লেখক: | Sheikh Baten |
"আমি কিছুটা বিস্মিত হলাম প্রথম আলো পত্রিকায় প্রতিবেদনের প্রথম বাক্যটি এরকম, প্রধানমন্ত্রী শোভন-রাব্বানীকে
সরিয়ে দেবেন। আমি বুঝতে পারি না, প্রধানমন্ত্রী একটি রাষ্টে্র নির্বাহী
প্রধান। এক হিসেবে রাষ্ট্রের সব ছাত্র সংগঠনের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক একই রকম
হবার কথা। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের
শুধু একটি ছাত্র সংগঠনের নির্বাচিত প্রতিনিধিকে সরিয়ে দেবেন কিভাবে? এমন
সামান্য ব্যাপারে তাঁর সিদ্ধান্ত থাকবে কেনো!
অবশ্য দলনেত্রী হিসাবে তার
কিছু অধিকার থাকে। তারপরও যারা এদেরকে নির্বাচিত করেছে, তারাই শুধুই সরিয়ে
দিবার গণতান্ত্রিক অধিকার রাখে। অন্য কেউ তা পারে কি? আসলে এটা বুঝায় যে,
তাদের নেতা হবার প্রক্রিয়াটি অগণতান্ত্রিক গোয়েন্দা নির্ভর ছিল। বিদায়ের
প্রক্রিয়াতে তা স্পষ্ট হল। অনেক রকম চেইন অব কমান্ড ভেঙ্গে তাদেরকে
রাষ্ট্রের ক্ষমতার কেন্দ্রিয় স্তরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ফলে তারা দেশের
প্রচলিত আইনের উর্ধে ছিল, দলের ও দেশের কাউকেই নায্য গুরুত্ব দেয়া দরকার
মনে করতো না। কোন পর্যায়ে নিয়ে গেলে, এরা একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হয়ে অন্য বিশ্ববিদ্যালযের
ভিসির বাসায় গিয়ে, তার কাছে 'ন্যায্য পাওনা' হিসাবে একশো কোটি টাকা দাবী
করার ক্ষমতা রাখে এবং না-পেয়ে, বোঝা যায়, ভিসিকে গালমন্দ করেছে। তারা
অসুস্থ ভিসির হাসপাতালে গিয়েছেন ‘ন্যায্য পাওনার' চাপ দেবার জন্য। সম্ভবত অতীষ্ঠ হয়ে ভিসি ফারজানা ইসলাম অভিযোগ জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর কাছে।
কিন্তু স্বায়ত্বশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়ের
ভিসি কি প্রধানমন্ত্রীর অধীনস্ত কোনো পদ? আইনত রাষ্ট্রপতি চ্যান্সেলরের কাছে তার অভিযোগ জানানোর কথা, যদ্দুর জানি। আর ভিসির নিকট ঠিকাদারির
টাকা দাবি করলে সেটার জন্য সাভার থানার ওসিকে জানাবার কথা সবার আগে। আইনের
অনুশাসন থাকলে সেটাই যথেষ্ট ছিলো। এতক্ষণ আইনসঙ্গত কথা বলছিলাম। আসলে
এদেশটা তলিয়ে গেছে। পৃথিবীর কোনো রাষ্ট্রে বিশ্ববিদ্যালয়ে এত নিচুস্তরের
সমস্যা হয় না। হলে সেগুলোকে আর বিশ্ববিদ্যালয় বলা যায় না।
জানা গেলো, ভিসি ফারজানা ইসলাম অলরেডি প্রায় দেড় কোটি টাকা ঘুষ দিয়েছেন,
স্থানীয় ছাত্রলীগের নেতাদেরকে। কেন দিলেন? ভিসি থাকতে হলে তা করতে হয়,
এজন্য? ফারজানা ইসলাম সম্পর্কে বিরূপ কিছু বলা আমার জন্য মুশকিল। ফারজানা
ইসলাম আমার ক্লাসমেট। ঢাবি সমাজবিজ্ঞান বিভাগে আমরা সহপাঠি ছিলাম।
ব্যবহারে বেশ মার্জিত, ছাত্র থাকতেই। তবে সেই সময়ে সমাজবিজ্ঞান বিভাগে দুটি
ঘরানায় বিভক্ত ছিল, একটা বিএনপি অন্যটা জামাত ঘরানার। আর একটা প্রগতিশীল ঘরানা।
প্রথম ঘরানার অনুগত ছিলেন ফারজানা। তিনি ড. আনোয়াউল্লাহ চৌধুরীর
অনুগ্রহভাজন, পরে যিনি বিতকির্ত ভিসি হন ও বিতাড়িত হন এবং যিনি আমার ছাত্রত্ব
বাতিল করতে চেয়েছিলেন। আমি যে প্রগতিশীল ঘরানার। আসলে আমি সারা জীবন
