ক্ষমতার পট পরিবর্তনের সঙ্গে নিয়ম করে যে নিষ্ঠুর, কাপুরুষোচিত কান্ডটা ঘটে, সেটা হচ্ছে, ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকা মানুষটিকে মেরে ফেলা। এটাকে বাধা অপসারণের জন্য সবচেয়ে সহজ উপায় বলে মনে করা হয়। কিন্তু ১৯৭৫ সালে যে হত্যাকান্ডটা হয়েছিল তার উদাহরণ এই গ্রহের অন্যত্র আছে কিনা এটা আমার জানা নেই। পরিবারের প্রায় সবাইকে খুন করা, ছোট্ট একটি শিশুকেও।
যারা এই কাজটি করেছিল এরা সবাই সামরিক লোকজন ছিল, সৈনিক-যোদ্ধা! আমি মনে করি, এদেরকে কোনো প্রকারেই যোদ্ধা বলা চলে না। একজন যোদ্ধা কখনই মেয়ে এবং শিশুর গায়ে হাত তুলতে, খুন করতে পারে না।
এমনকি দুর্ধর্ষ যেসব সন্ত্রাসী থাকে, যারা প্রফেশনাল- যাদের কাজ হচ্ছে টাকার বিনিময়ে খুন করা; এরাও একটা অলিখিত নিয়ম মেনে চলে। খুনের তালিকায় শিশু-মেয়েমানুষ হলে চুক্তিবদ্ধ হওয়া যাবে না।
যাই হোক, আরেকটা বেদনার দিক হচ্ছে, তার স্বজনেরা কখনই জানতে পারবেন না তার প্রিয়মানুষকে ঠিক কোথায় কবর দেওয়া হয়েছে। যেমনটা আমরা দেখেছি, জেনারেল মঞ্জুরের বেলায়। একজন মুক্তিযোদ্ধা, একজন সেক্টর কমান্ডার, একজন জেনারেল- যার কবরের কোনো চিহ্ন পর্যন্ত নাই!
লে. কর্নেল (অবঃ) এম এ হামিদ ১৯৭৫ সালে, তিনি তখন ঢাকার স্টেশন কমান্ডার। আমরা তাঁর মুখ থেকে শুনি:
"...রাত তিনটা...ক্রমাগত ফোন বেজেই চলল। (এতো রাতে...) আমার স্ত্রীর নিষেধ উপেক্ষা করে ফোন ধরলে ওপাশ থেকে মেজর আবদুল মতিন (পরবর্তীতে ব্রিগেডিয়ার) বললেন, 'আমি বঙ্গভবন থেকে বলছি, নূতন রাষ্ট্রপতি, এবং সেনাবাহিনী ও অন্যান্য বাহিনীর প্রধানসহ অন্যান্য উচ্চপদস্ত কর্মকর্তাদের পক্ষে আপনাকে যে মেসেজ দিচ্ছি তা হচ্ছে, আগামীকাল সূর্য উঠার আগেই, শেখ সাহেবের বাসার সমস্ত লাশগুলো বনানী গোরস্তানে দাফন করার ব্যবস্থা নিতে হবে'।"
তাঁর উপর এই দায়িত্ব বর্তাবার পর স্টেশন কমান্ডার হামিদ প্রাণান্তকর চেষ্টায়, যথাসম্ভব মর্যাদার সঙ্গে প্রত্যেকটা লাশের আলাদা-আলাদা ট্যাগ লাগিয়ে কেবল আলাদা-আলাদা কবরে দাফনের ব্যবস্থাই করেননি, তিনি তাঁর প্যাডে আলাদা করে লিখে রেখেছিলেন কার কবর কোনটা।
এই প্যাডের লেখা ব্যতীত অন্যত্র আর কোনো রেকর্ড রাখা হয়নি বা ছিল না। সেই সময় এই সব নিয়ে মাথা ঘামাবার মত বাড়তি সময় কারো ছিল না!
ওই প্যাডের ফটোকপি তিনি যুক্ত করেছিলেন তাঁর লেখা বই, 'তিনটি সেনা অভ্যুত্থান ও কিছু না বলা কথা'-য়।
ওখানে তিনি লিখেছিলেন, "প্রথম কবরটা বেগম মুজিবের। দ্বিতীয়টা শেখ নাসেরের। তৃতীয়টা শেখ কামালের। চতুর্থ কবর মিসেস কামালের। পঞ্চম কবর শেখ জামালের। ষষ্ঠ কবরে মিসেস জামাল এবং সপ্তম কবরে শায়িত আছে মাস্টার রাসেল।"
...
