Search

Saturday, July 20, 2013

সেরা সন্তান এবং একজন কুলাঙ্গার!

আজকের পত্রিকা থেকে জানলাম, গোলাম আজমকে হাসপাতালে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ডাবল বেডের রুমে রাখা হয়েছে। অতি উত্তম দেখভাল হচ্ছে।
গোলাম আজমকে নিয়ে একটা লেখা লিখেছিলাম ফান করে, 'একটি অবিচার(!) এবং আবেদন' (১)। যে তার প্রতি অবিচার হয়েছে তাই তাকে আরামপ্রদ চিকিৎসা দেওয়া হোক। কিন্তু এটা যে সত্যি-সত্যি হবে এটা আমার কল্পনারও বাইরে ছিল।

গোলাম আজম যে হাসপাতালে চিকিৎসা করাচ্ছেন সেই হাসপাতালেই আমি আমার মার চিকিৎসা করাতে ব্যর্থ হয়েছিলাম। কেবিন দূরের কথা একটা বিছানারও ব্যবস্থা হয়নি! হয়তো তখন আমার মাকে এই হাসপাতালের বারান্দায় ফেলে রাখতে পারতাম। তাহলে কী চিকিৎসা হতো? না, কোনো-না-কোনো এক দিন হয়তো চিকিৎসা করাবার সুযোগ মিলতেও মিলতে পারত! কিন্তু আমার কাছে সেই সময়টুকু ছিল না, ২৪ ঘন্টার মধ্যে অপারেশনটা করাতে হবে।

আজ গোলাম আযমের চিকিৎসা সংক্রান্ত লেখাটা পড়ে দুম করে দু-বছর পেছনে চলে গেলাম। আমার মার কঠিন অসুখ, বড় ধরনের একটা অপরেশন লাগবে। আমার তখন খুব দুঃসময়। একটা বহুজাতিক কোম্পানির সঙ্গে আইনি লড়াই চলছিল, ফতুর অবস্থা। ঝামেলাটা হয়েছিল সংক্ষেপে এমন, আমি এদেরকে বোঝাতে চেয়েছিলাম, শ্লা, তোমরা ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানি না আর আমিও তোমাদের অধীনস্থ 'ব্লাডি নেটিভ' না।
তো, হাতে টাকা-পয়সা নাই। কী করি, কোথায় যাই!

ডাক্তার সাদিয়া তখন পুরনো ঢাকার ন্যাশনাল মেডিকেল ইন্সটিটিউট হাসপাতালে। তিনি অনেক দৌড়-ঝাপ করে আমার মাকে ওখানে ভর্তি করার ব্যবস্থা করে দিলেন। ওয়ার্ডে অনেক রোগির সঙ্গে আমার মাও শুয়ে থাকেন। কিন্তু আমার যে ঘুরেফিরে মার কাছে যেতে ইচ্ছা করে কিন্তু ফিমেল ওয়ার্ড বিধায় আমি বড়ো বিব্রত বোধ করি। কিন্তু এখানকার অন্য রোগিদের কেউ-কেউ বড়ো সদাশয় ছিলেন, এরা কেমন-কেমন করে যেন আমার এই বিব্রত ভাবটা বুঝতে পারতেন। দরোজায় আমি দাঁড়িয়ে থাকলে আমাকে এটা-সেটা বলে ভেতরে ডেকে নিতেন।

প্রায়শ, জায়গাটা আমার বাজার-বাজার মনে হতো। আমাদের এখানকার হাসপাতালে লোকজন দল বেঁধে চলে আসেন, একটা মচ্ছব-মচ্ছব ভাব!

আর হাসপাতালে যে খাবার দেয় তা খাওয়া দূরের কথা দেখলেই পেটের ভেতরের সব বেরিয়ে আসতে চায়। বাথরুমে যে-কেউ একবার গেলে দ্বিতীয়বার যেতে চাইবে না।
আমার মা এই পরিবেশের সঙ্গে অনেক সময় নিজেকে মানিয়ে নিতে পারতেন না- কখনও-কখনও বিরক্তি প্রকাশও করতেন।

আমি তাঁর ক্ষোভ-বিরক্তি বুঝতে পারতাম, যে মহিলার স্বামীর ১৯৭০ সালেই ব্যক্তিগত গাড়ি ছিল তার সন্তান তাকে কোথায় এনে ফেলে রেখেছে! আমি মার না-বলা কথাটা বুঝতে আমার সমস্যা হয় না: আমার পোলা একটা কুলাঙ্গার হইছে।
আবার কখনও তাঁর বড়-বড় চোখ অসহায় করে আমার দিকে তাকানোর ভঙ্গিটাও আমি বুঝতে পারতাম: খোকা-খোকা, আমাকে কবে বাড়ি নিয়ে যাবি?
ভালয়-ভালয় তাঁর অপারেশনও হলো। কিন্তু তারপরও তাঁকে বাঁচানো গেল না!