পরীক্ষায় প্রথম/ দ্বিতীয় হওয়া
ছাত্র। আমার ধারণা ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হবো। কিন্তু পরীক্ষার পর
আশাহত হলাম। এক ঘরানার শিক্ষকের খাতায় পাই ৭০ বিপরীত ঘরানায় পাই ৫০।
ফারজানা ফাষ্ট হলো। ফলাফল তলিয়ে দেখার জন্য আমি অভিযোগ জানাই বিভাগীয়
প্রধানের কাছে। জানিয়ে আসার পর রাইটিষ্ট ঘরানার অধ্যাপক কামরুল আহসান,
শিক্ষাগত যোগ্যতার ঘাটতি থাকা সত্ত্বেও চাকুরি পেয়েছিলেন। তিনি একটু
মাস্তান টাইপ ছিলেন, বললেন, 'তুমি আমার বিরুদ্ধে, আমাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ
করেছো। তোমাকে যেনো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আর না দেখি'।
বলে কী! আমি বললাম,
অভিযোগ থাকলে তো বিভাগের চেয়ারম্যানের কাছেই জানাতে হয়, আমি তাই করেছি,
অন্যায়টা করলাম কোথায়। তিনি কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে আমার শার্টের কলার ধরে
টেনে নিয়ে যেতে থাকলেন, কলাভবনের বারন্দায় সেটা। আমি বললাম, 'স্যার ছেড়ে
দেন, ভালো হবে না'। ছাড়লেন না। অগত্যা আমিও তাঁর সার্টের কলার চেপে ধরলাম।
আমি ক্ষুব্ধ ছিলাম। কলা ভবনের নিচতলায় তখন ক্লাশ চলছিলো। সকাল ১০ টায় এ
কান্ড দেখে অসংখ্য ছাত্র জমায়েত হল, হৈ চৈ। তার সমর্থকরা ঘুষি টুসি চালাতে
লাগলেন। সব কথা বলা যাবে না, সে সময়ের পত্রিকায় সেসব এসেছে।
অধ্যাপক
এমাজউদ্দিন তখন প্রক্টর। তিনি দৌড়ে এসে আমাকে পেছন থেকে জাপটে ধরলেন, 'বাবা-বাবা, থামো-থামো'। আমি বললাম, 'আপনি আমাকে এভাবে ধরলে আমি তো মার খাবো।
আপনি আপনার মাস্তান সহকর্মীকে ধরেন'।
এনএসএফ সমর্থক ওই অধ্যাপক নিজস্ব কিছু
ছাত্রকে লেলিয়ে দিয়েছিলেন। আমি ভালো ছাত্র হলেও নিরীহ টাইপ নই,
ছাত্ররাজনীতি করি। অতএব, মার খাবার পর হজম করলাম না। পাল্টা মার দিলাম।
মুহুর্তে ঢাকা বিশ্বদ্যালয়ের কলাভবন খালি হয়ে গেল। আমি, আমরা কাউকে আঘাত
করিনি। তবু ভয়ে মেয়েদের চেঁচামেচিতে কলাভবন জনশুন্য হযে গেলো। পুলিশ এল।
আমি তখন দেয়াল ডিঙিয়ে (দেয়ালটা তখন নিচু ছিল ওদিকটায়) আজিজ মার্কেটে এলাম।
এরপর বাড্ডায় চাচির বাসায় আশ্রয় নিলাম। পরদিন ইত্তেফাকে দেখলাম, বিরাট
একখান সাব এডিটরিয়াল।
আমার নেতৃত্বে বিশ্ববিদ্যালয়ে হামলা- এমন অনেক
কথা। হায় কপাল, পড়ুয়া টাইপ ছাত্র আমি। অসচ্ছল পরিবারের সন্তান। সারা বছর
দিনরাত বিশ্ববিদ্যালয় লাইব্রেীতে কাটাতাম। একদিনের এই প্রতিবাদে মাস্তান হয়ে
গেলাম! ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আমার সনদ বাতিল করার ঘোষণা দিলো। সে ঘোষণা পত্রিকার খবরে দেখলাম। সে সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তদন্ত কমিটিকে শো-কজের জবাবে আমি যে লিখিতপত্র দিয়েছিলাম, সেটা ছিল অকাট্য ও ঐতিহাসিক- এঁরা বুঝল এটা মাস্তানের হাতে লেখা নয়। আমাকে নিয়ে কী করবে, কর্তৃপক্ষ খেই
হারিয়ে ফেললেন। সিনিয়র অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, অধ্যাপক সাদউদ্দিনসহ
