একজন প্রবীর সিকদার। তাঁর কাছ থেকে আমরা শুনি মুক্তিযুদ্ধের সময়কার কথা:
"বাবার পিঠে একশ' ঘামাচি মেরে দিলে পাওয়া যেত একটা ফুটবল। বড় কাকাকে দেড়শ' ঘামাচি ফোটানোর শব্দ শুনিয়ে পেতাম ক্রিকেট ব্যট-বল।
...পেছন ফিরে তাকালে মনে হয়, ওগুলো বুঝি গতকালের গল্প, আনন্দঘন স্মৃতি।
৮মে, ১৯৭১। সবকিছু ওলটপালট হয়ে গেল। রাজাকাররা কুপিয়ে-পিটিয়ে খুন করল বড় কাকাকে। রামদায়ের কোপে মৃত্যু যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতেও বড় কাকা আমাকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলেন, 'দেশ ঠিকই স্বাধীন হবে। কিন্তু তোকে লেখাপড়া শিখিয়ে যেতে পারলাম না'।
আমার শার্ট রক্তে ভিজে গিয়েছিল বড় কাকার তাজা রক্তে। ওই সময়েই রাজাকারদের হাতে খুন হয়েছিলেন, ছোটকাকা, মামাসহ আমার আরো ১৩ স্বজন। অসহায় ও বোবার মতো সেদিন আমাকে ওই হত্যাযজ্ঞ প্রত্যক্ষ করতে হয়েছিল।
ওই রক্তভেজা শার্ট না-শুকাতেই খবর পেয়েছিলাম, ওরা বাবা আর দাদুকে ধরে নিয়ে গেছে। পরে বড়কাকার রক্তমাখা আমার শার্টটা মা কোথায় রেখেছেন তা যেমন জানা হয়নি, তেমনি আর জানা হয়নি ওরা আমার বাবা-দাদুকে কোথায় কিভাবে হত্যা করেছে?
...মুক্তিযুদ্ধের পুরো সময়টা নিজেদের ভিটেবাড়ি থেকে বিতাড়িত হয়ে ফরিদপুরেরই বিভিন্ন গ্রামে যাযাবরের মত জীবন কাটিয়েছি। খাদ্য আর নিরাপত্তার খোঁজে বাড়ি থেকে বাড়ি, গ্রাম থেকে গ্রামে ঘুরেছি।
পাক-রাজাকারদের ধাওয়ার মুখে পাড়ি দিয়েছি মাঠের পর মাঠ, বিলের পর বিল, নদীর পর নদী। চোখে পড়েছে কুকুরে-শুকুনে খাওয়া অজস্র লাশ। বাবা যেদিন হারিয়ে যান সেদিন তার পরনে ছিল নীল লুঙ্গি। ওই অজস্র লাশের কোনোটির সঙ্গেই নীল লুঙ্গি না-থাকায় চিহ্নিত করতে পারিনি বাবার লাশ। তবে ওই সময়ের ছোট্ট মনে এটুকু বুঝেছি, ওই লাশগুলোর কোনো একটির মতই দেশের কোথাও না কোথাও পড়ে আছে আমার বাবার লাশ।
...আর এভবেই কখন যেন পুরো বাংলাদেশ হয়ে উঠেছে আমার বাবার কবরস্থান। যেখানেই যাই সেখানেই এখন আমি শুধু আমার বাবার লাশের গন্ধ পাই; কেননা ওই মাটিতেই মিশে আছেন আমার বাবা। দেশ জুড়ে যতো মানুষ দেখি সকলকেই মনে হয় আমার পরম আত্মীয়; ওরা কিংবা ওদের কোনো স্বজন, নিশ্চয়ই একাত্তরে সৎকার করেছিলেন আমার বাবার লাশের।
...একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে লেখালেখির অপরাধে ঘাতকের বোমা-গুলিতে উড়ে গেছে আমার একটি পা, চাপাদির কোপে স্বাভাবিক কর্মক্ষমতা হারিয়েছে আমার একটি হাত। অবশ্য এসব নিয়ে আমার ক্ষোভ-যন্ত্রণা নেই।
...অস্থির যন্ত্রণায় লীন গয়ে ভাবতাম, কেন যে ওরা একাত্তরে 'ঘামাচি মারার শর্তে ফুটবল' দেওয়া বাবাকে আমার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে গেল? আমার সেই বাবা ডাকা, না ডাকার অসুস্থতা কেটেছে আমার ছেলের জন্মের পর। এখন আমি ছেলেকেই 'বাবা' ডাকি, ছেলের ভেতরেই একাত্তরে হারানো বাবার অস্তিত্ব খুঁজে পাই। এরই মধ্যে ছেলেকে বলেও দিয়েছি, 'তোমার চারপাশে যতো বড় বাংলাদেশ তার পুরোটাই তোমারই দাদুর কবরস্থান; কখনোই যেন দাদুর কবরস্থানের অমর্যাদা না হয়...।"
*একাত্তরের রাজাকারদের নিয়ে লেখার অপরাধে প্রবীর সিকদারকে গুলি করা হয়েছিল, বোমা মারা হয়েছিল। তাঁর শরীরে এখনও অসংখ্য স্প্লিন্টার, উড়ে গেছে ডান পা- এখন ক্রাচে ভর দিয়ে হাঁটেন।
চাপাতি দিয়ে কোপানোও হয়েছিল তাঁকে, বাম হাত প্রায় অকেজো।
তবুও এই মানুষটা বিন্দুমাত্র মনোবল হারাননি। আমি এখনও তাঁর সঙ্গে কথা বললে মনে বড়ো জোর পাই...।
**প্রবীর সিকদারের চমৎকার একটা বই আছে, 'আমি শালা রাজাকার'। এই বইটা থেকে খানিকটা তুলে দেই:
"...চারটা পায়ে একটা কুত্তা
আমার আছে দুই
আর দুইটা পা থাকতো যদি
আমিও কুকুর হই।"
...
"নিজামি আর মুজাহিদের
গাড়ি চলে উড়ে
লাল সবুজের ওই পতাকা
কাঁদে কিন্তু ওড়ে।"
"বাবার পিঠে একশ' ঘামাচি মেরে দিলে পাওয়া যেত একটা ফুটবল। বড় কাকাকে দেড়শ' ঘামাচি ফোটানোর শব্দ শুনিয়ে পেতাম ক্রিকেট ব্যট-বল।
...পেছন ফিরে তাকালে মনে হয়, ওগুলো বুঝি গতকালের গল্প, আনন্দঘন স্মৃতি।
৮মে, ১৯৭১। সবকিছু ওলটপালট হয়ে গেল। রাজাকাররা কুপিয়ে-পিটিয়ে খুন করল বড় কাকাকে। রামদায়ের কোপে মৃত্যু যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতেও বড় কাকা আমাকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলেন, 'দেশ ঠিকই স্বাধীন হবে। কিন্তু তোকে লেখাপড়া শিখিয়ে যেতে পারলাম না'।
আমার শার্ট রক্তে ভিজে গিয়েছিল বড় কাকার তাজা রক্তে। ওই সময়েই রাজাকারদের হাতে খুন হয়েছিলেন, ছোটকাকা, মামাসহ আমার আরো ১৩ স্বজন। অসহায় ও বোবার মতো সেদিন আমাকে ওই হত্যাযজ্ঞ প্রত্যক্ষ করতে হয়েছিল।
ওই রক্তভেজা শার্ট না-শুকাতেই খবর পেয়েছিলাম, ওরা বাবা আর দাদুকে ধরে নিয়ে গেছে। পরে বড়কাকার রক্তমাখা আমার শার্টটা মা কোথায় রেখেছেন তা যেমন জানা হয়নি, তেমনি আর জানা হয়নি ওরা আমার বাবা-দাদুকে কোথায় কিভাবে হত্যা করেছে?
...মুক্তিযুদ্ধের পুরো সময়টা নিজেদের ভিটেবাড়ি থেকে বিতাড়িত হয়ে ফরিদপুরেরই বিভিন্ন গ্রামে যাযাবরের মত জীবন কাটিয়েছি। খাদ্য আর নিরাপত্তার খোঁজে বাড়ি থেকে বাড়ি, গ্রাম থেকে গ্রামে ঘুরেছি।
পাক-রাজাকারদের ধাওয়ার মুখে পাড়ি দিয়েছি মাঠের পর মাঠ, বিলের পর বিল, নদীর পর নদী। চোখে পড়েছে কুকুরে-শুকুনে খাওয়া অজস্র লাশ। বাবা যেদিন হারিয়ে যান সেদিন তার পরনে ছিল নীল লুঙ্গি। ওই অজস্র লাশের কোনোটির সঙ্গেই নীল লুঙ্গি না-থাকায় চিহ্নিত করতে পারিনি বাবার লাশ। তবে ওই সময়ের ছোট্ট মনে এটুকু বুঝেছি, ওই লাশগুলোর কোনো একটির মতই দেশের কোথাও না কোথাও পড়ে আছে আমার বাবার লাশ।
...আর এভবেই কখন যেন পুরো বাংলাদেশ হয়ে উঠেছে আমার বাবার কবরস্থান। যেখানেই যাই সেখানেই এখন আমি শুধু আমার বাবার লাশের গন্ধ পাই; কেননা ওই মাটিতেই মিশে আছেন আমার বাবা। দেশ জুড়ে যতো মানুষ দেখি সকলকেই মনে হয় আমার পরম আত্মীয়; ওরা কিংবা ওদের কোনো স্বজন, নিশ্চয়ই একাত্তরে সৎকার করেছিলেন আমার বাবার লাশের।
...একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে লেখালেখির অপরাধে ঘাতকের বোমা-গুলিতে উড়ে গেছে আমার একটি পা, চাপাদির কোপে স্বাভাবিক কর্মক্ষমতা হারিয়েছে আমার একটি হাত। অবশ্য এসব নিয়ে আমার ক্ষোভ-যন্ত্রণা নেই।
