আমি রেল-স্টেশনে যে স্কুলটা চালাতাম, ওটায় শিক্ষার্থীরা যে কেবল বিনে-পয়সার পড়ার সুযোগ পেত এমনটাই না এরা এখানে চেপে রাখা শ্বাস ফেলতে পারত। ওটার ছাত্র-ছাত্রী ছিল ওরাই যাদের কারো-কারো বাবা-মা নেই, যাদের অধিকাংশই স্টেশনে পানি বিক্রি করত এবং রাতে ঘুমাত ওভারব্রিজে।
ওই স্কুলটার শিক্ষক ছিলেন তাহমিনা- যিনি এই দস্যু, বিচ্ছু বাহিনীর সমস্ত আবদার হাসিমুখে সহ্য করতেন! আমার দেখা সেরা শিক্ষকদের একজন!
আমি যতগুলো স্কুলের সঙ্গে যুক্ত হয়েছি এর মধ্যে এই স্কুলটার জন্য আমার ছিল আলাদা একটা টান, এখানটার পরিবেশ খুব উপভোগ করতাম। কারণ এটার কল্যাণে আমি অনেক কিছু জানতে পেরেছিলাম, শিখতে পেরেছিলাম। আমার মুখস্ত ছিল কোন বাচ্চাটা কোন দিন খায়নি, কোন বাচ্চাটা ড্যান্ডিতে-নেশায় আসক্ত!
তো, রেলের জায়গায় উদীচীর একটা অফিস অব্যবহৃত পড়ে ছিল। ওখানে অসংখ্য মাকড়সা তাদের সমস্ত পরিবার-পরিজন নিয়ে বসবাস করছিল। ওটাকে সাফসুতরো করে ওটাতেই স্কুলের কাজ শুরু করা হয়েছিল। এই বদান্যতার জন্য উদীচীর লোকজনের প্রতি আজও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি। কিন্তু...। কিন্তু, এক সময় এরা বড়ো যন্ত্রণা দেয়া শুরু করলেন। এদেরই এক কর্তা হুটহাট করে মিটিং-এর নামে স্কুলের বাচ্চাদেরকে যখন-তখন বের করে দিতেন। সেদিনের জন্য স্কুলের সমস্ত কার্যক্রম পন্ড! লেখাপড়ার সুরটাই কেটে যেত...।
আমি বিকল্প একটা জায়গা খুঁজছিলাম অথচ রেলওয়ের কতো জায়গা অব্যবহৃত পড়ে ছিল, লোকজন অবলীলায় দখল করে নিচ্ছিল কিন্তু স্কুলের জন্য এক চিলতে জায়গারও ব্যবস্থা হচ্ছিল না। এমন না, বাইরে ভাড়ার কোনো ঘর পাওয়া যেত না কিন্তু এটা আমি বিলক্ষণ জানতাম, বাইরে স্কুলের জন্য ঘর পাওয়া যাবে কিন্তু স্টেশনের এই সমস্ত বাচ্চাদেরকে আর পাওয়া যাবে না- ওদেরকে ওখানে নেয়া সম্ভব হবে না। কারণ এরা স্টেশন ছেড়ে ওখানে যেতে চাইবে না।
পরবর্তীতে আমার অনুমান সত্য হয়েছিল। তিতিবিরক্ত হয়ে আমি যখন এখান থেকে স্কুলটা সরিয়ে অন্যত্র নিয়ে গিয়েছিলাম
দু-এক জন ব্যতীত তখন এখানকার কাউকে আর পাওয়া যায়নি। এই দুয়েক জনের মধ্যে অন্যতম ‘পলাশ’ নামের একটি ছেলে। যে গায়ে-গতরে অন্যদের চেয়ে আলাদা ছিল। (প্রথম ছবিটায় যার মাথা সবাইকে ছাড়িয়ে গেছে!) কখনও-কখনও তাকে শিক্ষক হিসাবেও ভ্রম হতো। ছোট-ছোট বাচ্চাদের মাঝে পলাশকে বড়ো বেমানান দেখাত। আমি মাঝে-মাঝে তার জড়তা কাটাবার চেষ্টা করতাম, ’বুজঝ, পলাশ, ল্যাকাপড়ার কুনু বয়স নাই’।
পলাশ কথা খুব কমই বলত। মাথা দুলিয়ে তার সংক্ষিপ্ত উত্তর ছিল, জ্বে।
যাই হোক, এই পলাশ এই স্কুলে বেশ অনেক দিন পড়ল। তারপর একটা দোকানে বেচাবিক্রির কাজে লেগে গেল। সারা রাত দোকানদারি করে, সকালে ঘুম। একদিন স্টেশনে গেছি কি এক কাজে। পলাশকে দেখি ঘুম-ঘুম চোখে দোকান থেকে নেমে আসতে। এর টকটকে লাল চোখ দেখে আমার বুঝতে সমস্যা হয় না এ সারাটা রাত এক ফোঁটাও ঘুমায়নি!
এমনিতে প্রায়ই লক্ষ করতাম কিন্তু ভুলে যেতাম- রেলেরই করা, এই স্টেশনে পানির চমৎকার একটা ব্যবস্থা আছে, যেখানে অসংখ্য লোকজনকে হাত-মুখ ধুতে এমনকি পানি খেতেও দেখেছি। টাইলস লাগানো কিন্তু জায়গাটা ভারী নোংরা, অপরিচ্ছন্ন থাকে- খুব চোখে লাগে! আমি এমন কোনো ব্যক্তি না যে বললাম আর রেলের লোকজনেরা এটা সাফসুতরো করার আগ্রহ দেখাবে! নিরুপায় আমি, একজন কাউকে খুঁজছিলাম এটাকে ঘষেমেজে খানিকটা সাফ করার জন্য।
হাতের কাছে পলাশকে পেয়ে বললাম, ’যখন কাজ থাকব না, অবসর পাইলে এইটা একটু...’। পলাশ ছেলেটা স্বল্পভাষী, মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, ’আইচ্ছা’।
কী আশ্চর্য, একটু পরই স্টেশনের কাজ শেষ করে আমি যখন ফিরে আসছি তখন চোখ বড় বড় করে দেখতে পাই সঙ্গে আরেকজনকে নিয়ে পলাশ মিয়া পূর্ণ উদ্যমে জায়গাটা ঘষাঘষি করে চকচকে করার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে! ওর চোখে তখন ঘুমের লেশমাত্রও নেই! পেছন থেকে আমি যে কখন ওর ছবি তুলেছি এটা ও টেরটিও পায়নি...।
আমি প্রত্যেকটা বিষয় আমার নিজেকে দিয়ে বোঝার চেষ্টা করি। যেমন, আমি যখন লিখি তখন এটা মাথায় থাকে আমার লেখাটা যিনি পড়ছেন তার জায়গায় আমি হলে কেমন লেখা পড়তে চাইতাম? তেমনি আমি ভাবার চেষ্টা করি, পলাশের জায়গায় আমি হলে কি করতাম? সারা রাত না-ঘুমিয়ে এক্ষণই কী এই কাজটা করতাম? উত্তরটা অনেককে, এমনকি আমার নিজেকেও আহত করবে। আমি সলাজে স্বীকার যাই, না।
এখানেই পলাশ আমাকে অসম্ভব লজ্জিত করে অবলীলায় ছাড়িয়ে যায়!
আমি থাকব না, কিন্তু এই পলাশরা থেকে যাবে। আমার শবের চেয়ে তমোময় ছায়া হবে অনেক, অনেক দীর্ঘ...!
No comments:
Post a Comment