(সূত্র: আনোয়ার কবিরের 'সশস্ত্র বাহিনীতে গণহত্যা' থেকে)
১৯৭৭ সালে ঢাকা কারাগারে বন্দি ছিলেন রইসউদ্দিন আরিফ। তিনি গণফাঁসির প্রত্যক্ষদর্শী। তাঁর বর্ণনা থেকে জানা যায়:
"...'ওখান থেকে, যেমন করে ছাগল বেঁধে নিয়ে বধ্যভূমিতে জবাই করার জন্য , এমন করে নয়-দশ জনকে হাত এবং বুক বেঁধে নিয়ে যাচ্ছে! এদের চিৎকার, এদর গোঙানি, এদের আহাজারির শব্দটিই- এতো বিকট একটা শব্দ, এই শব্দ আমাদের কাছে একেবারেই অপরিচিত!
তাৎক্ষণিক ভাবে জানতে পারলাম, এই লোকগুলোর জন্য জেলঅফিসে একটি ট্রাইব্যুনাল করা হয়েছে এবং মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যেই এদের বিচার কাজ সমাপ্ত করা হয়েছে। যাদেরকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে তাদেরকেই ফাঁসি দেওয়া হবে। তারপরেই তাদেরকে বধ্যভূমিতে যেখানে ফাঁসি দেওয়া হয় সেখানে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। তারা বুঝতে পারছে তাদের ফাঁসির হুকুম হয়ে গেছে। এখন তাদেরকে টেনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ফাঁসিতে ঝোলাবার জন্য! টলতে টলতে গেল তারা আমাদের চোখের সামনেই।
...এভাবে ফাঁসি হলো। এটা হলো প্রথম রাতের ঘটনা। এই ঘটনাটি প্রতি রাতেই ঘটতে থাকল। ...একই অবস্থা, একই দৃশ্য, কখনও হয়তো ছয়জন, কখনও সাতজন, কখনও সাতজন একসাথে, নয়জন একসাথে। তখন আর আমাদের ঘুমই হতো না। দিনের বেলায়ও আমরা সতর্ক থাকতাম, দিনের বেলায়ও এরকম ফাঁসি দেয় কিনা...।
এর মধ্যে আমার কাছে সবচেয়ে মর্মান্তিক ঘটনা যেটা মনে হয়েছে। একজন ফাঁসির আসামীকে যখন টেনে ঝোলানো হচ্ছিল সে সবচেয়ে বেশী প্রতিবাদী ছিল। তার যে চিৎকার তা সম্ভবত জেলখানার বাইরেও পৌঁছে গিয়েছিল। জোর-জবরদস্তি করে তাকে যখন ফাঁসির দড়িতে ঝোলানো হয় তখনও সে ধস্তাধস্তি করছিল। যখন ফাঁসির রশি তার গলায় দিয়ে নীচের পাদানিতে ফেলে দেওয়া হয় তখন সে এতো জোরে পড়ে গিয়েছিল যে তার গলা ছিঁড়ে গিয়েছিল। নৃশংসতার মধ্যেও এখানে আরো অনেক নৃশংসতার ঘটনা ঘটেছিল।
এভাবে অবিরাম গণফাঁসি চলছিল।
বিচার নামের এই পর্বের নমুনা ছিল এমন। ৩০ জনের বিচার শেষ হতে ১৫ মিনিটও লাগেনি! একজন মানুষকে মৃত্যুদন্ড দেওয়া হবে, ফাঁসিতে ঝোলানো হবে অথচ আধা মিনিটও লাগেনি! জাস্ট অর্ডার এবং আগে থেকেই অর্ডার হয়ে আছে- ব্যস, ঘোষণা দেওয়া হলো, তোমার ফাঁসি হবে।
...এই যে গণফাঁসি, এটি ঢাকা সেন্ট্রাল জেলের দু'শ বছর ইতিহাসে বিরল ঘটনা এবং এটি নজিরবিহীন অভিজ্ঞতা।'
কর্পোরাল নূরুল ইসলাম, ১৯৭৭ সালের ঘটনায় চার বছরের কারাদন্ড প্রাপ্ত। তাঁর বর্ণনা:
...'প্রত্যেক দিনই ধরে ধরে নিয়ে ফাঁসি দিতে লাগল।...এরকম হাজারও লোককে ফাঁসি দেওয়া হয়েছে। ফাঁসি দিতে গিয়ে গলা ছিঁড়ে পড়ে গেছে এরকম ঘটনাও আছে। লিপির আব্বার গলা ছিঁড়ে পড়ে গিয়েছিল। ফাঁসি বাদে কত লোক যে গুপ্ত হত্যার শিকার হয়েছে এটিরও কোনো হদিস পাওয়া যায়নি'!
