সালটা ২০০৩। তখন কেবল মাত্র আমার ২টা উপন্যাস বেরিয়েছে- ৯২ সালে অনন্যা থেকে আর ৯৫ সালে কাজী আনোয়ার হোসেনের প্রকাশনী থেকে। ৯৩ সালে বাংলা একাডেমির (এঁরা আমাদেরকে পরামর্শ দেন একাডেমি লিখতে কিন্তু নিজেরা লেখেন একাডেমী) ’উত্তরাধিকার’-এ আমার যে উপন্যাসটা ছাপা হলো [১] সেটা নিয়ে আমি বিপদে পড়ে গেলাম কারণ তখন বাংলা একাডেমি ব্যতীত অন্য কোথাও ‘উত্তরাধিকার’ পাওয়া যেত না যা ছিল একেবারেই পাঠকের নাগালের বাইরে। আর পাঠক না-পড়লে লিখে কী হয়? লেখার প্রয়োজনটা কী! বটে, কিন্তু ছাপাবে কে?
আহা, আমি তো সেইসব মহান লেখক না যে আলাদা একটা ভঙ্গি করে বলব, ওরে, আমি তো কেবল আমার নিজের জন্য লিখি, রে পাগলা। শোনো কথা, লেখালেখি নামের বাড়িটা পড়ার নাম করে পাঠক ছুঁয়ে না-দিলে সে যে এক নিষ্প্রাণ ভুতুড়ে বাড়ি! এমন একটা বাড়িতে আমার কী কাজ- ওখানে তো বাস করবে ‘ভুতলেখক’? ভুতলেখক হওয়ার গোপন কোনও ইচ্ছা আমার ছিল না, আজও নাই। তাই দৌড়াদৌড়ি...!
আরেকটা মধুর বিপদের কথা না-বললেই নয়। সেটা হচ্ছে বাংলা একাডেমি আমাকে তখন সম্মানী দিয়েছিল ২০০১ টাকা। এই ১ টাকার মরতবা বুঝিনি। কাকে জিজ্ঞেস করব? এই ১ টাকা কেন, বাদাম খাওয়ার জন্য [২]!
যাই হোক, তখন সুতীব্র ইচ্ছা বাংলা একাডেমির সেই উপন্যাসটা বই আকারে বের হোক কিন্তু কোনও প্রকাশক এটা ছাপাতে চাচ্ছিলেন না, কারণ…? ইতিমধ্যে বিচিত্রসব অভিজ্ঞতা হলো। কোনও প্রকাশক 'দুধেল লেখক'-এর ওরফে হুমায়ূন আহমেদের জন্য মোষের দইয়ের নিমিত্তে মোষ কিনতে বাজারে গেছেন। তো কেউ বলছেন, টংকা ওরফে ট্যাকাটুকা দেন। শ্লা, মনে হচ্ছিল এটা বাংলা বাজার না, ঠাঠারি বাজার! একেকটা মাংসের কারবারি!
আহা, আমি তো সেইসব মহান লেখক না যে আলাদা একটা ভঙ্গি করে বলব, ওরে, আমি তো কেবল আমার নিজের জন্য লিখি, রে পাগলা। শোনো কথা, লেখালেখি নামের বাড়িটা পড়ার নাম করে পাঠক ছুঁয়ে না-দিলে সে যে এক নিষ্প্রাণ ভুতুড়ে বাড়ি! এমন একটা বাড়িতে আমার কী কাজ- ওখানে তো বাস করবে ‘ভুতলেখক’? ভুতলেখক হওয়ার গোপন কোনও ইচ্ছা আমার ছিল না, আজও নাই। তাই দৌড়াদৌড়ি...!
আরেকটা মধুর বিপদের কথা না-বললেই নয়। সেটা হচ্ছে বাংলা একাডেমি আমাকে তখন সম্মানী দিয়েছিল ২০০১ টাকা। এই ১ টাকার মরতবা বুঝিনি। কাকে জিজ্ঞেস করব? এই ১ টাকা কেন, বাদাম খাওয়ার জন্য [২]!
