লেখক: Ahmed Rashid joy
"আমাদের মেয়ে ঐশী আল্লাহর কাছে চলে যায় ১১ই নভেম্বর। প্রথম কয়েকদিন আমাদের কোনও হুঁশ ছিল না। কিছুই বুঝতে পারছিলাম না মেয়েটি কেন এভাবে চলে গেল!
"আমাদের মেয়ে ঐশী আল্লাহর কাছে চলে যায় ১১ই নভেম্বর। প্রথম কয়েকদিন আমাদের কোনও হুঁশ ছিল না। কিছুই বুঝতে পারছিলাম না মেয়েটি কেন এভাবে চলে গেল!
ওর স্কুলের ভিপি আমাকে লিখেছিলেন, 'I cannot tell you how shocked and saddened I am, in fact the whole school is, on hearing of the very tragic demise of the lovely girl, who was so friendly and full of life.'
কী ভুল করেছিলাম আমরা? মেয়েটাকে কি ঠিকমত আদর করিনি? আমাদের ভালবাসায় কী কোন ফাঁক ছিল? কোন কষ্ট দিয়েছি ওকে? স্কুলে কেউ কি খুব কষ্ট দিয়েছে? পরিক্ষার কি কোন চাপ চিল? ওর তো সাইকিয়াট্রিস্ট ট্রিট্মেন্ট চলছিল, ডিপ্রেশনের হাই ডোজ ঔষধ আর ১২টা কাউনসেলিং সেশন চলেছে তারপরও আত্মহত্যা করলো! কেন?
ওর সাইকিয়াট্রিস্টও ওদিন আমার এক কলিগকে ফোনে বলেছেন, 'বুঝলাম না, এন্টি সুইসাইডাল ঔষধ খাচ্ছিল তারপরও এটা করলো!'
আমরা কিছুই মেলাতে পারছিলাম না। ঐশী চলে যাবার পরদিন থেকে আমাদের হারেস মামা বারবার বলছিলেন:
'এন্টি ডিপ্রেশন মেডিসিন তো সুইসাইডাল টেনডেন্সি বাড়ায়, বিশেষ করে Prozac । তোদেরকে ডাক্তার কিছু বলে নাই?'
পরে Prozac নিয়ে কিছুটা পড়লাম, দেশে-বিদেশে অনেক ডাক্তারের সঙ্গে কথা বললাম, ঔষধের রেগুলেশন আর লিফলেট পড়লাম। ঐশীর সাইকিয়াট্রিস্ট-এর সাথেও আলাপ করলাম। তারপর ব্যাপারটা যখন বুঝলাম, ততক্ষণে পৃথিবীর কঠিনতম ভার আর কষ্ট আমাদের বুকে চেপে বসেছে।
আমি বিষয়টি এখানে শেয়ার করছি কারণ আমি চাই না আর কোন বাবা-মা’র কপালে সারা জীবনের অসহ্য কষ্ট নেমে আসুক। সবাই দয়া করে একটু মনোযোগ দিয়ে পড়বেন। আর কেউ যেন ভুল না করেন। যে ভুলের মূল্য স্রেফ আমাদের কয়েকটা জীবনের মূল্যের সমান। আমার জীবন দিয়েও এই ভূল শুধরাতে পারবো না।
আগস্ট মাসের ২০ তারিখের দিকে ঐশী ওর মাকে বলছিল:
'মা আমি পড়তে চাচ্ছি কিন্তু কিছুতেই মন লাগাতে পারছি না। যা পড়ি ভুলে যাচ্ছি'।
ঐশী কেঁদেছিল সেদিন। ওর মা আমার সাথে আলাপ করে সাইকিয়াট্রিস্ট কাউন্সেলিং নিয়ে যাবে কিনা। আমি বলি, নিয়ে যাও। ২৪শে আগস্ট ঐশীকে আমাদের বাবার বয়সি এক সাইকিয়াট্রিস্ট-এর কাছে নেয়া হল। বললাম সব। সেই সাইকিয়াট্রিস্ট এবং তার এসিস্ট্যান্ট, অল্প বয়সী একটা মেয়ে, ডাক্তার, প্রেস্ক্রিপশনে ঐশীর ব্যাপারে লিখলেন:
'Procrastination, not focusing on anything, attention down, Memory problem.'