কর্পোরাল খায়রুল আনোয়ার। ১৮৭৭ সালের ঘটনায় ৮ বছর কারাদন্ড প্রাপ্ত। তাঁর বর্ণনা:
...'কর্পোরাল আকবারের ২ বছরের সাজা হয়েছিল, আর আর্মির একই নামের, তার নামও আকবর, সেই সৈনিকের মৃত্যুদন্ড হয়েছিল। সে রাতে আর্মির আকবরের মৃত্যুদন্ড কার্যকর করার কথা। সে কনডেম সেলে বসে আল্লাহকে ডাকছিল, তাই তারা যখন আকবরের নাম ধরে ডাকে তখন হয়তো শোনেনি বলে উত্তর দেয়নি।
এদিকে যারা ফাঁসি দিত তাদের হাতে সময় কম থাকত। তো, আকবর বলে যখন ডাকছিল তখন অন্যজন কর্পোরাল আকবর উত্তর দেয়ার পরই তাকে ধরে নিয়ে গেল। সে বারবার বলছিল আমার তো ২ বছরের জেল হয়েছে, আমার তো ফাঁসির আদেশ হয়নি। তারা সেই আকবরের কোনো কথাই শুনছিল না। তাকে শেষ গোসল করিয়ে যমটুপি পরিয়ে ফাঁসির মঞ্চে নিয়ে গেল। তার গলায় ফাঁসির রশি পরিয়ে দিল।
শেষ ইচ্ছা জানার সময় সে বলল, ঠিক আছে আপনারা আমাকে অন্যায় ভাবে ফাঁসি দিচ্ছেন, দেন, আমার কোনো কথাই শুনছেন না, আমার বাবার নাম, কোথায় চাকরি করি তাও শুনছেন না! এয়ারফোর্সের নাম্বার এবং আর্মির নাম্বারের মধ্যে বিশাল পার্থক্য আছে। আপনারা অন্তত এই নাম্বারটা মিলিয়ে দেখেন।
যাই হোক, নাম্বার মিলিয়ে দেখা গেল, নাম্বার মিলছে না।
পরে জেলার তাকে ফাঁসির মঞ্চ থেকে নামিয়ে আনলেন।
,,,কর্পোরাল আরজু তখন বিমানবাহিনীর চিফ অভ এয়ার স্টাফ এয়ার ভাইস মার্শাল এজি মাহমুদের বডিগার্ড। এই আরজুই সেই টালমাটাল অবস্থার সময় এজি মাহমুদকে নিরাপদে পার করে দেয়। অথচ ফাঁসির আগে বারবার বলছিলেন, আপনারা এয়ার ভাইস মার্শাল এজি মাহমুদকে জিজ্ঞেস করুন আমি তাকে রক্ষা করেছিলাম কি না বা আমি এই বিদ্রেহের সঙ্গে জড়িত ছিলাম কি না। কিন্তু কেউ কর্পোরাল আরজুর কথায় কান দেয়নি! একবারও কেউ এজি মাহমুদকে জিজ্ঞাসা করার প্রয়োজন বোধ করেনি! কর্পোরাল আরজুর ফাঁসি হয়ে যায়...'।"
*১৯৭৭ সালে যে রহস্যময় সেনা অভ্যুত্থান হয় [১] তখনই অনেককেই মেরে ফেলা হয়। যারা বেঁচে গিয়েছিলেন তাঁদের বিচারের নামে স্রেফ খুন করা হয়। যার অসংখ্য নমুনা থেকে সামান্যই এখানে উল্লেখ করা হলো।
১. ঢাকায় রহস্যময় বিমান-সেনা হামলা (অভ্যুত্থান)!: https://www.facebook.com/ali.mahmed1971/posts/10151605687217335
১৯৭৭ সালে ঢাকা কারাগারে বন্দি ছিলেন রইসউদ্দিন আরিফ। তিনি গণফাঁসির প্রত্যক্ষদর্শী। তাঁর বর্ণনা থেকে জানা যায়:
"...'ওখান থেকে, যেমন করে ছাগল বেঁধে নিয়ে বধ্যভূমিতে জবাই করার জন্য , এমন করে নয়-দশ জনকে হাত এবং বুক বেঁধে নিয়ে যাচ্ছে! এদের চিৎকার, এদর গোঙানি, এদের আহাজারির শব্দটিই- এতো বিকট একটা শব্দ, এই শব্দ আমাদের কাছে একেবারেই অপরিচিত!