যাই হোক, তখন সুতীব্র ইচ্ছা বাংলা একাডেমির সেই উপন্যাসটা বই আকারে বের হোক কিন্তু কোনও প্রকাশক এটা ছাপাতে চাচ্ছিলেন না, কারণ…? ইতিমধ্যে বিচিত্রসব অভিজ্ঞতা হলো। কোনও প্রকাশক 'দুধেল লেখক'-এর ওরফে হুমায়ূন আহমেদের জন্য মোষের দইয়ের নিমিত্তে মোষ কিনতে বাজারে গেছেন। তো কেউ বলছেন, টংকা ওরফে ট্যাকাটুকা দেন। শ্লা, মনে হচ্ছিল এটা বাংলা বাজার না, ঠাঠারি বাজার! একেকটা মাংসের কারবারি!
এমনকি 'দিব্য প্রকাশের' মইনুল আহসান সাবের পর্যন্ত বলে বসলেন, 'আমরা অথরের ফিন্যান্স ছাড়া বই প্রকাশ করি না’।
বটে রে, তাহলে মননশীন-সৃজনশীল-‘চলনশীল’ বুলি কপচাবার প্রয়োজন কী, হে? যাই হোক, এরপর আর লেখালেখি নিয়ে কথা চলে না!
এভাবে বছরের-পর-বছর গেল। একজন লেখক, তিনি কোনও এক প্রকাশনীকে বলে-কয়ে বইটা ছাপাবার ব্যবস্থা করবেন বলে আমাকে দিনের-পর-দিন ধরে আশ্বাস দিয়ে গেলেন। হায়, সরকারি প্রেসনোটের মতই মিথ্যা তার আশ্বাস। পরে বুঝেছি তার আশ্বাস আর ব্যবহৃত টিস্যুপেপারের মধ্যে আদৌ কোনও পার্থক্য নাই। কালে কালে তিনি যে চালবাজ একটা লেখক হয়ে উঠলেন শেষে তা প্রমাণ করেই ছাড়লেন।
এমনিতেও আমার জেদ চেপে গেল, দেব না, কোনও প্রকাশককে একটা অচল আধুলিও দেব না। আধুলি দূরের কথা- 'চাইর আনাও দোব না'! কেন দেব, রে পাপিষ্ঠ! এমন অমর্যাদা মাথায় নিয়ে পাঠকের কাঠগড়ায় দাঁড়াবার প্রয়োজন কী আদৌ! কী হয় এমন ছাতার লেখালেখি না করলে…!
এই আলোকিত ভুবনের অন্ধকার দিকগুলো আমার ভাল লাগছিল না। নিতল অন্ধকারের শেষ মাথায় কোথাও-না-কোথাও এক চিলতে আলো থাকে, থাকেই…।
এতক্ষণ এই ভনিতার কারণটা বলি। একজন প্রকাশক ২০০৩ সালে বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত ওই লেখাটা নিয়েই 'নিশিগন্ধা' বইটা বের করলেন। সেই মানুষটাই 'জাগৃতি প্রকাশনীর' ফয়সাল আরেফিন দীপন।
এতক্ষণ এই ভনিতার কারণটা বলি। একজন প্রকাশক ২০০৩ সালে বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত ওই লেখাটা নিয়েই 'নিশিগন্ধা' বইটা বের করলেন। সেই মানুষটাই 'জাগৃতি প্রকাশনীর' ফয়সাল আরেফিন দীপন।
আমি অতি আনন্দের সঙ্গে বইটা উৎসর্গ করলাম সেই চালবাজ লেখককে। বইয়ের ভূমিকায় লিখলাম:
"মি. এক্স। সেই লেখক, যিনি মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে এক বছর আমাকে লাটিমের মত বনবন করে ঘুরিয়েছেন। আপনি হয়তো একজন ভাল লেখক- আই বেট, ভাল মানুষ নন। গড ব্লেস ইউ!"
এই লেখককে গড ভালই ব্লেস করলেন, করেন। হয়তো গড থাকেন এই সব মেকি মানুষদের 'ভদ্দরনোকপল্লীতে' ওরফে কারওয়ান বাজারে। কালে-কালে তিনি প্রিন্টমিডিয়ার ঢালের আড়ালে কাউকে এভারেস্টে কোলে করে তুলে নিয়ে গেলেন তো কাউকে পাতালে। মিডিয়ার চাকরিরসূত্রে যে কোনও প্রকারে নিজের লেখা-বইয়ের প্রসঙ্গ নিয়ে আসেন সেটা কোনও অভিনেতা হোক বা কোনও নেতার মুখে। বিশ্ববেহায়া এরশাদকেকে ছাড়িয়ে গেলেন- নিজের বইয়ের বিজ্ঞাপন নিজেই দেওয়া শুরু করলেন। নিজেই লিখে দেন প্রথম মুদ্রণ শ্যাষ দ্বিতীয় মুদ্রণ অন দ্য ওয়ে, আসিতেছে...।
যাই হোক, কেবল যে আমার বই প্রকাশ করার কারণেই ফয়সাল আরেফিন দীপনকে খুব পছন্দ করতাম এমন না, এই মানুষটা আমাকে খানিকটা বোঝার চেষ্টা করতেন। এমন উদাহরণের অভাব নেই।
আমার কাছের লোকজনেরা আমার ব্রেন নাই এটা নিয়ে বিস্তর রসিকতা করেন, এখনও! কিন্তু এতে যে আমার প্রাণ যায়, সখা! আমি লোকেশন একেবারেই মনে রাখতে পারি না যেমনটা মনে রাখতে পারি না মানুষের মুখ। ঢাকায় কেউ-যদি বলে এই ঠিকানায় চলে আসবেন তাহলে ধরে নিন আমার মাথায় মাসুদ রানার প্রিয় ওয়েলথার পিপিকে তাক করা হলো। অবশ্যই গুলিভর্তি। কখন দুম করে গুলি বেরিয়ে পড়ে এর ঠিক নেই! অথচ পূর্বে ঢাকা আমি অজস্রবার গেছি, তারপরও...!
এমনিতে সঙ্গে কেউ থাকলে আমার আনন্দের শেষ নেই। তখন আমার একটাই কাজ মানুষটার পেছন পেছন ঘুরে বেড়ানো! কিন্তু একা হলেই সর্বনাশ- ঢাকার মত যান্ত্রিক শহরে হারিয়ে যাই, স্রেফ হারিয়ে যাই। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য- আমার লেখালেখির শপথ! কিন্তু সেই সব সহৃদয় মানুষগুলোও এক সময় আমাকে নিয়ে তিতিবিরক্ত হয়ে পড়েন। রাগী গলায় সাফ ঘোষণা দেন: আমি লিখে সই করে দিচ্ছি, আপনি ঢাকা শহরে চলাচলের জন্য অনুপযুক্ত বা অচল [৩]।
যতটুকু মনে পড়ে তখন প্রকাশক ফয়সাল আরেফিন দীপনের অফিস ছিল দোতলায়। লেখার কাজে, প্রূফ দেখতে দীর্ঘ সময় ওখানে থাকা লাগত। কখনও পূর্বের টাট্টিখানা হালের ওয়াশরুম-রেস্টরুমে যাওয়ার প্রয়োজন হলে আমার মুখ শুকিয়ে যেত কারণ আজিজ সুপার মার্কেটের এই ভবনটা আমার কাছে গোলকধাঁধাঁর মত মনে হতো। সব দেখতে একই রকম! দীপনের অফিসের এমাথা থেকে ওমাথা কোনও প্রকারে যেতে পারলেও ঠিক-ঠিক চিনে ফিরে আসতে পারতাম না। তাই ওঠার জন্য আমি আমার পরিচিত এইটাই সিঁড়ি ব্যবহার করতাম নইলে আমার জন্য দীপনের অফিস চেনাটা মুশকিল হয়ে যেত।
পরে একটা বুদ্ধি বের করলাম! ওয়শরুমের কাজ সেরে হাতের নাগালের সিঁড়িটা দিয়ে সোজা নীচে নেমে যেতাম এবং যথারীতি আমার পরিচিত সেই সিঁড়ি দিয়ে শিস বাজাতে-বাজাতে উঠে আসতাম।
একদিন বিষয়টা ফয়সাল আরেফিন দীপন ধরে ফেললেন, হাসি লুকিয়ে বললেন, ’ঘটনা কী, বলেন তো- আপনি ওয়শরুমের নাম করে নীচে কোথায় যান’?
আমি বিব্রত হয়ে বললাম, ‘না, মানে, ইয়ে, নীচে আমার একটা মানে একটা ইয়ে কেনার ছিল’।
এবার দীপন নামের সদাশয় মানুষটা মুখ ভরে হেসে বললেন, ‘হুম, আমি কিন্তু এই নিয়ে বেশ ক-দিন আপনাকে এমনটা করতে দেখেছি’।
চোখাচোখি বাঁচিয়ে আমি ছাদে লটকে থাকা পরিত্যাক্ত টি-ব্যাগ দেখি [৪]।
পরে দীপন যেটা করতেন আমার ওয়শরুমে যাওয়ার প্রয়োজন হলে সঙ্গে অফিসের কাউকে দিয়ে দিতেন। হে মাবুদ, একজন মার্চ করে আমার সঙ্গে যাচ্ছেন আবার ফিরে আসার সময়ও...মার্চ। কী লজ্জা-কী লজ্জা, এই দিনও দেখার ছিল, মরণ! দীপনকে বলেকয়ে আগের নিয়মটাই চালু রাখলাম।
ফয়সাল আরেফিন দীপন নামের সহৃদয় এই মানুষটা বিদায় দেওয়ার বেলায় কেবল যে নীচেই নেমে আসতেন এমন না রিকশা ঠিক করে রিকশাওয়ালা কাছে আগেই জেনে নিতেন: মামা, আপনি ওই জায়গা চেনেন তো, শোনেন কোন দিক দিয়া যাবেন...?
কারণ এই মানুষটা বিলক্ষণ জানেন রিকশাওয়াওয়ালা যখন মুখ ঘুরিয়ে আমার কাছে জানতে চাইবে 'কোন দিক দিয়া যাইতাম', তখন আমি কেবল অসহায়ের মত তাকিয়ে থাকব।
কারণ এই মানুষটা বিলক্ষণ জানেন রিকশাওয়াওয়ালা যখন মুখ ঘুরিয়ে আমার কাছে জানতে চাইবে 'কোন দিক দিয়া যাইতাম', তখন আমি কেবল অসহায়ের মত তাকিয়ে থাকব।
...
৩১ অক্টোবর ফয়সল আরেফিন দীপন খুন হন নিজের অফিসে, নৃশংস ভাবে। কেন খুন হলেন এটা নিয়ে মন্তব্য করা থেকে বিরত রইলাম কারণ আজও খুনি ধরা পড়েনি। যেমনটা আমরা এখনও জানি না সাগর-রুনির খুনি কে, কেন তাঁরা খুন হলেন? এই সব জানার চল এই দেশে নাই!
অবশ্য দীপনের বাবা স্পষ্ট করে বলেছেন অভিজিত রায়ের বই প্রকাশ করার কারণেই এই খুন। দীপন বিভিন্ন লেখকের আনুমানিক ১৬০০ বই প্রকাশ করেছেন যার মধ্যে আছে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের প্রামাণ্য গ্রন্থ নীলিমা ইব্রাহিমের ‘আমি বীরাঙ্গনা বলছি’র মত কালজয়ী অসংখ্য বই।
কেবল একজন লেখকের বই প্রকাশ করার কারণে এই খুন হয়ে থাকলে, কাল যে কেউ অভিজিৎ রায়ের বই পড়ার সময় কোপ খাবেন বা কেউ ওকে নিয়ে লিখলে! বটে রে, একজন অভিজিৎ রায়ের এমন বিপুল ক্ষমতা!