প্রগতিশীল শিক্ষকেরা আমার ক্ষোভটা বুঝতে পেরেছিলেন। আমার মহসীন হলের
প্রভোষ্ট আবু হেনা মোস্তফা কামাল বললেন, 'ও তো ভালো ছাত্র'। মহসীন হলমেট
সলিমুল্লাহ খান বললেন, 'তোমার কথা প্রভোস্ট আমাকে জিগায়, আমি কি তো তোমাকে
খারাপ বলতে পারি'? আসলে সে সমযে আমরা সবচেয়ে মেধাবী ছাত্র। সব মিলিয়ে বেঁচে
গেলাম। একজন শিক্ষক হয়ে তিনি আমার গাযের জামা ধরে টানটানি করলেন আমাকে এর
কী জবাব দেবেন আপনারা? বললাম, হু ইগনাইটেড দ্য ফায়ার? সেই প্রশ্নটাই
সামনে চলে আসলো।
ঢাবি ইতিহাসে আলোচিত ঘটনার মধ্যে এটা একটা। অনেকের
মনে আছে, অনেকে ভুলে গেছেন। বললাম এ জন্য যে, সেই প্রতিবাদের কারনে ওই বছর
ঢাবি সমাজবিজ্ঞান বিভাগে ফারজানা ইসলাম, আমি কিংবা কাউকেই শিক্ষক হিসাবে
গ্রহন করা হল না। ফারজানা শিক্ষকতা পেল জাবি নৃবিজ্ঞান বিজ্ঞানে। আমি
অত্যন্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও সিভিল সার্ভিসে ঢুকে ম্যাজিস্ট্রেট হলাম। তবু
বিশ্ববিদ্যালয়ে যাই, অধ্যাপক এমাজউদ্দিন স্যার তখনও বোধহয় প্রক্টর।
অধ্যাপক সাদউদ্দিন আমাকে দেখিয়ে বলেন, 'ওই দেখেন, আপনার সেই ছাত্র এখন
ম্যাজিস্ট্রেট, বিচার করবেন কিভাবে'? অধ্যাপক এমাজউদ্দিন মেধায় ধারালো মানুষ ছিলেন না কিন্তু আমার ফাদার্লি মনে হত। সে সময় অনেকের মধ্যে সেটা ছিল।
আমার শিক্ষক হতে না পাবার কষ্টটা রয়ে গেলো। আমি সরকারি চাকুরি করার লোক
নই। ফলে, আমি সুযোগ পেয়ে সিভিল সার্ভিস থেকে পিএইচডি করার জন্য স্টেট
ইউনির্ভারসিটি অব নিউ ইয়র্কে চলে গেলাম। ফারজানা তখন ক্যামব্রিজে
ডক্টরেট প্রোগ্রামে গেলো। ফোনে কথা হয় দুই মহাদেশে। দেশে ফিরে এসেও আমি
জাবিতে গেলে নৃবিজ্ঞান কিভাবে যেন ওর সঙ্গে দেখা হযেছে। সৌজন্য বিনিময়ে কোনো
ঘাটতি ছিল না। আসলে ঢাকা ও সাভারের ম্যাজিস্টেট হিসাবেও আমি জাবির
আভ্যন্তরীন পরিস্তিতি সম্পর্কে অবগত এবং জরুরি অবস্থায় পুলিশসহ ভেতরে
ঢুকেছি, ভেতরের কিছু খবর জানি।
ভিসি ফারাজানা ইসলাম কেনো দেড়
কোটি টাকা বখরা দিতে গেলেন, তার কোনো ভালো ব্যাখ্যা নেই। আরো যে সব
পারিবারিক অভিযোগ সেসব নিয়েও সন্দেহ দূর করা প্রয়োজন। এমন নৈতিক অবস্থান
থেকে দায়িত্ব পালন করা অনুচিত মনে করি। আসলে বিশ্ববিদ্যায়লের
ভিসি পদটিকে, এমন পর্যায়ে অবনমিত করা হয়েছে এবং প্রতিদিন ভিসি প্রজাতির
এমন খবর পাওযা যাচ্ছে, তাতে এটা আর সম্মানজক পদ নয়। ক্ষমতার কানেকশন
চলে গেলে ভিসিরা ওইসব বিশ্ববিদ্যালয়েই ঢুকতে পারবেন কি না সন্দেহ আছে। অথচ বিশ্ববিদ্যালয়ের
শ্রেষ্ঠ শিক্ষকরদের ভিসি হবার কথা। তারা স্তব্ধ হয়ে সাইড লাইনে সরে গেছেন।
প্যানেল থেকে সবচেয়ে নতজানুকে বেছে নেয়া হয়। তারা ছাত্র নেতাদের সঙ্গে
মিলে ‘উন্নয়ন’ ভাগাভাগি করেন। যেখানে বা যে পর্যায়ে গেলে ভাগ মেলে না, তখন
খবর হয়। এর আগে আনোয়ার ভাই (কর্ণেল তাহেরের ভাই) জাবির ভিসি থাকতে পারলেন
না। আমরা তো দুরে সরে গেছি, বন্ধুরা অনেক জায়গায় ভিসি আছেন। কী কারণে একটা
জাতির বাতিঘর নিভছে কারো না বোঝায় কথা নয়। সেটা মোকাবেলা করার দায়
আপনাদের সকলের।"
No comments:
Post a Comment