আজকের অতিথি লেখক সাব্বির হোসাইন (https://www.facebook.com/sabbirhossain.uni)। রওশন আরাকে নিয়ে তথ্যবহুল এক লেখা লিখেছেন:
“মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা দেখতে যেয়ে
আবিষ্কার করলাম,
সে তালিকায়
রোশেনারার (রওশন আরা) নাম নেই। দু:খ পেলাম। অথচ রোশেনারা যে কাজ করেছিলেন, তা কোন বীরশ্রেষ্ঠ থেকে কম নয়। ইতিহাসে আমরা দুজন রোশেনারার (রওশন আরা)
সম্পর্ক জানতে পারি।
এক.
মুক্তিযোদ্ধারা ভারী অস্ত্র নিয়ে কিশোরী
রোশেনারাদের গ্রামে আশ্রয় নিয়েছিল। রোশেনারাদের বাড়িতে অস্ত্র রেখেছিল, গ্রেনেড আর মাইন। রোশেনারাকে খুব স্নেহ করতেন মুক্তিযোদ্ধারা। মুক্তিযোদ্ধাদের কাছ থেকে রোশেনারা মাইন, গ্রেনেড সহ নানান অস্ত্র চালাতে শিখেছিল।মুক্তিযোদ্ধাদের কাছেই সে শুনেছিল, মাইন দিয়ে বড় বড় গাড়ি, বাড়ি ধ্বংস করা যায়।
রাজাকারদের থেকে খবর পেয়ে এক পড়ন্ত দুপুরে রোশেনারাদের গ্রামে ট্যাংক নিয়ে পাকিস্তান বাহিনী আক্রমণ করে। গ্রামে তখন মুক্তিযোদ্ধারা ছিলেন না, ওঁরা একটা অপারেশানে দূরে কোথাও গিয়েছিলেন।
সারা গ্রাম পাকিরা লন্ড-ভন্ড করে। মেয়েদের উঠোনে এনে সবার সামনে নির্যাতন করে। কুকুর শিকারের মত বাঙালি মারতে থাকে। এসব দেখে আর সহ্য হলো না রোশেনারার। হঠাৎ কি থেকে যেন কি হয়ে গেল।
ছোট্ট শুকনো একটা মেয়ে জয় বাঙলা বলে পাকিদের ট্যাংকের নিচে ঝাঁপিয়ে পড়লো। এরপর, বিকট শব্দ আর পাকিদের আর্তচিৎকার। রোশেনারার আত্মঘাতী মাইন-আক্রমনে ধ্বংস হয়ে যায় পাকি ট্যাংক, লাশ হয় কুড়িজনের মত পাকি হায়েনা।
দুই.
২৫ মার্চের আগে থেকেই মুক্তির সংগ্রামের জন্য বাঙালি তরুণ-তরুণীরা গোপনে সামরিক প্রশিক্ষন নিচ্ছিল। সেই দলের সদস্য ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের রওশন আরা।
২৫ মার্চ, ১৯৭১ এ শুরু হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর সবচেয়ে বড় গণহত্যা। পাকিরা গুলি করে, বেয়নেট চার্জ করে কুকুর মারার মত করে বাঙালি হত্যা করছে। সেই রাতেই (২৬ মার্চ, প্রথম প্রহর) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ট্যাংক নিয়ে হামলা করে পাকি বাহিনী। হঠাৎ করে দানব ট্যাংকের সামনে এসে পড়েন রওশন আরা।
তাঁর বুকে মাইন বাঁধা। জয় বাঙলা চিৎকার দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লেন ট্যাংকের নিচে। মুহুর্তেই দলিত হয়ে গেল রওশন আরার দেহ আর বিকট বিস্ফোরন। বাঙলার মাটিতে ধ্বংস হলো প্রথম পাকি ট্যাংক।
...
পাঠকের কাছে শুধু এই প্রশ্নটুকু রেখে যায়- কতটা দেশপ্রেম, দেশের প্রতি কতটা ভালোবাসা থাকলে একজন মানুষ পালিয়ে যেয়ে আত্মরক্ষার সুযোগ থাকা সত্বেও আত্মঘাতী হয়ে দেশের শত্রুবধে ব্রত হতে পারেন? দেশপ্রেমের সেই তলহীন গভীরতার কতটুকু আমরা স্পর্শ করতে পেরেছি।
রোশেনারাকে (রওশন আরা) নিয়ে বেশ কিছু সাহিত্যও রচিত হয়েছিল।
সামসুল হকের
কবিতা
রোশেনারা
“তোমার বয়স কতো, আঠারো উনিশ?মুখশ্রী কেমন? রঙ চোখ চুল কী রকম? চলার ভঙ্গিমা?
