এই মানুষটার নাম মো. নুরুন্নবি। মাটি কাটার কাজ করেন। মাটি কোপাকোপি করে আমার একটা কাজ করে দিচ্ছেন। প্রথম দেখাতেই যেটা
আমাকে টেনেছিল মানুষটার মধ্যে বাউল-বাউল একটা ভাব আছে। কাজ করতে করতে এই মানুষটার
সঙ্গে আমার টুকটাক কথা হয়। মানুষটার কিছু কথা মজার। একবার আমি বললাম, ‘বাহ, আপনার হাসিটা তো সুন্দর’। মানুষটার লাজুক উত্তর, 'ইহ, বেছুলা’। একবার ক্লান্ত হয়ে বলছিলেন, ‘মাতাডা হেড হয়া আছে’। আরেকবার পাশের লোকটাকে নুরন্নবি বলছেন, ‘হুনো মিয়া, ঔরন্ডি কইরো না। ফাজলামি করারও একটা সিস্টেম আছে’।
যাই হোক, আমি খুব
অবাক হয়েছিলাম এটা জেনে এই মানুষটা ফি-বছর নিয়ম করে অন্তত দুই বার ভারতে অবস্থিত
এক মাজারে যান। খুব অবাক হয়েছিলাম কারণ এমন আয়ের একজন মানুষের জন্য এই খরচটা
বিপুল, হুজ্জতও কম না! যদিও পাসোপর্ট ব্যতীত, তবুও!
আমার সোজাসাপটা
প্রশ্ন ছিল, ‘কেন যান? কি আছে ওখানে। একজন মৃত মানুষের পক্ষে আপনার জন্য কি
করার ক্ষমতা আছে’?
তিনি পক্ষে যুক্তি
দেন, আমি বিপক্ষে। এভাবে কথা
চালাচালি হতে থাকে। আমি
ধর্মের উদাহরণ দিয়ে একের-পর-এক ‘কথাসস্ত্র’ ছুড়ে দেই। মনুষটার মধ্যে কি কোনও ক্ষীণ পরিবর্তন আশা করছিলাম? হবে হয়তো...।
আজ দেখলাম সঙ্গে একটা
ছোট্ট ছেলেকে নিয়ে এসেছেন। আমি অনেকখানি বিরক্ত হয়ে বলি, ‘এই বাচ্চাটাকে আনলেন কেন, এ কি মাটি কাটার কাজ করতে পারবে’!
নুরুন্নবি ঝাকড়া চুল
দুলিয়ে বলেন, ‘আরে নাহ, হে তো বিপদের মানু’।
আমি কিছুই বুঝলাম না।
জানতে চাইলাম, ‘মানে কি’?
তিনি বলেন, হের
বাপ-মা হেরে ফালাই গেছে’।
এবার আমার কৌতুহল হয়।
বিষয়টা ভিন্ন। যেটা জানা গেল গতকাল ট্রেনে এই ছেলেটা ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম যাচ্ছিল বাবা-মার সঙ্গে। নেমেছিল পানি কেনার জন্য। বাবা-মা তখন গভীর ঘুমে। ট্রেন ছেড়ে গেছে।
এ উঠতে পারেনি। এখানে রয়ে গেছে। রাতে নুরন্নবি স্টেশনে একে পান। এরপর ভাত খাইয়েছেন। সকাল
পর্যন্ত বুক দিয়ে আগলে রেখেছেন। দিশামিশা না-পেয়ে একে সঙ্গে করে কাজের জায়গায় নিয়ে
এসেছেন।
এবার আমি নুরন্নবি নামের মানুষটাকে আবারও নতুন করে দেখার চেষ্টা করি। বিভ্রম হয়তো, মনে হচ্ছিল
এমন, তাঁর দীর্ঘ ছায়া ছাড়িয়ে যায় আশেপাশের সবকিছু, অবলীলায় আমাকেও।
এরপর করার মত আমার
বিশেষ কোনও কাজ নেই। চট্টগ্রাম স্টেশনে পৌঁছলে আমার পরিচিত একজন ছেলেটার দায়িত্ব নেবেন।
আজ যখন ছেলেটাকে (এর নাম সোহেল) ট্রেনে তুলে দিয়ে ফিরছি তখন আবারও নুরন্নবিকে পেলাম স্টেশনের ওভারব্রিজে। আমি অবাক হয়ে বলি,’ এতো রাতে এখানে কী’!
নুরন্নবি হাসেন, ‘ওয়াল্লা, আমি তো এইখানেই ঘুমাই’।
আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে
এপাশ-ওপাশ মানুষটার ছায়া খুঁজি- রাতের আধারে ছায়া দেখার ক্ষমতা আমার কোথায়...!
No comments:
Post a Comment