লেখক: মনোরম পলক
"৫৩ দিন পরে ৫৪ ধারার মামলা। পিঠমোড়া করে তো শুধু কাজলকে বাধেনি আমাদের পুরো পরিবারটিকে বেঁধেছে একসাথে। একটার পর একটা মামলা দিয়ে বাঁধছে।
আমাদের পরিবারে আমরা ৫ জন মানুষ। মাথাপ্রতি একটি করে মামলা। তিনটি Digital sequrity act মামলা দিয়েছে।
ধরেন, একটি আমার বাবার মাথা গুনে, একটি আমার মা জুলিয়া ফেরদৌসকে, একটি আমি মনোরম পলকের মাথা ভেবে। এই গেলো তিনটি মামলার হিসাব তারপর ধরেন আমার ১১ বছরের বেয়াড়া ছোট বোনের মাথা কাউন্ট করে দেশ উপহার দিলো ৫৪ ধারার মামলা। এরপর আমাদের সাথে থাকেন আমার নানাভাই। নানাভাইকে মাথায় রেখে বিজিবি দিলো অবৈধ অনুপ্রবেশের মামলা। এই একটি মাত্র মামলায় আমার বাবা এবং আপনাদের কাজলের জামিন হয়েছে। নানাভাই আপাতত দুধ ভাত।
প্রথম ৫৩টা দিন আমরা ছিলাম শোকে কাতর তবুও আমরা ছিলাম প্রচন্ড রকমের আশাবাদী। আপনাদের মধ্যে অনেকেই বলেছেন 'কাইট্যা ভাসিয়ে দিয়েছে কখন', অনেকেই বলছেন 'ফিরে আর পাবেন না'। আবার অনেকেই বলেছেন সঙ্গে আছি, সঙ্গে থাকবো। দুই বিপরীতমুখী টানে আমরা ৫টা প্রাণী মাঝখানে সিধা দাঁড়িয়ে ছিলাম। রাষ্ট্র বলেন বা দেশ বলেন অথবা সিস্টেম, আমাদেরকে নিজ ঘরের সবচেয়ে অন্ধকার অংশে কোনঠাসা করে রেখেছিলো। আমরা সেখানে ৫টা প্রাণী প্রতিদিন পালা করে কেঁদেছি। মনে হয়েছিলো আমরা ৫ জন একটা চিকন সরু তারের উপর দুদোল্যমান। কতবার যে সেই তার থেকে নিচে পড়েছি। রক্তাত্ব মুখটা নিয়ে আবার উঠে দাঁড়িয়েছি সেই তারে আপনাদের অনেকের বাড়ানো হাতটি ধরে।টিভি মিডিয়ার ব্যক্তিত্ব, শিল্প নির্দেশক, শিল্পী, লেখক , সাংবাদিক, মানবাধিকার কর্মী এরকম বহুজনের কথা এখন মনে পড়ছে যাদের বাড়ানো হাতে আমরা শক্তি পেয়েছি।
এখন আমাদের 'মে ইন যশোর ডেইজ' শুরু। আমাদের আর আমাদের চার দেয়ালের ঠুনকো নিরাপত্তার মধ্যে পুরে রাখেনি আপনাদের রাষ্ট্র। আমাদেরকে টেনে-হিঁচড়ে যশোরে নিয়ে গেছে। আমাদের গায়ের চামড়া সরু তার থেকে পরতে-পরতে, তদুর্যপরি অদৃশ্য চাবুকের একটার-পর-একটা আঘাতে কবেই ছিলে নিয়েছিল। এখন সিস্টেম দিয়ে আমাদের ছালহীন গতরে লবন মাখানো হচ্ছে। আমাদের পুরো পরিবারটিকে পিঠে হাত মোড়া দিয়ে বেঁধেছে।আমাদের মুখ বাধা লাল গামছায়। আমাদের পায়ে টাকা নামক অভাবের শিকল দিয়ে বাধবে-বাধবে বলে তাদের নীল নকশা তৈরি। আমরা কোর্ট করবো, কাচারী করবো। আমাদের খালি গতর থেকে মাংসের দলা আদালতের সিঁড়িতে এবং জেল ফটকের সামনে স্লো মোশনে খসে খসে পড়বে। তাও আমরা এক দণ্ডের জন্য থামবো না। সিঁড়ির-পর-সিঁড়ি ভাঙতে ভাঙতে আমাদের পায়ের গোড়ালিতে দাগ পড়বে, পড়ুক।
আমাদের বাজার করতে একবার ভাবতে হবে, ভাববো। আমরা প্রতিদিনকার মতো যতটুকু ঘুমুতে পারি, ঘুমুতে যাওয়ার আগে কল্পনা করে নিতে পারি বাবা আমাদের থেকে ঠিক সেই দুরুত্বে -জেলখানায় পাশ ফিরে আমাদের মতোই ঘুমুতে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। আমাদের কথা জড়িয়ে যাবে ,যাক। আমি মনোরম পলকের মনোবলের প্রাচীরে চিড় ধরাতে নানারকম চেষ্টা করবে, করুক। সেই ফাটলে আমি আমাদের ছাপা প্রিন্টের চাদর দিয়ে টান-টান করে বাঁধবো। চাদরটা যখন সরাতে যাবো তখন চাদরে থাকবে আমাদের অনুভূতির নানা রকম রক্তের ছোপ-ছোপ দাগ।
আমাদেরকে চামড়া বিহীন অনেক কুৎসিত লাগবে। আমরা আমাদের সেই কুৎসিত পরিবেশনা নিয়ে সিস্টেমের মুখোমুখি দাঁড়াবো। আশা করছি আপনারা ছাপা প্রিন্টের ফুলগুলিকে দেখবেন। রক্তের দাগ আপনাদের জন্য নয় বলে রাখছি। কিন্তু দিন শেষে আমরাও তো মানুষ। আমাদের প্রচুর যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে যখন আমাদের চামড়া তোলা হচ্ছিলো। আর এখন একটা মধ্যবিত্ত শরীরে যতুটুকু মাংস থাকে তার থেকে খাবলার-পর-খাবলা তুলে নিচ্ছে প্রতিনিয়ত। দলার পর দলা এখানে সেখানে আমাদের মাংস পিন্ড আপনারা এখন পড়ে থাকতে দেখবেন।
আপনাদের থেকে লুকাবো না। সত্যি বলতে কি, আমাদেরও আপনাদের মতোই কষ্ট হয় একটু কম আর বেশি। মনে হয় কেউ আমাদের হৃদপিন্ডে ক্রমাগত সাঁড়াশি চালাচ্ছে। কিন্তু এও জানবেন সেই ধারালো সাঁড়াশি আপনাদের ভালোবাসার কাছে নস্যি। বাবাকে যখন দেখলাম পিছমোড়া করে বাঁধা হ্যান্ডকাফে, কলিজাটা দুমড়ে মুচড়ে গেছে। অপমানে লজ্জায় চোখের পানি আগুন হয়ে বাস্প হয়ে উড়ে গেছে আপনাতেই।
দিনশেষে যখন আপনাদের কাছে আসি তখন দেখতে পাই বাংলাদেশের বিশিষ্ট শিল্পী সব্যসাচী হাজরা আমার বাবার পিঠে আড়মোড়া করে বাধা ছবির অনুরূপে একটি পোস্টার করে কাজলের মুক্তি চেয়েছেন; দিনের আলোর অপমান এবং লজ্জা রাতের মিশকালো অন্ধকারে সেই পোস্টারখানা জ্বলজ্বল করে আমাকে আমার যাবতীয় অপমানের হাত থেকে বাঁচিয়েছে। তারপর ধরেন সাংবাদিক গোলাম মোর্তোজার তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ার 'পিঠমোড়া করে হাতকড়ায় বাঁধা ক্যামেরাশিল্পী' হেডলাইন আমার বাবাকে ফটোসাংবাদিক থেকে এক মুহূর্তেই ক্যামেরাশিল্পী করে তার পরিধির সীমা বাড়িয়েছেন।
আমার বাবাকে নিয়ে আমার গর্ব প্রতিদিনই বাড়ছে আপনাদের দেওয়া মলমে এবং এন্টিবায়োটিকে। আপনাদের কাছ থেকেই প্রতিনিয়ত মূল্যবোধ আর সম্মানের সংজ্ঞা শিখছি। আমাদের চামড়া বিহীন গতরের সর্বদা বিদ্যমান জ্বালাকে মুহূমুহূ প্রশান্তি দিচ্ছে আপনাদের দেওয়া মলম এবং এন্টিবায়োটিক। সবাই হয়তো মলম এবং এন্টিবায়োটিক দিতে পারবেন না কিন্তু আমরা বাঙালি আমরা সবাই টোটকা দিতে পারি যেকোনো সময়। আপনাদের মধ্যে যারা শিল্পী, লেখক , সমাজ কর্মী , ডিজাইনার এবং যত ক্রিয়েটিভ মাধ্যমের আছেন তাদেরকে বলছি আপনারা আমাদেরকে মলম এবং এন্টিবায়োটিক সরবরাহ দিতে থাকেন। আমাদের লজ্জা থেকে বাঁচান। আমাদের আগুনপোড়া শরীরে আপনাদের মলম খুবই প্রয়োজন।"
ধরেন, একটি আমার বাবার মাথা গুনে, একটি আমার মা জুলিয়া ফেরদৌসকে, একটি আমি মনোরম পলকের মাথা ভেবে। এই গেলো তিনটি মামলার হিসাব তারপর ধরেন আমার ১১ বছরের বেয়াড়া ছোট বোনের মাথা কাউন্ট করে দেশ উপহার দিলো ৫৪ ধারার মামলা। এরপর আমাদের সাথে থাকেন আমার নানাভাই। নানাভাইকে মাথায় রেখে বিজিবি দিলো অবৈধ অনুপ্রবেশের মামলা। এই একটি মাত্র মামলায় আমার বাবা এবং আপনাদের কাজলের জামিন হয়েছে। নানাভাই আপাতত দুধ ভাত।
প্রথম ৫৩টা দিন আমরা ছিলাম শোকে কাতর তবুও আমরা ছিলাম প্রচন্ড রকমের আশাবাদী। আপনাদের মধ্যে অনেকেই বলেছেন 'কাইট্যা ভাসিয়ে দিয়েছে কখন', অনেকেই বলছেন 'ফিরে আর পাবেন না'। আবার অনেকেই বলেছেন সঙ্গে আছি, সঙ্গে থাকবো। দুই বিপরীতমুখী টানে আমরা ৫টা প্রাণী মাঝখানে সিধা দাঁড়িয়ে ছিলাম। রাষ্ট্র বলেন বা দেশ বলেন অথবা সিস্টেম, আমাদেরকে নিজ ঘরের সবচেয়ে অন্ধকার অংশে কোনঠাসা করে রেখেছিলো। আমরা সেখানে ৫টা প্রাণী প্রতিদিন পালা করে কেঁদেছি। মনে হয়েছিলো আমরা ৫ জন একটা চিকন সরু তারের উপর দুদোল্যমান। কতবার যে সেই তার থেকে নিচে পড়েছি। রক্তাত্ব মুখটা নিয়ে আবার উঠে দাঁড়িয়েছি সেই তারে আপনাদের অনেকের বাড়ানো হাতটি ধরে।টিভি মিডিয়ার ব্যক্তিত্ব, শিল্প নির্দেশক, শিল্পী, লেখক , সাংবাদিক, মানবাধিকার কর্মী এরকম বহুজনের কথা এখন মনে পড়ছে যাদের বাড়ানো হাতে আমরা শক্তি পেয়েছি।
এখন আমাদের 'মে ইন যশোর ডেইজ' শুরু। আমাদের আর আমাদের চার দেয়ালের ঠুনকো নিরাপত্তার মধ্যে পুরে রাখেনি আপনাদের রাষ্ট্র। আমাদেরকে টেনে-হিঁচড়ে যশোরে নিয়ে গেছে। আমাদের গায়ের চামড়া সরু তার থেকে পরতে-পরতে, তদুর্যপরি অদৃশ্য চাবুকের একটার-পর-একটা আঘাতে কবেই ছিলে নিয়েছিল। এখন সিস্টেম দিয়ে আমাদের ছালহীন গতরে লবন মাখানো হচ্ছে। আমাদের পুরো পরিবারটিকে পিঠে হাত মোড়া দিয়ে বেঁধেছে।আমাদের মুখ বাধা লাল গামছায়। আমাদের পায়ে টাকা নামক অভাবের শিকল দিয়ে বাধবে-বাধবে বলে তাদের নীল নকশা তৈরি। আমরা কোর্ট করবো, কাচারী করবো। আমাদের খালি গতর থেকে মাংসের দলা আদালতের সিঁড়িতে এবং জেল ফটকের সামনে স্লো মোশনে খসে খসে পড়বে। তাও আমরা এক দণ্ডের জন্য থামবো না। সিঁড়ির-পর-সিঁড়ি ভাঙতে ভাঙতে আমাদের পায়ের গোড়ালিতে দাগ পড়বে, পড়ুক।
আমাদের বাজার করতে একবার ভাবতে হবে, ভাববো। আমরা প্রতিদিনকার মতো যতটুকু ঘুমুতে পারি, ঘুমুতে যাওয়ার আগে কল্পনা করে নিতে পারি বাবা আমাদের থেকে ঠিক সেই দুরুত্বে -জেলখানায় পাশ ফিরে আমাদের মতোই ঘুমুতে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। আমাদের কথা জড়িয়ে যাবে ,যাক। আমি মনোরম পলকের মনোবলের প্রাচীরে চিড় ধরাতে নানারকম চেষ্টা করবে, করুক। সেই ফাটলে আমি আমাদের ছাপা প্রিন্টের চাদর দিয়ে টান-টান করে বাঁধবো। চাদরটা যখন সরাতে যাবো তখন চাদরে থাকবে আমাদের অনুভূতির নানা রকম রক্তের ছোপ-ছোপ দাগ।
আমাদেরকে চামড়া বিহীন অনেক কুৎসিত লাগবে। আমরা আমাদের সেই কুৎসিত পরিবেশনা নিয়ে সিস্টেমের মুখোমুখি দাঁড়াবো। আশা করছি আপনারা ছাপা প্রিন্টের ফুলগুলিকে দেখবেন। রক্তের দাগ আপনাদের জন্য নয় বলে রাখছি। কিন্তু দিন শেষে আমরাও তো মানুষ। আমাদের প্রচুর যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে যখন আমাদের চামড়া তোলা হচ্ছিলো। আর এখন একটা মধ্যবিত্ত শরীরে যতুটুকু মাংস থাকে তার থেকে খাবলার-পর-খাবলা তুলে নিচ্ছে প্রতিনিয়ত। দলার পর দলা এখানে সেখানে আমাদের মাংস পিন্ড আপনারা এখন পড়ে থাকতে দেখবেন।
আপনাদের থেকে লুকাবো না। সত্যি বলতে কি, আমাদেরও আপনাদের মতোই কষ্ট হয় একটু কম আর বেশি। মনে হয় কেউ আমাদের হৃদপিন্ডে ক্রমাগত সাঁড়াশি চালাচ্ছে। কিন্তু এও জানবেন সেই ধারালো সাঁড়াশি আপনাদের ভালোবাসার কাছে নস্যি। বাবাকে যখন দেখলাম পিছমোড়া করে বাঁধা হ্যান্ডকাফে, কলিজাটা দুমড়ে মুচড়ে গেছে। অপমানে লজ্জায় চোখের পানি আগুন হয়ে বাস্প হয়ে উড়ে গেছে আপনাতেই।
দিনশেষে যখন আপনাদের কাছে আসি তখন দেখতে পাই বাংলাদেশের বিশিষ্ট শিল্পী সব্যসাচী হাজরা আমার বাবার পিঠে আড়মোড়া করে বাধা ছবির অনুরূপে একটি পোস্টার করে কাজলের মুক্তি চেয়েছেন; দিনের আলোর অপমান এবং লজ্জা রাতের মিশকালো অন্ধকারে সেই পোস্টারখানা জ্বলজ্বল করে আমাকে আমার যাবতীয় অপমানের হাত থেকে বাঁচিয়েছে। তারপর ধরেন সাংবাদিক গোলাম মোর্তোজার তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ার 'পিঠমোড়া করে হাতকড়ায় বাঁধা ক্যামেরাশিল্পী' হেডলাইন আমার বাবাকে ফটোসাংবাদিক থেকে এক মুহূর্তেই ক্যামেরাশিল্পী করে তার পরিধির সীমা বাড়িয়েছেন।
আমার বাবাকে নিয়ে আমার গর্ব প্রতিদিনই বাড়ছে আপনাদের দেওয়া মলমে এবং এন্টিবায়োটিকে। আপনাদের কাছ থেকেই প্রতিনিয়ত মূল্যবোধ আর সম্মানের সংজ্ঞা শিখছি। আমাদের চামড়া বিহীন গতরের সর্বদা বিদ্যমান জ্বালাকে মুহূমুহূ প্রশান্তি দিচ্ছে আপনাদের দেওয়া মলম এবং এন্টিবায়োটিক। সবাই হয়তো মলম এবং এন্টিবায়োটিক দিতে পারবেন না কিন্তু আমরা বাঙালি আমরা সবাই টোটকা দিতে পারি যেকোনো সময়। আপনাদের মধ্যে যারা শিল্পী, লেখক , সমাজ কর্মী , ডিজাইনার এবং যত ক্রিয়েটিভ মাধ্যমের আছেন তাদেরকে বলছি আপনারা আমাদেরকে মলম এবং এন্টিবায়োটিক সরবরাহ দিতে থাকেন। আমাদের লজ্জা থেকে বাঁচান। আমাদের আগুনপোড়া শরীরে আপনাদের মলম খুবই প্রয়োজন।"
No comments:
Post a Comment