এই মানুষটাকে নিয়ে একটা লেখা লিখেছিলাম, ‘অপেক্ষা’ [১]। আমি যথন তাঁর পরিবারের কথা জিজ্ঞেস করতাম তখন মানুষটা ক্ষেপে যেতেন। তাচ্ছিল্যের সঙ্গে হাত নাড়তেন। তাঁর সঙ্গে কথা বলে আমি খানিকটা আঁচ করতে পেরেছিলাম মানুষটা খুবই স্বচ্ছল পরিবারের মানুষ। কী অভিমানে তিনি সব ছেড়ে চলে এসেছিলেন তা আর জানার উপায় ছিল না। আমি যখন জানতে চেয়েছিলাম, ‘আপনি এখানে তাহলে কীসের জন্য অপেক্ষা করছেন’? তিনি স্পষ্ট গলায় বলেছিলেন, ‘মৃত্যুর’!
এই মানুষটার চিকিৎসা করেছিলেন, ডা. @Gulzar Hossain Ujjal। পূর্বের লেখায় উল্লেখ করেছিলাম তাঁর শরীরের একটা পাশ অবশ ছিল- যেটার চিকিৎসা এখানে অসম্ভব। তাছাড়া হাই-প্রেসার ছিল এবং বাজে রকমের চর্মরোগ। মানুষটার সঙ্গে মাত্র গতকালই দেখা হয়েছিল কারণ প্রেসারের ওষুধ শেষ হয়ে গিয়েছিল, পৌঁছে দেয়ার তাড়া ছিল।
যথারীতি আজও স্টেশনে গেছি। একবার চক্কর না-লাগালে ফাঁকা-ফাঁকা লাগে কিন্তু আজকের কারণটা ভিন্ন। অন্য একজন অতি বয়স্ক মানুষকে নিয়ে গত ৪ দিন ধরে কস্তাকস্তি চলছে। এটা নিয়ে পরে কখনও শেয়ার করব।
যাই হোক, আজ স্টেশনে গিয়ে যেখানে এই মানুষটা শুয়ে থাকতে দেখতাম সেখানটা দেখলাম ফাঁকা। আমার গা হিম হয়ে আসে, বুকের ভেতর কষ্ট পাক থেয়ে উঠে। আমি প্রায় নিশ্চিত মানুষটা মারা গেছেন। আমি হৃদয় নামের মানুষটাকে ফোন করি- কেবল এঁর কাছেই বিস্তারিত জানা সম্ভব। কারণ এই হৃদয়ই মানুষটাকে পরিচ্ছন্ন করা, দেখভাল করতেন। আর এই হৃদয়ই এখানে কেউ মারা গেলে সবটা ভার নিজের কাঁধে তুলে নেন।
হৃদয় আমার ফোন পেয়েই হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসলে আমি তীব্র গলায় বলি, ‘মানুষটা মারা গেল আপনি আমাকে একটা খবরও দিলেন না’?
হৃদয় ঝলমলে মুখে বলেন, ‘ঘটনা আছে, ভাই’!
আমি বলি, ‘কী ঘটনা’?
হৃদয়ের কাছেই জানা গেল, অবশ্য রাতে তিনি তখন ছিলেন না অন্যদের কাছ থেকে পরে জেনেছেন- গতকাল রাতে এই মানুষটার তাঁর পরিবারের লোকজনেরা নিয়ে গেছেন। অবশ্য এই মানুষটাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য রাজি করাতে পরিবারের লোকজনের নাকি বিস্তর ঘাম ঝরাতে হয়েছে!
জানি না কেন আমার চোখ ভরে আসে। চোখের পানি কী বাঁধ মানে, শ্লা! হৃদয় আর কীসব যেন বিজবিজ করে বলছিলেন কিন্তু আমি মনোযোগ দিয়ে শুনছিলাম না। ইশ-শ, একজন মরদের চোখের পানি লুকাবার জন্য কী কসরতই না করতে হয়! মরদদের কাঁদার কিছু নিয়ম-কানুন আছে, এর ব্যত্যয় হওয়ার যো নেই। বাথরুমে পানির ট্যাপ ছেড়ে এই কর্মকান্ড করতে হয়- এর অন্যথা হওয়ার উপায় নেই।
আফসোস, আমি এই দৃশ্যটা দেখতে পেলাম না এই মানুষটার সঙ্গে তাঁর পরিবারের মিলনটা। দেখার বড় তীব্র ইচ্ছা ছিল, কেমন হয় হারিয়ে যাওয়া প্রিয়মানুষকে সিনেমার মত করে ফিরে পেলে। যে নিতল আনন্দ সেটা কী একটা আনন্দে থইথই কুয়ার মত...।
No comments:
Post a Comment