আচ্ছা, দেওয়ানবাগির পির যে ইসলাম ধর্ম নিয়ে কেবল অশ্লীল, আপত্তিকরই না [৫] ধর্ম অবমাননার আওতায় জঘন্য অপরাধ করে যাচ্ছেন দিনের-পর-দিন! তখন দেখি কেউ রা কাড়েন না? বিষয়টা কী, বাহে? তার গোপন অঙ্গে কোপ দূরের কথা আজ পর্যন্ত তার নামে একটা মামলা পর্যন্ত হয়নি! তার গোপন চুলও আপনারা কেউ স্পর্শ করতে পারেননি!
বেশ-বেশ, তা আপনারা কী ধর্মের কারকুন-তত্ত্ববধায়ক? আপনাদের কারফরমা-আদেশে আমাদেরকে চলতে হবে? এই প্রসঙ্গে পূর্বে বিস্তর লেখা লিখেছি [৫] আপাতত এই প্রসঙ্গ থাকুক। কেবল আমার অন্য এক লেখা থেকে ধার করে বলি:
“আমার যা ইচ্ছা তা পড়ব- অভিজিতকে পড়ব অভিজিতের বাপকে পড়ব, বান..., তোমাদের সমস্যা কী? ভুলেও অন্তত আমাকে কখনও এই সব জুজু, মৃত্যুর ভয় দেখাতে আসবা না। আর কাপুরুষের মত পেছন থেকে না সাহস থাকলে সামনাসামনি। শোন, নর্দমার কীটরা, কেউ থুত্থুড়ে বুড়া হয়ে গু-মুতে মাখামাখি হয়ে মারা যায়, কেউ ব্যাটলফিল্ড-যুদ্ধক্ষেত্রে, কেউবা তোমাদের মত নরকের কীট-কাপুরুষদের হাতে। কাউকে-কাউকে মেরে ফেলা যায় এ সত্য কিন্তু তার আদর্শ, তাঁর ভাবনাকে মেরে ফেলা যায় না। আমাকে মেরে ফেললে আমার ভাবনাগুলো থেকে যাবে। সেই ভাবনার রেশ ধরে আমার গলিত শব থেকে জন্ম নেবে, নেবেই অন্য একজন। সেই মানুষটা হাতে থাকবে জ্ঞানের এমন এক তরবারি যেটা দিয়ে সে ছিন্নভিন্ন করে ফেলবে তোমাদের মত সমস্ত অন্ধকার, তোমাদের মত কাপুরুষদেরকে...। তোমাদের মুখে একগাদা থুতু, শুয়োরের ছা!”
ফয়সাল আরেফিন দীপন খুন হওয়ার পরই দীপনের বাবা আবুল কাশেম ফজলুল হক বললেন: ‘আমি আমার সন্তানের খুনের বিচার চাই না’।
একমাত্র সন্তানের শব কাঁধে নিয়ে একজন বাবা কেন এমনটা বলেন সেটা বোঝার মত মগজের বড় অভাব আমাদের দেশে। সরকারের দায়িত্বশীল একজন মানুষ যখন জনাব কাশেমের এই কথার রেশ ধরে অতি কুৎসিত কথাটা বললেন, এমন কুৎসিত অমানবিক কথা আমি আমার সমস্ত জীবনে কখনও শুনেছি এমনটা মনে করতে পারছি না। পারলে এই মানুষটাকেই খুনি বানিয়ে দেন!
