লিটন মিয়া সাত বছর বয়সে মানুষের বাসায় কাজ করতেন। পরে সেলুনের কাজ শিখলেন। একটা সময়
রাজমিস্ত্রির কাজও করেছেন। কিন্তু কোথাও তেমন সুবিধা করতে পারছিলেন না। এক সময় রিকশা চালাতে শুরু করলেন। তাঁর ছোট্ট একটা স্বপ্ন ছিল নিজের একটা সেলুন হবে। কিন্তু সে যে ম্যালা টাকা, অন্তত পঞ্চাশ হাজার টাকার কম না! এ তো খুবই সহজ-সরল গল্প, তাই না? তাহলে এই মানুষটার কথা কেন বলছি?
কেন বলছি একটু বলি, অপার বিস্ময়ে আমি দেখি, একজন মানুষ কেমন করে সাধারণ থেকে অসাধারণ- জিরো থেকে হিরো হয়ে উঠেন! রিকশা চালাতে গিয়ে একদিন লিটন মিয়ার হাতে চলে আসে একটা ওয়ালেট-মানিব্যাগ। যেটায় কড়কড়ে নোটে ভর্তি। অংকটা অনেকের কাছে সামান্য হলেও লিটন মিয়ার কাছে অসামান্য- পঞ্চাশ হাজার টাকা! এই টাকায় অনায়াসেই তাঁর স্বপ্নপূরণ হয়, তাঁর একটা নিজের সেলুন, একটা স্বপ্ন...। তা, কেমন করে এটা তাঁর হাতে এলো? ভুলে এক যাত্রীর পকেট থেকে তাঁর রিকশায় পড়ে যায়। যাত্রী নেমে তার কাজে চলেও যান। লিটন মিয়া ঠিকই ওই মানুষটকে খুঁজে বের করেন। কুড়িয়ে পাওয়া সেই পঞ্চাশ হাজার টাকা ঠিক-ঠিক বুঝিয়ে দেন। সেই মানুষটি অসম্ভব আনন্দিত হয়েছিলেন কিন্তু লিটন মিয়াকে এক টাকাও দেননি বাদাম খাওয়ার জন্যও! তাতে অবশ্য লিটন মিয়ার কোনো মাথাব্যথা নেই। তিনি তার দায়িত্ব যথাযথ পালন করেছেন এতেই তাঁর আনন্দের শেষ নেই।
এলাকার অধিকাংশ সংবাদদাতারা এই ঘটনাটি জাতীয় দৈনিকে পাঠালেও, ছাপা হয়নি! কেন? আমি জানি না, কেবল এটুকু জানি, ওই পত্রিকাগুলো যারা চালান তারা আমার চোখে চোখ রেখে এর কোনো সদুত্তর দিতে পারবেন না।
পরবর্তীতে আমি যখন এই গল্পটা ঝলমলে মুখে যাদের কাছেই বলেছি তারা বিন্দুমাত্র সময় না-নিয়েই উত্তর দিয়েছেন, ‘এইটা কোনো বিষয় হইল, আমি পাঁচ লাখ টাকা পেলেও তো ফেরত দিতাম’। বটে রে- আপনারা মহাপুরুষ বটে! অবশ্য কেউ যদি আমাকে ঠিক এই প্রশ্নটাই করতেন, তা বাপু, আপনি টাকাটা পেলে কী করতেন? প্রশ্নটা শুনে আমি কিছুটা সময় ঝিম মেরে থাকতাম। কারণ উত্তরটা দিতে আমাকে বেগ পেতে হতো। অবশেষে আমি চিঁ চিঁ করে বলতাম, সম্ভবত ফেরত দিতাম। ‘সম্ভবত’ এই কারণে, কারণ আমি জানি না এমন একটা ঘটনার মুখোমুখি হলে আমার মস্তিষ্ক আমাকে নিয়ে কী খেলা খেলত! আমার ভেতরের ’সু’এবং ’কু’- শিশু এবং পশুটা, যাদের মধ্যে হরদম মারামারি লেগেই আছে। কখনও এ জেতে, কখন ও জেতে- কখন যে কে কাকে ছাড়িয়ে যাবে এটা আগাম বলা মুশকিল! আমার বেলায় কে এই খেলায় জিতত এটা আমি বুকে হাত দিয়ে নিশ্চিত বলতে পারি না!
এলাকায় ঝাঁ-চকচকে একটা ব্যাংক আছে, ‘এনসিসি ব্যাংক’। মাঝে-মাঝে আমার যাওয়া পড়ে। প্রথম দিনই দেখেছি, এঁরা কলম দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখেন। আমি রাগ চেপে বলেছিলাম, ‘আপনাদের ব্যাংকের গ্রাহকেরা লক্ষ-লক্ষ টাকা বিশ্বাস করে আপনাদের ব্যাংকে জমা রাখেন আর আপনারা পাঁচ টাকার কলম দিয়ে গ্রাহকের উপর বিশ্বাস রাখতে পারেন না? কী আশ্চর্য’! এরা চটজলদি উত্তর দিয়েছিলেন, ‘কলম নিয়ে যায় তো...’। ‘কলম নিয়ে যায় তো’- এটা আমার মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকে! বেশ-বেশ, এখান থেকে তাহলে কারা কলম নিয়ে যায়, কোনো রিকশাচালক, ঠেলাওয়ালা? এঁদের তো এই ব্যাংকে আসার কথা না। তাহলে? বিষাদের সঙ্গে আমাকে বলতেই হয়, আমার মতই কেউ-না-কেউ কলম নিয়ে যায়!