উনারা ঐশিকে প্রথম দিন থেকেই Prozac-20mg (anti depression) দিনে ২টা করে, Cavinton-(brain booster) ৩টা করে, Mirtaz (ঘুমের) ১টা করে ঔষধ দেন। পরে Ritalin (Mood enhancer) দেয়। এগুলো চলে সেপ্টেম্বরের ১২ পর্যন্ত। সাথে চলে উনাদের কাছে ৩ দফা কাউনসেলিং । আমাদের ১৭ বছরের ঐশী, যে জীবনেও হাত বা তার আঙ্গুল কাটে নাই, সেই মেয়ে সেপ্টেম্বরের ১২ তারিখে এক রকম হাসতে-হাসতে প্রথম সুইসাইডের চেষ্টা করে। অনেকগুলো স্লিপিং পিল খেয়ে। সাথে-সাথে এপোলো হাসপাতালের এমার্জেন্সিতে নিয়ে গিয়ে ওকে বাঁচানো হয় আর ওর সাইকিয়াট্রিস্টকে ফোনে জানানো হয়। তারা বললেন, সুস্থ হলে আমাদের কাছে নিয়ে আসেন।
সেপ্টেম্বরে ১৬ তারিখে ঐশীকে আবার নিয়ে গেলাম। সাইকিয়াট্রিস্ট সব ঔষধের ডোজ বাড়িয়ে দিলেন। Prozac করা হল ৩টা (৬০ মিঃগ্রাঃ), যোগ করলেন Luraprex 40 mg ২টা (bipolar disorder and schizophrenia), সাথে Cavinton ৬টা, Mirtaz ১টা, ইন্ডেভার ৩টা আর Ritalin ২টা। ঐশীর মা প্রায়ই টেলিফোনে ওই মেয়ে এসিস্ট্যান্ট ডাক্তারকে বলত, 'ওকে যে এখনো ৩টা করে প্রোজ্যাক দিচ্ছেন, ওর তো ডিপ্রেশন লাগে না'।
জবাব ছিল: 'না ডিপ্রেসন আছে। আমরা চেহারা দেখে বুঝতে পারি'। এভাবে আড়াই মাসে মোট ১২ দফা কাউন্সেলিং আর এই সমস্ত হাই ডোজের ঔষধ চলার পর, নভেম্বরের ১১ তারিখে আমার ‘lovely girl, friendly and full of life’ ঐশী মা স্কুল থেকে ফিরে এসে নিজেই আল্লাহর কাছে চলে যায়। যাওয়ার ১ ঘন্টা আগে আমাকে WhatsApp করে, 'can you bring cherry from unimart today? Or tomorrow?'.
কিছুদিন পর থেকে Prozac নিয়ে পড়া শুরু করলাম। আমেরিকার FDA, Prozac এর ব্যাপারে WARNING: SUICIDALITY AND ANTIDEPRESSANT DRUGS: Increased risk of suicidal thinking and behavior in children, adolescents, and young adults taking antidepressants. Anyone considering the use of PROZAC or any other antidepressant in a child, adolescent, or young adult must balance this risk with the clinical need.
এটাকে ব্ল্যাক বক্স WARNING বলা হয়। এছাড়াও Luraprex ঔষধের লিফলেটে বলা আছে, Precautions: It can cause increase suicidal thoughts and behaviors in adolescents and young adults.
অর্থাৎ সুইসাইড warning লাগানো দুইটা ঔষধ , Prozac (60mg) আর Luraprex (80 mg) হাই ডোজ চলেছে দুই মাসের উপরে।
ঐশীর ডাক্তাররা আমাদেরকে এই সমস্ত ওয়ার্নিং নিয়ে কিছুই বলেন নি। ঐশী চলে যাওয়ার কয়েকদিন পর পরিবারের কয়েকজন গেলাম সেই সাইকিয়াট্রিস্ট আর তার সহকারী মহিলা ডাক্তারের কাছে। কথোপকথন ছিল এরকম (সংক্ষিপ্ত):
'স্যার, ঐশীকে আমরা এখানে নিয়ে এসেছিলাম ও পড়তে পারছিল না বলে। আপনি ওকে ANTIDEPRESSANT DRUGS দিলেন কেন'?
