Search

Saturday, June 8, 2013

উঁচু তলার সাতকাহন: ২

আজকের অতিথি-লেখক, আবারও, EmOn SarWar 
এর পূর্বে তিনি লিখেছিলেন, উঁচু তলার সাতকাহন [১]। আজ লিখছেন:
"২০০০ এর প্রথম দশকের কোন এক নভেম্বর মাসের কথা। চাকুরির কারণে সৌদি আরব গেছি। দিন-বারোর এক রাষ্ট্রীয় সফরের প্রতিনিধি দলের লেজের আগার এক গোছা চুলের মত ঝুলে-ঝুলে নানা স্থানে যাচ্ছি। কেমন-কেমন করে যেনো পাঁচ তারকা হোটেল কিংবা রাজকীয় অতিথিশালায় থাকার সুযোগ হয়ে যাচ্ছিল।

সফরের প্রথম ভাগে মদিনায় থাকতে হয়েছিল বেশ কদিন। মদিনার পবিত্র মাটিতে প্লেন ল্যান্ড করার আগ মুহুর্ত পর্যন্ত মনে হচ্ছিল, মদিনার বাতাস গায়ে লাগার সঙ্গে-সঙ্গে স্বর্গীয় অনুভূতিতে মুহ্যমান হয়ে পড়ব। সন্ধ্যা ৭ টার দিকে যখন বিমানের দরোজা খুলে সবার আগে বেরুলাম, মুখে একটা গরম হাওয়ার ঝাপ্টা লাগলো শুধু। ভিআইপি টারমাক দিনের আলোর মত জ্বল জ্বল করছে! নিচে 'তাগিয়া-গুতরা' মাথায় বেশ কিছু সৌদি সরকারি লোক দাঁড়িয়ে আছে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য। সৌদি রাজকীয় প্রহরী বাহিনির লোকজনও আছে।

প্লেনের দরজায় লাগানো হয়েছে একটা খোলা লিফ্ট, অনেকটা শোরুমে গাড়ি উঠানো নামানোর জন্য যেগুলো ব্যবহার করা হয়, সেরকম। সৌদি আরবে নিয়োজিত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত বেশ স্মার্ট মানুষ, ঢাকার নবাব পরিবারের সদস্য। সারা জীবন কাটিয়েছেন মধ্যপ্রাচ্য আর রাশিয়ান ব্লকে কাজ করে। তিনি অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে খুব অল্প সময়ে প্রটোকল পর্ব শেষ করে আমাদের হোটেলের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করিয়ে দিলেন। মদিনার ওবেরয় ইন্টারন্যাশেনাল হোটেল। মসজিদে নববীর পাশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে। রুমে যেয়ে কার্ডে রুমরেন্টের সুচী দেখে চোখ চড়ক গাছ! এখানে রুমের ভাড়া পজিশন ভেদে কম বেশী আছে।

'হারাম ফেসিং' (মানে মসজিদের দিকে মুখ করা) রুমের ভাড়া অন্য রুমগুলির চেয়ে প্রায় দুগুণ বেশী। থাইল্যান্ডের পাতায়ায় যেমন, সী ফেসিং রুমের ভাড়া বেশী হয়। আমাদের কক্সবাজারেও কি এমন কিনা জানা নেই। তবে এত দামী কামরা বরাদ্ধ হলেও, অবস্থান করার সময় খুবই কম। রাতে ২ ঘন্টার বেশী ঘুমানোর সময় নেই। দিনে রাতে নানা সময়ে সৌদি রয়্যাল গার্ডের সদস্যদের সাথে করিডোরে দাঁড়িয়ে পাহারা দেই। আমাদের ৪ জন ছাড়া ওরা কাউকেই বিশ্বাস করে না। যেই আসুক, খুব রুক্ষ ভাব-ভংগি করে অনেক্ষণ দাঁড় করিয়ে রাখে। প্রতিনিধি দলের সদস্যদেরও অনেক সময় ওদের হাতে হেনস্ত হতে হয়।

