হৃদয়কে যখন হুইল-চেয়ার দেওয়া হয়েছিল [১] তখনই শুনেছিলাম এই স্কুলেই আরেকটি ছেলে নাকি পড়ে যার হাঁটাচলায় খুব সমস্যা। তখন এক শিক্ষককে বলে এসেছিলাম আমাকে এই ছেলেটির খোঁজ দেওয়ার জন্য। শিক্ষক মহাশয় আর খোঁজ দেননি! আজকালকার শিক্ষক মহাশয়ের প্রাইভেট পড়িয়ে হাতে সময় কোথায়?
যাই হোক, কেমন-কেমন করে আমার ফোন নাম্বার জোগাড় করে আশেপাশের কারও ফোন থেকে মাহবুব নামের এই ছেলেটি আমাকে ফোন দেয়। তার সঙ্গে কথাবার্তা নিম্নরূপ:
মাহবুব ক্ষীন গলায় বলে, ‘আমি ইসকুলে যাইতে চাই’।
আমি বললাম, ‘তো সমস্যা কোথায়। যাও না’।
মাহবুব এবার কুন্ঠিত হয়ে বলল, ‘আমি তো হাটতাম পারি না’।
আমার চট করে মনে পড়ে গেল আমি তো একেই খুঁজছিলাম। আমি জানি না কেমন করে একটা হুইল -চেয়ারের ব্যবস্থা হবে কিন্তু ঠিকই সাহস করে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কিন্তু তোমার বাড়ি থেকে তোমাকে সঙ্গে করে কে নিয়ে আসবে’?
মাহবুব হড়বড় করে বলে, ‘আমার বইন, তানিয়া। হে নিয়া যাইব। হে-ও আমার লগে ক্লাস সিক্সে পড়ে’।
অনেক যন্ত্রণা করে মাহবুবের বাড়ি খুঁজে বের করতে হলো। কেউ চেনে না কিন্তু যখন বললাম হাঁটতে যে একটু সমস্যা হয়। এটা বলার সঙ্গে সঙ্গে অনেকেই চিনে ফেলল। কেউ-কেউ খানিকটা বিরক্তিও প্রকাশ করল: ধুর মিয়া, আগে কইবেন না, ‘ল্যাংড়া মাহবুব’। এই এক চুতিয়া পাবলিক! এরা, এরাই অপ্রকৃতস্থ লোকজনকে দেখলে হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ে। যেন এই গ্রহে এরচেয়ে মজার আর কিছু নেই!
মাহবুবের ঘরটায় ঢুকে বুকে একটা ধাক্কা খেলাম- প্রায় অন্ধকার একটা ঘর। দিনের বেলায়ও অপ্রতুল আলো! আমি যখন মাহবুবের ছবি উঠাচ্ছিলাম ফ্ল্যাশের আলোও কুলাতে পারছিল না। আমার সামনে মাহবুবকে দেখে, এর চোখের দৃষ্টি তীব্র, অতি তীব্র তাকিয়ে থাকা যায় না এমন। এই অবয়বটা দেখে কেবল মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল যেন খাঁচায় আটকানো ডানা-ভাঙ্গা এক পাখি। পার্থক্য কেবল একটাই এই খাঁচাটা আট ফুট বাই দশ ফুট। তার সঙ্গে কথা বলে আমার অনুমান যে যথার্থ তার প্রমাণ পেলাম। মাহবুবের এখন যে অবস্থা হাঁটা তো দূরের কথা সে ঠিকঠাক মতো দাঁড়াতেই পারে না। এটা বুঝতে বেগ পেতে হয় না যে ২৪টা ঘন্টাই সে এই ছোট্ট ঘরটায় আটকে থাকে। ঘুরে বেড়ানো নেই, মাঠ নেই, আকাশ নেই! কিচ্ছু নেই- এর ভুবনটা আট ফুট বাই দশ ফুট নামের এক খাঁচা!
কোত্থেকে দৌড়ে আসে মাহবুবের বোন তানিয়া। আমি একে দেখে বলি, ‘ওহ, তুমিই তাহলে তানিয়া। তুমিও তো ক্লাশ সিক্সেই পড়ো?
তানিয়া লাজুক হেসে বলে, ‘আমি এইবার সেভেনে উঠতাম হইলে। হের লিগ্যাই সিক্সে রয়া গেছি। হের পড়নের খুব শখ। আমি ক্লাশের পড়া বাড়িতে আইসা হেরে লেইখ্যা দেই’।
এইটুকুন ছোট্ট একটা মেয়ে, এতো মায়া-এতো মায়া! আমি এবার পূর্ণদৃষ্টিতে তানিয়াকে দেখার চেষ্টা করি। আধো অন্ধকারে ছোট্ট এই মেয়েটি প্রায় অস্পষ্ট হয়ে আসে। ঘটনাটা আমি বুঝতে পেরে চট করে চোখ সরিয়ে নেই। চশমা আমার চোখ আড়াল করে রেখেছে, তবুও। পানিতে ছাপাছাপি চোখ দেখতে পেলে সে-এক কেলেঙ্কারী হয়ে যাবে। পাগল, তা যে হতে দেওয়া চলে না।
মাহবুব নামের এই ডানা-ভাঙ্গা পাখিটার জন্য দুইটা ডানা দরকার। আধুনিক মানুষেরা যেটার নাম দিয়েছে হুইল-চেয়ার। কেমন করে, কোথায় থেকে? অতসব কী আমি জানি ছাই, কেবল যেটা জানি যত দ্রুতসম্ভব একটা হুইল চেয়ার আমার প্রয়োজন...।
১. হৃদয় এক মুক্ত বিহঙ্গ: http://www.ali-mahmed.com/2013/12/blog-post_13.html
আপডেট: নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন সহৃদয় মানুষ মাহবুবের জন্য হুইল চেয়ারের ব্যবস্থা করে দেবেন বলে কথা দিয়েছেন। তাঁকে কেবল ধন্যবাদ দিয়ে খাটো করি না। কেবল বলি, আপনারা এতো ভাল কেন? কেন-কেন-কেন!
যাই হোক, কেমন-কেমন করে আমার ফোন নাম্বার জোগাড় করে আশেপাশের কারও ফোন থেকে মাহবুব নামের এই ছেলেটি আমাকে ফোন দেয়। তার সঙ্গে কথাবার্তা নিম্নরূপ:
মাহবুব ক্ষীন গলায় বলে, ‘আমি ইসকুলে যাইতে চাই’।
আমি বললাম, ‘তো সমস্যা কোথায়। যাও না’।
মাহবুব এবার কুন্ঠিত হয়ে বলল, ‘আমি তো হাটতাম পারি না’।
আমার চট করে মনে পড়ে গেল আমি তো একেই খুঁজছিলাম। আমি জানি না কেমন করে একটা হুইল -চেয়ারের ব্যবস্থা হবে কিন্তু ঠিকই সাহস করে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কিন্তু তোমার বাড়ি থেকে তোমাকে সঙ্গে করে কে নিয়ে আসবে’?
মাহবুব হড়বড় করে বলে, ‘আমার বইন, তানিয়া। হে নিয়া যাইব। হে-ও আমার লগে ক্লাস সিক্সে পড়ে’।
অনেক যন্ত্রণা করে মাহবুবের বাড়ি খুঁজে বের করতে হলো। কেউ চেনে না কিন্তু যখন বললাম হাঁটতে যে একটু সমস্যা হয়। এটা বলার সঙ্গে সঙ্গে অনেকেই চিনে ফেলল। কেউ-কেউ খানিকটা বিরক্তিও প্রকাশ করল: ধুর মিয়া, আগে কইবেন না, ‘ল্যাংড়া মাহবুব’। এই এক চুতিয়া পাবলিক! এরা, এরাই অপ্রকৃতস্থ লোকজনকে দেখলে হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ে। যেন এই গ্রহে এরচেয়ে মজার আর কিছু নেই!