ছিল কি বাগান, আর তোমার মল্লিকা বনে ধরেছিল কলি?
ছিলে তুমি কারো প্রতিমা?
জানি না।
না, জানি।
পৃথিবীর সব মাস সব দিন তোমার হাতের মধ্যে এসে গিয়েছিল,
দুপুরের মতো মুখ, রৌদ্রদগ্ধ চোখ, পায়ে চৈত্রের বাতাস,
তোমার বাগানে- কলোনি স্বদেশে-
ধরেছিল সাড়ে সাত কোটি মল্লিকার কলি,
তুমি ছিলে মুক্তির প্রতিমা।
ওই বুকে মাইন বেঁধে বলেছিলে-
জয় বাংলা- মানুষের স্বাধীনতা দীর্ঘজীবী হোক,
ট্যাঙ্কের ওপর ঝাঁপ দিতে দিতে বলেছিলে-
বর্বরতা এইভাবে মুছে যাক, ধ্বংস হোক সভ্যতার কীট।
অন্তিমবারের মতো পথিকেরা পথে এসে দাঁড়িয়েছে, আকাশে উঠেছে ধ্রুবতারা-
ধ্রুবতারা হয়ে গেছে মুক্তির জননী রোশেনারা।"
প্রীতিশ নন্দীর
কবিতা:
(মূল ইংরেজী রচনার অনুবাদ করেন শিশির
ভট্টাচার্য্য;
একাত্তরে
পশ্চিমবঙ্গ থেকে প্রকাশিত ‘গঙ্গা থেকে
বুড়িগঙ্গা’ সাময়ীকিতে ছাপা হয়)
একটি মেয়ের মৃত্যু
“রোশেনারা মারা গেছে, মনে রেখো।নদীর মেয়ে রোশেনারা, প্রতিহিংসার সূর্য আমাদের, রাত্রির স্তরের ওপর তুষারীভূত দুটো চোখ
রোশেনারার শান্ত চোখদুটোর কথা মনে করো
এরপরও যদি তুমি হিংসার প্রসঙ্গ তোল
তবে আমি তোমাকে ওর চূর্ণ বিচূর্ণ বাহুদুটোর উচ্চারিত ভয়ঙ্কর প্রশ্নটির দিকেই দেখিয়ে দেব।
আর তারপর ইবলিস যদি তোমার পথ প্রদর্শক হয়
তবে আমি সেই নীল নিঃস্তব্ধতার দিকেই তোমাকে এগিয়ে যেতে বলব
যা রাত্রির কামনা নিয়ে জ্বলতে থাকে
যখন লক্ষ লক্ষ কৃষ্ণাভ রক্তগোলাপ ওর চোখের সামনেই ঝরে যায়।
মনে রেখো আজ রাতে রোশেনারা মারা গেছে
আর নিজের মরা চোখ দুটোই ওর সেই নীরবতা পালন করছে।
দূরের গ্রামগুলো যখন বন্দুকের আওয়াজে শব্দিত হয়ে উঠবে
ওর খোঁপায় গোঁজা অঙ্গারীভূত লাইলাক ফুলটা রাতের জাফরিতে বুনে দেবে সাহস
সময়ের সেনানী-সবুজ রূপকথাগুলো রোশেনারার বরণ করা মৃত্যুর জন্য প্রতীক্ষা করবে না আর।
একটা ট্যাঙ্ক একটা জীবনের সমান
হ্যাঁ রোশেনারা ওই দাম ওর
গ্রীষ্মের মূল্য ও শতলক্ষ নিহতের, পর্বতপ্রমাণ ধর্ষণ আর শঙ্খ চিলের মৃত্যুর।
আর যদিও সাতটি রাত্রির পৈশাচিক ভীষণতা জুড়ে প্রাচীনতম নদীটি জ্বলছে
ভস্মীভূত বৃক্ষ আর নাপাম বোমাহত পাখিটা নীরবে অপেক্ষামান।
যদিও তোমার অন্তহীন প্রশ্নগুলো চুয়াডাঙার জনহীন পথে পথে ঘুরে বেড়াচ্ছে
পাবনা মেশিনগানের গুলিতে ঝাঁঝরা
সিলেট প্রাণহীন
আর চট্টগ্রাম হলুদ-নদীর অপরপারে অপেক্ষামান।
তবু মনে রেখো, রোশেনারা মারা গেছে
আর তার মৃত্যুই চূড়ান্ত।“
বাউল কবি অমর
পালের দুটি গান।
এক:অনলাইনে শুনুন:
http://kiwi6.com/file/imj8hl5kpf
“আকাশ কান্দে বাতাস কান্দে যেন মণিহারা,
কান্দিয়া কান্দিয়া অন্ধ হৈল চক্ষু তারা,
তোমার লাগি দেশ কান্দে ওগো রোশেনারা।
যতদিন ঐ মাঠে মাঠে বুনবে সোনার ধান,
ততদিন ঐ মাঝির মুখের হৈয়া রইবে গান।
তোমার নামে কান্দে ঐ বাউল একতারা,
তোমার লাগি দেশ কান্দে ওগো রোশেনারা।
রক্তের অক্ষরে নাম লিখে গেছ হায়,
ঝড়ে জলে বৃষ্টিতে যে ও নাম মোছা দায়।
কাহার ঘরের ঘরণী গো ছিলে কন্যা কার,
দেশের লোকে জানে তুমি মেয়ে যে বাংলার।
আন্ধার পথের পথিকেরে দেখায়ো পথ শুকতারা,
তোমার লাগি দেশ কান্দে ওগো রোশেনারা।“
দুই:
অনলাইনে শুনুন:
http://kiwi6.com/file/us0tao48zy
“তোরা দ্যাখ আসিয়া রে বাংলা যে হৈয়াছে স্বাধীন,
দুই রঙা যে পতাকা ওড়ে আসিল সুদিন।
ও তার জমিনটা যে সবুজ দেশের মাটির কথা কয়,
মধ্যিখানে নতুন দিনের সূর্যের উদয়।
শেখ মুজিবের সোনার বাংলা আনল নতুন দিন,
তোরা দ্যাখ আসিয়া রে বাংলা যে হৈয়াছে স্বাধীন।
যে দেশেতে জন্ম নিল বীর মুজিব ভাই,
রক্ত দিল রোশেনারা যার তুলনা নাই,
প্রাণ দিয়া মান রেখে গেল রাম ও রহিম,
তোরা দ্যাখ আসিয়া রে বাংলা যে হৈয়াছে স্বাধীন।
বাংলাদেশ যে হৈল স্বাধীন কররে এবার পণ,
দেশের তরে আপন স্বার্থ দিয়া বিসর্জন,
সেই পতাকা নবার উপর রাখরে চিরদিন,
তোরা দ্যাখ আসিয়া রে বাংলা যে হৈয়াছে স্বাধীন।“
সামরিক বাহিনীতে রোশেনারা:
একাত্তরে মুক্তিবাহিনীর দুটি গোলন্দাজ ব্যাটারির একটি ছিল ‘মুজিব ব্যাটারি’ এবং আরেকটি ছিল ‘রওশন আরা ব্যাটারি’। ট্যাংক ধ্বংসকারী রোশেনারার (রওশন আরা) প্রতি কৃতজ্ঞতা স্বরূপ একাত্তরে মুক্তিবাহিনীর একটি গোলন্দাজ ব্যাটারীর নাম তাঁর নামানুসারে রাখা হয়।
(সূত্র: বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী)
ঐতিহাসিকতার দ্বন্দ্ব:
রোশেনারা (রওশন আরা) চরিত্রটির ঐতিহাসিকতা নিয়ে বেশ কিছু বির্তক আছে। স্বাধীন বাংলা বেতারের নুরজাহান মাযহারের মতে, চরিত্রটি বাস্তবে ছিল। নুরজাহান মাযহারের কাছে অনেক নারী মুক্তিযোদ্ধার আসল পরিচয় দেয়ার জন্য আমরা ঋণী।
রোশেনারা চরিত্রটি সম্পর্কে চার ধরণের মতামত প্রচলিত আছে:
০১. রোশেনারা চরিত্রটি সামরিক কৌশল হিসেবে ভারতীয় বেতারের সৃষ্টি।
০২. এম আর আখতার মুকুলের সৃষ্টি।
০৩. আহমেদ সফার সৃষ্টি।
০৪. চরিত্রটি বাস্তবে ছিলেন।
স্বাধীনতার সাড়ে তিন দশক পর রোশনারা চরিত্র সম্পর্কে অনুসন্ধান করার ক্ষেত্রে অগ্রজদের লেখা, প্রাতিষ্ঠানিক প্রকাশনা, মুক্তিযোদ্ধাদের ইতিহাসবর্ণনের উপর নির্ভর করতে হয়েছে। ইতিহাস যাচাইয়ের প্রামাণ্য নিয়ম অনুসারে শেষ মতটি বেশি গ্রহণযোগ্য বলে ধরে নিলাম। কারন, এই সংক্রান্ত সবচেয়ে পুরাতন দলিলটি হলো, নূরজাহান মাযহারের মুক্তিযুদ্ধ কথিকা ও স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র হতে যুদ্ধকালীন সময়ে প্রকাশিত নারী মুক্তিযোদ্ধাদের উপর পুস্তিকা; দুটো বইতেই নুরজাহান মাযহারকে বাস্তবের চরিত্র বলে বর্ণনা করা হয়েছে।
