Search

Wednesday, November 13, 2013

আলোর মশাল হাতে মানুষটা

ফি রোজ নিয়ম করে স্টেশনে যাওয়া এখন অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। আমার কাজের অনেক উপকরণ পেয়ে যাই এখানে। অবশ্য ’আমার কাজ’ কথাটা খানিকটা ভুল বললাম, লোকজনের ভাষায়, অকাজ। অবশ্য আমি যে কাজের লোক এমনটা আমি নিজেও মনে করি না- অকাজের লোক হয়েই যে আমার আনন্দের শেষ নাই। আহা, এই দুনিয়ায় সবাই কাজের লোক হয়ে গেলে তো ভারী মুশকিল!

প্ল্যাটফরমে একজন বয়স্ক মহিলাকে পড়ে থাকতে দেখতাম। চারপাশে শত-শত মাছি ভনভন করছে, হাঁ করে থাকা মুখেও! কারণটা অনুমান করতে পেরেছিলাম, এই মানুষটার উঠে বাথরুমে যাওয়ার শক্তি ছিল না।
পূর্বে এমন দৃশ্য দেখিনি এমন না কিন্তু তবুও এই দৃশ্য আমাকে বড়ো অপরাধী করে দেয়। সে সময় মাথায় সব জট পাকিয়ে যায়। তখন নিজের মাথার উপর ছাদটাকে একজন স্বার্থপর মানুষের ছাদ মনে হয়। নিজেকে স্রেফ একটা পোকা মনে হয়। ছোট্ট একটা ওল্ড হোম করতে কোটি-কোটি টাকা লাগে না। অথচ একটা ওল্ড হোম করার স্বপ্ন দেখে দেখেই এই জীবনটা পার করে দেব- একদা অবসান হবে অর্থহীন এ জীবনের...!

এই মানুষটার যে তীব্র শ্বাসকষ্ট এটা একটা ছোট্ট বাচ্চা দেখলেও বুঝবে। এই বয়স্ক মানুষটার সঙ্গেও কেউ নাই যে হাসপাতালে ভর্তি করার চেষ্টা করা হবে। এর পূর্বে একজনকে হাসপাতালে ভর্তি করে বিস্তর ঝামেলার মুখোমুখি হয়েছিলাম যার রেশ এখনও কাটেনি! জনে-জনে আমাকে জবাবদিহি করতে হয়েছিল।
যাই হোক, একজন ডাক্তারকে বলেকয়ে শ্বাসকষ্টের ওষুধের ব্যবস্থা করা গেল। কিন্তু এমন অবস্থার একজন মানুষকে ওষুধ, ভাতের ব্যবস্থা করে দিলে, নিয়ম করে খাওয়াবেটা কে? একজন দয়ার্দ্র মহিলাকে পাওয়া গেল যিনি পরম মমতায় এই মানুষটাকে ওষুধ খাওয়াতেন, ভাত মুখে তুলে খাইয়ে দিতেন। এই ব্যবস্থার পর খানিকটা হাঁফ ছেড়ে বাঁচা গিয়েছিল।


যথারীতি কাল গেছি স্টেশনে। যে জায়গাটায় ওই বয়স্ক মহিলাটি পড়ে থাকতেন সেই জায়গাটা শূন্য! এর আগের দিন একজন চালবাজ হকারের মুখে শুনেছিলাম, এই মানুষটাকে নাকি শ্রীমঙ্গলের ট্রেনে তুলে দেয়ার শলা করা হচ্ছে। আমি রাগি গলায় বলেছিলাম, এঁর তো পরিবারের কেউ আছে এমনটা শুনিনি, তা শ্রীমঙ্গলে এর দায়িত্ব কে নেবে, তুমি?
তো, আমার মনে হলো কেউ ট্রেনে তুলে দায় সেরেছে। কিন্তু খানিক দূরেই দেখলাম একটা মানুষের শরীর, মুখসহ ঢাকা। আমার বুকটা ধক করে উঠে! অন্য একজন মহিলাকে বললাম, মুখের চাদরটা সরান তো। আমার অনুমান নির্ভূল। এটা সেই মহিলাই! মরে গেছেন, নিজেকে এবং আমাদের সবাইকে বাঁচিয়ে দিয়ে।

সব কেমন এলোমেলো হয়ে যায়- কী করব এখন? এর পরের অংশটা যে অসম্ভব জটিল। এখন এখান থেকে অতি দ্রুত সরে পড়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ। কিন্তু আমার মস্তিষ্কের একটা অংশ হা হা করে হেসে বলছে: পালাবি কোথায়? বটে, বটে রে, তোকে কে বলল তুইও কোথাও-না-কোথাও এমন করে পড়ে থাকবি না, বেওয়ারিশ লাশ হয়ে।
আহা, বেচারা মস্তিষ্ককে কেমন করে বোঝাই আমার মত দু-পাতা ’ল্যাকাপড়া’ জানা মানুষদের এই সব ক্ষেত্রে চট করে সরে পড়ারই নিয়ম। আর কার সহায়তাই-বা চাইব? ওরাও যে আমার মতই ’ল্যাকাপড়া’ জানা মানুষ- ওরা যে আমার নির্বুদ্ধিতায় ভারী বিরক্ত হবে এতে কোনো সন্দেহ নেই! হলোও তাই! আমার পরিচিত একজন পত্রিকা পড়ছিলেন, তাকে বলার পর তিনি মুখ না-তুলেই বললেন, আরে, এইটা তো জিআরপির দায়িত্ব।
দেখো দিকি কান্ড, জাতীয় ’পরতিকায়’ যে দেশ নিয়ে কত্তো বড়ো বড়ো সংবাদ- এই ছোট্ট সংবাদে মাথা ঘামাবার সময় কোথায় তার!
একজন সহৃদয় জিআরপি বললেন, আপনি এমনিতে কিছুই করতে পারবেন না। স্টেশন মাস্টার মেমো না-দিলে কেউ এই লাশ ছোঁবে না। কারণ নিয়মমাফিক কাজ শুরু করতে হবে, পোস্টমর্টেম হবে...। আমি স্টেশন মাস্টারের খোঁজে গেলাম, অফিসে পাওয়া গেল না। এখানে-ওখানে স্টেশন মাস্টারকে খুঁজছি...!
 

যেখানে মৃতদেহটা রাখা ওখানে ফিরে এসে আমি হতবাক-বাক্যহারা! একজন মানুষ কাফনের কাপড় এবং আনুসাঙ্গিক জিনিসপত্র বগলে চেপে ডোমের সঙ্গে বেদম হইচই করছেন: ’এক্ষণ গিয়া কবর খুঁড়বি, এক্ষণ, এই নে টেকা’।
মানুষটা পাগলের মত এদিক-ওদিক দৌড়াচ্ছেন। একবার একে ধরছেন, আরেকবার ওকে। মানুষটার কর্মকান্ড দেখছি, দু-চোখ ভরে।

এরিমধ্যে এই মানুষটাই মৃতদেহকে গোসল করাবার জন্য কিছু মহিলাকেও যোগাড় করে ফেলেছেন। মানুষটার অফুরন্ত প্রাণশক্তি- তাঁর গতির সঙ্গে তাল মেলাতে আমার ঘাম ছুটে যায়। মানুষটা ণিকের জন্যও স্থির থাকছেন না! পানি লাগবে, পর্দার জন্য কাপড় লাগবে সবই এই মানুষটার কণ্যাণে নিমিষেই হাজির হচ্ছে। কেবল চোখ দিয়ে দেখা ব্যতীত আমার কোনো কিছুই করার অবকাশ নেই।

যখন একটা পর্দা ঘিরে রেললাইনের পাশে শেষ গোসল করানো হচ্ছে ঠিক তখনই সেই লাইনেই একটা গাড়ি আসার সময় হয়ে গেছে। ভারী বিপদ! কিন্তু এই মানুষটার দেখি সবই নখদর্পণে, কিছুই চোখ এড়ায় না। মানুষটার আবার দৌড়, মাস্টারকে বলে, মাইকিং করে, গাড়ি আসার লাইনটা বদলে দিলেন। এই লাইনে গাড়ি না-এসে অন্য একটা খালি লাইনে আসবে।
আমি ঘোর লাগা চোখে কেবল দেখে যাই। এক ফাঁকে আমি মানুষটাকে বলি, ’আসেন, একটু চা খাই’। আসলে চা খাওয়াটা মূখ্য না, দু-মিনিটের জন্য হলেও এই মানুষটাকে কথা বলার জন্য পাওয়াটা আমার জন্য বড়ো জরুরি। কারণ আমার বোঝা প্রয়োজন এই মানুষটার সমস্যাটা কোথায়? ভিড়ের মাঝে অন্য রকম মানুষ দেখলে বিভ্রান্তি লাগে, অস্বস্তি হয়; নিজেকে বোকা-বোকা মনে হয়।


চা খেতে খেতে কথা হয়, হৃদয় খান নামের এই মানুষটার সঙ্গে। চার বছর ধরে তিনি স্টেশনের পাবলিক টয়লেট চালান অথচ আমি মানুষটাকে চিনি না। আহা, চিনব কেমন করে? আমি যে দু-পাতা ’ল্যাকাপড়া করা’ মানুষ!
এই বেচারি মহিলাকে কাটাছেঁড়া করে কী আর হবে তাই তিনি জিআরপির সেকেন্ড অফিসার মুখলেছুর রহমানকে বলেকয়ে রাজি করিয়েছেন পোস্টমর্টেম না-করেই যেন দাফনের ব্যবস্থা করা হয়। আরও কীসব যেন বলছিলেন আমি আসলে মনোযোগ দিয়ে তাঁর কথা শুনছিলাম না।
ক্ষণিকের জন্য আমি চোখ বন্ধ করে রেখেছিলাম। কেবল মনে হচ্ছিল, চারদিকে নিকষ অন্ধকার- আমি যে আমাকেই দেখতে পাচ্ছিলাম না! কেবল দৃশ্যমান হয় মশাল হাতে একটা মানুষ দাঁড়িয়ে। ভাগ্যিস, মশালের আলো ছিল নইলে চিনতেই পারতাম না যে মশাল হাতের মানুষটা, হৃদয় খান...।

No comments: