রওশন আরাকে নিয়ে লেখাটায় যেটা লিখেছিলাম [১]:
“...তখন রওশন
আরাকে যে-প্রকারে বিকচ চৌধুরী বা আহমদ ছফা সৃষ্টি করেছিলেন এতে আমি দোষের কিছু দেখি
না। যুদ্ধের বিভিন্ন কৌশল
থাকে। যোদ্ধা বা যুদ্ধের সঙ্গে জড়িত মানুষদের
উদ্দীপ্ত করার জন্য এও এক কৌশল।...”
সাব্বির
হোসাইন
রওশন আরাকে নিয়ে অসম্ভব পরিশ্রমী এক লেখা
লিখেছেন [২]। তাঁর এই উদ্যেগকে আমি সাধুবাদ জানাই। কিন্তু তাঁর মত, লেখার সঙ্গে
আমি সবিনয়ে দ্বিমত পোষণ করি। আমি মনে করি, রওশন আরা চরিত্রটি একটি কাল্পনিক
চরিত্র। যেটা আমি পূর্বেও বলেছি। এই
প্রসঙ্গে অন্য একজনের লেখার জবাবে আমি তীব্র শ্লেষভরা উত্তর দিয়েছি কিন্তু সাব্বির
হোসাইন-এর বিষয়টি ভিন্ন।
যদিও আমি তাঁর সঙ্গে
একমত নই কিন্তু মানুষটার প্রতি আছে আমার ভাল লাগা কারণ তিনি কাজটা করেছেন সততার
সঙ্গে।
যাই হোক, রওশন আরাকে
নিয়ে তখন কেন এমনটা
করার প্রয়োজন দেখা দিয়েছিল? পূর্বেই বলেছি এটাকে আমি দোষের মনে করি না কারণ যুদ্ধের অনেক কৌশলের এটাও
একটা। কখনও কখনও এরও তীব্র প্রয়োজন আছে।
যিনি ১৯৭১ সালে রওশন
আরাকে নিয়ে প্রতিবেদনটা লিখে হইচই ফেলে দিয়েছিলেন সেই মানুষটা হচ্ছেন, বিকচ
চৌধুরী। এবং রওশন আরা নামের এই
চরিত্রটি সৃষ্টির পেছনে যে মানুষটির প্রচ্ছন্ন হাত ছিল তিনি হচ্ছেন আহমদ ছফা। আহমদ
ছফার জবানিতে আবারও শুনি:
“...আমরা যখন প্রবেশ করলাম রওশন আরার স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা
নিবেদন করে কলকাতার এক গুণী শিল্পী একটি গান পরিবেশন করছিলেন। গানের কথাগুলো ভারি
সুন্দর। ভদ্রলোক তন্ময় হয়ে
গাইছিলেন-
‘শহীদ লক্ষ ভাই ভগিনী শহীদ
রোশেনারা
তোমরা তো সব প্রাণের আগুন চোখের
ধ্রুবতারা
রোশেনারা বোনটি আমার কোন গাঁয়ে যে ছিল
তোমর ঘর...’
শিল্পীর কন্ঠে গানটি
যেই শেষ হল, এই বীরাঙ্গনা তরুণীর স্মৃতির প্রতি অপার মমতায় উপস্থিত দর্শকের চোখ অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠল।...
গানের পর কলকাতার
সবচেয়ে খ্যাতিমান আবৃত্তিকার বিখ্যাত কবি এবং সমালোচক প্রমথনাথ বিশীর সুললিত ছন্দে
লেখা একটি সুদীর্ঘ কবিতা আবৃত্তি করলেন।
তারপরে একজন মাঝবয়েসী
মহিলা মঞ্চে এলেন। তিনি উপস্থিত শ্রোতাদের কাছে রওশন আরা সম্পর্কিত এপর্যন্ত যে সব সংবাদ তারা সংগ্রহ করতে পেরেছেন, একটি লিখিত বিবরণ পাঠ করলেন।
রওশন আরার বাড়ি
রাজশাহী জেলার নাটোর। তার বাবা পেশায় একজন পুলিশ অফিসার। এবং সম্পর্কে সে ছিল শেখ
মুজিবুর রহমানের আত্মীয়া। পড়াশোনা করত ঢাকার ইডেন কলেজে। ...বগুড়া ক্যান্টনমেন্ট
থেকে ট্যাঙ্ক নিয়ে পাকিস্তানি সৈন্যরা রাজশাহীর দিকে এগিয়ে আসছে।...(রওশন
আরা) মাথার ওড়নাটা খুলে
নিয়ে ভালো করে বুকের সঙ্গে তিনটা মাইন শক্ত করে বেঁধে নিল। ...তারপর প্রাণপন
চীৎকারে জয় বাংলা ধ্বনি উচ্চারণ করে, সারা শরীর ট্যাঙ্কের তলায় ছুড়ে দিয়েছিল।
...এটুকু পাঠ করার পর
হলের মধ্যে আহা উহু ধ্বনি শোনা
যেতে থাকল। কোনো কোনো মহিলা উচ্চৈঃস্বরে রোদন করে উঠলেন।
...তারপর এলেন আরো এক
মহিলা। তিনি এপর্যন্ত ভারতবর্ষের নারীসমাজ রওশন আরার আত্মদানে উদ্বুদ্ধ হয়ে কী কী
কর্মসূচী গ্রহণ করেছে, তার একটা আনুষ্ঠানিক বিবরণ দাখিল করলেন। দিল্লিতে শ্রীমতি
অরুণা আসফ আলির নেতৃত্বে একটি রওশন আরা ব্রিগেড গঠিত হয়েছে। তাঁরা পায়ে হেঁটে
আগ্রা অবধি মার্চ করে গেছেন এবং বাংলাদেশের শরণার্থীদের জন্য সাড়ে পাঁচ লক্ষ টাকা
সংগ্রহ করেছেন। পাটনায় রশন আরা বিগ্রেডের কর্মীরা নিজের হাতে বাংলাদেশের
মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য আড়াই হাজার উলের সুয়েটার বুনে দিয়েছে। এইভাবে এলাহাবাদ, বেনারস, জলন্ধর, অমৃতসর, মাদ্রাজ, দিল্লি
রওশন আরা বিগ্রেড কর্মীদের কর্মসূচীর বর্ণনা দিলেন।...
