কাজী নজরুল ইসলামকে আমরা ‘দুখু মিয়া’ নামেও চিনি। তিনি কেবল দুখি মানুষই ছিলেন না তাঁর গোটা পরিবারই ‘দুখি পরিবার’। আমি তো বলব, ‘অভাগা পরিবার’। যাদেরকে অহরহ এটা জানতে-শুনতে-পড়তে হয়েছে কাজী নজরুল ইসলামের মৃত্যু হয়েছে সিফিলিসে? কেবল দিনের-পর-দিনই না বছরের-পর-বছর যুগের-পর-যুগ ধরে এই অপবাদ বয়ে বেড়াতে হয়েছে গোটা পরিবারকে।
অথচ এটা ছিল নিরেট মিথ্যা! এখনও, আজও আমি অজস্র লেখায় এটা পাই এই মিথ্যাচার নিয়ে [১]। এখানে বিশদ লিখেছি। নজরুল নিউরো সিফিলিসে ভুগছিলেন না, ভুগছিলেন Pick's disease তাঁর চিকিৎসা হয় ভিয়েনায়, ড. হফের তত্ত্বাবধায়নে।
এখন এই লেখায় আর চর্বিতচর্বণ করি না।
তিনি কেবল দুখু মিয়াই ছিলেন না, সুখু মিয়াও ছিলেন। কেমন করে? বলছি...।
তিনি যখন বাবরি চুল দুলিয়ে এই এই গান লিখলেন:
"...খোদারও প্রেমের শরাব পিয়ে, বেহুঁশ হয়ে রই পড়ে...।"ক্কী-ক-কী, কয় কী! খোদার প্রেমের সঙ্গে শরাব! কিন্তু তখন কারও চাকু-চাপাতির কোপে তাঁর বাবরি চুল লুটিয়ে পড়েনি।
যখন নজরুল লিখেলেন:
“...দোযখ আমার হারাম হ'ল পিয়ে কোরানের শিরীন শহদ।...”
(খোদার বন্ধু /কাজী নজরুল ইসলাম।)
বলে কী- ‘কোরানের শিরীন শহদ’! মধু না বিষ সে পরের কথা কিন্তু কোরানের সঙ্গে তুলনা! তখনও কিন্তু নজরুলের বাবরি চুল গড়াগড়ি খায়নি! বুদ্ধিমান পাঠকের জন্য বাবরি চুলের সঙ্গে যে নজরুলের গোটা মাথাটাও যে গড়িয়ে পড়ত এটা আর উল্লেখ করার প্রয়োজন বোধ করলাম না।
আর যখন লিখলেন এটা:
“...খোদার আসন ‘আরশ’ ছেদিয়া, উঠিয়াছি চির-বিস্ময় আমি বিশ্ববিধাতৃর!...
...তাজী বোর্রাক্ আর উচ্চৈঃশ্রবা বাহন আমার হিম্মত-হ্রেষা হেঁকে চলে!...
...আমি বিদ্রোহী ভৃগু, ভগবান বুকে এঁকে দেবো পদ-চিহ্ন! আমি খেয়ালী বিধির বক্ষ করিব ভিন্ন!..."
(বিদ্রোহী/ কাজী নজরুল ইসলাম।)
কাট মাই...! বলে কী, ভগবানের বুকে...! তখনও কিন্তু খোদাভক্ত কেউ ‘কোপা সামসু’ বলে কোপায়নি বা ভগবানভক্ত কেউ ‘কোপা শংকর’ বলে ভোজালি দিয়ে নজরুলকে ফালা-ফালা করেনি! অবশ্য
তখন অনেকে নজরুলকে ‘লোকটা শয়তান না মুসলমান?' বা 'ইসলাম বৈরী মুসলমান কবি', 'ধর্মজ্ঞানশূন্য বর্বর' 'কুলাঙ্গার', ‘কাফের', 'ফেরাউন', 'নমরুদ', 'খোদাদ্রোহী', 'ধর্মদ্রোহী', ইত্যাদি সম্বোধনে সম্বধন করতে ছাড়েনি। কিন্তু নজরুলের বাবড়ি, বাবড়ির সঙ্গে মুন্ডুর কোন সমস্যা হয়নি। স্বস্থানেই ছিল।
আবার কিন্তু অনেকে লেখার উত্তর লেখা দিয়ে দিতেও ভুল করেননি। সজনীকান্ত দাস শনিবারের চিঠিতে ‘গাজী আব্বাস বিটকেল', 'ভবকুমার প্রধান' নামে লিখতেন। সজনীকান্ত দাস নজরুলের 'বিদ্রোহী' কবিতাটির জবাবে একটি ব্যঙ্গ কবিতা লিখেছিলেন, 'ব্যাঙ'।
”আমি ব্যাঙ
লম্বা আমার ঠ্যাঙ
ভৈরব রভসে বরষা আসিলে ডাকি সে
গ্যাঙোর গ্যাঙ
আমি ব্যাঙ
দুইটি মাত্র ঠ্যাঙ...।“
আমাদের বাপ-দাদাদের চেয়েও আমরা যে এখন অনেক বড় মুসলমান- দা থেকে আছাড় বড়! সুখু মিয়ার ভাগ্য-সুখ দেখে ঈর্ষা-ঈর্ষা! ভাগ্যিস, নজরুল আজ আর বেঁচে নেই- ঠিক সময় মরে গিয়ে বেঁচে গেছেন! নইলে হাওয়ায় কেবল তাঁর বাবরি চুলই উড়ে বেড়াত না সঙ্গে কাটা মুন্ডুটাও...।
সহায়ক সূত্র:
১. কবি নজরুল সিফিলিসে আক্রান্ত, এই বিষয়ক মূর্খতা: http://www.ali-mahmed.com/2010/10/blog-post_21.html)।
No comments:
Post a Comment