সুরুয নামের এক বালকের কথা লিখেছিলাম যার শৈশব থেকেই দু’ পা নেই [১]!
ওই লেখাটা শেষ করেছিলাম এই বাক্য দিয়ে:
“...স্বপ্ন দেখি, এই গ্রহের কোথাও-না কোথাও কেউ-না-কেউ সুরুযের প্রতি তার মমতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। কৃত্রিম পা নিয়ে সুরুয নড়বড়ে করে হলেও হাঁটছে। আহ, এই দৃশ্য দেখার চেয়ে তাজমহল দেখাটা আমার কাছে তুচ্ছ, অতি তুচ্ছ...।”
তাজমহলের প্রসঙ্গটা কেন এলো এটা একটু বলি। একবার তাজমহলের খুব কাছ থেকে ফিরে এসেছিলাম। তখন স্বর্ণমন্দিরে হামলার কারণে শিখরা প্রচন্ড ক্ষুব্ধ ছিলেন। বিশেষ করে দিল্লি ছিল উত্তাল। আমার সঙ্গে যিনি ছিলেন তিনি কোনো প্রকারেই যেতে রাজি হলেন না। তখন বয়স ছিল অল্প, তাজমহল দেখতে না-পাওয়ার খেদ ছিল তীব্র।
অথচ আজ দু-দেশের কোনো প্রকারের কাগজপত্র ব্যতীত আমার সেই স্বপ্নটা অবশেষে সত্যি হয়। এ নিতল আনন্দ রাখি কোথায় [২]! @Pradip
Saha এবং তাঁর বন্ধুরা এগিয়ে আসেন। সুরুযের জন্য দু-পা লাগাবার জন্য যে অর্থ প্রয়োজন এটা তাঁরা যোগাড় করে আমার কাছে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। আমার ক্ষমতায় কুলালে এঁদের প্রত্যেককে স্পর্শ করে বলতাম, এতো মায়া কেন গো তোমাদের মনে? এটা বিলক্ষণ জানি বাস্তবে ক্ষমতায় কুলাবে না কারণ এর জন্য আমাকে আবার অস্ট্রেলিয়ায় যেতে হবে!
আজ যখন সুরুযের সামনে দাঁড়ালাম তখন সত্যি সত্যিই ভেজা চোখে এই অনুভূতিটাই হলো। অতি আনন্দেও কখনও-কখনও চোখ ব্যাটা ঝামেলা করে, ব্যাটা পাজি, নচ্ছার। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, সুরুযের সামনে দাঁড়াবার চেয়ে তাজমহলের সামনে দাঁড়ালে তা আমার কাছে বড়ো পানসে মনে হতো।
তবে গোটা বিষয়টা এতো সহজ ছিল না কারণ এই কৃত্রিম পা সংযোজনের কাজটা হয়েছে সুদূর কক্সবাজারের মালুমঘাটে, ‘মেমোরিয়াল খ্রীষ্টিয়ান হাসপাতালে’। আফসোস, বাংলাদেশে অন্য যারা এই কাজটা করেন তাদের টাকার দাবীটা ছিল বিপুল যেটা এই টাকায় সম্ভব ছিল না। ব্র্যাক, প্রায় দ্বিগুণ টাকা দাবী করেছিল।
তো, পা সংযোজন এবং হাঁটার অনুশীলন, সব মিলিয়ে অনেক দিনের ধাক্কা। বিভিন্ন কারণে আমার পক্ষে এদের সঙ্গে যাওয়া সম্ভব ছিল না। কক্সবাজারে দূরের কথা, বছর ধরে চট্টগ্রামেই যাব-যাব করে যাওয়া হয়নি। সুরুযের সঙ্গে গিয়েছিলেন তার বাবা।
সব মিলিয়ে কাজটা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। কিন্তু তীব্র ইচ্ছার সঙ্গে জিততে পারে কে?