আমাদের অনেকের পক্ষে পাঁচ টাকার লোভ সামলানো যায় না অথচ একজন লিটন মিয়া নামের দরিদ্র রিকশাচালক অবলীলায় পঞ্চাশ হাজার টাকার লোভ সামলে ফেলেন? তাঁর এই লোভ সংবরণের জোরটা কোথায়, আমি জানি না! লিটন মিয়া কেবল আমাদেরকে স্বপ্নই দেখান না নিজেও স্বপ্ন দেখেন, নিজের একটা সেলুনের স্বপ্ন। লিটন মিয়ার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আমিই-বা কেন এই স্বপ্নটা দেখতে পারব না যে, কোনো-না-কোনো একজন হৃদয়বান মানুষ ঠিকই এগিয়ে এসেছেন লিটন মিয়ার স্বপ্ন পূরণে। লিটন মিয়ার একটা নিজস্ব সেলুন, একটা অদেখা স্বপ্ন...!
*প্রথম ছবিটা জনাব, লিটন মিয়ার। দ্বিতীয়টা এনসিসি ব্যাংকের কলম বেঁধে রাখার ছবি।
**ঠিক করা হয়েছিল, প্রতি সংখ্যায় একজন নায়ককে নিয়ে লেখা থাকবে। সিনেমার নায়ক না, সত্যিকারের নায়ক। এই লেখাটা দেয়া হয়েছিল খবরের খোঁজের প্রথম সংখ্যার শেষ পৃষ্ঠায়, ফলাও করে: http://khoborer-khoje.blogspot.com/2013/09/blog-post_2430.html
***গত লেখায় (https://www.facebook.com/ali.mahmed1971/posts/10151677682627335?notif_t=like) অমার্জনীয় একটা ভুল হয়েছে। পত্রিকা হলে বলতাম, মুদ্রণ প্রমাদ কিন্তু এখানে সে সুযোগ নেই! ‘খবরের খোঁজে’ পরিবারের গুরুত্বপূর্ণ একজন মানুষের নাম বাদ পড়েছে। তিনি হচ্ছেন, ডা. সাদিয়া তাবাসসুম। আন্তরিক দুঃখ প্রকাশ করি।
রাজমিস্ত্রির কাজও করেছেন। কিন্তু কোথাও তেমন সুবিধা করতে পারছিলেন না। এক সময় রিকশা চালাতে শুরু করলেন। তাঁর ছোট্ট একটা স্বপ্ন ছিল নিজের একটা সেলুন হবে। কিন্তু সে যে ম্যালা টাকা, অন্তত পঞ্চাশ হাজার টাকার কম না! এ তো খুবই সহজ-সরল গল্প, তাই না? তাহলে এই মানুষটার কথা কেন বলছি?
কেন বলছি একটু বলি, অপার বিস্ময়ে আমি দেখি, একজন মানুষ কেমন করে সাধারণ থেকে অসাধারণ- জিরো থেকে হিরো হয়ে উঠেন! রিকশা চালাতে গিয়ে একদিন লিটন মিয়ার হাতে চলে আসে একটা ওয়ালেট-মানিব্যাগ। যেটায় কড়কড়ে নোটে ভর্তি। অংকটা অনেকের কাছে সামান্য হলেও লিটন মিয়ার কাছে অসামান্য- পঞ্চাশ হাজার টাকা! এই টাকায় অনায়াসেই তাঁর স্বপ্নপূরণ হয়, তাঁর একটা নিজের সেলুন, একটা স্বপ্ন...। তা, কেমন করে এটা তাঁর হাতে এলো? ভুলে এক যাত্রীর পকেট থেকে তাঁর রিকশায় পড়ে যায়। যাত্রী নেমে তার কাজে চলেও যান। লিটন মিয়া ঠিকই ওই মানুষটকে খুঁজে বের করেন। কুড়িয়ে পাওয়া সেই পঞ্চাশ হাজার টাকা ঠিক-ঠিক বুঝিয়ে দেন। সেই মানুষটি অসম্ভব আনন্দিত হয়েছিলেন কিন্তু লিটন মিয়াকে এক টাকাও দেননি বাদাম খাওয়ার জন্যও! তাতে অবশ্য লিটন মিয়ার কোনো মাথাব্যথা নেই। তিনি তার দায়িত্ব যথাযথ পালন করেছেন এতেই তাঁর আনন্দের শেষ নেই।
এলাকার অধিকাংশ সংবাদদাতারা এই ঘটনাটি জাতীয় দৈনিকে পাঠালেও, ছাপা হয়নি! কেন? আমি জানি না, কেবল এটুকু জানি, ওই পত্রিকাগুলো যারা চালান তারা আমার চোখে চোখ রেখে এর কোনো সদুত্তর দিতে পারবেন না।
পরবর্তীতে আমি যখন এই গল্পটা ঝলমলে মুখে যাদের কাছেই বলেছি তারা বিন্দুমাত্র সময় না-নিয়েই উত্তর দিয়েছেন, ‘এইটা কোনো বিষয় হইল, আমি পাঁচ লাখ টাকা পেলেও তো ফেরত দিতাম’। বটে রে- আপনারা মহাপুরুষ বটে! অবশ্য কেউ যদি আমাকে ঠিক এই প্রশ্নটাই করতেন, তা বাপু, আপনি টাকাটা পেলে কী করতেন? প্রশ্নটা শুনে আমি কিছুটা সময় ঝিম মেরে থাকতাম। কারণ উত্তরটা দিতে আমাকে বেগ পেতে হতো। অবশেষে আমি চিঁ চিঁ করে বলতাম, সম্ভবত ফেরত দিতাম। ‘সম্ভবত’ এই কারণে, কারণ আমি জানি না এমন একটা ঘটনার মুখোমুখি হলে আমার মস্তিষ্ক আমাকে নিয়ে কী খেলা খেলত! আমার ভেতরের ’সু’এবং ’কু’- শিশু এবং পশুটা, যাদের মধ্যে হরদম মারামারি লেগেই আছে। কখনও এ জেতে, কখন ও জেতে- কখন যে কে কাকে ছাড়িয়ে যাবে এটা আগাম বলা মুশকিল! আমার বেলায় কে এই খেলায় জিতত এটা আমি বুকে হাত দিয়ে নিশ্চিত বলতে পারি না!
এলাকায় ঝাঁ-চকচকে একটা ব্যাংক আছে, ‘এনসিসি ব্যাংক’। মাঝে-মাঝে আমার যাওয়া পড়ে। প্রথম দিনই দেখেছি, এঁরা কলম দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখেন। আমি রাগ চেপে বলেছিলাম, ‘আপনাদের ব্যাংকের গ্রাহকেরা লক্ষ-লক্ষ টাকা বিশ্বাস করে আপনাদের ব্যাংকে জমা রাখেন আর আপনারা পাঁচ টাকার কলম দিয়ে গ্রাহকের উপর বিশ্বাস রাখতে পারেন না? কী আশ্চর্য’! এরা চটজলদি উত্তর দিয়েছিলেন, ‘কলম নিয়ে যায় তো...’। ‘কলম নিয়ে যায় তো’- এটা আমার মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকে! বেশ-বেশ, এখান থেকে তাহলে কারা কলম নিয়ে যায়, কোনো রিকশাচালক, ঠেলাওয়ালা? এঁদের তো এই ব্যাংকে আসার কথা না। তাহলে? বিষাদের সঙ্গে আমাকে বলতেই হয়, আমার মতই কেউ-না-কেউ কলম নিয়ে যায়!
আমাদের অনেকের পক্ষে পাঁচ টাকার লোভ সামলানো যায় না অথচ একজন লিটন মিয়া নামের দরিদ্র রিকশাচালক অবলীলায় পঞ্চাশ হাজার টাকার লোভ সামলে ফেলেন? তাঁর এই লোভ সংবরণের জোরটা কোথায়, আমি জানি না! লিটন মিয়া কেবল আমাদেরকে স্বপ্নই দেখান না নিজেও স্বপ্ন দেখেন, নিজের একটা সেলুনের স্বপ্ন। লিটন মিয়ার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আমিই-বা কেন এই স্বপ্নটা দেখতে পারব না যে, কোনো-না-কোনো একজন হৃদয়বান মানুষ ঠিকই এগিয়ে এসেছেন লিটন মিয়ার স্বপ্ন পূরণে। লিটন মিয়ার একটা নিজস্ব সেলুন, একটা অদেখা স্বপ্ন...!
*প্রথম ছবিটা জনাব, লিটন মিয়ার। দ্বিতীয়টা এনসিসি ব্যাংকের কলম বেঁধে রাখার ছবি।
**ঠিক করা হয়েছিল, প্রতি সংখ্যায় একজন নায়ককে নিয়ে লেখা থাকবে। সিনেমার নায়ক না, সত্যিকারের নায়ক। এই লেখাটা দেয়া হয়েছিল খবরের খোঁজের প্রথম সংখ্যার শেষ পৃষ্ঠায়, ফলাও করে: http://khoborer-khoje.blogspot.com/2013/09/blog-post_2430.html
***গত লেখায় (https://www.facebook.com/ali.mahmed1971/posts/10151677682627335?notif_t=like) অমার্জনীয় একটা ভুল হয়েছে। পত্রিকা হলে বলতাম, মুদ্রণ প্রমাদ কিন্তু এখানে সে সুযোগ নেই! ‘খবরের খোঁজে’ পরিবারের গুরুত্বপূর্ণ একজন মানুষের নাম বাদ পড়েছে। তিনি হচ্ছেন, ডা. সাদিয়া তাবাসসুম। আন্তরিক দুঃখ প্রকাশ করি।
No comments:
Post a Comment