উত্তর: 'আসলে ওর যে এটেনশন কম, ফোকাস কম, এগুলাই ডিপ্রেশনের লক্ষণ'।
আমাদের বক্তব্য বললাম:
'ঠিক আছে স্যার কিন্তু প্রোজ্যাক যে দিলেন স্যার, সেটা আগস্ট মাস থেকে খাওয়ার পর সেপ্টেম্বরে ও প্রথম সুইসাইড এটেম্পট করলো আর প্রোজ্যাক এর ব্যাপারেতো ব্ল্যাক বক্স ওয়ার্নিং দেয়া ছিল যে বাচ্চারা এই ঔষধ খেলে তাদের সুইসাইডাল চিন্তা বাড়ায়। এ ব্যাপারে আমাদেরতো কিছুই বলেননি। তারপরও ওর প্রথম এটেম্পট এর পর আপনি দিলেন ডোজ বাড়িয়ে। সাথে লুরাপ্রেক্সও দিলেন'!উত্তর ছিল,
'আসলে প্রোজ্যাক খুব ভালো ঔষধ, বেস্ট ANTIDEPRESSANT DRUGS ওয়ার্ল্ডের। ম্যাক্সিমাম পারমিসেবল ডোজ দিয়েছিলাম ৬০ মিগ্রা। কিন্তু পারলাম না। ৪১ বছরের মধ্যে আমার প্রথম রুগী এভাবে চলে গেল। Extremely sorry, আমি আসলে এই ব্ল্যাক বক্স ওয়ার্নিং এর ব্যাপারে জানতাম না! আর আপনি যে বলেছিলেন, ঐশীর এন্টি-সুইসাইডাল ঔষধ চলছিল সেটা কোনটা'?
আমরা খানিকটা অবাক হয়ে বললাম, 'কেন, প্রোজ্যাকই তো এন্টি-সুইসাইডাল। এটা তো সবাই জানে'।
হতবাক উত্তর, 'মানে'?
-যেটার ব্যাপারে সুইসাইডাল ওয়ার্নিং দেয়া আছে সেটা এন্টি-সুইসাইডাল?
ওনার আর কোন জবাব নেই। ডাক্তার সাহেব এক পর্যায়ে আমাদের বোঝানোর চেষ্টা করেন যে ডিপ্রেশনে থেকেই মানুষ সুইসাইড করে। যদি তাই হয় তাহলে তো আড়াই মাস ধরে পৃথিবীর বেস্ট এন্টি ডিপ্রেসেন্ট ঔষধের ম্যাক্সিমাম ডোজ চলার পর ঐশীর তো খুব ভালো মেজাজে থাকার কথা। এরপর আসলে আর কোন কথা থাকে না। কিছুক্ষণ পরে আমরা কাঁদতে-কাঁদতে ডাক্তারের ওখান থেকে চলে আসলাম। আসার সময় চিৎকার করে বললাম, 'কিছুই পড়েন না, কোন খোঁজ-খবর রাখেন না। পারবেন আমার মেয়েকে ফেরত দিতে'?
দুইদিন পরে আমি গুলশানে ঔষধের দোকানে গিয়ে প্রোজ্যাক এর লিফলেট নিয়ে আসলাম দেখার জন্য সেখানে আসলে কি লেখা আছে। এগুলো লেখা। Prozac is not for use In children and adolescents under 18. WARNING & PRECAUTIONS: Thoughts of suicide and worsening of your depression or anxiety disorder. Patients under 18 have an increased risk of side effects such as suicide attempt, suicidal thoughts and hostility (predominantly aggression, oppositional behavior and anger) when they take this class of medicines. Information from clinical trials has shown an increased risk of suicidal behaviour in adults aged less than 25 years with psychiatric conditions who were treated with an antidepressant. Use in children and adolescents aged 8 to 18 years with depression: Treatment should be started and be supervised by a specialist. The starting dose is 10 mg/day. After 1 to 2 weeks, your doctor may increase the dose to 20 mg/day. The dose should be increased carefully to ensure that you receive the lowest effective dose.
ঐশীর প্রোজ্যাক এর ডোজ শুরু করা হয় প্রথম দিন থেকেই তাও আবার ৪০ মিগ্রাঃ। পরে বাড়িয়ে করে ৬০ মিগ্রা। কোথায় পেলেন ডাক্তার সাহেব বাচ্চাদের ক্ষেত্রে ম্যাক্সিমাম পারমিসেবল ডোজ ৬০ মিগ্রা? ঔষধ কোম্পানি বলছে সর্বোচ্চ ২০ মিঃগ্রা। অর্থাৎ ডাক্তার সাহেব আর তার এসিস্ট্যান্ট যে ঔষধ প্রতিনিয়ত শত-শত রোগীদের দেন তার লিফলেট পড়েন না? এটা কি সম্ভব? আমার স্রেফ মনে হল হাতুড়ে দুই ডাক্তার শিক্ষিতের বেশে ঢাকায় বসে চিকিৎসা দিচ্ছে আর কাড়িকাড়ি হারাম টাকা কামাচ্ছেন।
কপাল, আর আমিও আমার মেয়ে চলে যাওয়ার পর সব পড়ে ফেললাম! আফসোস, যখন ঔষধ চলছিল তখন কিছুই পড়ি নাই। শুধু ডাক্তারের উপর বিশ্বাস করেছিলাম। আমার এই ভুলের এত চড়া মূল্য দিতে হবে কখনো কল্পনাও করিনি। পরে আমরা এই প্রেসক্রিপশন দেশে-বিদেশে অনেক ডাক্তারকে দেখিয়েছি। বিদেশে সাইকিয়াট্রিস্টকে দেখিয়েছি। তাদের অনেকেই বলেছেন এটা আসলে medicine induced suicide. কেউ অবাক হয়েছেন বাচ্চাকে কিভাবে প্রোজ্যাক দেয়! কেউ ডোজ নিয়ে বলেছেন, দিনে ৩টা করে প্রজ্যাক কিভাবে দিল?
কোরিয়ান এক ডাক্তার আমার বন্ধুকে ঐশীর বিষয়ে বলেছে:
একটা ছোট বাচ্চাকে এক বয়স্ক বদ্ধ পাগলের ঔষধ দিয়েছে! লন্ডন থেকে এক ডাক্তার বলেছে এটা জাস্ট 'পলি মেডিসিন ম্যালপ্র্যাক্টিস'। মেয়েটা আড়াই মাস ধরে বয়স্ক বদ্ধ পাগলের হাই ডোজের ঔষধ খেয়ে না-জানি কতটা কষ্ট পেয়েছে। আহারে-আহারে, কিছুই বলেনি তার বাবা মাকেও। এভাবে মেয়েটি চলে গেল না-ফেরার দেশে। সন্তানহারা আমরা এখন শুধু দোয়া চাই ওর জন্য, আর চাই যেন আর কোন বাচ্চার ঐশীর মত অবস্থা না হয়। এতেই মনে হয় ঐশীর আত্মা খুশি হবে।
আপনাদের কাছে আমাদের অনুরোধ, কোন বাচ্চাকে ANTIDEPRESSANT DRUGS শুরু করার আগে ডাক্তারকে জিগ্যেস করবেন, এই ঔষধ কেন দিচ্ছেন? এটা না খেলে কি হবে? খেলে কি সাইড এফেক্ট হবে? কতদিন খাবে? আর অবশ্যই অবশ্যই ঔষধের লিফলেট পড়বেন। এই ভুল আর কেউ করবেন না, প্লিজ। ঔষধের লিফলেট পড়তে কিন্তু ২-৩ মিনিটের বেশী লাগে না। যেকোন ঔষধেরই লিফলেট পড়বেন।
আমি প্রতিদিন সকালে ঐশীর কবরে যাই। ওর জন্য দোয়া করি মন থেকে। আমার খুব ভারী কান্নায় আল্লাহর কাছে বিচার চাই। আর ঐশীকেও বলি, ‘তোর অনেক স্বপ্ন ছিল মা। বিদেশে পড়তে যাবি। ডে-কেয়ার সেন্টার দিবি। তোর বাবাকে ক্ষমা করে দিস মা, একজন ডাক্তারকে বেশি বিশ্বাস করেছিল। বাবা একদম বুঝে নাইরে মা। একদিন আবার দেখা হবে আমাদের চারজনের। ততদিন ভালো থাকিস মা'।
ঐশী আত্মহত্যা করেনি।"
ঐশী আত্মহত্যা করেনি।"
... ... ...
(অনেকে বলবেন এটা হত্যাকান্ড, কেউ বলবেন এটা খুন! কিন্তু আমি বলি, আসলে এটা উপলক্ষ মাত্র। ঐশী নামের নক্ষত্রটিকে নেভাবার দুর্বল-এক চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু ওই চেষ্টা যা অসম্ভব এক প্রচেষ্টা মাত্র! আসলে কোন-না-কোন প্রকারে তাকে যেতেই হত। কেন-না...।
আমাদের মস্তিষ্ক আমাদেরকে নিয়ে কখন কী খেলা খেলবে এটা আগাম বলা মুশকিল, এ সত্য। কিন্তু এটা বলা যায় ঐশী নামের এই নক্ষত্রটির ভার নেওয়ার ক্ষমতা এই গ্রহের ছিল না। ঐশীকে আটকে রাখার ক্ষমতাও এই তুচ্ছ গ্রহের নাই। আকাশে সবচেয়ে আলোকিত যে নক্ষত্রটি সেই নক্ষত্র হয়ে ঐশী, যে ঐশীকে কোন গ্রহের মালিন্য-মলিনতা স্পর্শ করার অবকাশ নাই। তার স্বজনের পাক খেয়ে উঠা অন্য ভুবনের কষ্টের ক্ষত ঐশী নামের সেই নক্ষত্রের নরোম আলো মেখে-মেখে উবে যায়...।)
(অনেকে বলবেন এটা হত্যাকান্ড, কেউ বলবেন এটা খুন! কিন্তু আমি বলি, আসলে এটা উপলক্ষ মাত্র। ঐশী নামের নক্ষত্রটিকে নেভাবার দুর্বল-এক চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু ওই চেষ্টা যা অসম্ভব এক প্রচেষ্টা মাত্র! আসলে কোন-না-কোন প্রকারে তাকে যেতেই হত। কেন-না...।
আমাদের মস্তিষ্ক আমাদেরকে নিয়ে কখন কী খেলা খেলবে এটা আগাম বলা মুশকিল, এ সত্য। কিন্তু এটা বলা যায় ঐশী নামের এই নক্ষত্রটির ভার নেওয়ার ক্ষমতা এই গ্রহের ছিল না। ঐশীকে আটকে রাখার ক্ষমতাও এই তুচ্ছ গ্রহের নাই। আকাশে সবচেয়ে আলোকিত যে নক্ষত্রটি সেই নক্ষত্র হয়ে ঐশী, যে ঐশীকে কোন গ্রহের মালিন্য-মলিনতা স্পর্শ করার অবকাশ নাই। তার স্বজনের পাক খেয়ে উঠা অন্য ভুবনের কষ্টের ক্ষত ঐশী নামের সেই নক্ষত্রের নরোম আলো মেখে-মেখে উবে যায়...।)
...
আপডেট: ২৭.০৬.২৪
অবশেষে...অবশেষে, ঐশীর আত্মা খানিকটা হলেও শান্তি পায়। কারণ সে পেয়েছিল অসাধারণ এক বাবা। এক নিঃসঙ্গ শেরপা। যে দিনের-পর-দিন, রাতের-পর-রাত লড়ে গেছে। তাঁর কান্নার সঙ্গে মিশে গেছে সাগরের জল- মানুষটা উবু হয়ে গড়াগড়ি করে কেঁদেছে কিন্তু আবারও ঝাঁপিয়ে পড়েছে ক্ষিপ্রগতিতে সেই উত্তাল সাগরে। ঐশীর সেই দুই চিকিৎসক, ডাক্তার নামের সেই খুনিদের খানিকটা হলেও শাস্তি হয়...