ওদের দলনেতা, মেজর আলি। ভাংগা-ভাংগা ইংরেজিতে কথা বলতে পারেন। গার্ডরা, কেউ এলেই আগে আমাদের ডেকে আনে। আমরা সম্মতি দিলে, মেজর আলির কাছ থেকে আদেশ নিয়ে তারপরেই হোটেলের এ অংশে কাউকে ঢুকতে দেয়। যাওয়ার পর দ্বিতীয় দিন বিকেলে হঠাৎ আমাদের কাছে খবর এলো, বাংলাদেশি রাজনৈতিক দলের সৌদি শাখার প্রধান তিন নেতাকে সৌদি পুলিশের কাছে দেওয়া হয়েছে। আমরা যেনো তাদের একটু ছাড়ানোর ব্যবস্থা করি। প্রতিনিধি দলের, 'কাঁচা-পাকা চুলের গোঁফধারি সদা-হাস্যময়', রাজনৈতিক সমন্বয়কারি, রাষ্ট্রদুতকে বলে সৌদি বিদেশ মন্ত্রণালয়ের মধ্যস্থতায় তাদের ছাড়ানোর ব্যবস্থা করলেন।

পরে জানতে পেরেছিলাম, ওই নেতারা আমাদের হোটেলের গেটে এসে নিজেদের দলের নিজেদের কলহের কারণে মারামারিতে লিপ্ত হয়েছিলেন। তাই সৌদি পুলিশ তাদের ধরে উত্তম-মধ্যম দিয়ে জেলে পুরে দেয়। সৌদি আরব গিয়ে দেখি, ওখানে আমাদের আগেই পৌছে গেছেন অনেক জাতীয় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। প্রায় সবাই সস্ত্রীক, আল্লাহ আর তাঁর রাসুলের কৃপা লাভের জন্য মহা উদ্যমে প্রতি ওয়াক্ত মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়েন। শুনেছি, থাইল্যান্ডে গেলে, উনারা কেউই স্ত্রীদের সাথে নিয়ে যান না। মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়ে আল্লাহর প্রতি আনুগত্য প্রকাশে উনাদের যত আগ্রহ তার চেয়ে বেশি আগ্রহ আমাদের মধ্যমনির কাছে এক মুহুর্তের জন্য হলেও দেখা দেওয়া। ঢাকার 'দৌড় উদ্দিন', চট্টগ্রামের 'সোনা মিয়া চৌ' এদের মধ্যে সবচে বেশি সফল ছিলেন।

প্রতিদিন সময় কাটে নামাজ আর শপিং-এ। সারা রাত ক্কিয়াম আল লাইল এর নামাজ পড়ে, পরদিন আসর পর্যন্ত ছুটি। মাঝের দু ওয়াক্ত নামাজ, ফি আমানিল্লাহ । আসরের নামাজের আগে যখন দল বেঁধে মসজিদে ঢুকতাম, দূর থেকে 'হালকা গোলাপি' রঙ্গের ছড়াছড়িতে দেখে মনে হতে পারত, দুধ আর আলতার একটা নহর বয়ে যাচ্ছে। চার পাশে নানান দেশের সকল মানুষ দাড়িয়ে কৌতুহল নিয়ে তামাশা দেখত ।
ইফতারের প্রথম পর্ব হয় মসজিদে মাগরিবের নামাজের সময়, বাকিটা হোটেলে ফিরে। আমাদের ফ্লোরে স্পেশাল ব্যুফে লাগানো হয়েছিল। আমি যাই কিন্তু খুব একটা খেতে পারি না। লাবান আর পানি খেয়েই আমার পেট ভর্তি থাকে। কিন্তু দলের সব হোমরা-চোমরা সদস্যদের দেখে মনে হত, যেন ফাঁসির খানা খাচ্ছেন। এক্কেবারে 'Dog in the Menger' অবস্থা! জেনে, না জেনে সব কিছুই তাদের খেতে হবে। যা আছে তার আইটেম, সবই তাঁদের খাওয়া চাই।

আমরা শপিং-এ যাই। যাই মানে উনি যান- যথারীতি ওঁর সঙ্গে আমাদেরকেও যেতে হয়! উনি, উনার পরিবারের সদস্যদের নিয়ে সোনার গহনা, ঘরের পর্দ্দা, সুইস ঘড়ি, মাদার কেয়ারে বাচ্চাদের জিনিস, সব কিছুই দেখেন, কিন্তু কিছুই কেনেন না। আমার লজ্জা লাগে! চারদিকে এতো নিরাপত্তার লোকজনসহ কোনো দোকানে গেলে দোকানের অন্য ক্রেতারা বেরিয়ে যায়। দোকানের ম্যানেজার এসে খাতির যত্ন করে সব দেখান, দাম বলেন। কিন্তু এরপর কিছু না-কিনেই আমরা বেরিয়ে আসি।

