অপারেশন জ্যাকপটের নায়কদের
একজন, নৌ-কমান্ডো ফজলুল হক ভূঁইয়া। যিনি ১৯৭১ সালে
বুকে লিমপেট মাইন বেঁধে উড়িয়ে দিয়েছিলেন
পাকিস্তানিদের বিশাল-বিশালসব জাহাজ।
এই অপরেশন জ্যাকপটই পাকিস্তানি আর্মিদের মনোবল অনেকটা ভেঙ্গে দিয়েছিল।
তাঁর কাছ থেকেই আমি জেনেছিলাম, মুক্তিযুদ্ধে একমাত্র
নৌ-কমান্ডোদেরকেই লিখিত আকারে এটা দিতে হতো যে ‘আমার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয়’। সঙ্গে দেয়া হতো কাফনের কাপড়। তাঁর
কাছ থেকে এটাও জেনেছিলাম, আলী আহসান
মুজাহিদ কেমন ছলনা করে ৩০ জন নৌ-কমান্ডোকে ১৯৭১ সালে হত্যা করিয়ে ছিলেন।
তাকে নিয়ে আমার অজস্র লেখা
আছে। নতুন করে চর্বিতচর্বণ করি না। [১], [২], [৩], [৪], [৫]
গোটা এই দেশে এই মানুষটার
নিজস্ব এক ইঞ্চি জায়গাও নেই। এই বিষয়টা
ভাবলেই নিজেকে বড়ো অপরাধি মনে হয়। আমরা চেষ্টা করছিলাম, তিনি যে সরকারি জায়গাটায় ছাপরার মত একটা ঘর তুলে থাকেন সেটা তাঁর
নামে বন্দোবস্ত করে দেয়া।
তাঁর নড়বড়ে ঘরটার আশু
মেরামতও প্রয়োজন। যথাসম্ভব দ্রুত এর একটা ব্যবস্থা না-করলে জোর বাতাসে উড়ে যাবে এ
ঘর। ঘর মেরামত এবং একটা গাভী কিনে দেওয়ার জন্য মেজর
কামরুল হাসান ভূঁইয়া আমাকে কথা দিয়েছেন।
আগামী মঙ্গলবার কামরুল ভাইয়ের ওখানে ফজলুল হক ভূঁইয়ার যাওয়া স্থির হয়ে আছে।
‘জনযুদ্ধের গণযোদ্ধা’র লেখক মেজর কামরুল হাসান ভূঁইয়ার সঙ্গে যখন আমার ফোনে কথা হচ্ছিল
তখন এই সহৃদয় মানুষটা ফোনে আমাকে বড়ো কাতর হয়ে বলছিলেন, ‘আমি এখন চোখেও ভাল দেখতে পাই না, শারীরিক ভাবেও দুর্বল হয়ে পড়েছি, কখন...’।
আমি তাঁর কথা খানিকটা আঁচ
করতে পারছিলাম। আমি দৃপ্ত গলায় বলেছিলাম, ‘কামরুল ভাই, আপনার মত মানুষের কখনও মৃত্যু হয় না, খোলস পরিবর্তন হয়
মাত্র। “জনযুদ্ধের গণযোদ্ধা”র মত একটা বই-ই
আপনাকে অমর করে রাখবে’।
মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লেখার সময়
আমি অনেক বারই “জনযুদ্ধের গণযোদ্ধা” বইটার রেফারেন্স ব্যবহার
করেছি। এটা আমার নিজস্ব মত, এই বইটা না-পড়লে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে জানাটা অনেকটা
অসম্পূর্ণ থেকে যায়।
যাই হোক, নৌ-কমান্ডো ফজলুল হক ভূঁইয়াকে নিয়ে একটা লেখা লিখেছিলাম, ‘যদভবিষ্য’ [৬]। সেটা ২০১১
সালের কথা। নৌ-কমান্ডো ফজলুল হক ভূঁইয়া
তখন মাদক ব্যবসায়িদের সঙ্গে কুলিয়ে উঠতে পারছিলেন না। কারণটা আঁচ করাটা অতি সহজ-
যেখানে তাঁকে পুলিশ পরামর্শ দেয় মাদক ব্যবসায়িদের সঙ্গে মিলেমিশে থাকার জন্য [৭]।
এই মানুষটা তখন দ্বারে-দ্বারে
ঘুরেছেন। থানায় অভিযোগ জানানোর পাশাপাশি কশিনার, উপজেলা চেয়্যারমেন থেকে শুরু করে ডিসি,
এস.পি কেউ এই তালিকা থেকে কেউ বাদ পড়েননি!
তখনই আমরা আঁচ করেছিলাম এই
বিষবৃক্ষ গাছে যথাসময়ে ফল ধরবে।
আজ ২০১৪ সালে এসে ঠিক-ঠিক
বিষবৃক্ষ গাছটায় ফল ধরেছে। এই
নৌকমান্ডোর বাড়িতে সেই মাদক ব্যবসায়িদের চক্ররাই আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। কেবল ঘর পুড়েছে এমনই না, পুড়ে গেছে মুক্তিযুদ্ধে এই মানুষটার
অবদানের প্রায় সমস্ত কাগজপত্রই। আমি যখন তাঁর পোড়া ঘরের সামনে স্তুপ করা পোড়া
কাগজগুলো দেখছিলাম তখন ভাগ্যক্রমে পেয়ে
যাই ডিসির কাছে লেখা, উপজেলা চেয়্যারমেনের কাছে
লেখা আধপোড়া কাগজগুলো।
আমি যখন গিয়েছি তখন
মানুষটাকে বাসায় পাইনি। তিনি আবারও এর-ওর দ্বারে-দ্বারে ঘুরছেন। ...আমার লেখা
এখানে এসে ফুরিয়ে যায়। কেবল শিরোনামের কথাটা দিয়েই শেষ করি, ‘কমান্ডো, খবরদার, তোমার এক ফোঁটা চোখের জল যেন গড়িয়ে না-পড়ে...’।
*প্রথম ছবিটা দুলাল ঘোষের কাছ থেকে নেয়া। কৃতজ্ঞতা।
৭. মুক্তিযোদ্ধাকে
মাদক ব্যবসায়ীদের সাথে মিলে চলার পরামর্শ পুলিশ কমকর্তার!: http://bdn24x7.com/?p=13682
No comments:
Post a Comment