আমার এক সুহৃদ আমার
লেখালেখি নিয়ে খুবই উদ্বিগ্ন থাকেন। তার এই উদ্বেগ অনেক গুণ বেড়ে গেল যখন
তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি অধ্যাদেশ-২০১৩ আইনটার অনুমোদন দেয়া হলো। ওয়ারেন্ট
ছাড়াই পুলিশ গ্রেফতার করতে পারবে। একজন পুলিশ বউয়ের সঙ্গে ঝগড়া করে এসে কাউকে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে গেলে ‘কিসসু’ করার নেই।
এটা স্রেফ একটা কালো আইন- কোনো প্রকারেই এই আইনটাকে আইন বলা চলে না, কারো হাত-পা বেঁধে সাঁতরাবার প্রয়াস মাত্র। প্রিন্ট বা ইলেকট্রনিক মিডিয়ার জন্য এমন আইন করা হলে এরা সবাই একাট্টা হয়ে তুলকালাম করে ফেলতেন। কিন্তু এই আইনটার বেলায় এরা ঝিম মেরে রইলেন!
কারণটা সম্ভবত এমন, ওয়েবে যারা লেখালেখি করেন এরা তাদের বাড়া ভাতে ছাই দেয়ার চেষ্টা করছেন। ওয়েবে লেখালেখি, বিশেষ করে প্রিন্ট মিডিয়া ক্রমশ নিজেদের জন্য হুমকি মনে করছে। তাদের ‘পাছাভারী’ ভাবটা হালকা হয়ে যায় যে। এটা সত্য, ইলেকট্রনিক-প্রিন্ট মিডিয়ার কাউকে-কাউকে নিয়মিত বেতন পেতে সমস্যা হয় কিন্তু এই ভুবনেরই কাউকে-কাউকে আশি লাখ টাকার গাড়ি হাঁকাতেও দেখা যায়! একটা ইলেকট্রনিক মিডিয়ার প্রধানকে এমনিতে লম্বা-লম্বা কথা বলতে শুনি। অথচ এই মানুষটার কারণে ওখানে চাকুরিরত এক মহিলাকর্মীকে নিয়মিত মনোবিদের চিকিৎসা নিতে হচ্ছে। কারণটা সহজেই অনুমেয়...।
যাই হোক, সেই সুহৃদ, বিচিত্র কারণে আমার মত মানুষের জন্য তার বাড়াবাড়ি রকমের মমতা- এমন মমতায় মাখামাখি হয়ে অন্য ভুবনে যেতে ইচ্ছা করে না যে। তিনি আমাকে দু-দিন আগেও বলছিলেন, দেশের শক্তিমান মানুষদের নিয়ে না-লিখলেই ভাল। সেফ...।
এটা সত্য, আমি খুব দুর্বল একজন মানুষ কিন্তু লেখার সময় যা লিখতে যেটা মন সায় দিয়েছে, তাই লিখেছি। কারণ যখন লিখতে বসি তখন আমার নিজের উপর কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকে না- জাগতিক কোনো ভয় তখন কাজ করে না।
কিন্তু এখন কেন যেন দেশ, বড়-বড় সমস্যা নিয়ে লিখতে ইচ্ছা করে না। আমার মধ্যে এখন যে ভাবনাটা কাজ করে সেটা এমন, শত-শত টন নিউজপ্রিন্টে লিখে বা ওয়েব তথ্যের ভারে তার কাত হয়ে গেলেই বা কী? এই দেশে ‘দুইজন ভদ্রমহিলা’ যেটা চাইবেন, যা চাইবেন; সেটাই হবে- এর ব্যত্যয় হওয়ার কোনো যো নাই। এই সব নিয়ে লেখাটা এখন আমার কাছে অপচয় মনে হয়, শব্দের অপচয়! এটা আমার নিজস্ব মত। কারো অন্য মত থাকলে তার সঙ্গে আমি তর্ক করতে যাব না।
আমি বরং ছোট-ছোট বিষয় নিয়েই থাকি না কেন। এই ছেলেটির সঙ্গে পরিচয় খানিকটা অন্য ভাবে। এই মাসের ১৫ তারিখে পত্রিকা বের হলো, (যেটার সঙ্গে আমি জড়িত)। রেল-ইস্টেশনে পত্রিকা বিতরণকারীদেরকে পত্রিকা বুঝিয়ে দেয়ার পর আমার হাতে বেশ কিছু বেঁচে যাওয়া পত্রিকা। একটা ট্রেন তখন স্টেশনে দাঁড়ানো। একজন যাত্রী কিছু একটা কিনতে স্টেশনে নেমেছিলেন সম্ভবত। আমার হাতে পত্রিকা দেখে বললেন, ‘আপনি কি পত্রিকা বিক্রি করেন’?
