লেখক, Sabbir Hossain
[ পোস্টটা লেখবার সময় সচেতনভাবে ধর্মগ্রন্থে বর্ণিত ইতিহাসকে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে এবং এখানে বর্ণিত সকল তথ্য আর্কিওলজিক্যালি ফাইন্ডিংস থেকে প্রাপ্ত ]
ইজরাইল-ফিলিস্তিন ইস্যুতে দুটো প্রশ্ন করা হয়:
০১. ফিলিস্তিনিরা কি ইজরাইলীদের তাদের আদিনিবাস থেকে বের করে দিয়েছে?
০২. কারা ইজরায়েল-ফিলিস্তিনের আদিবাসী; ইজরাইলীরা নাকি ফিলিস্তিনিরা?
বিভিন্ন বই-পুস্তক থেকে আমি এই দুটো প্রশ্নের উত্তর অনুসন্ধান করার চেষ্টা করেছি। আমার অনুসন্ধান থেকে পাওয়া ফলাফল নিয়েই মূলত এই পোস্ট।
লিভান্ত অঞ্চল সম্পর্কে আশা করি সকলের ধারণা আছে। তারপরও পুনরায় উল্লেখ করছি।
লিভান্ত অঞ্চল বলতে পূর্বাঞ্চলীয় ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলকে বোঝায়, অর্থাৎ, বর্তমান ইজিপ্ট রাষ্ট্রের উত্তরাংশ থেকে বর্তমান তুরস্ক রাষ্ট্রের দক্ষিণাংশের মাঝে বিস্তৃত অঞ্চল; আরো ভেঙে বললে, বর্তমান ফিলিস্তিন, ইজরায়েল, সিরিয়া, জর্দান, লেবানন, সাইপ্রাস, মিশরের উত্তরাংশ (সিনাই উপত্যকা), দক্ষিণ তুরস্ক (তুরস্কের আলেপ্পো প্রদেশ), ইরাকের দক্ষিণাংশ।
লিভান্ত অঞ্চলে খ্রীস্টপূর্ব ৪,০০০ অব্দের আগে (প্রস্তর যুগ) আহমারিয়ান, এ্যানতেলিয়ান, ক্যাবারান, ন্যাটুফিয়ান, হারিফিয়ান, গাস্সুলিয়ান কালচারের বিকাশ ঘটেছিল।
এই সময় মানুষরা শিকার ও সংগ্রহের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করতো এবং ধীরে ধীরে মানবসভ্যতার ক্রমবিকাশ হচ্ছিল। এই মানুষরাই আফ্রিকা থেকে আগমনকারীদের বংশধর।
পরবর্তীতে লিভান্ত অঞ্চলে খ্রীস্টপূর্ব ৪,০০০ থেকে ১,০০০ খ্রীস্টাব্দে (ব্রোঞ্জ যুগ) একাধিক গোত্রভিত্তিক নগরের উত্থান হওয়া শুরু করে। এই নগরগুলোর উত্থান হওয়ার সময় গোত্রপতি, কিনশিপ, ধর্ম, বিনিময় প্রথা, কৃষিকাজ, ঘরবাড়ি নির্মাণ, প্রযুক্তি, সংস্কৃতি, লেখার পদ্ধতি, যানবাহন ইত্যাদি বিষয়গুলোর প্রচলন শরু হয়।
এই সময় বিভিন্ন সভ্যতা, যেমন পার্শ্ববর্তী মেসোপটেমিয়ায় সুমেরীয়, অ্যাসিরিয়ান, আক্কাডিয়ান, আমোরাইটস, ও ইজিপ্টে ইজিপ্টিয়ান সভ্যতা, তুরস্কের আনাতোলিয়ায় হিত্তিতে সভ্যতা বিকশিত হয়।
এখানে একটি বিষয় উল্লেখযোগ্য, ধর্ম ও যুদ্ধ বিষয়টি এই অঞ্চলে খুব স্পর্শকাতর ছিল। এই অঞ্চলের মানুষ ধর্মকে অত্যাধিক প্রাধান্য দেয়া শুরু করে এবং এই অঞ্চলের বিভিন্ন গোত্রের মাঝে যুদ্ধ নিত্যকার বিষয় ছিল।
লিভান্তের দক্ষিন অংশকে বলা হতো ক্যানান। দক্ষিণ লিভান্ত বলতে বর্তমান ইজরাইল, ফিলিস্তিন, জর্ডান, লেবাননের উপকূলীয় অঞ্চল ও সিরিয়ার দক্ষিণ সীমান্ত অংশকে বোঝায়।
ক্যানানে বসবাস করা নগরভিত্তিক গোত্র ছিল; যারা মোয়াব, জেশুর, ফিলিস্তিয়া, এ্যাম্মোন, ত্যাজেক্যার, উপকূলীয় এবং জুদেয়া ও সামারিয়ার পর্বতভূমিতে বসবাসকারী গোত্র-সমষ্টি (এরাই ইজরাইলটদের পূর্বপুরুষ)। এদের সমষ্টিকে বলা হতো ক্যানানাইটস।
এদের মধ্যে জুদেয়া ও সামারিয়ার পর্বতভূমিতে বসবাসকারী গোত্র-সমষ্টি এই অঞ্চলে খ্রীস্টপূর্ব ২,৫০০ অব্দের দিকে প্রাধান্য বিস্তার করা শুরু করে। স্বাভাবিক কারণে এই প্রাধান্য বিস্তার ও প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়াটি ছিল এই অঞ্চলের অন্যান্য অধিবাসীদের সঙ্গে বিশেষত ফিলিস্তিয়াদের সংঘাতপূর্ণ।