...অস্থির যন্ত্রণায় লীন গয়ে ভাবতাম, কেন যে ওরা একাত্তরে 'ঘামাচি মারার শর্তে ফুটবল' দেওয়া বাবাকে আমার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে গেল? আমার সেই বাবা ডাকা, না ডাকার অসুস্থতা কেটেছে আমার ছেলের জন্মের পর। এখন আমি ছেলেকেই 'বাবা' ডাকি, ছেলের ভেতরেই একাত্তরে হারানো বাবার অস্তিত্ব খুঁজে পাই। এরই মধ্যে ছেলেকে বলেও দিয়েছি, 'তোমার চারপাশে যতো বড় বাংলাদেশ তার পুরোটাই তোমারই দাদুর কবরস্থান; কখনোই যেন দাদুর কবরস্থানের অমর্যাদা না হয়...।"
*একাত্তরের রাজাকারদের নিয়ে লেখার অপরাধে প্রবীর সিকদারকে গুলি করা হয়েছিল, বোমা মারা হয়েছিল। তাঁর শরীরে এখনও অসংখ্য স্প্লিন্টার, উড়ে গেছে ডান পা- এখন ক্রাচে ভর দিয়ে হাঁটেন।
চাপাতি দিয়ে কোপানোও হয়েছিল তাঁকে, বাম হাত প্রায় অকেজো।
তবুও এই মানুষটা বিন্দুমাত্র মনোবল হারাননি। আমি এখনও তাঁর সঙ্গে কথা বললে মনে বড়ো জোর পাই...।
**প্রবীর সিকদারের চমৎকার একটা বই আছে, 'আমি শালা রাজাকার'। এই বইটা থেকে খানিকটা তুলে দেই:
"...চারটা পায়ে একটা কুত্তা
আমার আছে দুই
আর দুইটা পা থাকতো যদি
আমিও কুকুর হই।"
...
"নিজামি আর মুজাহিদের
গাড়ি চলে উড়ে
লাল সবুজের ওই পতাকা
কাঁদে কিন্তু ওড়ে।"
9 comments:
চোখে পানি কিন্তু দাতে দাত চেপে আছি। প্রবীরদাকে বলবেন আমরা এই প্রজন্ম আছি ওনার সঙ্গে।
shovo vai, probir sir ke amar torof theke salam pouche deben...
অবশ্যই আপনাদের তীব্র ভাল লাগার কথাটা আমি ওনাকে জানিয়ে দিচ্ছি। আপনাদের ভাল লাগার কথাটা তিনি জানবেন না তা তো হয় না...
প্রবীর সিকদার নিজে কোন স্মৃতিচারণমূলক বইপত্র লিখেছেন কি?
তাঁর কিছু বই আছে:
১. বাংলাদেশ শুধুই আমার বাবার কবরস্থান
২. আমি শালা রাজাকার
৩. বর্ণমালায় বাংলাদেশ @Ripon Majumder
গতকাল রাতে পিতা ছবিটা দেখলাম আর আজ এই লেখাটা পড়লাম। কিছুতেই কান্না থামাতে পারছিনা। যে বাঙালী এত কষ্ট করে স্বাধীনতা অর্জন করেছে আজ বাঙালী সেই পবিত্র ভূমিতে কিভাবে এইসব রাজাকারের বাচ্চাদের সহ্য করে তাদের সাপোর্ট করে আমি কিছুতেই ভেবে পাইনা... কবে আমাদের বোধোদয় হবে? কবে আমরা সত্যিই দেশটাকে ভালবাসতে শিখব? কবে প্রিয় মাতৃভূমিটাকে হায়েনা মুক্ত করতে পারব?
আমরা আমাদের দেশ কে কখনোই অই হায়না গুলার খাদ্য হতে দেবো না। যে আমাদের দেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে কথা বল্বে,আমার বাবা হলেও তাকে ছার দেয়া হবে না।
আপনার প্রশ্নের উত্তর আমার জানা নেই :( @Moushumi Shultana
"...আমার বাবা হলেও তাকে ছার দেয়া হবে না।"
অসাধারণ একটা কথা বললেন তো! @Rumpa Islam
Post a Comment