একমাত্র সন্তানের শব কাঁধে নিয়ে একজন বাবা কেন এমনটা বলেন সেটা বোঝার মত মগজের বড় অভাব আমাদের দেশে। সরকারের দায়িত্বশীল একজন মানুষ যখন জনাব কাশেমের এই কথার রেশ ধরে অতি কুৎসিত কথাটা বললেন, এমন কুৎসিত অমানবিক কথা আমি আমার সমস্ত জীবনে কখনও শুনেছি এমনটা মনে করতে পারছি না। পারলে এই মানুষটাকেই খুনি বানিয়ে দেন!
দীপনের বাবা নামের এই মানুষটাকে বেশ ক-বার দীপনের অফিসে আমি দেখেছি। আপাতত দৃষ্টিতে অতি সাধারণ এই মানুষের ব্যক্তিত্বের এমন ছটা যে তাঁর সামনে নিজেকে দেখেছি কাঠ হয়ে থাকতে।
কিন্তু এই মানুষটারই ব্লগ-ব্লগিং নিয়ে [৬] খুব ভাল একটা ধারণা নেই এটা বোঝা যায় তাঁর এই মন্তব্য থেকে।
হয়তো কোনও সাংবাদিক তাঁকে প্রশ্ন করেছিল: আপনার ছেলে কি ব্লগ লিখতেন?
তিনি সোজাসাপটা বলেছেন, ও ব্লগে ঢোকেনি।
কিন্তু বিষয়টা এমন আকারে এসেছে যে মনে হচ্ছে তিনি আগ বাড়িয়ে এটা বলতে চাইছেন। কারও সাক্ষাৎকার-বক্তব্য মিডিয়ার কল্যাণে কেমনতরো হয় তার নমুনা এখানে পাওয়া যাবে [৭]। দীপনের বাবার এই মন্তব্য নিয়েও পানি কম ঘোলা হয়নি। এখন দেশে পাঠকের চেয়ে লেখকের আধিক্য এবং এই এই সমস্ত লেখক মহোদয়গণ এই গ্রহের এমন কোনও বিষয় নাই যেটা নিয়ে কাটাকুটি খেলা খেলেন না।
আর মিডিয়া, আহ, আমাদের চুতিয়া মিডিয়া! খুনিরা কেবল দীপনকে কুপিয়েছে আর মিডিয়া কুপিয়েছে দীপনের পরিবারের লোকজনকে, সবিরাম। এমনিতে এরা অবলীলায় মৃত্যুপথযাত্রী মানুষের মুখে বুম ধরে বলতে পারে: আপনি এখন কেমন বোধ করছেন?
এরা অবিকল একটা হায়েনার মত! শকুনের চোখ নিয়ে (যার চালু নাম ক্যামেরা) অপেক্ষায় থাকে কোন এঙ্গেলে হাহাকার-করা বুক ভেঙ্গে কাঁদার ছবিটা ভাল আসবে। এই অপেক্ষায় এদের কোনও ক্লান্তি নেই। এদের জন্য প্রিয়মানুষের শব ধরে কেঁদে বুক হালকা করারও উপায় নেই। দীপনের স্ত্রী ডা. রাজিয়া প্রিয়মানুষটার নিথর দেহ ধরে যেসব আবেগঘন কথা বলেন: 'তুমি না বলছিলা...'।
তা আমরা দাঁড়ি-কমাসহ প্রথম আলোর কল্যাণে জেনে যাই। বদলে দাও, এরাই বদলে দিচ্ছে আমাদের ভাবনা। নোংরা ভাবনা! ওহে, মতিউর রহমান, ব্যক্তিগত কর্মকান্ড করার সময় আপনার ওয়শরুমে গিয়ে আপনার মুখে বুম ঠেসে ধরলে আপনার অনুভূতিটা কেমন হবে?