ডাক্তারদের শাস্তি হওয়ার পর এশীর বাবা স্যোসাল মিডিয়ায় লেখেন:
আমাদের মেয়ে, ঐশী (১৭ বছর) 'পৃথিবী ত্যাগ' করে ১১ই নভেম্বর, ২০১৯। লেখাপড়া, পরীক্ষা নিয়ে টেনশনে থাকায় ঐশী একজন সাইকিয়াট্রিস্ট এবং তার সহযোগীর তত্ত্বাবধানে ছিল। তাঁরা মেয়েটিকে কাউন্সিলিং এর পাশাপাশি প্রচুর এবং মাত্রাতিরিক্ত পরিমানে ঔষধ দিয়েছিল।
যে ঔষধগুলো সেবন করলে কিশোর-কিশোরীদের সাইড এফেক্ট হিসেবে আত্মহত্যার প্রবণতা হতে পারে সেই সতর্কতা ঔষধ কোম্পানি থেকে দেয়া লিফলেটে ছিল। আড়াই মাস এরকম ঔষধ সেবন করার পর ঐশী আল্লাহ্র কাছে চলে যায়।
এ ব্যাপারে আমি ২৬শে ডিসেম্বর, ২০১৯ ফেইসবুকে লিখেছিলাম। লেখাটি আপনারা অনেকেই পড়েছেন, শেয়ার করেছেন। ঐ পোস্টের শেষে আমি লিখেছিলাম, ঐশী আত্মহত্যা করেনি (কমেন্টে লিংক দিয়ে দিলাম)
এরপর আমরা এ বিষয়ে অনেক পড়ালেখা করে এবং দেশে বিদেশে অনেক ডাক্তার, ফার্মাসিস্ট এর সাথে কথা বলে ২০২১ সালের মার্চ মাসে ঐশীর দুইজন সাইকিয়াট্রিস্ট এর বিরুদ্ধে বাংলাদেশ মেডিক্যাল এন্ড ডেন্টাল কাউন্সিলে (বিএমডিসি) অভিযোগ দায়ের করি।
ঐশী লেখাপড়ায় মনোযোগ সংক্রান্ত চাপে ছিল তাই ওর প্রেসক্রিপশনে লেখা ছিল, “procrastination, not focusing on anything, attention down, memory problem.” ডায়াগনোসিস আকারে এখানে কোন মানসিক রোগের কথা লেখাও হয়নি আর বাবা-মা কে সে রকম কোন কথা বলাও হয় নি।ঐশীকে দৈনিক যে সমস্ত ঔষধ দেয়া হয়েছিল:প্রতিদিন প্রোজ্যাক ২০ মি.গ্রা. (৩টা করে মোট ৬০ মিগ্রা), ক্যাভিন্টন ৫ মি.গ্রা. (৬টা করে মোট ৩০ মিগ্রা), লুরাসিডন ৪০ মি.গ্রা. (২টা করে মোট ৮০ মিগ্রা), রিটালিন ১০ মি.গ্রা. (২টা করে মোট ২০ মিগ্রা), মিরতাজেপিন ৩০ মি.গ্রা.- (১/২ , ১৫ মিগ্রা), প্রোপ্রানলল ১০ মি.গ্রা. (৩টা করে মোট ৩০ মিগ্রা)।
ঐশীর চলে যাওয়ার পর জানতে পারি প্রোজ্যাক, লুরাসিডন, রিটালিন এবং মিরতাজেপিন এই চারটা ঔষধে সুইসাইড ওয়ার্নিং দেয়া আছে। এর মধ্যে দুটো ঔষধ কিশোর-কিশোরীদের জন্য নিরাপদ নয়। তারচেয়েও ভয়াবহ ব্যাপার যেটা জানতে পারি তা হচ্ছে ড্রাগ ইন্টারেকশন অর্থাৎ একটা ঔষধ এর সাথে আরেকটা ঔষধ মিলালে কি ভয়াবহ পরিনাম হয়। আমি মাত্র দুটি উদাহরন দিচ্ছি:Prozac oral and Mirtazapine oral both increase affecting serotonin levels in the blood. Too much serotonin is a potentially life-threatening situation.Lurasidone oral, Prozac oral; either increases toxicity of the other. Combination increases the effect of both drugs on the nervous system, causing more side effects.
