এদের নিয়ে কাজ করার সুবাদে
হররোজ এমন কোনও-না-কোনও একটা গল্পের মুখোমুখি হতেই হয়, এ তো আর নতুন কিছু না।
আমাদের দেশে ক্রমশ এদের সংখ্যা বাড়ছে তাইএখন আমরা দেখি নিরাসক্ত দৃষ্টিতে। কিন্তু
এই মেয়েটির ঘটনাটা একেবারেই অন্য রকম।
মেয়েটি বাকীতে সাদা-সাদা ভাত ঝোল দিয়ে মেখে খাচ্ছিল। যে ভদ্রমহিলা স্টেশনে ভাত বিক্রি
করেন তাঁকে আমি চিনি অনেক বছর ধরে। ‘প্রজেক্ট ন্যানো ক্রেডিটের’ একজন গর্বিত সদস্য [১]। ‘প্রজেক্ট ন্যানো ক্রেডিট’ নামটা জমকালো হলেও ন্যানো
ক্রেডিট নিয়ে অল্প কথায় খুব সহজ করে বলি, বিনা সুদে টাকা ধার দেওয়া। সুবিধামতো কেবল মূল
টাকাটা ফেরত দেওয়া।
এই ভদ্রমহিলার স্টেশনে ভাত
বিক্রি করার জন্য টাকার প্রয়োজন খুবই অল্প। অনেকে হা হা করে হাসতে হাসতে গড়িয়ে
পড়বেন, মাত্র ৩০০ টাকা! এই ভদ্রমহিলার নাম জানি না সবাই বলে, জসীমের মা, আমিও বলি,
জসিমের মা। এই ভদ্রমহিলা যতবারই টাকা ধার
নিয়েছেন ঠিক-ঠিক ফেরত দিয়েছেন। বাড়তি যে সুবিধাটুকু পাই সেটা হচ্ছে, স্টেশনের
সমস্ত তথ্য এঁর নখদর্পণে। কে সকাল থেকে কিচ্ছু খায়নি,
কে রাত থেকে উপোস সমস্ত তথ্যই পাওয়া যায় এঁর কাছে। আমার কাজের খুব সুবিধে হয়।
এই মহিলার দয়ার শরীর।
বাকীতে লোকজনকে খেতে দেন, একটা ব্লেডের ব্যবস্থা করে দিলে পা ছড়িয়ে কারও নখ কাটতে লেগে যান। এই মেয়েটির
সঙ্গে যখন কথা বলছি তখন পাশ থেকে একজন বললেন, ‘হের লগে কথা কইয়া লাভ নাই হে ফাগল (পাগল)’।
আমি রাগ চেপে বললাম, ‘আপনি কেমন করে জানেন এ পাগল’?
লোকটির কাটা-কাটা উত্তর, ‘হে আমার মাইয়া’।
আমি খানিক থমকে যাই। জসীমের
মাকে জিজ্ঞেস করি, ‘কথা সত্য’?
জসীমের মা বলেন, ‘হ’।
আমি খুবই অবাক হলাম। অদম্য
রাগ চেপে লোকটাকে বললাম, ‘আপনি কেমন বাপ
যে নিজের মেয়েকে পাগল বলছেন! পৃথিবীর কোনও বাপ কী তার সন্তানকে পাগল বলে!
বাপ-মাদের কাছে তো তার সন্তান সবচেয়ে আদরের,
সুন্দর, নিখুঁত। শোনেন, আপনি আর কক্ষণো এই মেয়েটি পাগল বলবেন না, এর সামনে তো
অবশ্যই না’।
আমি তো এই মেয়েটির সঙ্গে
কথা বলে তো কোনো প্রকারের অসঙ্গতি দেখলাম না। খুব গুছিয়ে উত্তর দিচ্ছিল এই মেয়েটি।
নাম জানতে চাইলে তেলহীন-জট চুলগুলো ঝাঁকিয়ে বলল, ‘শাবানা’। বাপ মনে হয় বালকবেলায় শাবানার খুব মুভি দেখত। আমি যখন মেয়েটিকে বললাম, ‘তুমি লেখাপড়া জানো’? নেতিবাচক
উত্তরের পর জানতে চাইলাম, ‘তুমি পড়বা’?
মেয়েটির উত্তর দেওয়ার
পূর্বেই বাপ চিল-চিৎকারে বলল, ‘না-না-না,
মাইয়া মানুষের পড়ালেকা করা ভালা না’।
এর বাপটা আসলেই আসল পাগল তাই আমি এই কথা নিয়ে তার
সঙ্গে কথা চালাচালিতে গেলাম না। কিন্তু এই হার্মাদ জানে না আমার পকেটে তাসের অভাব
নেই। আমি গম্ভীর মুখ করে বললাম, ‘ঘটনা কী, আপনে
তো মাইয়ারে আরবিও পড়ান নাই! সর্বনাশ করছেন দেখি। তা, আরবি পড়লে তো সমস্যা নাই,
নাকি’?
মানুষটা হলুদ দাঁত বের করে বলে, ‘নাহ, আরবি
পড়লে তো খুবই ভালা’।
শাবানার জন্য আরবি বইয়ের
ব্যবস্থা হয়। হালের আরবি বইগুলো চকচকে, ভেতরে আবার ফুল-ফলের ঝাঁ চকচকে ছবি। আমার
বিস্ময়ের শেষ নেই- অল্পক্ষণেই দেখি শাবানা প্রথম পাঁচটা অক্ষর মুখস্ত করে ফেলেছে।
বাপও দেখলাম, মেয়ের এই কেরামতি নিয়ে গর্বিত।
হে হে করে বলছে, ‘দেখতে হইব না কার মাইয়া’।
এদের নিয়ে কাজ করার সূত্রে
আমার যে অল্প জ্ঞান সে থেকে আমি জানি, এরা একটা আলাদা খোলস দিয়ে নিজেদেরকে মুড়িয়ে
রাখে। ওখানে আমার মত মানুষ স্রেফ একটা যন্ত্রণা বৈ আর কিছু না। এখানে তাড়াহুড়ো করা
চলে না। করতে হবে রয়েসয়ে। কাল জসীমের মা নামের ‘মায়াবতীকে’ পটাতে হবে
শাবানার চুলের জট ছাড়াবার একটা গতি করতে। শাবানা মেয়েটিকে বই নিয়ে যে উচ্ছ্বাস
দেখেছি তা আমার কাছে বিস্ময়কর বটে। পূর্বে কখনও কাউকে এতোটা উচ্ছ্বসিত হতে দেখিনি।
এর এই প্রতিক্রিয়ার উৎস কী আমি জানি না- এর নিতল কুয়ার মতো মস্তিষ্কে উঁকি দেওয়ার ক্ষমতা আমার নাই। থাকলে ভালো হতো...।
1 comment:
Post a Comment