নূরজাহান মাযহার রোশেনারার (রওশন আরা) ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন নাকি ওঁনার কথা শুনেছিলেন, এই বিষয়ে কোন বর্ণনা কথিকায় নেই। তাঁর লেখা মুক্তিযুদ্ধ কথিকায় রোশেনারার বীরত্ব বর্ণনার সময় প্রীতি রানী পুরকায়স্থর নারী মুক্তি ফৌজের কথা উল্লেখ করা হয়। এই হিসেবে রোশেনারার বাড়ি সম্ভবত সিলেট অঞ্চলে (আরো স্পষ্টত সুনামগঞ্জ)।
রওশন আরার কোন পূর্বপরিচয় জানা যায়নি। যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র থেকে নারী মুক্তিযোদ্ধাদের উপর একটি পুস্তিকা প্রকাশিত হয়েছিল। সেই পুস্তিকায় ঘটনা- দুইয়ের বর্ণনা পাওয়া যায়। এই পুস্তিকায় স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের নিয়ে একটি বাহিনী গঠনের কথা উল্লেখ আছে। রওশন আরাকে এই বাহিনীর সদস্য উল্লেখ করা হয়। সম্ভবতঃ এই একই বাহিনীর কথা ষোলখন্ডে প্রস্তুতকৃত স্বাধীনতাযুদ্ধের দলিলপত্রে উল্লেখ আছে।
২০১৩ সালে জাতীয় মহিলা সংস্থার উদ্যোগে নারী মুক্তিযোদ্ধা সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলাম। ওই অনুষ্ঠানে পাবনার বীর মুক্তিযোদ্ধা শিরিন বানু মিতিল মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় রোশেনারার (রওশন আরা) বীরত্বের বর্ণনা করেন। এই একই অনুষ্ঠানে সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী একাত্তরে তাঁর নেতৃত্বাধীন একটি নারী মুক্তিযোদ্ধা বাহিনীর কথা বলেন এবং তিনিও রোশেনারাকে (রওশন আরা) নিয়ে বীরত্বের বর্ণনা করেন।
একটি কথা না বললেই নয়, এই লেখাটি মূলত রোশেনারার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে লেখা। রোশেনারা সম্পর্কে একটি বর্ণনামূলক লেখা। রোশেনারা মিথ নাকি বাস্তবতা, তা প্রমাণ করা এই লেখার উদ্দেশ্য নয়। রোশেনারা সম্পর্কে সবচেয়ে বেশি যে দুইটি বইতে পাওয়া যায়, তার দুটোই রোশেনারাকে বাস্তবের একটি চরিত্র বলে অভিহিত করছে এবং আমি ব্যক্তিগতভাবে তাদের মতামতটুকু গ্রহণ করেছি।
তথ্যসূত্র:
০১। মুক্তিযুদ্ধ কথিকা, নূরজাহান মাযহার।
০২। স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র থেকে নারী মুক্তিযোদ্ধাদের উপর একটি পুস্তিকা।
*রোশেনারার (রওশন আরা) উপর রচিত কবিতা, গান ও গানের অডিও সহ তথ্য দিয়ে এবং নানানভাবে বিশেষ সহযোগীতা করেছেন: শ্রদ্ধেয় এমএমআর জালাল ভাই।
3 comments:
আমাদের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অজানা দিক জানলাম। ধন্যবাদ লেখককে
its a question fantasy or facts
বাস্তবতা নাকি মিথ হিসেবে বিবেচনা করা হবে, সেটা ব্যাক্তি পাঠকের উপর ছেড়ে দিলাম।
আমি ব্যাক্তিগতভাবে চরিত্রটিকে বাস্তবের চরিত্র বলেই মেনে নিচ্ছি।
Post a Comment