আমার এখানে আজ ছিল উপজেলা
নির্বাচন। ক্ষমতার দিক থেকে উপজেলা চেয়ারম্যানের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নেই। তবুও
লড়াইটা মর্যাদার। সরকারী দল তাদের সবটুকু ক্ষমতা ব্যবহার করার চেষ্টা করবে এ আর
বিচিত্র কী! দলবাজির রঙির চশমা কারও চোখে না-থাকলে তার নমুনা যে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকবে এটা চোখে না-পড়ার তো কোনও কারণ নেই।
এই নির্বাচন ঘিরে একজনের
মৃত্যু হয়েছে বিজিবির গুলিতে। ব্যালট-বক্স ছিনতাই করলে সেনাবাহিনীকে গুলি করার
নির্দেশ দেওয়া হয়েছে কিন্তু এই ক্ষমতা বিজিবিকে দেওয়া হয়েছে কিনা এটা আমার জানা
নেই। তর্কের খাতিরে ধরে নিলাম তাদেরকেও গুলি করার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে।
আচ্ছা, ওখানে কি
ব্যালট-বক্স ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছিল? প্রথমে কি বিজিবি ফাঁকা গুলি ছুড়েছিল? পরে কি
পায়ে গুলি করেছিল? প্রত্যক্ষদর্শীর বক্তব্য কিন্তু ভিন্ন। ওখানে সত্যটা কি এটা আপাতত
ভবিষ্যতের জন্য তোলা থাকুক।
কাছের লোকজনেরা জানেন কোন
দল গেল এই নিয়ে আমার বিশেষ উৎসাহ নেই। তারপরও গেছি ভোট দিতে। আমি ঝামেলা এড়িয়ে
চলার আপ্রাণ চেষ্টা করি কিন্তু ড্রেন রাস্তার মাঝখানে চলে এলে আমার কী দোষ? সবই
কপাল! ব্যালট দেওয়ার পূর্বে সহকারী প্রিসাইডিং অফিসার দেখি আমার বাম হাতর বুড়ো আঙ্গুল নিয়ে টানাটানি করছেন।
এবেলা বলে রাখি, অনেক বছর
ধরে বাম হাতের বুড়ো আঙ্গুলে একটা আংটি পরি। বাম হাতের বুড়ো আঙ্গুলে এটাকে রাখাই
আমার জন্য সুবিধাজনক। এটা নিয়ে কঠিন ব্যাখ্যা আছে আমার কাছে কিন্তু সেই ব্যাখ্যাটা
এখানে দেওয়াটা আমার কাছে জরুরি মনে হচ্ছে না।
এবং পাথরটার বংশ পরিচয় আমার
কাছে গুরুত্বপূর্ণ না। এটাও জানি এটা চার আনায়ও কেউ নিতে চাইবে না। আর পাথর-টাথরের
গুণাগুণ নিয়েও আমি বিন্দুমাত্র বিচলিত না। আংটিটা ছিল আমার বাবার এটাই আমার কাছে
জরুরি আর কিছু না।
যাই হোক, এ সত্য সহকারী
প্রিসাইডিং অফিসার আংটিটা খুলে রেখে দিতে
চাইছেন এটা নিয়ে আমি উদ্বিগ্ন ছিলাম না।
যৎসামান্য শংকাও কেটে গেল যখন তিনি আমাকে বললেন. ‘এখানে টিপসই দেন’।
আমি বললাম, ‘সরি, আমি টিপসই দেব না। সই করব’।
সহকারী প্রিসাইডিং অফিসার
রূঢ় গলায় বললেন, ‘টিপসই দেন’।
আমি খানিক থমকে গিয়ে বললাম,
‘আচ্ছা বলুন তো টিপসই ব্যতীত সই করার অপশন আছে কি না’?
তিনি বললেন, ‘আছে’।
আমি এবার বললাম, ‘তাহলে আমি সই-ই করব’।
এবার সহকারী প্রিসাইডিং
অফিসার অসভ্য আচরণ করলেন। তিনি বললেন, ‘সই করলে আপনি নিজের কলম দিয়ে করেন’।
আমি বললাম,’আমি তো কলম আনিনি। আর আপনি কয়েক সেকেন্ডের জন্য আপনার কলমটা দিলে এতে তো খুব একটা সমস্যা
হওয়ার কথা না। বেশ, তাহলে আমি কলম নিয়ে আসছি’।
এবার তিনি গজ গজ করতে করতে
কলমটা দিলেন। পোলিং এজেন্ট যারা ছিলেন এরা বললেই পারতেন, দিক না সই অথবা আমাকে
একটা কলম দিলেও হতো। উল্টো এরা কেউ-কেউ তাচ্ছিল্য করে বললেন, ‘হুম, সই করলে তো সারাদিন
লাগবে’। একজন আবার বলে বসলেন, ‘সবাই টিপসই দিল কোনো সমস্যা হলো না কেবল আপনার সমস্যা হয়ে গেল’!
বটে! তাই তো, এদেশে অনিয়মই
নিয়ম যে...।
আমি সই করে ব্যলটপেপার
নিলাম কিন্তু আর কথা বাড়ালাম না। আমি যে মুহূর্তে গিয়েছিলাম তখন সেই বুথে আমি
ব্যতীত অন্য কোনও ভোটার ছিলেন না। আমি আর কথা বাড়াইনি ইচ্ছা করেই। কারণ এখানে আমি একা আর কথা কাটাকাটির এক
পর্যায়ে এরা সবাই মিলে ব্যালট-বক্স আমাকে ধরিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ডেকে নিয়ে
এলেন। এরা দেরি না-করে দুম করে গুলি করে বসলেন। একটাই প্রাণ সেটাও কেড়ে নিলে আমি
বাঁচব বুঝি! হাত-পা ছড়িয়ে থই থই রক্তের মাঝে পড়ে থাকব। কোনও দুঁদে সাংবাদিক আমার শরীর থেকে গলগল
করে বের হওয়া রক্তের মাঝে সূর্যের প্রতিফলন আটকাবার চেষ্টা করলে তাকে তো দোষ দেওয়া
চলে না। আমার মত এলেবেলে মানুষের ছবি ছাপাবার জন্য এর যে বড়ো প্রয়োজন আছে। বাই এনি
চান্স, জাতীয় কোনও দৈনিকে ছবিটা ছাপা হয়ে গেলে সেটা হবে আমার জন্য অপার সৌভাগ্যের। কিন্তু এমন সৌভাগ্য আমি দেখে যেতে
পারব না এটা আমি মেনে নিতে পারি না। কদাপি না...।
No comments:
Post a Comment