাবুডুবু খাচ্ছিল।
কারণ পুকুরে এতোই পানি ছিল যে সেখানে দাঁড়ানোর জন্য তার ঠাঁই হচ্ছিল না। এখন
সে উভয় সংকটে পড়েছে। উপরে ভূত আর নিচে মানুষখেকো মাছ। কোনোটা নীচ
থেকে তাঁকে কামড়াচ্ছিল, কোনোটা আবার শিং ফুটিয়ে দিচ্ছিল আবার কোনোটা তাকে
প্রাণে মেরে ফেলার ভয় দেখাচ্ছিল ।
তার এই বিপদের সময় সে তার আড়তদার সবাইকেই ডাকছিল কিন্তু সবাই তখন ব্যস্ত ছিল। তার বিপদের সময় কেউ পাশে এসে
দাড়ায়নি । সে খুব কান্নাকাটি করছিল তখন। পানিতে সাঁতার কাটতে কাটতে
কিছুক্ষণ পর পায়ের নিচে এক টুকরো মাটি খুঁজে পেলো এটিই ছিল তাঁর বেঁচে থাকার
শেষ ভরসা ।
অন্যদিকে
ভূতটা রেগে গিয়ে হইচই করে সারা দেশ মাথায় তুললো! ভূতের অভিযোগ
মাছের গন্ধে তার ঘুমের ব্যাঘাত ঘটানো হয়েছে। চাচা আপন প্রাণ বাঁচা বলে
আড়তদার মহাজন ভূতের পা ধরে ক্ষমা চাইল। এবং ভূতকে খুশি করার জন্য তারা ঘোষণা
দিলো যে আবুল মিয়াকে তারা আর কখনও তাদের পুকুরে মাছ মারতে দেবে না এবং
তাকে বহিস্কার করা হলো। ভূতকে খুশি করার জন্য তাঁরা আরও বহু
প্রতিশ্রুতি দিল।
এদিকে আবুল বেচারার আবস্থা কাহিল। চিন্তায় চিন্তায় সে শুকিয়ে কাঠ হয়ে
গেছে। ঠিকমত তার খাওয়াদাওয়াও হয় না, বিপদ থেকে সে কখনও রক্ষা পাবে কি না সেটা সে
নিজেও জানে না, সব সময় শুধু আকাশের দিকে সে তাকিয়ে থাকে আর কাঁদে ।
কিছু
দিন পর পুকুরের পাশ দিয়ে যাচ্ছিল কালো পোষাক পরা একদল মানুষ, আবুলকে
দেখে তাদের খুব মায়া হলো, তাই তারা পুকুরে একটা লম্বা দড়ি নামিয়ে দিলো, আবুল সেই দড়ি ধরেই উপরে উঠে এলো। ছয় মাস দুই দিন পর সে জল থেকে ডাঙ্গায়
উঠলো। সে নতুন জীবন ফিরে পেল । কিন্তু আবুলের মন থেকে ভূতের ভয় দূর হয় না,
ভূতগুলো তাকে সবসময় তাড়া করে ফেরে।
এদিকে কঠোর বাস্তবতা। কাজের খোঁজে আবুল রাস্তায় রাস্তায় ঘোরে, কিন্তু
কেউ তাকে কোনো কাজ দেয় না, সবাই ভয় পায়, চাকরি দিলে ভূত যদি তাদের উপর
আক্রমণ করে।
এদিকে যাদের সঙ্গে কাজ করতো তাদের কেউ আর তার কোনো খোঁজ খবর নেয় না। প্রয়োজনও মনে করে না।
একদিন আড়তদারের ম্যানেজার চক্রবর্তী সাহেবের সাথে আবুলের দেখা,
চক্রবর্তী সাহেব তাকে কাছে বসিয়ে বললেন, 'আবুল, আমরা তো তোমার সঙ্গে অন্যায়
করে ফেলেছি, তা কি করলে তুমি আমাদের ক্ষমা করবে বলো? কি করলে তুমি খুশি
হবে?
আমরা তো ঘোষণা দিয়েছি আমরা তোমাকে দিয়ে আর কখনও মাছ ধরাবো না। ঠিক আছে,
তুমি কোনো চিন্তা কোরো না আমরা তোমাকে একটা নতুন কাজ জোগাড় করে দেব। পুকুরে
থাকতে তো অনেক শাপলা-শালুক খেয়েছো, এই নাও আমার হাতের কোক আর বিরিয়ানি খাও।
পরে তোমার সাথে যোগাযোগ করব'।
এটা বলে চক্রবর্তী সাহেব আর কোক-বিরিয়ানি তার
সামনে রেখে চলে গেলেন। পরে তিনি আর কখনও যোগাযোগ করেননি! আবুল নিজ থেকেও
চেষ্টাও করেছে বহুবার কিন্তু সে মানুষটার নাগাল পায়নি। কারণ তারা অতি বড়লোক, উপরতলার মানুষ,
তারা সব সময় ব্যস্ত থাকেন। তাছাড়া প্রয়োজন মনে না-করলে সবার সঙ্গে তারা কথাও
বলেন না।
এভাবে অনেক দিন কেটে গেল এক সময় চক্রবর্তী সাহেব তাঁর দেয়া কথাও ভুলে গেল ।
বহুদিন
আবুলের কারও সঙ্গে কোনো যোগাযোগ নাই তাই সে নিজে থেকেই বাউন্ডুলেকে একটা
ফোন করল। উত্তরে বাউন্ডুলে বললেন, 'ভাই আমি খুব অসুস্থ সকালে
হাসপাতালে ভর্তি হইছি'।
শুনে আবুল বলল, 'আমি আপনাকে দেখতে আসি'?