ধীরে ধীরে পুরো দক্ষিণ লিভান্তে জুদেয়া ও সামারিয়ার পর্বতভূমিতে বসবাসকারী গোত্র-সমষ্টি তাদের প্রাধান্য বিস্তার করে। বিজেতারও এগিয়ে যাওয়া গোত্রের ধর্ম, ভাষা ও আচার সে আমলে প্রভাব বিস্তার করতো; তাই, জুদেয়া ও সামারিয়ার পর্বতভূমিতে বসবাসকারী গোত্র-সমষ্টি ধর্ম-ভাষা-আচার দক্ষিণ লিভান্ত অঞ্চলের অন্যান্য আদিবাসীদের উপর প্রাধান্য বিস্তার করে এবং ক্যানানে বসবাস করা গোত্রগুলোর ধর্ম-ভাষা ও আচার পরস্পরের সঙ্গে সিনক্রোনাইজ করে।
এখানে কয়েকটি কথা বলে রাখা ভালো ইহুদীদের পূর্ব-পুরুষ হলো এই জুদেয়া ও সামারিয়ার পর্বতভূমিতে বসবাসকারী গোত্র-সমষ্টি ও অন্যান্য ক্যানানাইটস গোত্র এবং ক্যানানাইটসদের ধর্মই হলো ইহুদী ধর্মের পূর্বরূপ। আরো সোজা করে বললে, ক্যানানাইটসদের ধর্মের বিবর্তিত রূপ হলো বর্তমানে প্রচলিত বিভিন্ন সেমেটিক (আব্রাহামিক) ধর্ম।
খ্রীস্টপূর্ব ১৫০০ অব্দের দিকে লিভান্ত অঞ্চলটি পাশ্ববর্তী ইজিপ্টিয়ান সভ্যতা ও বর্তমান তুরস্কের আনাতোলিয়া কেন্দ্রিক হিত্তিতে সভ্যতার সংঘর্ষভূমিতে পরিণত হয় এবং এই অঞ্চল ইজিপ্টিয়ানদের অধিকারে ছিল। এই সময়টাতে ইজিপ্টিয়ানরা ক্যানানাইটসদের দাস হিসেবে ব্যবহার করতো।
মোজেসের কাহিনীর উৎপত্তিও এই সময়টাতে এবং ইহুদী ধর্মের প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তিও এই সময়টিতে রচিত হয়।
খ্রীস্টপূর্ব ১২০০ অব্দের দিকে জুদেয়া ও সামারিয়ার পর্বতভূমিতে বসবাসকারী গোত্র-সমষ্টির উত্তর-পুরুষদের ইজরালাইট বলে সম্বোধন করা শুরু হয়।
খ্রীস্টপূর্ব ১২০০ অব্দের দিকে দিকে ক্যানান অঞ্চলের উপকূলীয় অংশে (বিশেষত বর্তমান লেবানন, ইজরাইল-ফিলিস্তিনের উপকূল) ফোনিশিয়ানরা প্রাধান্য বিস্তার করে।
ফোনিশিয়ানরা হলো, ক্যানানাইটস (বিশেষত: ফিলিস্তিয়া গোত্র) ও অন্যান্য সেমিটিক গোত্র (বিশেষত বর্তমান দক্ষিন আরব ও আরব-উপকূলের গোত্রগুলো) এবং আশপাশের বিভিন্ন গোত্র ও সভ্যতার মানুষের মিশ্রণ। এরা দক্ষ নাবিক ছিল, এদের নিজেদের বর্ণমালা ছিল এবং সভ্যতার নানান দিকে এরা অভূতপূর্ব উন্নতি সাধন করেছিল।
ইজিপ্টিয়ান সভ্যতা ও বর্তমান তুরস্কের আনাতোলিয়া কেন্দ্রিক হিত্তিতে সভ্যতা মূলত: এই অঞ্চলে তাদের প্রাচুর্য্য ও গুরুত্ব ফোনিশিয়ানদের কাছে হারায় এবং ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে ফোনিশিয়ানরা নিজেদের একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করে।
খ্রীস্টপূর্ব ৫৫০ অব্দের কাছাকাছি পারসিয়ান ও গ্রীকদের কাছে ফোনিশিয়ানদের চুড়ান্ত পতন হয়।
১১৭৫ খ্রীস্টপূর্বাব্দে ইজিপ্টিয়ান শাসক তৃতীয় রামেসিসকে পরাজিত করে ফোনিশিয়ানরা তাদের পূর্বপুরুষ ফিলিস্তিয়াদের নামে একটি নগর রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে; নগররাষ্ট্রের নাম ফিলিস্তিয়া।
এখানে একটি কথা স্মরণ করিয়ে দেই ফিলিস্তিয়া গোত্রের সঙ্গে ইজরালাইটদের পূর্বপুরুষ জুদেয়া ও সামারিয়ার পর্বতভূমিতে বসবাসকারী গোত্র-সমষ্টির দ্বন্দ্ব ছিল, যা উপরে উল্লেখ করা হয়েছে।
এই সময়ে (খ্রীস্টপূর্ব ১২০০ থেকে ৭৪০ অব্দ) পুরো ক্যানান অঞ্চলটি প্রশাসনিকভাবে ফোনিশিয়ানদের রাজ্যভুক্ত ছিল এবং ক্যানানাইটস গোত্রগুলো বস্তুত: আভ্যন্তরীণ বিষয়ে ছিল স্বাধীন।
ঐতিহাসিকভাবে ক্যানানাইটস গোত্রগুলোর ধর্মের উপাদানভিত্তিক প্রচুর মিল থাকলেও, পরবর্তীতে ইজরালাইটদের ধর্ম ভিন্নরূপ লাভ করতে শুরু করে এবং ক্রমেই ইজরাইলাইটদের ধর্ম ‘ইশ্বর ও রীতির’ ক্ষেত্রে অন্য ক্যানানাইটসদের ধর্মের চেয়ে আলাদা হতে থাকে।
প্যাগান ফিলিস্তিয়া ও অন্যান্য ক্যানানাইটস গোত্রগুলোর সাথে একেশ্বরবাদী ইজরালাইটদের ধর্মীয় বিরোধ সুস্পষ্ট হতে যায়।
পরবর্তীতে, সভ্যতা চর্চার দৌঁড়ে ইজরাইলাইটরা এগিয়ে যায় এবং এই অঞ্চলে তাদের ভাষা-ধর্ম-আচারের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয় এবং সেই সাথে প্যাগান ক্যানানাইটস ভাষা-ধর্ম-আচারও প্রচলিত ছিল।
ততদিনে ইহুদী ধর্মের ভিত্তি রচিত হয়ে গেছে এবং এই অঞ্চলে দুটো ইজরালাইট রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়; খ্রীস্টপূর্ব ৯০০ অব্দে ইজরাইল রাজ্য ও ৮০০ অব্দে জুদেয়া রাজ্য।
খ্রীস্টপূর্ব ৭৪০ অব্দে অ্যাসিরীয়রা ইজরাইল রাজ্য-দখল করে। এই সময় প্রথম ইহুদীদের উচ্ছেদ করা হয়। অ্যাসিরীয়রা ৭৩২ খ্রীস্টপূর্বাব্দে পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথমবারের মত ইহুদীদের তাদের বসতি থেকে উচ্ছেদ করে এবং ইজরাইল রাজ্য ধ্বংস করে দেয়া হয়।
এখানে, একটা কথা বলে রাখা জরুরি, অ্যাসিরীয়রা ইজরাইল-রাজ্যের শাসক ও তার গোত্র তথা ইহুদীদের শুধুমাত্র উচ্ছেদ করে, অন্যান্য ক্যানানাইটস গোত্রগুলো এই উচ্ছেদের আওতামুক্ত ছিল।
খ্রীস্টপূর্ব ৬২৭ সালে ব্যাবিলোনিয়ানরা অ্যাসিরীয়দের পরাজিত করে নিজেদের সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে। ব্যাবিলোনিয়ানদের সঙ্গে ইজিপ্টিয়ানদের রাজ্য বিস্তার নিয়ে বিরোধ ছিল। খ্রীস্টপূর্ব ৬০৯ থেকে ৬০৫ অব্দ পর্যন্ত ইজিপ্টিয়ানরা ব্যাবিলোনিয়ানদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে ইহুদী রাজ্যগুলো অধিকার করে রাখে। ৬০৫ অব্দে ব্যাবিলোনিয়ানরা এই অঞ্চর পুনরায় দখল করে।
পরবর্তীতে ইজিপ্টিয়ান ও ব্যাবিলোনিয়ানদের মাঝে ব্যাপক যুদ্ধ হয় এবং এই যুদ্ধে ইজরালাইটদের (ইহুদীদের) বিশ্বাসঘাতক হিসেবে চিহ্নিত করে ব্যাবিলোনিয়ানরা।
ফলশ্রুতিতে, ৫৮৬ খ্রীস্টপূর্বাব্দে ব্যাবিলোনিয়ানরা জেরুজালেম ও সলোমনের মন্দির ধ্বংস করে দেয় ও পৃথিবীর ইতিহাসে ‘দ্বিতীয়বার’ ইহুদীরা উচ্ছেদের সন্মুখীন হয়।
এখানে, একটি কথা বলে রাখা জরুরি, ব্যাবিলোনীয়রা এবার শুধু ইজরালাইটদের (ইহুদীদের) নয়, পুরো দক্ষিন লিভান্ত অঞ্চলের সবগুলো গোত্রকে হত্যা ও উচ্ছেদ করে।
খ্রীস্টপূর্ব ৫৪০ অব্দে পারশিয়ানরা ব্যাবিলোনিয়ানদের পরাজিত করে দক্ষিন-লিভান্ত অঞ্চলকে (ক্যাানান) নিজেদের দখলভুক্ত করে। এরা এই অঞ্চলকে তিনটি ভাগে বিভক্ত করে:
এক.
ফোনেশিয়া (বর্তমান লেবানন ও ইজরায়েলের দক্ষিন অংশ) [ফোনিশিয়ানরা অধিকাংশ ছিল সেমিটিক প্যাগান]।
দুই.
জুদেয়া ও সামারিয়া [জুদেয়া ও সামারিয়ার মানুষরা ছিল ইজরালাইট ইহুদী ও ফিলিস্তিয়া সেমিটিক প্যাগান]।
তিন.
আরব ও সেমেটিক বিভিন্ন গোত্রগুলির জন্য একটি অঞ্চল (বর্তমান গাজা, নেগেভ মরুভূমি সহ বর্তমান ইজরাইলের উত্তারাংশ, পশ্চিমতীর থেকে শুরু করে জর্দান, সিরিয়া) [আরব ও সেমেটিক বিভিন্ন গোত্রগুলি ছিল সেমিটিক প্যাগান]।
এই সময় ইজরালাইটরা (ইহুদী) মন্দির পুনরায় নির্মাণ করা হয় এবং ইহুদী ধর্ম ও ইজরাইলাইটাদের রিভাইব হয়। হিব্রু ভাষা ও ইজরালাইটদের ধর্ম (বর্তমান ইহুদী ধর্মের পূর্বরূপ) পারশিয়ানদের শাসনামলে বিকশিত হয়।
৩৩০ খ্রীস্টপূর্বাব্দে দক্ষিন লিভান্ত (ক্যানান) গ্রীকদের হস্তগত হয় এবং ১৪০ খ্রীস্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত গ্রীকরা প্রকারান্তরে এই অঞ্চল নিজেদের অধিকারে রাখে। এই সময় এই অঞ্চলটি গ্রীকদের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করলেও আভ্যন্তরীনভাবে স্বাধীন ছিল।
এই সময় ১৬৭ খ্রীস্টপূর্বাব্দে গ্রীকরা ইজরালাইটদের ধর্মপালনে বাধা দেওয়া শুরু করে। গ্রীকরা এই অঞ্চলকে প্যালেস্টিনা বলে সম্বোধন করতো; তার কারণ, ফোনিশিয়ানদের পূর্বপুরুষ ছিল ফিলিস্তিয়া; ফোনিশিয়ানদের সঙ্গে গ্রীকদের অসংখ্য যুদ্ধ হয়েছিল, ফিনিশীয়ানদের পতনের মূলে গ্রীকরা অন্যতম প্রধান শক্তি ছিল।
১৪০ খ্রীস্টপূর্বাব্দে জুদেয়ায় ইজরালাইটদের স্বাধীন রাজ্য স্থাপিত হয়। এই রাজ্য শাসন করতো হ্যাসমোনিয়ান ডাইনেস্টি। এই রাজ্য ৬৩ খ্রীস্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত টিকে ছিল। এই সময়ে ইজরালাইটরা রাজনৈতিকভাবে সবচেয়ে বেশি অগ্রসর হয়; দক্ষিন লিভান্তের (ক্যানান) অধিকাংশ অংশ ইজরালাইটদের রাজ্যভুক্ত হয়।
এই সময় ইজরাইলাইটরা তাদের উন্নতি ও বিকাশের সর্বোচ্চ সময়ে আরোহণ করে।
রোমানরা ৬৩ খ্রীস্টপূর্বাব্দে জুদেয়া রাজ্য দখল করে। রোমানরা তাদের শাসন এই অঞ্চলে পাকাপোক্ত করার জন্য স্থানীয় ইজরালাইটদের থেকে একজন রাজা নিয়োগ করেছিল, যার নাম হেরোদ। এই সময়ে ইজরালাইটদের মধ্যে অনেকে নিজেকে তাদের ধর্মে বর্ণিত মেসাইয়া (প্রেরিত পুরুষ) বলে দাবি করে।
ইজরালাইটদের একটি ধর্মীয় উপগোত্র হিসেবে খ্রীস্টান ধর্মের আর্বিভাব হয়।
কিন্তু ইজরালাইটদের এই সুদিন খুব বেশি সময় টিকে ছিল না। ইজরালাইটদের সাথে রোমানদের যুদ্ধ বেঁধে যায়। টাইটাস ৭০ খ্রীস্টাব্দে জেরুজালেম ধ্বংস করে এবং প্রায় এক মিলিয়ন ইজরালাইটকে হত্যা করা হয় ও তাদের উচ্ছেদ এবং এটিই ইজরালাইটদের সর্ববৃহৎ উচ্ছেদ। এরপর ইজরালাইটরা এশিয়া-আফ্রিকা-ইউরোপের নানান জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে।
১৩২ খ্রীস্টাব্দে রোমানরা সম্রাট হাদ্রিয়ানের সময় থেকে জুদেয়া অঞ্চলকে অফিসিয়ালি প্যালেস্টিনা বলে সম্বোধন করা শুরু করে। কেন রোমানরা এই অঞ্চলকে প্যালেস্টিনা বলে সম্বোধন করা শুরু করে? তার কারণটাও খুব ইন্টারেস্টিং।
সে সময় জুদেয়া অঞ্চলে বসবাস করতো দুটো ধর্মভিত্তিক সম্প্রদায়:
এক.
ইহুদী ধর্মাম্বলী ইজরালাইট, এরা ছিল শাসক ও এলিট শ্রেণী।
দুই.
সেমিটিক প্যাগান ধর্মাম্বলী অন্যান্য ক্যানানাইটস ও সেমিটিকরা, এরা ছিল প্রজাশ্রেণীর।
এখানে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে, উপরে বর্ণনা করা হয়েছে, হাজার বছর আগে এই অঞ্চলের অন্যান্য গোত্রগুলোর (বিশেষত: ফিলিস্তিয়াদের) সঙ্গে ইজরালাইটদের পূর্বপুরুষ জুদেয়া ও সামারিয়ার পর্বতভূমিতে বসবাসকারী গোত্র-সমষ্টির সম্পর্কের টানাপোড়নের কথা এবং আরেকটি বিষয় মনে করিয়ে দিই, এরা সবাই কিন্তু এই অঞ্চলেরই আদিবাসী।
রোমানরা জুদেয়াতে বসবাসকারী সেমিটিক প্যাগান ধর্মাম্বলী অন্যান্য ক্যানানাইটস ও সেমিটিক গোত্রগুলোকে ইজরালাইটদের বিপক্ষে একটি শক্তি হিসেবে দাঁড় করানোর চেষ্টা করে; ঠিক যেন ‘ডিভাইড এন্ড রুল’ তত্ত্ব আর এই লক্ষ্যে রোমানরা জুদেয়া অঞ্চলকে প্যালেস্টিনা বলে সম্বোধন শুরু করে এবং ইজরালাইট বাদে অন্যান্য প্যাগান ধর্মাম্বলী ক্যানানাইটস ও সেমিটিক গোত্রকে প্যালেস্টিনিয়ান বলে সম্বোধন করা শুরু করে।
এখানে রোমান হঠকারিতাটি হলো, যে ফিলিস্তিয়া গোত্রের সঙ্গে ইজরালাইটদের পূর্বপুরুষ জুদেয়া ও সামারিয়ার পর্বতভূমিতে বসবাসকারী গোত্র-সমষ্টির দ্বন্দ্ব ছিল। সে ফিলিস্তিয়া গোত্র এবং জুদেয়া ও সামারিয়ার পর্বতভূমিতে বসবাসকারী গোত্র-সমষ্টির কেউই তখন আর বিদ্যমান ছিল না; যারা ছিল, তারা ওদের বংশধর এবং তাদের গোত্রের নাম-ধর্ম-আচার-ভাষা হাজার বছরের ব্যবধানে বির্বতিত হয়ে গেছে।
রোমানরা তাদের এই হঠকারিতা এই অঞ্চলে তাদের শাসনক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে। কিন্তু তারপরও এই অঞ্চলে শান্তি আসেনি। ১৩৫ খ্রীস্টাব্দে ইজরালাইটরা রোমানদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে।
রোমান সম্রাট হাদ্রিয়ান ১৩৬ খ্রীস্টপূর্বাব্দে ইজরালাইটদের প্রকাশ্যে ধর্মপালন নিষিদ্ধ করেন। তাদের ধর্মগ্রন্থ পুড়িয়ে ফেলা হয়, পবিত্র মন্দির ধ্বংস করা হয়, জেরুজালেম ধ্বংস করে দেন, জেরুজালেমে ইজরাইলাইটদের প্রবেশাধিকার নিষিদ্ধ করে দেয়া হয়। জেরুজালেমের নাম পরিবর্তন করে করা হয় এইলিয়া, ছয় লক্ষাধিক ইজরালাইটকে হত্যা করা হয় এবং অধিকাংশ ইজরালাইট প্রাণ বাঁচাতে এই অঞ্চল ত্যাগ করে এশিয়া-আফ্রিকা-ইউরোপের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে।
১৯৪৮ সালে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করার আগে ইজরালাইটরা (ইহুদী) যে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছিল, তার কারণ হলো রোমানদের হাতে ৭০ ও ১৩৫ খ্রীস্টাব্দে সংঘটিত ইজরালাইটদের গণহত্যা ও উচ্ছেদ।
এখানে একটি কথা বলা দরকার, রোমানরা এবং তাদের পূর্বতন বিভিন্ন শক্তি অ্যাসিরীয় ও ব্যাবিলোনিয়ানরা যে শুধু ইজরালাইটদের হত্যা ও বিতাড়ন করেছে, তা কিন্তু নয়; এই অঞ্চলে হাজার বছর ধরে প্রভাব বিস্তার করা শাসক-শ্রেণী ইজরালাইটদেরকে স্থানীয় অন্যান্য গোত্রগুলোর যারাই সমর্থন দিয়েছে ও সাহায্য করেছে, তাদেরও হত্যা ও বিতাড়ন করা হয়েছিল। তবে, এখানে এটাও বলা জরুরি যে, এই অঞ্চলের প্রজাশ্রেণী সেমিটিক গোত্রগুলো স্বাভাবিক কারণেই অ্যাসিরীয়, ব্যাবিলোনিয়ান ও রোমানদের করা এসব অত্যাচারের সন্মুখীন খুব বেশি হয়নি; কারণ, এই অঞ্চলের শাসকশ্রেণী ইজরালাইটদের সঙ্গে অ্যাসিরীয়, ব্যাবিলোনিয়ান ও রোমানদের দ্বন্দ্বগুলো তাদের কাছে ‘রাজায় রাজায় যুদ্ধ করে...’ জাতীয় ছিল; এসব যুদ্ধে প্রজাশ্রেণীর তেমন বিশেষ আগ্রহ ছিলো না।
তবে, এই অঞ্চলের সব গোত্রই কোন না কোন সময় বিজেতাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছে। ফিনিশিয়ান, সামারাটিয়ান, বেদুইন-গাস্সানিদ সহ বিভিন্ন আরব গোত্র ও অন্যান্য সেমিটিক গোত্ররা নানান সময়ে বিজেতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছে এবং অধিকাংশ সময়ই বিজেতারা এদের গণহত্যা ও উচ্ছেদ করেছে।
ইজরালাইটদের ইহুদী ধর্ম ও প্যাগান সেমিটিকদের ধর্ম নিয়ে একটি কথা বলে রাখা উচিত হবে যে, এই দুটো ধর্মের অনেক উপাদানের মিল ছিল, এমনও দেখা গেছে একই ব্যাক্তি উভয় ধর্মে সম্মানিত, একই আচার উভয় ধর্ম পালন করছে; এর কারণ, উভয় ধর্ম একই উৎস থেকে এসেছে।
পরবর্তীতে ইজরালাইটদের ইশ্বর-ধারণা একেশ্বরবাদীতার রূপান্তরিত হয়েছে এবং অন্যান্য সেমিটিক গোত্রগুলোর ইশ্বর-ধারণা আগের মত বহু-ইশ্বরে রয়ে গেছে।
রোমানদের ইজরালাইট তথা ইহুদী নিধন এতটাই ভয়াবহ ছিল যে, বস্তুত ইহুদী ধর্মের গতি-প্রকৃতি পরিবর্তন হয়ে যায়। রোমানদের নিপীড়ন শুরু করার আগের ইহুদী ধর্ম ও পরের ইহুদী ধর্মের ব্যাপক পার্থক্য আছে।
এর কারণ, রোমানরা যেভাবে পেরেছে, সেভাবে ইজরালাইটদের নিধন করেছে; প্রায় সব ধর্মীয় ব্যাক্তিত্বকে হত্যা করেছে, উপসানালয় ধ্বংস করেছে, ধর্মগ্রন্থ ধ্বংস করেছে।
বর্তমানে ইজরালাইট তথা ইহুদীদের যে ধর্ম আমরা দেখি তার চর্চা মূলত ৬০০ খ্রীস্টাব্দের দিক থেকে শুরু হয়।
৩১৩ খ্রীস্টাব্দে খ্রীস্টান ধর্ম গ্রহণ করে রোমান সম্রাট কন্সটানটাইন এবং ৩২৪ খ্রীস্টাব্দে খ্রীস্টান ধর্মকে রোমানরা ধর্ম হিসেবে স্বীকৃতি দেয়; কন্সটানটাইনের সময় খ্রীস্টান শহর হিসেবে জেরুজালেমের নাম পুনরায় প্রচলন করে।
এসময় মরার উপর খড়ার ঘাত হিসেবে ইজরাইলাইটদের নতুন শত্রু সৃষ্টি হয় আর তারা হলো খ্রীস্টানরা। খ্রীস্টানরা যীশুর মৃত্যুর জন্য ইজরাইলাইটদের দায়ী করে; শুরু হয় সংঘাতের নতুন অধ্যায়; খ্রীস্টান-ইহুদী দ্বন্দ্ব। ৩৫১-৩৫২ খ্রীস্টাব্দে রোমানদের বিরুদ্ধে ইজরাইলাইটরা বিদ্রোহ করলে, কঠোর হস্তে তা দমন করা হয় এবং আগের মত ইজরাইলাইটদের হত্যা ও উচ্ছেদ করা হয়।
৩৬১ সালে রোমানরা ইজরালাইটদের জেরুজালেমে প্রবেশাধিকার দেয়, তাদের মন্দির তৈরী ও প্রার্থনা করার অনুমতি দেয়া হয়। রোমান সম্রাট থিওডোসিয়াস খ্রীস্টান ধর্মকে ৩৮০ খ্রীস্টাব্দে রাষ্ট্র ধর্ম ঘোষনা করেন।
এসময় যীশুর অঞ্চল হিসেবে জেরুজালেম ও তৎসংলগ্ন এলাকা খ্রীস্টানদের কাছে গুরুত্ব পেতে থাকে।
এরমধ্যে ৩৯৫ সালে চুড়ান্তভাবে রোমান সাম্রাজ্য দু'ভাগে ভাগ হয়ে পড়ে; পূর্বতন অংশকে বলা হতো বিজান্টিয়াম সাম্রাজ্য। বিজান্টিয়ামদের সময় জেরুজালেম খ্রীস্টান ধর্মচর্চার প্রধান কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়।
৬১৪ সালে পারশিয়ান-বিজান্টিয়াম যুদ্ধে ইজরালাইটরা পারশিয়ানদের পক্ষ নেয়। পারশিয়ান-ইজরালাইটদের যৌথবাহিনী জেরুজালেম জয় করে, খ্রীস্টানদের চার্চগুলো ধ্বংস করে ফেলা হয়, খ্রীস্টানদের গণহত্যা করা হয়।
ইজরালাইটরা পারশিয়ানদের অধীন প্যালেস্টিনা ও জেরুজালেম শাসন করতে থাকে। ৬১৭ সালে পারশিয়ান-ইজরালাইটদের দ্বন্দ্ব শুরু হয়।
পারশিয়ানরা ইজরালাইটদের হাত থেকে প্যালেস্টিনার ক্ষমতা কেড়ে নেয়, ইজরালাইট সৈন্য ও সরকারী কর্মকর্তাদের স্বপরিবারে হত্যা করা হয়।
জেরুজালেম থেকে তাদের বের করে দেয়, জেরুজালেমের তিন মাইলের মধ্যে কোন ইজরালাইটের প্রবেশাধিকার নিষিদ্ধ করে দেয়।
৬২৯ খ্রীস্টাব্দে বিজান্টিয়াম সম্রাট হেরাক্লিয়াস জেরুজালেম পুনরায় জয় করেন, পারশিয়ানদের বিতাড়িত করেন।
এসময় অধিকাংশ ইজরালাইটরা বিজান্টিয়ামদের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে, বিজান্টিয়ামরা ইজরালাইটদের হত্যা ও উচ্ছেদ করা থেকে বিরত থাকে কিন্তু ইজরালাইটরা জেরুজালেমে বসবাস করতে পারতো না।
মূলত: ইজরালাইটদের অধিকাংশই ১৩৫ খ্রীস্টাব্দের পর জেরুজালেম ও দক্ষিন লিভান্ত ছেড়ে এশিয়া-আফ্রিকা-ইউরোপের নানান প্রান্তে চলে যায়।
এখানে ঐতিহাসিক কিছু কথা বলে নেয়া ভালো। ৬১০ খ্রীস্টাব্দে প্যালেস্টিনার ঠিক পাশেই আরব উপদ্বীপে হেজাজ অঞ্চলের মক্কা নগর রাষ্ট্রে ইসলাম নামে নতুন একটি সেমিটিক একেশ্বরবাদী ধর্মের আর্বিভাব হয়। উল্লেখ্য, আরবরাও একটি সেমিটিক জাতি।
৬২৪ খ্রীস্টাব্দের আগ পর্যন্ত ইসলাম ধর্মের অনুসারীরা প্রার্থনার জন্য জেরুজালেমকে কিবলা হিসেবে ব্যবহার করতো, পরে মক্কার কাবাকে কিবলা করা হয়।
৬২৪ খ্রীস্টাব্দে চুক্তিভঙ্গ করায়, আরব মুসলমানরা ইজরালাইট গোত্র বনু কুনাইকাকে উচ্ছেদ করে। ৬২৫ খ্রীস্টাব্দে ইসলামের রাসূলকে হত্যা পরিকল্পনা করার অভিযোগ এনে, আরব মুসলমানরা ইজরালাইট গোত্র বনু নাদিরকে উচ্ছেদ করে।
৬২৭ খ্রীস্টাব্দে চুক্তিভঙ্গ করার অভিযোগ এনে আরব মুসলমানরা মদিনার ইজরালাইট গোত্র বনু-কুরাইজার প্রায় এক হাজার জন পুরুষের শিরোশ্ছেদ করে এবং তাদের শিশু ও স্ত্রীদের দাস-দাসীতে পরিণত করে।
৬৪১ খ্রীস্টাব্দে আরব মুসলমানরা হেজাজ অঞ্চল (বর্তমান সৌদি আরব) থেকে খ্রীস্টান ও ইজরালাইটদের বসতি অন্যত্র সরিয়ে নেয়।
৬৩৪-৬৩৮ খ্রীস্টাব্দে মুসলমান আরবরা জেরুজালেম ও লিভান্ত জয় করে। তখন জেরুজালেম খ্রীস্টানদের একটি পবিত্র শহর হিসেবে গণ্য হতো।
আরবরা লিভান্ত জয়ের সময় খ্রীস্টান ও ইজরালাইটদের গণহত্যা বা উচ্ছেদের বিষয়ে কৌশলগত কারণে সংযত ছিল, লিভান্ত জয়ের সময় আরব মুসলমানরা লিভান্তের খ্রীস্টান ও ইজরালাইটদের গণহত্যা বা উচ্ছেদ করেনি কিন্তু জিজিয়া কর চালু করে।
এদিকে ১৩৫ খ্রীস্টাব্দে রোমানদের দ্বারা উচ্ছেদের পর ইজরালাইটদের অধিকাংশই সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে; তবে অধিকাংশ ইজরালাইট ইউরোপে আশ্রয় নেয়।
ইউরোপিয়ানরা ৩৮০ খ্রীস্টাব্দের পর শাসকের ধর্ম হিসেবে খ্রীস্টান ধর্ম গ্রহণ করা শুরু করে। খ্রীস্টান ধর্ম অনুসারে, ইজরালাইটরা যীশুকে ক্রুশবিদ্ধ করেছে। ফলশ্রুতিতে, খ্রীস্টানরা ইজরালাইটদের শত্রু হিসেবে বিবেচনা করতো।
এর প্রভাব আমরা দেখতে পাই, ইউরোপে ইউরোপিয়ান খ্রিস্টানদের দ্বারা ইজরালাইটদের হত্যা ও উচ্ছেদের অসংখ্য ঘটনার মধ্য দিয়ে।
স্প্যানিশ-পর্তুগীজ ও ক্যাথলিক ইনকুইজিশানের সময় ক্যাথলিক খ্রীস্টানরা নানান সময়ে ইউরোপে অবস্থানরত অসংখ্য ইজরালাইটদের হত্যা ও উচ্ছেদ করেছে, ক্রুসেডের সময় এবং পরবর্তীতে মধ্যযুগ ও আধুনিক যুগে খ্রীস্টানরা ইউরোপের বিভিন্ন অঞ্চলে ইজরালাইটদের গণহত্যা ও উচ্ছেদ করেছিল।
স্পেন থেকে মধ্যযুগে ক্যাথলিক খ্রীস্টানরা ইজরালাইটদের উচ্ছেদ করলে অটোম্যানরা সে সময় ইজরালাইটদের আশ্রয় দিয়েছিল।
ইউরোপের মুরিশ স্পেনে বেশ কয়েকবার মুসলমান ও খ্রীস্টানরা মিলে ইজরালাইটদের গণহত্যা ও উচ্ছেদ করেছে, মুসলমানদের সূচনালগ্ন হতে অাধুনিকযুগ পর্যন্ত মুসলমান অধ্যুষিত অঞ্চলগুলোতে যেসব ইজরালাইট বসবাস করতো, তারা বহুবার মুসলমানদের হাতে গণহত্যা ও উচ্ছেদের শিকার হয়েছে।
সত্যি বলতে, প্রাচীন আমল থেকে শুরু করে বিংশ শতাব্দীর অর্ধাংশ পর্যন্ত ইজিপ্টিয়ান, অ্যাসিরীয়ান, ব্যাবিলোনিয়া, গ্রীক, রোমান, খ্রীস্টান, মুসলমান, আরব, অটোম্যান, পারসিয়ান, ইউরোপিয়ান, নাজী, ফ্যাসিস্ট, রুশ, সোভিয়েত সকলেই নানান সময়ে ইজরালাইটদের পার্সিকিউট করেছে।
এত বড় পোস্ট লিখতে হয়েছে শুধুমাত্র দুটো প্রশ্নের উত্তর দেবার জন্য-
প্রশ্ন- ০১.
ফিলিস্তিনিরা কি ইজরাইলী তাদের আদিনিবাস বের করে দিয়েছে?
উত্তর:
না, ফিলিস্তিনিরা ইজরালাইটদের তাদের আদিনিবাস দক্ষিন লিভান্ত থেকে বিতাড়িত করেনি। ইজরালাইটদের তাদের মাতৃভূমি থেকে বিতাড়িত করেছে মূলত: রোমানরা।
ফিলিস্তিনিরা বর্তমান ইজরাইল-ফিলিস্তিন ভূখন্ডের আদিবাসীদের বংশধর এবং ইজরালাইটরাও এই ভূখন্ডের আদিবাসীদের বংশধর।
এখন প্রশ্ন আসতে পারে ফিলিস্তিনিরা কারা, ওরা কিভাবে মুসলমান হলো ও তাদের ভাষা আরবী কেন? ফিলিস্তিনিরা ঐতিহাসিক দক্ষিন লিভান্ত অঞ্চলের নানান সময়ে বসবাসকারী বিভিন্ন গোত্রের বংশধর। ফিলিস্তিনিরা মূলত: ক্যানানাইটসদের বংশধর।
ফিলিস্তিনিদের বর্তমানে ক্যানানাইট না ডেকে ফিলিস্তিনি ডাকা হয়, কারণ, ১৩২ খ্রীস্টাব্দে এই অঞ্চলের শাসক রোমানরা উদ্দেশ্যমূলকভাবে এই অঞ্চলকে প্যালেস্টিনা এবং ইজরালাইট বাদে এর অন্যান্য অধিবাসীদের প্যালেস্টাইন বলে সম্বোধন করতো। এর কারণ উপরে বর্ণনা করা হয়েছে।
আগেই বলেছি, শাসকের ভাষা ও ধর্ম প্রজাদেরও ভাষা ও ধর্মে রূপান্তরিত হয়। কারণ, এতে শাসকশ্রেণীর অংশ হওয়া যায়, নিরাপত্তার বিষয়টির সঙ্গে ক্ষমতাও উপভোগ করা যায়।
আরব-মুসলমানরা লিভান্ত জয় করার পর, লিভান্তের প্যাগানরা মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য অঞ্চলের প্যাগানদের মত ধর্মান্তরিত হয় এবং দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে আরবীর প্রচলন থাকায় মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য জায়গার মত লিভান্তের মানুষরাও আরবীকে মূল ভাষা হিসেবে ব্যবহার করা শুরু করে।
প্রশ্ন- ০২.
কারা ইজরায়েল-ফিলিস্তিনের আদিবাসী; ইজরাইলীরা নাকি ফিলিস্তিনিরা?
উত্তর:
বস্তুত: উভয়ের মাতৃভূমি ইজরায়েল-ফিলিস্তিন; কারণ, উভয়েই ক্যানানাইটসদের বংশধর। ক্যানানাইটস গোত্রগুলোর মাঝে ইজরালাইটদের এই অঞ্চল রোমানরা উচ্ছেদ করেছিল বলে, ওরা নানান জায়গায় মাইগ্রেট করে কিন্তু বর্তমান ইজরায়েল-ফিলিস্তিন ভূখন্ড এদের পূর্বপুরুষের মাতৃভূমি।
বর্তমানে ফিলিস্তিনি যাদেরকে বলা হয়, এরাও ক্যানানাইটস গোত্রসমূহ, আরব সহ অন্যান্য সেমিটিক গোত্র ও এই অঞ্চলে বসতিস্থাপনকারীদের বংশধর; এরা প্রাচীনকাল থেকে হাজার বছর ধরে বংশপরম্পরায় এই অঞ্চলে বসবাস করে আসছে; বর্তমান ইজরায়েল-ফিলিস্তিন ভূখন্ডটি ফিলিস্তিনিদের হাজার হাজার বছরের বসতভূমি ও মাতৃভূমি।
১৯৪৮ সালে ইজরায়েল রাষ্ট্রের প্রতিষ্টা হয় আর এর মাধ্যমে ইজরালাইটদের বড় অংশ তাদের পূর্বপুরুষের মাতৃভূমিতে আসতে শুরু করে এবং এনিয়ে ‘ইজরালাইট সহ এই অঞ্চলে বসবাসকারী বিভিন্ন জাতি ও গোত্রের বর্তমান বংশধরদের তথা ফিলিস্তিনিদের’ সঙ্গে ইজরালাইটদের সংঘাত শুরু হয়; যা ক্রমশ বড় হয়েছে এবং বর্তমানে বস্তুত এর কোন সমাধান আমরা পাইনি।
বর্তমান বিশ্বরাজনীতির প্রেক্ষাপটে ইজরায়েল রাষ্ট্রের বিলুপ্তি সম্ভব নয় এবং এই চেষ্টা করা উচিতও হবে না। এছাড়া, ক্যানানাইটসদের বংশধর হিসেবে এই ভূমিকে ইজরাইলী ও ফিলিস্তিনিরা উভয়েই নিজেদের বলে দাবি জানাতে পারে।
ইজরায়েল-ফিলিস্তিনের অধিবাসীরা পরস্পরের সহাবস্থান সহ্য করা ছাড়া ভিন্ন কোন বিকল্প আছে কি?
তথ্য সহায়িকা:
০১. A History of the Jewish People (1976) - H.H. Ben Sasson - Harvard University Press.
০২. A History of the Jews (London 1987) - Paul Johnson.
০৩. Muhammad: His Life Based on the Earliest Sources - Martin Lings.
০৪. Between Rome and Jerusalem: 300 Years of Roman-Judaean Relations - Martin Sicker.
০৫. A History of Palestine - Moshe Gil.
০৬. Origin of the Phoenicians: Interactions in the Early Mediterranean Region - Sanford Holst.
০৭. The Jews of Arab Lands: A History and Source Book - Norman A. Stillman.
০৮. The Jews of Islam (1984) - Bernard Lewis.
০৯. Biblical Peoples and Ethnicity: An Archeological Study of Egyptians, Canaanites, Philistines, and Early Israel, 1300–1100 B.C.E. - Ann E. Killebrew.
১০. Jews and Judaism in World History - Howard N. Lupovitch.
১১. A Short History of the Jewish People: From Legendary Times to Modern Statehood - Raymond P. Scheindlin.
১২. The History of the Jews : from the earliest period to the present time (1800) - Henry Hart Milman.
১৩. The Crisis of Islam - Bernard Lewis.
4 comments:
চমৎার পোস্ট!!
//ইজরায়েল-ফিলিস্তিনের অধিবাসীরা পরস্পরের সহাবস্থান সহ্য করা ছাড়া ভিন্ন কোন বিকল্প আছে কি?//
মানতে পারলাম না,
why u r disagree? আবদুর রহমান
এত তথ্যর সন্নিবেশএখানে মাথা খারাপ হওয়ার দশা
Post a Comment