এরা অবিকল একটা হায়েনার মত! শকুনের চোখ নিয়ে (যার চালু নাম ক্যামেরা) অপেক্ষায় থাকে কোন এঙ্গেলে হাহাকার-করা বুক ভেঙ্গে কাঁদার ছবিটা ভাল আসবে। এই অপেক্ষায় এদের কোনও ক্লান্তি নেই। এদের জন্য প্রিয়মানুষের শব ধরে কেঁদে বুক হালকা করারও উপায় নেই। দীপনের স্ত্রী ডা. রাজিয়া প্রিয়মানুষটার নিথর দেহ ধরে যেসব আবেগঘন কথা বলেন: 'তুমি না বলছিলা...'।
তা আমরা দাঁড়ি-কমাসহ প্রথম আলোর কল্যাণে জেনে যাই। বদলে দাও, এরাই বদলে দিচ্ছে আমাদের ভাবনা। নোংরা ভাবনা! ওহে, মতিউর রহমান, ব্যক্তিগত কর্মকান্ড করার সময় আপনার ওয়শরুমে গিয়ে আপনার মুখে বুম ঠেসে ধরলে আপনার অনুভূতিটা কেমন হবে?
যেদিন ফয়সাল আরেফিন দীপনকে খুন করা হলো এর পরদিনই দীপনের ছেলে রিদাতের জেএসসি পরীক্ষা। ছেলে বড়োসড়ো হয়ে গেছে বাপের জুতো পায়ে দিব্যি এঁটে যায় তবুও আগে হয়তো বাপ ছেলের হাত ধরে পরীক্ষা হলে নিয়ে গেছেন। পরীক্ষা হলে ছেলে ঢুকছে আর বাপ বিড়বিড় করে বলছেন: ব্যাটা, মাথা ঠান্ডা রাখবি, একদম ঠান্ডা। প্রশ্ন হাতে পেয়ে কিন্তু …।
এইবার এমনতরো বলার কেউ ছিল না তবুও বাবার শীতল শব রেখে 'রিদাত' গেছে পরীক্ষা দিতে। ‘শকুনক্যামেরা’ সেখানেও তার পিছু ছাড়েনি। কালেরকন্ঠ ঠিকই রিদাতের পরীক্ষাকক্ষের ছবিটা ছাপিয়েছে। এই হচ্ছে আমাদের দেশে চালু পত্রিকাগুলোর নমুনা! আহ, কালের কন্ঠ! মিডিয়া-পত্রিকার নাম করে একজন পরোক্ষ খুনি কেমন করে আমাদের দেশের বুদ্ধিজীবীদের কিনে নেয় কয়েকটা নোংরা কাগজের বিনিময়ে [৮]! আমি ইমদাদুল হক মিলনকে দেখতে পাই...বয়স্ক একটা মানুষকে নগ্ন দেখতে ভাল লাগে না।
বিচিত্র এই দেশের রাজনীতিবিদদের ন্যায় সবজান্তা-সর্বজ্ঞ এই গ্রহের অন্য কোথাও আর নাই! এদের কেউ হয়তো কৃষিবিভাগের সঙ্গে জড়িত কেউ বা সড়ক বিভাগের সঙ্গে, তাতে কী আসে যায়। একটি অপরাধ সংঘটিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এরা অপরাধীকে চিহ্নিত করে ফেলেন, গণহারে একের-পর-এক বক্তব্য দিতে থাকেন। ফল যা হওয়ার তাই হয়, অস্ত্র-চাপাতির খোঁজ আমরা পাই কিন্তু চাপাতির পেছনের মানুষটা অদৃশ্যই থেকে যায়। নিশ্চিন্তে এরা ঘুরে বেড়ায় আমাদের আশেপাশেই। আপনি টেরটিও পাবেন না আপনার পাশে বসেই চুকচুক করে চা খাচ্ছে।
আহারে-আহারে, বাবার গায়ের গন্ধ মিশে যায় সন্তানের চোখের জলে সেটা দেখার সময় কোথায় আমাদের! পরে রিদাতের পরীক্ষার খাতা যিনি দেখবেন তিনি ভারী বিরক্ত হবেন এটা দেখে এই ছেলেটা পরীক্ষার খাতার জায়গায়- জায়গায় কালি লেপ্টে আছে! কেন? ওই শিক্ষকের মাথায় আসবে না এই কালি সঙ্গে লেপ্টে আছে বাবাহারা এই ছাত্রের চোখের জল। শিক্ষক বিড়বিড় করবেন: কী অমনোযোগী ছেলে রে বাবা- পরীক্ষা মনে হয় এর কাছে খেলা, হাহ।