তাৎক্ষণিক ভাবে জানতে পারলাম, এই লোকগুলোর জন্য জেলঅফিসে একটি ট্রাইব্যুনাল করা হয়েছে এবং মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যেই এদের বিচার কাজ সমাপ্ত করা হয়েছে। যাদেরকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে তাদেরকেই ফাঁসি দেওয়া হবে। তারপরেই তাদেরকে বধ্যভূমিতে যেখানে ফাঁসি দেওয়া হয় সেখানে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। তারা বুঝতে পারছে তাদের ফাঁসির হুকুম হয়ে গেছে। এখন তাদেরকে টেনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ফাঁসিতে ঝোলাবার জন্য! টলতে টলতে গেল তারা আমাদের চোখের সামনেই।
...এভাবে ফাঁসি হলো। এটা হলো প্রথম রাতের ঘটনা। এই ঘটনাটি প্রতি রাতেই ঘটতে থাকল। ...একই অবস্থা, একই দৃশ্য, কখনও হয়তো ছয়জন, কখনও সাতজন, কখনও সাতজন একসাথে, নয়জন একসাথে। তখন আর আমাদের ঘুমই হতো না। দিনের বেলায়ও আমরা সতর্ক থাকতাম, দিনের বেলায়ও এরকম ফাঁসি দেয় কিনা...।
এর মধ্যে আমার কাছে সবচেয়ে মর্মান্তিক ঘটনা যেটা মনে হয়েছে। একজন ফাঁসির আসামীকে যখন টেনে ঝোলানো হচ্ছিল সে সবচেয়ে বেশী প্রতিবাদী ছিল। তার যে চিৎকার তা সম্ভবত জেলখানার বাইরেও পৌঁছে গিয়েছিল। জোর-জবরদস্তি করে তাকে যখন ফাঁসির দড়িতে ঝোলানো হয় তখনও সে ধস্তাধস্তি করছিল। যখন ফাঁসির রশি তার গলায় দিয়ে নীচের পাদানিতে ফেলে দেওয়া হয় তখন সে এতো জোরে পড়ে গিয়েছিল যে তার গলা ছিঁড়ে গিয়েছিল। নৃশংসতার মধ্যেও এখানে আরো অনেক নৃশংসতার ঘটনা ঘটেছিল।
এভাবে অবিরাম গণফাঁসি চলছিল।
বিচার নামের এই পর্বের নমুনা ছিল এমন। ৩০ জনের বিচার শেষ হতে ১৫ মিনিটও লাগেনি! একজন মানুষকে মৃত্যুদন্ড দেওয়া হবে, ফাঁসিতে ঝোলানো হবে অথচ আধা মিনিটও লাগেনি! জাস্ট অর্ডার এবং আগে থেকেই অর্ডার হয়ে আছে- ব্যস, ঘোষণা দেওয়া হলো, তোমার ফাঁসি হবে।
...এই যে গণফাঁসি, এটি ঢাকা সেন্ট্রাল জেলের দু'শ বছর ইতিহাসে বিরল ঘটনা এবং এটি নজিরবিহীন অভিজ্ঞতা।'
কর্পোরাল নূরুল ইসলাম, ১৯৭৭ সালের ঘটনায় চার বছরের কারাদন্ড প্রাপ্ত। তাঁর বর্ণনা:
...'প্রত্যেক দিনই ধরে ধরে নিয়ে ফাঁসি দিতে লাগল।...এরকম হাজারও লোককে ফাঁসি দেওয়া হয়েছে। ফাঁসি দিতে গিয়ে গলা ছিঁড়ে পড়ে গেছে এরকম ঘটনাও আছে। লিপির আব্বার গলা ছিঁড়ে পড়ে গিয়েছিল। ফাঁসি বাদে কত লোক যে গুপ্ত হত্যার শিকার হয়েছে এটিরও কোনো হদিস পাওয়া যায়নি'!
কর্পোরাল খায়রুল আনোয়ার। ১৮৭৭ সালের ঘটনায় ৮ বছর কারাদন্ড প্রাপ্ত। তাঁর বর্ণনা:
...'কর্পোরাল আকবারের ২ বছরের সাজা হয়েছিল, আর আর্মির একই নামের, তার নামও আকবর, সেই সৈনিকের মৃত্যুদন্ড হয়েছিল। সে রাতে আর্মির আকবরের মৃত্যুদন্ড কার্যকর করার কথা। সে কনডেম সেলে বসে আল্লাহকে ডাকছিল, তাই তারা যখন আকবরের নাম ধরে ডাকে তখন হয়তো শোনেনি বলে উত্তর দেয়নি।
এদিকে যারা ফাঁসি দিত তাদের হাতে সময় কম থাকত। তো, আকবর বলে যখন ডাকছিল তখন অন্যজন কর্পোরাল আকবর উত্তর দেয়ার পরই তাকে ধরে নিয়ে গেল। সে বারবার বলছিল আমার তো ২ বছরের জেল হয়েছে, আমার তো ফাঁসির আদেশ হয়নি। তারা সেই আকবরের কোনো কথাই শুনছিল না। তাকে শেষ গোসল করিয়ে যমটুপি পরিয়ে ফাঁসির মঞ্চে নিয়ে গেল। তার গলায় ফাঁসির রশি পরিয়ে দিল।
শেষ ইচ্ছা জানার সময় সে বলল, ঠিক আছে আপনারা আমাকে অন্যায় ভাবে ফাঁসি দিচ্ছেন, দেন, আমার কোনো কথাই শুনছেন না, আমার বাবার নাম, কোথায় চাকরি করি তাও শুনছেন না! এয়ারফোর্সের নাম্বার এবং আর্মির নাম্বারের মধ্যে বিশাল পার্থক্য আছে। আপনারা অন্তত এই নাম্বারটা মিলিয়ে দেখেন।
যাই হোক, নাম্বার মিলিয়ে দেখা গেল, নাম্বার মিলছে না।
পরে জেলার তাকে ফাঁসির মঞ্চ থেকে নামিয়ে আনলেন।
,,,কর্পোরাল আরজু তখন বিমানবাহিনীর চিফ অভ এয়ার স্টাফ এয়ার ভাইস মার্শাল এজি মাহমুদের বডিগার্ড। এই আরজুই সেই টালমাটাল অবস্থার সময় এজি মাহমুদকে নিরাপদে পার করে দেয়। অথচ ফাঁসির আগে বারবার বলছিলেন, আপনারা এয়ার ভাইস মার্শাল এজি মাহমুদকে জিজ্ঞেস করুন আমি তাকে রক্ষা করেছিলাম কি না বা আমি এই বিদ্রেহের সঙ্গে জড়িত ছিলাম কি না। কিন্তু কেউ কর্পোরাল আরজুর কথায় কান দেয়নি! একবারও কেউ এজি মাহমুদকে জিজ্ঞাসা করার প্রয়োজন বোধ করেনি! কর্পোরাল আরজুর ফাঁসি হয়ে যায়...'।"
*১৯৭৭ সালে যে রহস্যময় সেনা অভ্যুত্থান হয় [১] তখনই অনেককেই মেরে ফেলা হয়। যারা বেঁচে গিয়েছিলেন তাঁদের বিচারের নামে স্রেফ খুন করা হয়। যার অসংখ্য নমুনা থেকে সামান্যই এখানে উল্লেখ করা হলো।
১. ঢাকায় রহস্যময় বিমান-সেনা হামলা (অভ্যুত্থান)!: https://www.facebook.com/ali.mahmed1971/posts/10151605687217335
No comments:
Post a Comment