অবশেষে...কাজটা শেষ হয়। সুরুয কৃত্রিম পা লাগিয়ে ফিরে এসেছে আজ।
ওই হাসপাতালের জনাব প্রদীপ চাকমা এবং আপন দে, এঁরা যে কেবল সুরুযের প্রতি কেবল মমতার হাতই বাড়িয়ে দেননি, বিভিন্ন প্রকারে আমাকেও সহায়তা করে গেছেন। যখনই আমি ফোন করেছি এঁরা কখনই বিরক্ত বোধ করেননি। আমি জনাব, প্রদীপ চাকমাকে বলেছিলাম, ‘দাদা, এটা আমাদের অনেকের স্বপ্ন যে সুরুযকে আমরা হাঁটতে দেখব’। মানুষটা প্রত্যেকবারই আমাকে আশ্বস্ত করেছেন। কেবল তাই না, এই দু-জন সদাশয় মানুষ কাজটা করে দিয়েছেন বিনা পারিশ্রমিকে। আমি গভীর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি এই পা লাগাবার কারিগর প্রদীপ চাকমা এবং তার সহকর্মী আপন দে, এদেঁর কাছে।
পূর্বে লিখেছিলাম, “...সুরুজকে দেখার পর থেকে, আমি যখন লম্বা-লম্বা পা ফেলে হনহন করে হেঁটে যাই তখন কেমন যেন একটা ঘোরের মধ্যে থাকি। অজান্তেই বিড়বিড় করি, হে পরম করুণাময়, কেমন করে তোমার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি, কেমন করে?...”।
সুরুয, তার বাবা-মা, @Pradip Saha বা তাঁর বন্ধুদের অনুভূতিটা কেমন আমি জানি না কেবল নিজেরটা বলতে পারি, আমার নিজের পা-এর প্রতি যে অপরাধ বোধ কাজ করত আজ তা অনেকখানি লাঘব হয়েছে...।
২. এ নিতল আনন্দ রাখি কোথায়! : https://www.facebook.com/ali.mahmed1971/posts/10151809555712335?stream_ref=10
ছবি ১: সুরুযের পূর্বের ছবি
ছবি ২: ‘মেমোরিয়াল খ্রীষ্টিয়ান হাসপাতালে’ সুরুযের সঙ্গে জনাব প্রদীপ চাকমা এবং আপন দে।
ছবি ৩: সুরুযের বাসার সামনে সুরুয হাঁটছে। এখন লাঠিতে ভর দিতে হয় কিন্তু অনুশীলনের পর লাঠির আর প্রয়োজন পড়বে না।
ছবি ৪: সুরুয তার বাবা-মার সঙ্গে।
...
সুরুয নিয়মিত অনুশীলন করছে কি না এটা জানার জন্য অতর্কিতে হাজির হয়ে যাই আজ (২ ফেব্রুয়ারি)। কারণ সুরুযের হাঁটার সঙ্গে জড়িয়ে আছে আমাদের স্বপ্ন। সুরুয হেরে যাওয়া মানে আমরা হেরে যাওয়া, একটি স্বপ্নের মৃত্যু- এ হতে দেওয়া যায় না।
নাহ, ঠিকঠাক মতো পাই সুরুযকে অনুশীলনরত অবস্থায়। যে রেললাইন তার দু-পা কেড়ে নিয়েছিল সেই রেললাইনকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে! আসলে স্বপ্নের মৃত্যু নেই। স্বপ্ন হচ্ছে একটা অসীম দৌড়- এখানে থামাথামির কোনো স্থান নেই। একজনের স্বপ্ন যেখানে শেষ হয় সেখান থেকেই শুরু হয় অন্য একজনের স্বপ্ন। কেবল স্বপ্নদৌড়ের ব্যাটন হাতবদল হয় মাত্র।
...
সুরুয নিয়মিত অনুশীলন করছে কি না এটা জানার জন্য অতর্কিতে হাজির হয়ে যাই আজ (২ ফেব্রুয়ারি)। কারণ সুরুযের হাঁটার সঙ্গে জড়িয়ে আছে আমাদের স্বপ্ন। সুরুয হেরে যাওয়া মানে আমরা হেরে যাওয়া, একটি স্বপ্নের মৃত্যু- এ হতে দেওয়া যায় না।
নাহ, ঠিকঠাক মতো পাই সুরুযকে অনুশীলনরত অবস্থায়। যে রেললাইন তার দু-পা কেড়ে নিয়েছিল সেই রেললাইনকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে! আসলে স্বপ্নের মৃত্যু নেই। স্বপ্ন হচ্ছে একটা অসীম দৌড়- এখানে থামাথামির কোনো স্থান নেই। একজনের স্বপ্ন যেখানে শেষ হয় সেখান থেকেই শুরু হয় অন্য একজনের স্বপ্ন। কেবল স্বপ্নদৌড়ের ব্যাটন হাতবদল হয় মাত্র।
আজ (৯ ফেব্রয়ারি) সুরুযকে দেখে পুরোই হাঁ- এ যে সত্যি-সত্যি
অদম্য সুরুয! কারণ সুরুয হাঁটছে, হাঁটতে
পারছে লাঠিতে ভর না দিয়েই!
প্রদীপ সাহা এবং তাঁর বন্ধুদের প্রতি আবারও অজস্র শিউলি ফুলের
ভাল লাগা...।