প্রথম দিন খুব অবাক হচ্ছিলাম। পরে হোটেলে এসে দেখি, এক গৌরিসেন আছেন আমাদের দলে। যেসব জিনিস নাড়াচাড়া করা হয়েছিল, সবই উনি পরে গিয়ে কিনে নিয়ে আসেন। বুঝতে পারলাম, অপারেশন দু'পর্বে ভাগ করা। প্রথম পর্বে পর্যবেক্ষণ ও পছন্দ, দ্বিতীয় পর্বে ক্রয় ও ডেলিভারি।

আমি আরব ভুমিতে গিয়েও ভুদাই বনে গেলাম। তা এই গৌরি সেন নিঃসঙ্কোচে লুংগি-পাঞ্জাবি পড়ে পাঁচ তারা হোটেলে ঘুরে বেড়ান, শপিং করেন, খেতে যান। আমার সাথে বেশ খাতির হয়ে গেল উনার। একদিন, সোনালী ফ্রেমে বাধাই করা ক্কাবা শরীফের দরজার একটা মিনিয়েচার কপি এনে আমার হাতে দিয়ে বললেন, 'আব্বা, এটা রাখেন, আপনার জন্য নিয়া আসছি'।

এই হোটেলের অন্য এক ফ্লোরে থাকতেন পাকিস্তানের নির্বাসিত প্রধানমন্ত্রী নেওয়াজ শরীফ। আমার সঙ্গে দু'বার একই লিফ্টে সস্ত্রীক উঠানামা করেছেন। আমি প্রথমে চিনতে পারিনি! বিরলকেশ, মধ্য পঞ্চাশের মন খারাপ করা চেহারা। টাকের পেছন দিকটায় যেকটি চুল ছিল সব কাশবনের মত সাদা। আমি লিফ্টে উঠে নড করতেই বললেন, 'আপ বাংগালি হো'?
আমি বললাম, 'ইয়েস স্যার'।
উনি বললেন, 'ভেরি গুড'।
লবিতে নেমে উনি চলে গেলেন। পেছন থেকে কাবুলি সেলোয়ার-কামিজ পরা এক লোক এসে আমার কাঁধে হাত দিয়ে জিজ্ঞেস করল, 'আপ, মিঞা কি সাথ হো'?
পিঠে হাত দেওয়াতে মেজাজ খারাপ হয়ে গিয়েছিল। আমি চোখ গরম করে বললাম, 'who is mia and who the hell are you'? লোকটি আর কিছু না-বলে কেটে পড়ল।


পরে জানতে পেরেছিলাম, নেওয়াজ শরীফকে পাকিস্তানের লোকেরা মিঞা বলে ডাকে। আমাকে প্রশ্ন করা লোকটি হয়ত 'আই এস আই'-এর এজেন্ট ছিল। আজকাল টিভিতে দেখি, নেওয়াজ শরীফের মাথায় আর টাক নেই, চুলও সব কালো। ক্ষমতা আর টাকা সবই দিতে পারে! আবুল মনসুর আহমেদ একবার বলেছিলেন, টাকা দিয়ে আর যাই হোক কিন্তু টাক সারানো যায় না; তা না হলে খাজা নাজিমুদ্দিনের মাথায় টাক থাকতো না। আজ বেঁচে থাকলে উনি লজ্জা পেতেন।

এর কিছুদিন পর ঢাকায় পারভেজ মোশারফ সাহেবের সাথে কথা বলার সুযোগ হয়েছিল। সোনার গাঁ হোটেলের ৮ তলার করিডোরে দাঁড়িয়ে প্রায় দুমিনিট কথা বলেছিলেন তিনি। সেদিন নেওয়াজ শরীফ নির্বাসনে ছিলেন আর মোশারফ মহা দর্পে পাকিস্তান শাসন করেছেন। আজ পাশা পাল্টে গেছে। মোশারফ অপেক্ষায় আছেন, নেওয়াজ শরীফ হয়তো তাকে জেলে না-ঢুকিয়ে নির্বাসনে যাবার সুযোগ দেবেন...।"

সহায়ক সূত্র:
উঁচু তলার সাতকাহন...: http://www.ali-mahmed.com/2013/06/blog-post_7.html

4 comments:

সায়মন said...

মনোযোগ দিয়ে পড়ছি,,,,

ধীমান said...

ইন্টারেস্টিং কন্টেন্ট।

নুহান said...

সোনা চৌ হাঃ হাঃ হাঃ। লেখক দেখি আমাদের দেশের ড্যান ব্রাউন :/

মাহি said...

++++++++++