লে. কর্নেল হামিদ যখন সিএমএইচ-এ এসে পৌঁছান তখন ঘটনাচক্রে সঙ্গে আলোচিত্রি আফতাব আহমদও ছিলেন।
খালেদ মোশারফের লাশ হুদা এবং হায়দারের সঙ্গে মর্গে থাকার কথা কিন্তু হামিদ এসে দেখেন অন্য দুইটা লাশ মর্গে আছে ঠিকই কিন্তু খালেদ মোশারফের লাশ অতি অবহেলা ভরে মাঠে ফেলে রাখা হয়েছে। তখন আফতাব আহমদ জেনারেল খালেদের দুই-তিনটা ছবিও তোলেন।
মাঠে অনাদরে ফেলে রাখা খালেদ মোশারফের লাশ সৈনিকেরা দলে-দলে এসে দেখছে, কেউ-কেউ লাশের উপর থু থু-ও দিচ্ছে!
সিএমএইচে তখন কোনো অফিসার ছিলেন না কারণ সৈনিকরা তখন কোনো অফিসারকে পেলেই চরম অপমান করছে, হত্যা করছে। লে. কর্নেল হামিদ কোনো অফিসারকে না-পেয়ে তখন একজন সুবেদারকে ডেকে বললেন, খালেদ, একজন সিনিয়র অফিসার। তাঁর লাশকে এভাবে অসম্মান করাটা অন্যায় হচ্ছে। তাঁর লাশটা মর্গে উঠিয়ে রাখার জন্য।
সেই সুবেদার তখন একজন ডোমকে ডেকে খালেদ মোশারফের লাশ মর্গে রাখার ব্যবস্থা করেন।
জনাব হামিদ, আরেকটা অসাধারণ কাজ করেছিলেন, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে খালেদ মোশাররফের পরিবারের সঙ্গে নিজে উপস্থিত থেকে বনানী কবরস্থানে খালেদ মোশাররফের লাশ দাফন করার ব্যবস্থা করেছিলেন।
*জনাব হামিদ, দাবাড়ু রানী হামিদের স্বামী, ফুটবলার কায়সার হামিদের বাবা।
যারা এই কাজটি করেছিল এরা সবাই সামরিক লোকজন ছিল, সৈনিক-যোদ্ধা! আমি মনে করি, এদেরকে কোনো প্রকারেই যোদ্ধা বলা চলে না। একজন যোদ্ধা কখনই মেয়ে এবং শিশুর গায়ে হাত তুলতে, খুন করতে পারে না।
এমনকি দুর্ধর্ষ যেসব সন্ত্রাসী থাকে, যারা প্রফেশনাল- যাদের কাজ হচ্ছে টাকার বিনিময়ে খুন করা; এরাও একটা অলিখিত নিয়ম মেনে চলে। খুনের তালিকায় শিশু-মেয়েমানুষ হলে চুক্তিবদ্ধ হওয়া যাবে না।
যাই হোক, আরেকটা বেদনার দিক হচ্ছে, তার স্বজনেরা কখনই জানতে পারবেন না তার প্রিয়মানুষকে ঠিক কোথায় কবর দেওয়া হয়েছে। যেমনটা আমরা দেখেছি, জেনারেল মঞ্জুরের বেলায়। একজন মুক্তিযোদ্ধা, একজন সেক্টর কমান্ডার, একজন জেনারেল- যার কবরের কোনো চিহ্ন পর্যন্ত নাই!