বিচিত্র এই দেশের রাজনীতিবিদদের ন্যায় সবজান্তা-সর্বজ্ঞ এই গ্রহের অন্য কোথাও আর নাই! এদের কেউ হয়তো কৃষিবিভাগের সঙ্গে জড়িত কেউ বা সড়ক বিভাগের সঙ্গে, তাতে কী আসে যায়। একটি অপরাধ সংঘটিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এরা অপরাধীকে চিহ্নিত করে ফেলেন, গণহারে একের-পর-এক বক্তব্য দিতে থাকেন। ফল যা হওয়ার তাই হয়, অস্ত্র-চাপাতির খোঁজ আমরা পাই কিন্তু চাপাতির পেছনের মানুষটা অদৃশ্যই থেকে যায়। নিশ্চিন্তে এরা ঘুরে বেড়ায় আমাদের আশেপাশেই। আপনি টেরটিও পাবেন না আপনার পাশে বসেই চুকচুক করে চা খাচ্ছে।
আহারে-আহারে, বাবার গায়ের গন্ধ মিশে যায় সন্তানের চোখের জলে সেটা দেখার সময় কোথায় আমাদের! পরে রিদাতের পরীক্ষার খাতা যিনি দেখবেন তিনি ভারী বিরক্ত হবেন এটা দেখে এই ছেলেটা পরীক্ষার খাতার জায়গায়- জায়গায় কালি লেপ্টে আছে! কেন? ওই শিক্ষকের মাথায় আসবে না এই কালি সঙ্গে লেপ্টে আছে বাবাহারা এই ছাত্রের চোখের জল। শিক্ষক বিড়বিড় করবেন: কী অমনোযোগী ছেলে রে বাবা- পরীক্ষা মনে হয় এর কাছে খেলা, হাহ।
ফাঁকতালে ফয়সাল আরেফিন দীপন নামটা হারিয়ে যাবে। যাবে না কেবল দীপনের সন্তানদের নাকে আটকে থাকা তাদের বাবার গায়ের গন্ধটা। আর দীপনের প্রচন্ড রাশভারী বাবাটার চশমার কাঁচ কখনও-কখনও ঝাপসা হয়ে আসবে, আহা-আহারে, আমার বাবুটার সঙ্গে সময়ে সময়ে এতো কঠিন হওয়ার কী-ই বা দরকার ছিল। আহারে, আমার বাবুটা...!
দীপনের অজস্র স্মৃতি তাড়া করবে এই পরিবারটিকে, আজীবন...।
সহায়ক সূত্র:
১. আমার আনন্দ-বেদনার অপকিচ্ছা: http://www.ali-mahmed.com/2009/05/blog-post.html
২. ১ টাকার মরতবা: https://www.ali-mahmed.com/2009/05/blog-post_01.html
৩. বন ভয়েজ, বইমেলা: http://www.ali-mahmed.com/2010/02/blog-post_27.html
৪. টি-ব্যাগ, শিল্পকর্ম: https://www.ali-mahmed.com/2007/06/blog-post_5091.html
৫. ধারা ৫৭: http://www.ali-mahmed.com/2015/10/blog-post_7.html
৬. কয়েদখানার মেহমান: http://www.ali-mahmed.com/2015/09/blog-post_23.html
৭. একটি আদর্শ সাক্ষাৎকার: http://www.ali-mahmed.com/2010/05/blog-post_05.html
৮. কালের কন্ঠ-মুড়ির ঘন্ট: https://www.ali-mahmed.com/2010/01/blog-post_16.html