আমি হ্যাঁ-না কিছুই বললাম না। অসুখের কারণে প্রচুর ওজন কমেছে কিন্তু আমার চেহারায় যে হকার-হকার ভাব চলে এসেছে এটা জানা ছিল না। কী আর করা, কপালের ফের!
হঠাৎ আমার মনে পড়ল, ছুটির কারণে আজ সমস্ত জাতীয় পত্রিকা বন্ধ। ভাল একটা সুযোগ তো। আমি একটা ছেলেকে দাঁড়ানো দেখে তাকে বললাম, ‘তুমি কি গাড়িতে পত্রিকা বিক্রি করতে পারবা। অর্ধেক তোমার, অর্ধেক আমার’। ছেলেটা বেশ কিছু পত্রিকা বিক্রিও করে ফেলল।
তার সঙ্গে কথা হলো। আমাদের দেশের জন্য খুবই সহজ-সরল গল্প! মা মারা গেছেন। বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করেছে। চট্টগ্রাম থেকে এই বাচ্চা একা-একা এখানে চলে এসেছে।
আমি যে স্কুলটা চালাই এটার টিচারকে কাল বলেছিলাম, একে যেন স্কুলে নিয়ে যায়। কাল এই বাচ্চাটার নাগাল পাওয়া গেল না। টিচার কচ্ছপের মত লেগে রইলেন। আজ একে ঠিক-ঠিক পাকড়াও করলেন। একে স্কুলে নিয়ে যাওয়ার দুইটা উদ্দেশ্য ছিল আমার। স্কুলটার নিয়ম হচ্ছে, এক ঘন্টার মধ্যে আধাঘন্টা খেলা, আধাঘন্টা পড়া। এই বাচ্চাটার ভুবন এলোমেলো হয়ে আছে। খেলার ছলে খানিকটা চেষ্টা করা। আর দ্বিতীয়টা হচ্ছে, এর সঙ্গে একটা যোগাযোগ থাকা।
স্কুলে সব বাচ্চাদের ছবি রাখার চেষ্টা করি- আজ স্কুলে যখন এর ছবি উঠাচ্ছিলাম তখন একবার আমি বললাম, ‘মুখটা এমন কইরা রাখছ ক্যান, একটু হাসো’।
ও হাসে- আমি মুগ্ধ চোখে এর হাসি দেখি। আমার হাসি ক্রমশ মিলিয়ে যায় যখন জিজ্ঞেস করি, ‘দুপুরে খাইছ’?
বাচ্চাটা এমনিতে খুব কম কথা বলে। দুয়েক বার জিজ্ঞেস করার পর বলল, ‘না’। যখন জানতে চাইলাম, ‘সকালে কি খাইছ’? এ চোখ নামিয়ে বলল, ‘সকালে কিছু খাই নাই তো’।
আমার আগেও এই অনুভূতিটা কাজ করেছে- আজও এটা ফিরে এলো। মাঝে-মাঝে নিজেকে মানুষ বলে মনে হয় না। মনে হয়, আমি স্রেফ একটা ‘পাইপমানুষ’! যে পাইপের এক পাশে, যার চালু নাম খাবার- অন্য পাশে আবর্জনা! খাবার...ভদ্রতা করে বললাম বলে নইলে খাবার না ছাই- মস্তিষ্ক খাবার নামে চেনে বলে নাহলে এও এক প্রকার বর্জ্য। গোটা গ্রহ বর্জ্যময়!