লে. কর্নেল (অবঃ) এম এ হামিদ ১৯৭৫ সালে, তিনি তখন ঢাকার স্টেশন কমান্ডার। আমরা তাঁর মুখ থেকে শুনি:
"...রাত তিনটা...ক্রমাগত ফোন বেজেই চলল। (এতো রাতে...) আমার স্ত্রীর নিষেধ উপেক্ষা করে ফোন ধরলে ওপাশ থেকে মেজর আবদুল মতিন (পরবর্তীতে ব্রিগেডিয়ার) বললেন, 'আমি বঙ্গভবন থেকে বলছি, নূতন রাষ্ট্রপতি, এবং সেনাবাহিনী ও অন্যান্য বাহিনীর প্রধানসহ অন্যান্য উচ্চপদস্ত কর্মকর্তাদের পক্ষে আপনাকে যে মেসেজ দিচ্ছি তা হচ্ছে, আগামীকাল সূর্য উঠার আগেই, শেখ সাহেবের বাসার সমস্ত লাশগুলো বনানী গোরস্তানে দাফন করার ব্যবস্থা নিতে হবে'।"
তাঁর উপর এই দায়িত্ব বর্তাবার পর স্টেশন কমান্ডার হামিদ প্রাণান্তকর চেষ্টায়, যথাসম্ভব মর্যাদার সঙ্গে প্রত্যেকটা লাশের আলাদা-আলাদা ট্যাগ লাগিয়ে কেবল আলাদা-আলাদা কবরে দাফনের ব্যবস্থাই করেননি, তিনি তাঁর প্যাডে আলাদা করে লিখে রেখেছিলেন কার কবর কোনটা।
এই প্যাডের লেখা ব্যতীত অন্যত্র আর কোনো রেকর্ড রাখা হয়নি বা ছিল না। সেই সময় এই সব নিয়ে মাথা ঘামাবার মত বাড়তি সময় কারো ছিল না!
ওই প্যাডের ফটোকপি তিনি যুক্ত করেছিলেন তাঁর লেখা বই, 'তিনটি সেনা অভ্যুত্থান ও কিছু না বলা কথা'-য়।
ওখানে তিনি লিখেছিলেন, "প্রথম কবরটা বেগম মুজিবের। দ্বিতীয়টা শেখ নাসেরের। তৃতীয়টা শেখ কামালের। চতুর্থ কবর মিসেস কামালের। পঞ্চম কবর শেখ জামালের। ষষ্ঠ কবরে মিসেস জামাল এবং সপ্তম কবরে শায়িত আছে মাস্টার রাসেল।"
...
লে. কর্নেল হামিদ যখন সিএমএইচ-এ এসে পৌঁছান তখন ঘটনাচক্রে সঙ্গে আলোচিত্রি আফতাব আহমদও ছিলেন।
খালেদ মোশারফের লাশ হুদা এবং হায়দারের সঙ্গে মর্গে থাকার কথা কিন্তু হামিদ এসে দেখেন অন্য দুইটা লাশ মর্গে আছে ঠিকই কিন্তু খালেদ মোশারফের লাশ অতি অবহেলা ভরে মাঠে ফেলে রাখা হয়েছে। তখন আফতাব আহমদ জেনারেল খালেদের দুই-তিনটা ছবিও তোলেন।
মাঠে অনাদরে ফেলে রাখা খালেদ মোশারফের লাশ সৈনিকেরা দলে-দলে এসে দেখছে, কেউ-কেউ লাশের উপর থু থু-ও দিচ্ছে!
সিএমএইচে তখন কোনো অফিসার ছিলেন না কারণ সৈনিকরা তখন কোনো অফিসারকে পেলেই চরম অপমান করছে, হত্যা করছে। লে. কর্নেল হামিদ কোনো অফিসারকে না-পেয়ে তখন একজন সুবেদারকে ডেকে বললেন, খালেদ, একজন সিনিয়র অফিসার। তাঁর লাশকে এভাবে অসম্মান করাটা অন্যায় হচ্ছে। তাঁর লাশটা মর্গে উঠিয়ে রাখার জন্য।
সেই সুবেদার তখন একজন ডোমকে ডেকে খালেদ মোশারফের লাশ মর্গে রাখার ব্যবস্থা করেন।
জনাব হামিদ, আরেকটা অসাধারণ কাজ করেছিলেন, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে খালেদ মোশাররফের পরিবারের সঙ্গে নিজে উপস্থিত থেকে বনানী কবরস্থানে খালেদ মোশাররফের লাশ দাফন করার ব্যবস্থা করেছিলেন।
*জনাব হামিদ, দাবাড়ু রানী হামিদের স্বামী, ফুটবলার কায়সার হামিদের বাবা।
No comments:
Post a Comment