লেখক: Shawkat Ali
১৯৯৭ সালে মুুক্তিপ্রাপ্ত ইতালিয়ান ছবি লা ভিটা ই বেলা (লাইফ ইজ বিউটিফুল)
গল্পের শুরুটা দুই বন্ধুকে নিয়ে। প্রেক্ষাপট দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কয়েক বছর আগের। স্থান ইতালির একটি ছোট শহর। এই দুই বন্ধুর একজন গুইডো। অভিনয়ে রবার্তো বেনিনি। তিনিই এই সিনেমার পরিচালক এবং গল্পলেখক।
স্থানীয় স্কুল শিক্ষিকা ডোরার (ডোরা চরিত্রে বেনিনির রিয়েল লাইফ স্ত্রী নিকোলিটা) প্রেমে পড়ে গুইডো। গুইডো ছিল সাধারণ একটি ইহুদি পরিবারের। তার কাজের কোন ঠিক ঠিকানা নাই।
আর ডোরার পরিবার ছিল উচ্চবর্গের। তারা ইহুদীও নয়। ডোরার ধনী, সম্ভ্রান্ত, উচ্চবর্গীয় মা চান একজন উচ্চপদস্থ সিভিল সার্ভেন্টের সাথে ডোরার বিয়ে দিতে।
কিন্তু গুইডো ছিল মজার একজন মানুষ। জীবন তার কাছে ছিল নিছক হাসি তামাসার একটি বিষয়। কঠিন বাস্তবতার মাঝেও সে জীবনকে উপভোগ করতে শিখেছিল। একের পর এক ছেলেমানুষি অদ্ভূত, হাস্যকর কান্ডকারখানা করে সে ডোরার মন জয় করে নেয়।
দুজনে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করে। তাদের ভালোবাসার ফসল ছেলে যশোয়া। কিন্তু জীবন মোটেও রূপকথা নয়। সেদিন যশোয়ার চতুর্থ জন্মদিন। সারা বাড়ি সাজানো হয়েছে। কিন্তু তখনই ঘটে গেল এক আঘটন।
জার্মান সেনারা সমস্ত ইহুদীদের ট্রেনে বোঝাই করে কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে পাঠাতে থাকে। ডোরা ইহুদী না হওয়া সত্ত্বেও স্বামী সন্তানের নিরাপত্তার কথা ভেবে ট্রেনে চেপে বসে। ক্যাম্পে নারী আর পুরুষদের জন্যে আলাদা আলদা ব্যবস্থা। সারি সারি লোক মাথা নিচু করে হেঁটে চলেছে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে। আর কোনদিন তারা তাদের সুস্থ জীবন ফিরে পাবে কিনা কে জানে। কার জীবনের আয়ু আর কদিন বা কঘণ্টা কেউ জানে না। কর্কশ কদাকার সেনারা চিৎকার করে আদেশ দিয়ে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। কিন্তু যশোয়ার ছোট্ট নরম মন তখনও আসন্ন বিপদের আঁচ করতে পারেনি। একসমকার প্রাণচঞ্চল গুইডো এবার একজন দায়িত্ববান বাবার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। আচরণে সেই একই হাব-ভাব। কিন্তু ভেতরে লুকোন এক অব্যক্ত যন্ত্রণা।
এক বিশালকায় বাঁজখাই গলার সেনা অফিসার এসে নির্দেশ দিয়ে গেল ক্যাম্পের নিয়ম-কানুন সম্বন্ধে। কিন্তু স্বেচ্ছায় দোভাষী নিযুক্ত হয়ে গুইডো যা অনুবাদ করল সেটা যে মিথ্যে তা যশোয়া ছাড়া আর কারও বুঝতে বাকি থাকল না। যশোয়াকে গুইডো বোঝালো পুরো ব্যাপারটাই একটা খেলা। প্রত্যেকে সেখানে পয়েন্ট যোগাড় করতে গিয়েছে। যে সবচেয়ে তাড়াতাড়ি হাজার পয়েণ্ট জোগাড় করে ফেলবে তাকে প্রথম পুরষ্কার হিসেবে একটা সত্যিকারের ট্যাঙ্ক দেওয়া হবে। যশোয়ার আবার ট্যাঙ্ক খুব পছন্দ। প্রতিদিনের শেষে পয়েন্ট হিসেব করে যার পয়েণ্ট সবচেয়ে কম হবে তার পিঠে একটা কাগজ সাঁটা থাকবে যাতে লেখা থাকবে 'বুর্বক, গাধা'।
গুইডো যশোয়াকে আরও বোঝায় যে, সে যদি মাকে দেখতে চায়, খিদে পেলে খাওয়ার জন্যে বায়না করে আর ঘরের ভেতর লক্ষী ছেলে হয়ে লুকিয়ে না থাকে তবে তাদের পয়েণ্ট কাটা যাবে। কোমল শিশুমনের সরলতায় আর গুইডোর অভিনয়ের স্বাভাবিকতায় যশোয়া তার বাবার কথা নিঃসঙ্কোচে মেনে নেয়। এরপর থেকে যতবার যশোয়া কিছু একটা সন্দেহ করে ততবার গুইডো নতুন নতুন খেলার নিয়ম বলে কঠিন, কদর্য সত্যকে আড়াল করে চলে। নরম ফুলের মত শিশু মনকে কনসেনট্রেশন ক্যম্পের ভয়াবহ আতংক থেকে রক্ষা করতে থাকে। কনসেনট্রেশন ক্যাম্প তাদের কাছে হয়ে যায় সামার ক্যাম্প।
সারাদিন প্রচন্ড পরিশ্রমের পর রুমে ফিরলে লুকিয়ে থাকা যশোয়া ঝাঁপিয়ে পড়ে পৃথিবীর সবচেয়ে নিরাপদ আশ্রয় বাবার কোলে। দু পায়ে দাঁড়িয়ে থাকা তখন কঠিন হয়ে পড়ে গুইডোর পক্ষে। তবু সে খাবার লুকিয়ে আনে, কৌশলে যশোয়াকে ভিড়িয়ে দেয় সুবিধা প্রাপ্ত ছেলে-মেয়েদের মাঝে। যখন যেই বিপদ আর সুবিধা আদায় প্রয়োজন তখন সেই অনুযায়ী খেলার নিয়ম বদলে দেয় গুইডো।
ছেলের মনে সন্দেহ হলেই আবার কিছু বলে তা দূর করতে চেষ্টা করে গুইডো।
এভাবে শত কষ্ট আর অপমান সহ্য করে ছেলেকে বিপদ থেকে আগলাতে থাকে বাবা। কিন্তু একদিন গোপনে ক্যাম্পের বাইরে গিয়ে ফিরে আসার সময় সেনাদের হাতে ধরা পড়ে গুইডো। তাকে সেনারা হত্যা করার আগমুহূর্তেও জীবনটাকে সহজভাবে নেয়ার সহজাত ইশারায় বাবা ছেলেকে বিশ্বাস করায়, মৃত্যুও একটা খেলা।
এক সময় মার্কিন সেনারা যশোয়াকে উদ্ধার করে সে খোঁজে পায় তার মাকে।
একদিন যশোয়া সত্যিকার এক ট্যাঙ্কের মুখোমুখি হয়। তার কানে বাজতে থাকে বাবার শেখানো কথাগুলি-যেদিন ১০০০ পয়েন্ট জমা হবে সেদিন আমরা সত্যিকারের একটি ট্যাঙ্ক জিতে নিব। যশোয়া উচ্ছাসিত হয়ে পড়ে। কিন্তু আজ বাবা তার পাশে নাই।
বাবা নামক বোকা চমৎকার মানুষটার সাথে আবার দেখা হবে কিনা তার জানা নাই।
কিন্তু সে জানে বাবা নামক ভালোবাসার ছায়াটা সব সময় তার আশেপাশেই থাকবে। তাকে সমস্ত বিপদ থেকে আগলে রাখবে। শত কঠিন বাস্তবতার মাঝেও চুপিচুপি কানে-কানে এসে বলে দিয়ে যাবে, লাইফ ইজ বিউটিফুল।
No comments:
Post a Comment