পরে তাঁকে নিয়ে একটা লেখা শুরু করেছিলাম, 'হাসপাতাল পর্ব', [*] সম্ভবত ১৩ পর্ব পর্যন্ত লিখেছিলাম। ওই লেখায়, যেখানে ডাক্তার সাদিয়া এখনও ছোটাছুটি করে বেড়াচ্ছেন, আমার মাও বাড়ি ফেরার অপেক্ষায়, হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে আছেন।
...মনে হয়, থাক না, এই মহিলা বাড়ি ফেরার অপেক্ষায়। আহা বেচারি, বছরের-পর-বছর, যুগের-পর-যুগ ধরে তাঁর সাজানো সংসারে ফিরে যাবে...।
এরপর আমি আর লেখাটা লিখতে পারিনি, শেষ করতে পারিনি! এই দু-বছরে কত হাবিজাবি লেখাই না লিখেছি কিন্তু আমার মাকে নিয়ে ওই লেখাটা আর এগোয় না! কেন? আমি জানি না, মস্তিষ্কের একটা অংশ কী চাচ্ছে না আমার মার মৃত্যু হোক! সে কী আমার স্মৃতিতে তাঁকে বাঁচিয়ে রাখতে চায়! আমি জানি না, জানি আমি!

কপাল! আজ আবার এটা পড়লাম, জাফর ইকবালের লেখাটা, (২)। অনেকটা প্রায় এক রকম ঘটনা আমার বেলায়ও ঘটেছিল। শেষ সময়ে সদাশয় ডা. গুলজারের কল্যাণে আমার মাকে নিয়ে গিয়েছিলাম আয়েশা মেমোরিয়াল হাসপাতালে কারণ ন্যাশনালে 'ইনসেনটিভ কেয়ার ইউনিট' ছিল না।

'ইনসেনটিভ কেয়ার ইউনিট'-এ আমরা ভাই-বোন শক্ত করে হাত ধরে রেখেছি। অসংখ্য যন্ত্রপাতি তাঁকে বাঁচিয়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করে ব্যর্থ হচ্ছে। ...দ্রুত তাঁর ব্লাডপ্রেশার কমে যাচ্ছে। আমাদের মা বিদায় নিচ্ছেন। মনিটরের আঁকাবাকা রেখা ক্রমশ সোজা হয়ে আসছে।
পাশে দাঁড়ানো আমার দুই সুহৃদ ডা. গুলজার, ডা. মোস্তাফিজ আমাকে জানাচ্ছেন, সময় ঘনিয়ে আসছে।

এই গ্রহের সবচেয়ে বড়ো ম্যাজিসিয়ান তার সেরা ম্যাজিকটা দেখাবার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন। 'দ্যা শো মাস্ট গো অন'- এই শো থামাবার ক্ষমতা কারো নাই, কারো না!

স্থির চোখে আমি পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। তাকিয়ে আছে আমার মার পান্ডুর মুখের দিকে- রক্তশূণ্য তাঁর সাদা মুখ। কী তামাশা, মানুষটা এই আছে, এই নাই হয়ে যাবে! আমি জানি এ হওয়ার নয় তবুও আমি বিড়বিড় করি, আমার প্রাণের বিনিময়ে...।
আমার বোনটা আকুল হয়ে কাঁদছে। আমি তো কাঁদতে পারি না কারণ আমি জানি, আমি কেঁদে ফেললে আমার বোনটা ছাদ ফাটিয়ে গড়াগড়ি করে কাঁদবে। এ হতে দেয়া যায় না...।

আজও আমার মার কথা ভাবলেই আমার মাথায় সব কেমন জট পাকিয়ে পুরোপুরি এলোমেলো হয়ে যায়, এখনও। হাউমাউ করে কাঁদতে ইচ্ছা করে। পাগল, বললেই কী পা ছড়িয়ে বসে কাঁদা চলে! মরদের কাঁদার যে অনেক নিয়ম-কানুন আছে। চোখ ভরে এলে চট করে মুখ ঘুরিয়ে নিতে হয়। এক দৌড়ে বাথরুমে, পানির ট্যাপ খুলে দিতে হয়, পানি পড়ার তীব্র শব্দের সঙ্গে মিশে যায় হাহাকারের শব্দ, পানির স্রোতের সঙ্গে ভেসে যায় চোখের জল, নর্দমায়।
...
তখন এটা আমি মেনে নিয়েছিলাম, এদেশের লক্ষ-লক্ষ মানুষ আমার মত প্রাপ্য সুবিধা পান না কিন্তু আজ গোলাম আযমের এটা পড়ে আমি পারছি না, মেনে নিতে পারছি না।
হে রাষ্ট্র, গোলাম আযমের মত এই সব সেরা সন্তানদেরই জন্যই তোমার সমস্ত সুবিধা, আমার মত কুলাঙ্গারের জন্য না...।


* হাসপাতালপর্ব: http://tinyurl.com/boya6xk

১. একটি অবিচার (!) এবং গোলাম আজমের জন্য আবেদন: https://www.facebook.com/ali.mahmed1971/posts/10151523914857335
২. আমার বড় ভাই হুমায়ূন আহমেদ: http://www.samakal.net/2013/07/19/7252

No comments: