Search

Monday, July 28, 2014

খোশ আমদেদ, আপনাদের অপেক্ষায়...।


হাবিজাবি ব্যস্ততার কারণে ক-দিন ধরে স্কুলে যাওয়া হচ্ছিল না। কাল যখন স্কুলের পথে হাঁটা ধরলাম রাস্তায় পুঁচকে একটা শিশু সালাম দিলে বুঝতে পারলাম এ আমাদের ইশকুলের ছাত্র। আমার অতি দুর্বল স্মৃতিশক্তির কারণে এই স্কুলে পড়ছে বা এই স্কুল থেকে বের হয়েছে এমন শিশুদের মুখ আমি মনে রাখতে পারি না। সালাম দিলে আমি চট করে বুঝে যাই এ আমাদের স্কুল নামের কারখানার ছাত্র।

 

শিশুটির সঙ্গে আমার কথোপকথন:

শিশু: তুমরা বলে ইছকুলে সেমাই দিবা?

আমি: কে বলছে তুমারে?

শিশু: কও কী, তুমি জান না!

আমি: নাতো, জানি না তো। আগে কও কে বলছে তুমারে?

শিশু: হগ্গলে কইতাছে।

আমি: হগ্গলে কেডা?

শিশু: ইছকুলের হগল পুলাপাইন। 

 

আমি খানিকটা শঙ্কিত হলাম। শঙ্কিত হওয়ার কারণ আছে। এ সত্য গত বছর আমাদের ইশকুলের সবাইকে সেমাই-টেমাই দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু এবার তো এটা সম্ভব না কারণ এই খাতে আমার কাছে বাড়তি কোনও টাকা নাই। আমি মনখারাপ ভাব নিয়ে উল্টো পথে হাঁটা ধরলাম। স্কুলে গেলে বিব্রতকর প্রশ্নের সম্মুখিন হব। কী দরকার অহেতুক মনখারাপের পারদ উঁচুতে তুলে।

ফিরে আসতে আসতে চিন্তা করছিলাম কাকে বলা যায়? আমার পরিচিত যারা আছেন তারা বিভিন্ন সময়ে আমার এই সমস্ত অকাজের আবদারে ত্যক্ত হয়ে ভবিষ্যতে আমার মুখদর্শন না-করলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।

 

কাকে ফাঁদে ফেলা যায় এটা ভেবে-ভেবে সারা। কিন্তু কোনও কূল-কিনারা হয় না! নাকি লটারি করব? রস-কস-শিংগা-বুলবুল-মালেক-মুশতাক... যার নামে শিংগা উঠবে সেই সই? জানি না কেন শেষপর্যন্ত কিছুই করা হয়ে উঠে না। আমার ভেতরের অন্ধকার ঝলমলে দাঁতে বলে উঠে: ওরে, থাকুক না, ঈদের আগে আর স্কুলে না গেলেই তো হবে। ঈদের ক-দিন পর গেলে বাচ্চারা এমনিতেই ভুলে যাবে।

আমিও দেখলাম তাই তো, এ তো মন্দ না।

 

কিন্তু...। ঘন্টাখানেকের মধ্যেই সাজ্জাদ হোসেন নামে একজন ফোন করলেন। তার সঙ্গে আমার কথোপকথন নিম্নরূপ:

সাজ্জাদ হোসেন: ইয়ে, আপনার স্কুলের বাচ্চাদেরকে কাপড় দিতে চাচ্ছিলাম।

আমি: (আনন্দের আতিশয্যে পারলে ফোনেই কিল মেরে বসি। শত-উল্লাস গোপন করে) আরে, তাহলে তো খুব ভাল হয়!

সাজ্জাদ হোসেন: আমি এই অংকের টাকা পাঠাব, কাপড়ের জন্য হবে তো?

(সএসসিতে, আমরা তখন বলতাম মেট্রিক। অংকে আমার ১৩ গ্রেস লেগেছিল অথচ সেই আমিই অতি দ্রুত আঁক কষে ফেলি।)

আমি: এই টাকায় সবার কাপড় তো বেশ হয়ে যাবে। আচ্ছা, সঙ্গে সেমাই দিলে কেমন হয়?

সাজ্জাদ হোসেন: বাহ!

আমি: (হাসি গোপন করে) সেমাইয়ের সঙ্গে চিনিও দিয়ে দেই?

সাজ্জাদ হোসে: কী বলেন, হবে?

আমি: বেশ হবে। আচ্ছা, অল্প কিশমিস না-দিলে কেমন হয় বলুন তো। কিশমিস ছাড়া সেমাই, ধুর! আর শোনেন, দুধ ছাড়া সেমাই রান্না হয় বুঝি! এক প্যাকেট গুঁড়ো দুধও দিয়ে দেই, কি বলেন?

সাজ্জাদ হোসেন: ওয়াল্লা, বলেন কী!

যাই হোক, আজ স্কুলের বাচ্চাদেরকে এইসব দেওয়ার পর্ব শেষ হলো।

স্কুলের বাচ্চাদের সঙ্গে তাদের মাস্টার-মশাই

 সাজ্জাদ হোসেন নামের মানুষটা আমাকে চমকে দিয়েছেন। কারণটা বলি। এমন না এটাই আমার জীবনের প্রথম ঘটনা। আমার ছোট-ছোট স্বপ্নগুলোর প্রতি বিভিন্ন সময়ে অনেকেই মমতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। তাহলে?

সাজ্জাদ হোসেন মানুষটা হুজুর টাইপের। এই অল্প বয়সেই ইয়া লম্বা দাড়ি এমনিতে হুজুর টাইপের লোকজনরা অকাতরে মসজিদ-মাদ্রাসায় হস্ত উপুড় করে দেন কিন্তু স্কুলের বেলায় আকাশপানে তাকিয়ে হস্ত গুটিয়ে নেন।

জানি না এরা কেন এমনটা করেন! যারা আক্ষরিক অর্থে অনুসরণ করেন তারা হয়তো বিস্তর ল্যাকাপড়া করে নিশ্চিত হন তৎকালীন সময়ে আরবদেশে স্কুল নামের জিনিস ছিল না। আর তখন ওখানে স্কুলের মত-মত কোনও জিনিস থেকে থাকলেও সেখানে বাংলা পড়ানো হত না।

(তখন কেন বাংলা পড়ানো হতো না এটা আবার দুম করে আমাকে জিজ্ঞেস করে বসবেন না যেন)

 

এই বিষয়ে অতীতে আমার অভিজ্ঞতা খুবই তিক্ত। অসংখ্য ঘটনা থেকে কেবল একটা উল্লেখ করি। হুজুর টাইপের অতি পরিচিত একজন। স্কুলের বাচ্চাদের জন্য তিনি অতি সামান্য সহায়তা দিতে রাজি হননি অথচ তিনি আমাকে বলেছিলেন মসজিদ-মাদ্রাসা করেন পাঁচ-দশ লাখ যা টাকা লাগে দেব। আমি জানি এটা মুখের কথা ছিল না। তিনি সত্যি সত্যিই দিতেন।

 

যেটা বলছিলাম, সাজ্জাদ হোসেনের বিষয়টা তাই আমাকে অনেকখানি বিস্মিত করেছে। কায়মনে আমি চাই এই মানুষগুলোর সংখ্যা ক্রমশ বৃদ্ধি পাক...অন্তত আমি এঁদের অপেক্ষায় আছি...।   

No comments: