"এই এপ্রিলেই রচিত হয়েছিলো আমাদের আরেকটি সাহসী গল্প, বীরত্বপূর্ণ ইতিহাস, আরেকটি গৌরবোজ্জ্বল দিন। কিন্তু ১৯ বছর আগের ঘটে যাওয়া সেই বীরত্বগাঁথা মনে রাখেনি কেউ। হয়নি কোথাও স্মৃতিচারণ। জীবন বাজি রাখা যোদ্ধারা পাননি কোনো স্বীকৃতি। সার্বভৌমত্ব রক্ষার সে যুদ্ধে প্রাণ হারানো শহীদের পরিবারগুলো পায়নি কোনো প্রণোদনা। গৌরবান্বিত দিনটি ঘিরে পালিত হয় না কোনো দিবস। নিভৃতে চলে গেলো পুরো এপ্রিল কিন্তু মেলেনি কোথাও একবিন্দু সাড়া!
১৯ বছর আগে ২০০১ সালের ১৬ এপ্রিল সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলার পদুয়ায় ভারতের কব্জা থেকে বাংলাদেশ কতৃক একটি অপদখলি ভূখণ্ড অতর্কিত আক্রমণের মাধ্যমে পুনরুদ্ধার করার মধ্য দিয়ে শুরু হয় বহুল আলোচিত পদুয়া-বড়াইবাড়ীর যুদ্ধের। এর দুই দিন পর ভারত পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে পদুয়া থেকে আনুমানিক আড়াইশো কিলোমিটার দূরে কুড়িগ্রামের রৌমারী উপজেলার বড়াইবাড়ীতে হামলা করে। সেখানেও ভারতের সামরিক শিকস্ত ঘটে। দিনটি ছিলো ২০০১ সালের ১৮ এপ্রিল। ভারতীয় সীমান্ত রক্ষীবাহিনী বিএসএফ কুড়িগ্রামের রৌমারী উপজেলার বড়াইবাড়ী সীমান্তে বড়াইবাড়ী বিডিআর ক্যাম্পসহ আশপাশের এলাকা দখল করে নিতে রাতের আঁধারে আচমকা হামলা করে। ১৮ এপ্রিল থেকে ২০ এপ্রিল পর্যন্ত চলমান সে সম্মুখ যুদ্ধে শেষতক বিএসএফ চরমভাবে পরাজিত হয়ে আত্মসমর্পণ করে। সেইসাথে ভূমি দখলের সব পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়ে যায়। তাদের আগ্রাসী মানসিকতার চড়া মূল্য দিতে হয়।
সেই যুদ্ধের প্রধান সমরনায়ক ছিলেন তৎকালীন বিডিআর (বর্তমান বিজিবি) এর মহাপরিচালক আ ল ম ফজলুর রহমান। তাঁর সাহসী সিদ্ধান্তে এবং নেতৃত্বগুণে দাঁতভাঙ্গা জবাবের মাধ্যমে সেদিন বিএসএফকে প্রতিহত করা সম্ভব হয়েছিলো।
সেদিনের ঐ ঘটনার একজন প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনায় জানা যায়, ২০০১ সালের ১৮ এপ্রিল ভোর সাড়ে ৩ টায় ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিডিআর ক্যাম্পসহ বড়াইবাড়ী দখলের উদ্দেশ্যে সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশের ভেতরে প্রবেশ করে। রাতে ধানক্ষেতে পানি দিতে আসা মিনহাজ উদ্দিন নামের এক যুবককে রাস্তায় পেয়ে ভারতীয় বাহিনী তার থেকে বিডিআর ক্যাম্পের লোকেশন জানতে চায়। সে ঘটনা আঁচ করতে পেরে বিডিআর ক্যাম্পের উল্টো দিকের পথ দেখিয়ে দিলে ভারতীয় বাহিনী সেদিকে চলে যায়। মিনহাজ উদ্দিন বিপরীত দিকের বিডিআর ক্যাম্পে রুদ্ধগতিতে ছুটে গিয়ে ভারতীয় বাহিনী প্রবেশের সংবাদ দিলে ক্যাম্পে থাকা বিডিআর জওয়ানরা দ্রুত প্রস্তুতি নেয়।
এরই মধ্যে রাস্তায় টহলদার বিডিআর সৈনিকদের পেয়ে গুলি চালায় ভারতীয় বাহিনী। ক্যাম্প থেকে পাল্টা গুলি চালায় বিডিআর। শুরু হয়ে যায় যুদ্ধ! সর্বত্র ভারী গুলির আওয়াজ।
ভারতীয় বিশাল বাহিনীর সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধে অটল থাকে ক্যাম্পের ২৫ বিডিআর জওয়ান। ততক্ষণে স্থানীয় জনগণ দৃঢ়তার সঙ্গে প্রতিরোধ গড়ে তোলে, লাঠিসোটা হাতে সম্মিলিতভাবে অংশগ্রহণ করে বিডিআর জওয়ানদের সাথে। সকাল অব্দি চলে দফায় দফায় হামলা, গুলিবিনিময়। আক্রমণের সংবাদ পেয়ে জামালপুর থেকে সকাল ১০ টায় লে. কর্নেল শায়রুজ্জামানের নেতৃত্বে অতিরিক্ত ফোর্স সেখানে পৌঁছায়। যুদ্ধ আরও তীব্ররূপ ধারন করে। ভারতীয় বাহিনীও বাড়তি সৈন্য এনে শক্তি বৃদ্ধি করে মরণপণ চেষ্টা চালায় বিডিআর ক্যাম্প দখলে নিতে।
১৯ তারিখ দিনভর যুদ্ধ চলে। রাতে স্থানীয় জনতা এবং বিডিআর জওয়ানরা সম্মিলিতভাবে ভারতীয় বাহিনীকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে। রাতভর চলে যুদ্ধ, বাড়তে থাকে হতাহতের সংখ্যা। ২০ এপ্রিল সকালে ভারতীয় বাহিনীর ব্যাপক প্রাণহানির মধ্য দিয়ে যুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটে। প্রাণে বেঁচে থাকা দুই বিএসএফ সদস্য আত্মসমর্পণ করে।
তৎকালীন বিডিআর ডিজি আ ল ম ফজলুর রহমানের দেয়া তথ্যমতে এবং অন্যান্য সুত্রমতে জানা যায় সেদিন প্রায় চার শতাধিক বিএসএফ সদস্য প্রাণ হারায়। আহত এবং মৃত বেশির ভাগ সৈন্যের লাশ বিএসএফ সরিয়ে নিয়ে যায়। ২০ এপ্রিল দুপুরে বিডিআর-বিএসএফ পতাকা বৈঠকের মধ্য দিয়ে দুজন জীবিত বিএসএফ এর সদস্যসহ পরে থাকা মৃত ১৮ বিএসএফ সদস্যের লাশ হস্তান্তর করা হয়। সেদিন বিডিআর এর ৩ জন জওয়ান শহীদ হয়। তাঁরা হলেন, ল্যান্স নায়েক ওয়াহিদ মিয়া, সিপাহী মাহফুজুর রহমান ও সিপাহী আবদুল কাদের। গুরুতর আহত হন আরও ৬ জন। প্রথম দফা আক্রমণে বিডিআর-জনতার প্রতিরোধের মুখে বিএসএফ বিডিআর ক্যাম্প দখলে নিতে না পেরে ক্ষুব্ধ হয়ে ওই গ্রামের ৮৬ টি বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে।
সার্বভৌমত্ব রক্ষার এমন একটি বিজয় লগ্ন এনে দিলো যে যোদ্ধারা, আজকে নেই তাদের কোনো স্বীকৃতি। সেই যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত এবং প্রাণ দানকারী বিডিআর জওয়ানদের দেয়া হয়নি কোনো রাষ্ট্রীয় মর্যাদা। ১৯ বছর আগের এপ্রিল মাসের এমন একটি গৌরবান্বিত অধ্যায় হতে পারতো আমাদের জন্য গর্বের। কিন্তু রাষ্ট্রীয় অবজ্ঞা আর বঞ্চনায় আজকের এপ্রিল বেদনাময় বিষাদে পরিণত হয়েছে। শুধু তাই নয় সে ঘটনার পাঁচ মাস পর জাতীয় নির্বাচনে বিএনপি সরকার গঠন করে কয়েক মাসের মাথায় বিডিআর-এর ডিজি আ ল ম ফজলুর রহমানকে এক অজানা কারণে বিডিআর থেকে প্রত্যাহার করে এবং কিছুদিন পরে সেনাবাহিনী থেকেও বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়। তাই এপ্রিলের এই বিজয়ের বঞ্চনা মনে করিয়ে দেয় ইংলিশ কবি টি এস এলিয়টের কবিতা 'এপ্রিল ইজ দ্যা ক্রুয়েলেস্ট মান্থ....'!
তবে ২০০৯ সালে দৈনিক আমার দেশ পত্রিকার প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীতে বড়াইবাড়ীর ৩ শহীদ পরিবারকে দেশ রক্ষায় বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য আনুষ্ঠানিক সম্মাননা এবং তাদের পরিবারকে ৫০ হাজার করে নগদ টাকা দেয়া হয়েছিলো। বড়াইবাড়ীর ঘটনার বিষয়ে নতুন প্রজন্মের স্থানীয় যুবকরা বলে, 'আমাদের মুক্তিযুদ্ধ দেখার সৌভাগ্য হয়নি; কিন্তু ২০০১ সালের ১৮ এপ্রিল ভারতীয় বাহিনীর আক্রমণ প্রতিরোধ যুদ্ধ দেখেছি। সেদিনটি সত্যিকারার্থে মনে হয়েছিলো আরেকটি মুক্তিযুদ্ধ'।"
No comments:
Post a Comment