মাহবুবের ঘরটায় ঢুকে বুকে একটা ধাক্কা খেলাম- প্রায় অন্ধকার একটা ঘর। দিনের বেলায়ও অপ্রতুল আলো! আমি যখন মাহবুবের ছবি উঠাচ্ছিলাম ফ্ল্যাশের আলোও কুলাতে পারছিল না। আমার সামনে মাহবুবকে দেখে, এর চোখের দৃষ্টি তীব্র, অতি তীব্র তাকিয়ে থাকা যায় না এমন। এই অবয়বটা দেখে কেবল মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল যেন খাঁচায় আটকানো ডানা-ভাঙ্গা এক পাখি। পার্থক্য কেবল একটাই এই খাঁচাটা আট ফুট বাই দশ ফুট। তার সঙ্গে কথা বলে আমার অনুমান যে যথার্থ তার প্রমাণ পেলাম। মাহবুবের এখন যে অবস্থা হাঁটা তো দূরের কথা সে ঠিকঠাক মতো দাঁড়াতেই পারে না। এটা বুঝতে বেগ পেতে হয় না যে ২৪টা ঘন্টাই সে এই ছোট্ট ঘরটায় আটকে থাকে। ঘুরে বেড়ানো নেই, মাঠ নেই, আকাশ নেই! কিচ্ছু নেই- এর ভুবনটা আট ফুট বাই দশ ফুট নামের এক খাঁচা!
কোত্থেকে দৌড়ে আসে মাহবুবের বোন তানিয়া। আমি একে দেখে বলি, ‘ওহ, তুমিই তাহলে তানিয়া। তুমিও তো ক্লাশ সিক্সেই পড়ো?
তানিয়া লাজুক হেসে বলে, ‘আমি এইবার সেভেনে উঠতাম হইলে। হের লিগ্যাই সিক্সে রয়া গেছি। হের পড়নের খুব শখ। আমি ক্লাশের পড়া বাড়িতে আইসা হেরে লেইখ্যা দেই’।
এইটুকুন ছোট্ট একটা মেয়ে, এতো মায়া-এতো মায়া! আমি এবার পূর্ণদৃষ্টিতে তানিয়াকে দেখার চেষ্টা করি। আধো অন্ধকারে ছোট্ট এই মেয়েটি প্রায় অস্পষ্ট হয়ে আসে। ঘটনাটা আমি বুঝতে পেরে চট করে চোখ সরিয়ে নেই। চশমা আমার চোখ আড়াল করে রেখেছে, তবুও। পানিতে ছাপাছাপি চোখ দেখতে পেলে সে-এক কেলেঙ্কারী হয়ে যাবে। পাগল, তা যে হতে দেওয়া চলে না।
মাহবুব নামের এই ডানা-ভাঙ্গা পাখিটার জন্য দুইটা ডানা দরকার। আধুনিক মানুষেরা যেটার নাম দিয়েছে হুইল-চেয়ার। কেমন করে, কোথায় থেকে? অতসব কী আমি জানি ছাই, কেবল যেটা জানি যত দ্রুতসম্ভব একটা হুইল চেয়ার আমার প্রয়োজন...।
১. হৃদয় এক মুক্ত বিহঙ্গ: http://www.ali-mahmed.com/2013/12/blog-post_13.html
আপডেট: নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন সহৃদয় মানুষ মাহবুবের জন্য হুইল চেয়ারের ব্যবস্থা করে দেবেন বলে কথা দিয়েছেন। তাঁকে কেবল ধন্যবাদ দিয়ে খাটো করি না। কেবল বলি, আপনারা এতো ভাল কেন? কেন-কেন-কেন!
No comments:
Post a Comment