Search

Wednesday, May 3, 2017

আপনার জন্য, কেবল আপনারই জন্য...।

আপনি আপনার ব্যক্তিগত কারণে স্কুলের জন্য আর টাকা পাঠাতে পারছেন না, এটার উত্তর লিখব-লিখব করে আর লেখা হয়ে উঠছে না- অমানুষ একটা, আমি, বুঝলেন!
ভাইরে, দেরিতে উত্তর লেখার জন্য সলাজে ক্ষমা চাচ্ছি্- হাঁটু ভেঙে। অন্তত দুঃখের একটা চিহ্ন :( লিখে দিয়েও দায় এড়াতে পারতাম- আসলে আপনাকে কেবল এক লাইনে লিখে দিলে বড়ো অন্যায় হয়।

যে মানুষটা বছরের-পর-বছর ধরে পরম মমতায় স্কুলের খরচ চালিয়ে গেছেন তাঁকে দু-চার লাইনে কেবল এটা লিখে দিলাম, ’ওকে বা না ভাই, কোনও সমস্যা নাই, আচ্ছা…’ বলে হাঁই তুললাম। এ হয় না। কিন্তু কী করব বলেন, এখন যে লিখতে বড়ো আলসেমী লাগে রে, ভাই।
আপনি হয়তো লক্ষ করেছেন কয়েক মাস ধরে কিছুই লেখা হয়ে উঠেনি! যে আমি এক রাতে ‘কনকপুরুষ’ নামে গোটা একটা উপন্যাস লিখে ফেলেছিলাম সেই আমার এক লাইনও লিখতে ইচ্ছা করে না, কী আজব যন্ত্রণা একটা! নষ্ট স্রোতের নষ্ট আঙ্গুল! আমার সম্ভবত আঙ্গুলে পচন ধরেছে। বলা হয়ে থাকে মানুষের পচন শুরু হয় মস্তিষ্ক থেকে আর লেখকের আঙ্গুল থেকে।

আচ্ছা থাকুক এইসব হাবিজাবি কথা…। এটা কিন্তু ঠিক আপনার সহৃদয়তা ব্যতীত সামনের দিনগুলোতে বিকট সমস্যা হবে কিন্তু আমি বিশ্বাস করি টানেলের কোথাও-না-কোথাও আলো থাকে, থাকতেই হয়; এর বিকল্প নেই। এই সংকটেরও একটা সমাধান হবে। নইলে এই ‘হতভাগা’ (!) বাচ্চাগুলোর গতি কী!
আচ্ছা বলেন তো এই দীর্ঘ সময় আপনার মমতার কথা কেমন করে বিস্মৃত হই! স্কুলের নাম করে আপনি যে টাকা পাঠাতেন কেবল কী স্কুলের খরচেরই যোগান হতো? ওখান থেকেই খানিকটা এদিক-ওদিক করে কত কিছুই না করা হতো। আপনি কখনও নাম প্রকাশ করার অনুমতি দেননি আজও আমি সেপথ মাড়ালাম না। কিন্তু আজ এই সব আপনার খানিকটা জানা প্রয়োজন।
ছোট্ট একটা উদাহরণ দেই। এই ছেলেটার নাম আকাশ। বাহ, কী চমৎকার নাম, না? 
এক হাত এক পা নাই এই ছেলেটাকে যখন আমি স্টেশনে পাই তখন এ ভাত খাচ্ছিল।
নিরাপদ দুরত্বে থেকে এর খাওয়া দেখি। কিন্তু খাওয়া শেষ করে এই ছেলেটি যখন প্রায় হামাগুড়ি দিয়ে যাচ্ছিল তখন আমি কাতর হয়ে এর কাছে জানতে চাই, ‘তুমি ক্রাচ দিয়ে হাঁটতে পারো না’? ছেলেটি উদাস হয়ে বলে, ‘ক্রাচ পামু কই’?