আমি একটা ‘পাইপমানুষ’ এই বাচ্চাটার জন্য কী করব তাই বুঝতে পারছি না- আর আমি 'শ্লা' কিনা মাথা ঘামাব বড়-বড় সমস্যা নিয়ে...! আফসোস, আমার মৃত্যুর পর ঠিক-ঠিক এটা ছড়িয়ে পড়বে, 'একটি বর্জ্য উৎপাদনকারী যন্ত্র বিনষ্ট হলো...'।
এটা স্রেফ একটা কালো আইন- কোনো প্রকারেই এই আইনটাকে আইন বলা চলে না, কারো হাত-পা বেঁধে সাঁতরাবার প্রয়াস মাত্র। প্রিন্ট বা ইলেকট্রনিক মিডিয়ার জন্য এমন আইন করা হলে এরা সবাই একাট্টা হয়ে তুলকালাম করে ফেলতেন। কিন্তু এই আইনটার বেলায় এরা ঝিম মেরে রইলেন!
কারণটা সম্ভবত এমন, ওয়েবে যারা লেখালেখি করেন এরা তাদের বাড়া ভাতে ছাই দেয়ার চেষ্টা করছেন। ওয়েবে লেখালেখি, বিশেষ করে প্রিন্ট মিডিয়া ক্রমশ নিজেদের জন্য হুমকি মনে করছে। তাদের ‘পাছাভারী’ ভাবটা হালকা হয়ে যায় যে। এটা সত্য, ইলেকট্রনিক-প্রিন্ট মিডিয়ার কাউকে-কাউকে নিয়মিত বেতন পেতে সমস্যা হয় কিন্তু এই ভুবনেরই কাউকে-কাউকে আশি লাখ টাকার গাড়ি হাঁকাতেও দেখা যায়! একটা ইলেকট্রনিক মিডিয়ার প্রধানকে এমনিতে লম্বা-লম্বা কথা বলতে শুনি। অথচ এই মানুষটার কারণে ওখানে চাকুরিরত এক মহিলাকর্মীকে নিয়মিত মনোবিদের চিকিৎসা নিতে হচ্ছে। কারণটা সহজেই অনুমেয়...।
যাই হোক, সেই সুহৃদ, বিচিত্র কারণে আমার মত মানুষের জন্য তার বাড়াবাড়ি রকমের মমতা- এমন মমতায় মাখামাখি হয়ে অন্য ভুবনে যেতে ইচ্ছা করে না যে। তিনি আমাকে দু-দিন আগেও বলছিলেন, দেশের শক্তিমান মানুষদের নিয়ে না-লিখলেই ভাল। সেফ...।
এটা সত্য, আমি খুব দুর্বল একজন মানুষ কিন্তু লেখার সময় যা লিখতে যেটা মন সায় দিয়েছে, তাই লিখেছি। কারণ যখন লিখতে বসি তখন আমার নিজের উপর কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকে না- জাগতিক কোনো ভয় তখন কাজ করে না।
কিন্তু এখন কেন যেন দেশ, বড়-বড় সমস্যা নিয়ে লিখতে ইচ্ছা করে না। আমার মধ্যে এখন যে ভাবনাটা কাজ করে সেটা এমন, শত-শত টন নিউজপ্রিন্টে লিখে বা ওয়েব তথ্যের ভারে তার কাত হয়ে গেলেই বা কী? এই দেশে ‘দুইজন ভদ্রমহিলা’ যেটা চাইবেন, যা চাইবেন; সেটাই হবে- এর ব্যত্যয় হওয়ার কোনো যো নাই। এই সব নিয়ে লেখাটা এখন আমার কাছে অপচয় মনে হয়, শব্দের অপচয়! এটা আমার নিজস্ব মত। কারো অন্য মত থাকলে তার সঙ্গে আমি তর্ক করতে যাব না।
আমি বরং ছোট-ছোট বিষয় নিয়েই থাকি না কেন। এই ছেলেটির সঙ্গে পরিচয় খানিকটা অন্য ভাবে। এই মাসের ১৫ তারিখে পত্রিকা বের হলো, (যেটার সঙ্গে আমি জড়িত)। রেল-ইস্টেশনে পত্রিকা বিতরণকারীদেরকে পত্রিকা বুঝিয়ে দেয়ার পর আমার হাতে বেশ কিছু বেঁচে যাওয়া পত্রিকা। একটা ট্রেন তখন স্টেশনে দাঁড়ানো। একজন যাত্রী কিছু একটা কিনতে স্টেশনে নেমেছিলেন সম্ভবত। আমার হাতে পত্রিকা দেখে বললেন, ‘আপনি কি পত্রিকা বিক্রি করেন’?
আমি হ্যাঁ-না কিছুই বললাম না। অসুখের কারণে প্রচুর ওজন কমেছে কিন্তু আমার চেহারায় যে হকার-হকার ভাব চলে এসেছে এটা জানা ছিল না। কী আর করা, কপালের ফের!
হঠাৎ আমার মনে পড়ল, ছুটির কারণে আজ সমস্ত জাতীয় পত্রিকা বন্ধ। ভাল একটা সুযোগ তো। আমি একটা ছেলেকে দাঁড়ানো দেখে তাকে বললাম, ‘তুমি কি গাড়িতে পত্রিকা বিক্রি করতে পারবা। অর্ধেক তোমার, অর্ধেক আমার’। ছেলেটা বেশ কিছু পত্রিকা বিক্রিও করে ফেলল।
তার সঙ্গে কথা হলো। আমাদের দেশের জন্য খুবই সহজ-সরল গল্প! মা মারা গেছেন। বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করেছে। চট্টগ্রাম থেকে এই বাচ্চা একা-একা এখানে চলে এসেছে।
আমি যে স্কুলটা চালাই এটার টিচারকে কাল বলেছিলাম, একে যেন স্কুলে নিয়ে যায়। কাল এই বাচ্চাটার নাগাল পাওয়া গেল না। টিচার কচ্ছপের মত লেগে রইলেন। আজ একে ঠিক-ঠিক পাকড়াও করলেন। একে স্কুলে নিয়ে যাওয়ার দুইটা উদ্দেশ্য ছিল আমার। স্কুলটার নিয়ম হচ্ছে, এক ঘন্টার মধ্যে আধাঘন্টা খেলা, আধাঘন্টা পড়া। এই বাচ্চাটার ভুবন এলোমেলো হয়ে আছে। খেলার ছলে খানিকটা চেষ্টা করা। আর দ্বিতীয়টা হচ্ছে, এর সঙ্গে একটা যোগাযোগ থাকা।
স্কুলে সব বাচ্চাদের ছবি রাখার চেষ্টা করি- আজ স্কুলে যখন এর ছবি উঠাচ্ছিলাম তখন একবার আমি বললাম, ‘মুখটা এমন কইরা রাখছ ক্যান, একটু হাসো’।
ও হাসে- আমি মুগ্ধ চোখে এর হাসি দেখি। আমার হাসি ক্রমশ মিলিয়ে যায় যখন জিজ্ঞেস করি, ‘দুপুরে খাইছ’?
বাচ্চাটা এমনিতে খুব কম কথা বলে। দুয়েক বার জিজ্ঞেস করার পর বলল, ‘না’। যখন জানতে চাইলাম, ‘সকালে কি খাইছ’? এ চোখ নামিয়ে বলল, ‘সকালে কিছু খাই নাই তো’।
আমার আগেও এই অনুভূতিটা কাজ করেছে- আজও এটা ফিরে এলো। মাঝে-মাঝে নিজেকে মানুষ বলে মনে হয় না। মনে হয়, আমি স্রেফ একটা ‘পাইপমানুষ’! যে পাইপের এক পাশে, যার চালু নাম খাবার- অন্য পাশে আবর্জনা! খাবার...ভদ্রতা করে বললাম বলে নইলে খাবার না ছাই- মস্তিষ্ক খাবার নামে চেনে বলে নাহলে এও এক প্রকার বর্জ্য। গোটা গ্রহ বর্জ্যময়!
আমি একটা ‘পাইপমানুষ’ এই বাচ্চাটার জন্য কী করব তাই বুঝতে পারছি না- আর আমি 'শ্লা' কিনা মাথা ঘামাব বড়-বড় সমস্যা নিয়ে...! আফসোস, আমার মৃত্যুর পর ঠিক-ঠিক এটা ছড়িয়ে পড়বে, 'একটি বর্জ্য উৎপাদনকারী যন্ত্র বিনষ্ট হলো...'।
No comments:
Post a Comment