আমার মাকে নিয়ে একটা ধারাবাহিক লেখা শুরু করেছিলাম, ‘হাসপাতাল পর্ব’ শিরোনামে [ http://tinyurl.com/boya6xk ]। সেই কবে, তা বছর দুয়েক তো হবেই। লেখাটা তেরো পর্ব পর্যন্ত লিখে ফেলে রেখেছি- আজও লেখাটা শেষ করা হয়ে উঠেনি। কয়েকবারই লেখার চেষ্টা করে হাল ছেড়ে দিয়েছি। মস্তিষ্কের একটা অংশ সম্ভবত চাচ্ছে না লেখাটা শেষ হোক। কিন্তু লেখাটা শেষ করাটা তো জরুরি। একজন মানুষকে আর কতদিন এভাবে হাসপাতালের বিছানায় ফেলে রাখা যায়! কর্তৃপক্ষ জবাব চাইলে কোনো উত্তর তো নেই আমার কাছে কারণ এ তো মিথ্যা না যে দেশের হাসপাতালে বিছানার কী সংকট! বিষয়টা যে ভারী দৃষ্টিকটু এতে কোনও সন্দেহ নেই।
আমার মা সেই কবে থেকে তোতা পাখির মত বকেই যাচ্ছিলেন, ‘ফাজিল, তুই আমারে বাড়ি নিয়া যাবি কবে’? মহিলা বড়ো যন্ত্রণা করতেন। দুনিয়ায় আর কোনও কথা নাই, না? একই কথা আর কত ভাল্লাগে, বলো তো?
আহ, সেই প্রফেসর তৌহিদুল আলম, যাকে আদর করে লিখেছিলাম, ‘গু ডাক্তার’ কারণ এই ভদ্রলোকের কাছে গু শব্দটা বড়ো প্রিয়- কী আর করা যার যেমন অভিরুচি। আমার মাকে এই মানুষটা প্রকারান্তরে খুন করেছিলেন কিন্তু তেরো পর্বের পর আর কিছু লেখা হয়েই উঠলো না তাই তৌহিদুল আলমকেও খুনি বলা হলো না! ওই ধারাবাহিক লেখায় কেবল ‘সম্ভাব্য খুনি’ বলেই সারতে হয়েছিল। সুতীব্র আশা নিয়ে আছি, লেখাটা তরতর করে এগুবে, আমার মারও মৃত্যু হব আর এই ডাক্তারকেও খুনি বলা যাবে।
মরণ! মৃত্যুর কথাটা কেন আসল এটা একটু বলি। দু-বছর পূর্বে ডাক্তাররা কীসব ছাতাফাতা কাগজে খসখস করে লিখল যেটার চালু নাম ডেথ-সার্টিফিকেট। এরপর লাশ উঠাও, লাশ নামাও। শেষশয্যায় শুইয়ে দেওয়ার সময় ঢাউস একটা কালো পিঁপড়া দেখে প্রাণপনে সরাবার চেষ্টা করছিলাম। অথচ সাদা কাপড়ের গিঁটগুলো তখনই খুলে দিতে হবে,নিয়ম। দ্রুত যেন পিঁপড়া-পোকা-ব্যাকটেরিয়া দেহটা নষ্ট করে ফেলে।
দূর-দূর, ডাক্তাররা ডেথ সার্টিফিকেট লিখে দিলেই হলো আর কী! আমি না-মানলে ডাক্তাররা আমার কী করবে! ছাতা..., জোর করে ধরে আমাকে তো আর অপারেশন টেবিলে তুলতে পারবে না?
আমি মানুষটাই আসলে এলোমেলো, সব উল্টো! যেটা দু-বছর পূর্বে মেনে নিয়েছিলাম সেটা পরে ক্রমশ আর মানতে পারিনি, আজও, এখনও না। এখনও এই মহিলার কথা মনে হলে ব্রেনে শর্টসার্কিট হয়ে যায়, কেমন পাগল-পাগল লাগে। শপথ আমার লেখালেখির, এখনও আমি এই মহিলার জন্য হিংস্র কুকুরের মত লড়ব।
আনন্দ-বেদনার স্মৃতিগুলো ক্রমশ ধূসর হয় এটাই নিয়ম কিন্তু ওই যে বললাম আমার সবই উল্টো। শালা স্মৃতির মত বদমাশ! কালেভদ্রে পরা হয় এমন, বাইরে যাওয়ার জুতোটা- পায়ে গলিয়ে টের পাই যার ভেতর ঠাসা পুরনো কাগজ। মার কান্ড- যেন জুতোটা না তুবড়ে যায়। ওই কাগজগুলো যত্ন করে রেখে দিলেই কী আর মার স্পর্শ পাওয়া যায়!
এই ভদ্রমহিলার খুব পছন্দ ছিল বেলি ফুল। হয়তো এর সঙ্গে তাঁর স্বামীর অজস্র স্মৃতি জড়িয়ে ছিল। দেখো দিকি কান্ড, দুনিয়ার গাছ লাগাতাম আমি, বেলিও লাগিয়েছিলাম কিন্তু একটা ফুল ফুটত না, আশ্চর্য! অথচ এখন গাছে বেলি ফুল উপচে পড়ে। পেড়ে শেষ করা যায় না এমন!
প্রচুর বাদাম খেতাম বলে এই মহিলা বাদামের খোসা ছাড়িয়ে ঝকঝকে কাঁচের বয়মে রেখে দিতেন। রগড় করে বলতেনও আমাকে, ‘বাদামকুমার’! আজও বাদাম খাওয়া হয় খোসা ছাড়িয়ে ছাড়িয়ে কিন্তু সেই ‘বাদামকুমার’ আজ কোথায়?
নাহ, থাকুক মহিলা যেমনটা আছেন তেমনই, বেঁচেবর্তে। বাড়ি ফেরার অপেক্ষায়। অহেতুক তাঁকে নিরাশ করার প্রয়োজন কী...।
No comments:
Post a Comment