...বাংলাদেশের জনগণের
মুক্তিসংগ্রাম থেকে এইরকম রওশন আরার মতো বীরকন্যা যদি সত্যি সত্যি জন্ম নিত, তা
হলে আমাদের সংগ্রামের অবস্থা কী দাঁড়াত মনে মনে কল্পনা করতে চেষ্টা করলাম।“
(অলাতচক্র, পৃষ্ঠা
নম্বর: ১৩১, ১৩২, ১৩৩)
সান জুর Art
of war বইটি পড়ল খানিকটা আঁচ
করা যায় যুদ্ধ কেবল ছেলেখেলা না- এখানে মস্তিষ্কের কারুকাজের খামতি নেই। তাই রওশন
আরা নামের চরিত্রটিও মস্তিষ্কের এক অসাধারণ কারুকাজ। সাড়ে পাঁচ লক্ষ টাকা সংগ্রহ বা মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য আড়াই হাজার উলের
সুয়েটার, ভাবা যায়!
তেমনি বলা চলে স্বাধীন
বাংলা বেতার কেন্দ্রের এম. আর. আখতার মুকুলের চরমপত্র নিয়ে। তাঁর চরমপত্র তখন কী
অসাধারণ প্রভাবই না ফেলেছিল!
“এম. আর. আখতার মুকুল ট্যাঙ্ক ধ্বংস করছেন, গানবোট ডোবাচ্ছেন,
সৈন্যভর্তি ট্রেনসহ ব্রিজ উড়িয়ে দিচ্ছেন, সেনা ছাউনিতে ছাউনিতে ত্রাসের সঞ্চার
করছেন। এ পর্যন্ত তিনি যত পাকিস্তানি সৈন্য খুন করেছেন, যত জখম করেছেন, যত ট্যাঙ্ক অচল করেছেন, যত কনভয় ধ্বংস করেছেন,
সব মিলিয়ে যোগ করলে যে সংখ্যাটি দাঁড়াবে, তাতে করে একজনও পাকিস্তানি সৈন্য বাংলার
মাটিতে থাকার কথা নয়। তার পরদিন সন্ধেবেলা আবার সৈন্য মারতে আসেন। আমরা অবাক হয়ে
ভাবি এত সৈন্য তিনি কোথায় পান?”
(অলাতচক্র, পৃষ্ঠা
নম্বর: ১২৩)
4 comments:
আহমেদ ছফা কি অই চরিত্র বানানো র ব্যপারে ভূমিকা নিয়ে ছিলেন? সম্ভবত তাই; এই. প্রসঙ্গে সলিমুল্লাহ খান সম্পাদিত " আহমেদ ছফা মহাফেজ খানা ১ " দ্রষ্টব্য !
পাতা ১৬৮ !
চমৎকার প্রত্যুত্তর।
বিরোধিতাও যে কতটা মাধুর্য্যের সাথে করা যায়, আপনার এই পোস্টটা তার নিদর্শন।
"আহমেদ ছফা কি অই চরিত্র বানানো র ব্যপারে ভূমিকা নিয়ে ছিলেন?..."
হ্যাঁ।
এবং ধন্যবাদ আপনার সূত্রের জন্য @cdebasish62
ভলতেয়ারের এই কথাটা আমার খুব পছন্দ। "আমি তোমার সঙ্গে একমত না কিন্তু তোমার মত প্রতিষ্ঠার জন্য লড়ব, আমৃত্যু।" :) @সাব্বির হোসাইন
Post a Comment