বাউন্ডুলে বললেন, 'আসেন'!
তার বিপদে বাউন্ডুলে তাকে দেখতে আসেনি তাতে কি হয়েছে, সে তাকে দেখতে
যাবে, তার বিপদে পাশে গিয়ে দাঁড়াবে কারণ তার মধ্যে যে এখনও মানবতা অবশিষ্ট আছে। তার জন্য কে
কি করল সেটা তো তার দেখার বিষয় নয়।
আবুল তার সাধ্য মত ফল কিনে হাসপাতালে বাউন্ডুলেকে দেখতে গেল।
বাউন্ডুলে হাসপাতালে আবুলকে দেখে তাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলেন।
একদিন দেশে রাজার মৃত সন্তানদের স্মরনে এক মেলার আয়োজন করা হল । মেলা
সবার জন্য উন্মুক্ত ছিল, সেখানে দেশ-বিদেশ থেকে বহু লোক জন আসতো, আবুলও
সেখানে গিয়ে হাজির হলো। মেলায় ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ বাউন্ডুলেকে সে দেখতে
পেলো । লম্বা একটা সালাম দিয়ে সে বাউন্ডুলের সামনে গিয়ে হাজির হল, সঙ্গে
সঙ্গে বাউন্ডুলে বলে উঠলেন, 'আরে আপনি? আপনাকে খুব চেনা-চেনা লাগছে, আপনাকে
কোথায় যেন দেখেছি? ঠিক মনে পড়ছে না! আপনাকে কোথায় দেখেছি বলুনতো'?
বাউন্ডুলের মুখে এরকম কথা শুনে সে খুব অবাক হচ্ছিলো, সে বলল, 'ভাইয়া
আমাকে চিন্তে পারছেন না? আমি আবুল'! (মনে মনে সে বলল, এক সঙ্গে এতদিন কাজ
করলাম, হাসপাতালে দেখতে গেলাম সব কিছু সে এত তাড়াতাড়ি ভুলে গেল?)
উত্তরে বাউন্ডুলে বলল, 'আরে, আবুল আপনি? আপনি ভাল আছেন? কি করছেন এখন?
কখন এসেছেন? তা চক্রবর্তী সাহেবের সাথে দেখা হয়েছিল আপনার? সেও তো এই মেলাতে এসেছে! দেখা হয়েছে'?
আবুল এতগুলো প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে ছোট্ট করে বলল, 'না, দেখা হয়নি!
বাউন্ডুলে আবুলকে নিয়ে চক্রবর্তী সাহেবের কাছে এলো। কফি শপের সামনে দাড়িয়ে তিনি কিছু লোকের সাথে গল্প করছিল।
বাউন্ডুলে বললেন, 'চক্রবর্তী ভাই, দেখছেন কে এসেছে'?
উত্তরে চক্রবর্তী, 'কে যেন? ঠিক চিন্তে পারছি না'?
বাউন্ডুলে এবার বললেন, 'চিনতে পারেননি! ও আবুল, আমাদের সেই আবুল'।
মুখভরা হাসি নিয়ে চক্রবর্তী বললেন, 'ওহ, আবুল ! ভাল আছ? এই দোকানদার আবুলকে কফি দাও! নাও, আবুল কফি খাও'!
কফি
শেষ হতে না হতেই আবুল আবিষ্কার করল নিজেকে, সে একা দাঁড়িয়ে আছে কফি শপের
সামনে, সবাই যার যার মত কাজে চলে গেছে। কফির কাপটা হাতে নিয়ে আবুল মনে মনে
ভাবছিল, কত সহজেই না মানুষ বদলে যায়, মানুষ কত অদ্ভুত !
একবুক কষ্ট নিয়ে সে হেঁটে বেড়ায় রাস্তায় রাস্তায়, একটি নিরাপদ জীবন এবং কাজের সন্ধানে...।"
সহায়ক সূত্র:
6 comments:
arif vai valo achen to, take amar salam deben.
এই ভদ্রলোকের সাথে প্রথম আলো যেটা করেছে এদেরকে জুতা মারা দর্কার
@mahin,
আরিফুর রহমান কিন্তু ফেসবুকে আছেন। সরাসরি তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন:
https://www.facebook.com/arifurr3
ধন্যবাদ আলী মাহমেদ ভাইয়া,
@mahin, আমি ভালো আছি,
আপনার জন্য শুভ কামনা রইলো
থ্যংকস আলি ভাই, আরিফ ভাইয়ের খোজ দেওয়ার জন্য।
আরিফ ভাইয়ের কি দেশে আসতে কোনও প্রকারের নিষেধ আছে?
Post a Comment