আপনার পাঠানো স্কুলের টাকা থেকে কষ্টেসৃষ্টে বাঁচিয়ে কিছু ক্রাচ আমার কাছে সবসময়ই মজুত থাকে। তাই আমি অনায়াসেই তাকে বলি, ‘আচ্ছা, আমি তোমাকে ক্রাচ যোগাড় করে দেব’।
আপনি জেনে অবাক হবেন আকাশ নামের এই ছেলেটার কিন্তু এক জোড়া না কেবল একটাই ক্রাচেরই প্রয়োজন, যার দাম মাত্র দুশো টাকা! একজোড়া ক্রাচের দাম ৪০০ হলে একটার দাম তাই হয়। কিন্তু এখানেও খানিকটা গল্প আছে। আজ গল্পের ঝাঁপিটা খানিকটা উপুড় করে দেই। ঢাকা ব্যতীত ক্রাচ নামের এই জিনিসটা পাওয়া যায় না, ঢাকার আবার সব জায়গায় না। নির্দিষ্ট জায়গা থেকে কিনতে হয়। অথচ আমার তেমন-একটা ঢাকা যাওয়া পড়ে না- শেষ আমি ঢাকা গেছি বছর দুয়েক পূর্বে! তাহলে? উপায়!

আসলে এটা একটা টিম-ওয়র্ক, আমার ভূমিকা এখানে একেবারেই গৌণ। এখানে আমি কেউ না, কিছু না- মিছরির পুতুল। সব তো আপনারাই করে ফেলেন! যেমন একজন অ্যাম্বুলেন্সচালক আছেন। কালো-কালো মায়াভরা দুবলাপাতলা এই মানুষটাকে বলে দিলেই তিনি ঢাকা থেকে ক্রাচ নিয়ে আসেন। অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে যাওয়ার সময় যন্ত্রণাকাতর রোগী নিয়ে যান শুইয়ে আর আসার সময় শুয়ে থাকে ক্রাচ, চুপচাপ, পাশাপাশি। এখানে চারশো টাকায়ই হয়ে যায় বাড়তি কোনো টাকার প্রয়োজনই হয় না!

যাই হোক, টাকা না-পাঠাবার কারণে আপনি মনোকষ্টে ভুগবেন না অস্থির হবেন না, প্লিজ। আমি ঠিক-ঠিক কোনও-না-কোনও একটা উপায় বের করব। এবং এটাও আমার প্রবল বিশ্বাস, আমার মৃত্যুর পূর্বে একটা ‘হোম’ করে যাব, যাবই। স্কুল চালু করার পূর্বে এটাই আমার স্বপ্ন ছিল; আমি সেই স্বপ্নটা লালন করি, আজও, এখনও।
আফসোস, ছোট্ট করে হলেও একটা হোম চালু করার জন্য নামকরা কত মানুষের হাতেপায়ে ধরেছি কিন্তু ফল 'আ বিগ জিরো'। এখন ঠিক করেছি এই বিষয়ে কক্ষণও কারও কাছে আর কোনও সহায়তা চাইব না। শোনেন, কেবল আপনাকে চুপিচুপি বলি একতাল মাটি বেচে দেওয়ার তালে আছি চালবাজ লোকজনেরা যার নাম দিয়েছে সম্পত্তি! কাজটা হয়ে গেলে ইয়ালি বলে লাফিয়ে পড়ব।
কেবল মনে হয় এটা এই স্কুলে যে বাচ্চারা পড়ে এদের দু-পাতা পড়িয়ে কী লাভ? যখন এই স্কুলেই পড়ে এমন একটা উঠতি বয়সের মেয়েকে স্টেশনে ঘুমাতে হয়, অরক্ষিত। বা যখন এই ‘রাজিব’ নামের ছেলেটি অবলীলায় বলে, ’মা একদিকে বাইর হয়া গেল আর আমি একদিকে...,’ তখন এই 'দু-পাতা পড়া' এদের কী কাজে লাগবে?
এদের জন্য একটা হোম নামের আশ্রয়স্থল না-করে আমার কোনও উপায় নেই, বাহে।

এই গ্রহের যেখানেই থাকুন না কেন এই শিশুগুলোর ব্লেসিংস আপনাকে তাড়া করবে...। ভাল থাকুন, অনেক।