এরকম আরো ৭টা ইন্টারেকশন ওয়ার্নিং ছিল। অর্থাৎ এগুলার মধ্যে এমনেই সুইসাইড ওয়ার্নিং ছিল তার উপর ডোজ ছিল অত্যধিক এবং একটা আরেকটার সাথে মিলে ভয়ানক সাইড এফেক্ট তৈরি করেছে ঐশীর উপর।বাংলাদেশ মেডিকেল এণ্ড ডেন্টাল কাউন্সিলে অভিযোগ দায়ের করার আগে আমি এটাও অনুসন্ধান করেছি যে পৃথিবীতে কোথাও এরকম হয়েছে কি না যে এই সমস্ত ঔষধ খেয়ে কেউ সুইসাইড করেছে।আমি কয়েকটি আইনি মামলা পেয়েছি। তার মধ্যে ২০১০ এর একটি মামলা ছিল যুক্তরাষ্ট্রে।
Romona L. Floyd v. United States of America (CASE NO. 3:08-CV-122 (CDL)), United States District Court, M.D. Georgia। এই মামলায় বলা হয় জেসিকা এন রে নামক একটা ১৬ বছর বয়সী মেয়েকে প্রোজ্যাক দেয়ায় সে কিছুদিন পর সুইসাইড করে। এই মামলার রায় আমি পুরোটা পড়েছি।
কোর্টের রায় ছিল এরকমঃ“The Court further finds that as a proximate result of ingesting the Prozac, Jessica Ann Ray hanged herself, which resulted in a devastating brain injury that ultimately caused her death. Accordingly, the Court finds in favor of Plaintiff and awards Romona L. Floyd, as surviving parent of Jessica Ann Ray, damages of $2,781,684.20 against the United States for the wrongful death of Jessica Ann Ray…….”
এখানে জেসিকা রে নামক মেয়েটিকে মাত্র একটা ঔষধ দেয়া হয়েছিল, প্রোজ্যাক। অনিয়ন্ত্রিত ভাবে এই ঔষধ প্রয়োগে তার মৃত্যু হয়। আর ঐশীকে প্রতিদিন খেতে দেয়া হয়েছিল ৬ ধরণের মোট ১৭ টি ওষুধ।বিএমডিসির মাধ্যমে সাইকিয়াট্রিস্ট এর কাছে প্রশ্ন করা হয়েছিল: 'ঐশীর কি রোগ ছিল, কেন এতগুলো ঔষধ দেয়া হয়েছিল, কেন অতিরিক্ত মাত্রার ঔষধ দেয়া হয়েছিল'? কিন্তু এসব প্রশ্নের কোন সদুত্তর উনি দেননি।
বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের নিয়ে দীর্ঘ তদন্ত এবং শুনানীর পর, গতকাল (২৮ জুন ২০২৪) বিএমডিসি গণবিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানায় যে, ঐশীর চিকিৎসায় অবহেলা এবং ঔষধের পার্শ প্রতিক্রিয়া ও তার ব্যাবস্থাপনা বিষয়ক জ্ঞানের ঘাটতি প্রমানিত হওয়ায়, শাস্তি হিসেবে সিনিয়র সাইকিয়াট্রিস্ট মোঃ নুরুল আজিম এর রেজিস্ট্রেশন ৫ বছরের জন্য এবং তার সহকারী তানজিমা তাজরিন এর রেজিস্ট্রেশন ১ বছরের জন্য স্থগিত করা হয়েছে। এ সময়ে তারা কোথাও কোন চিকিৎসা দিতে পারবেন না এবং নিজেকে চিকিৎসক হিসেবে পরিচয় দিতে পারবে না।
চিকিৎসা সংক্রান্ত অভিযোগের জন্য বাংলাদেশে একমাত্র প্রতিষ্ঠান হচ্ছে বিএমডিসি। সেটা পরিচালনা করেন বাংলাদেশের সবচেয়ে শ্রদ্ধাভাজন চিকিৎসকেরা। যে বিষয়ে অভিযোগ করবেন সেই সংক্রান্ত তিন জন বিশেষজ্ঞ ডাক্তার যারা সরকারী হাসপাতালগুলোর বিভাগীয় প্রধান তারা তদন্ত করেন, শুনানি করেন। তার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেন। আপনি কখনও ভুল চিকিৎসার শিকার হলে ডাক্তারদের গালিগালাজ না করে বিএমডিসিতে অভিযোগ করুন। চিকিৎসা সংক্রান্ত ভুল ভ্রান্তি মেডিক্যাল শাস্ত্রের টেকনিক্যাল ব্যাপার যা অন্য কেউ তদন্ত করতে পারবে না। ঐশীর বাবা মা হিসেবে, আমরা বিএমডিসি এর প্রতি কৃতজ্ঞ।
আমাদের আত্মীয়স্বজন ডাক্তার, ভাই-বোন ডাক্তার, ঘনিষ্ঠ বন্ধু-বান্ধব ডাক্তার। আগামীতেতে আমি অসুস্থ হলে ডাক্তারের কাছেই যাব। সুতরাং হামলা, ভাংচুর, গালিগালাজ না-করে বিএমডিসিতে অভিযোগ করুন। আর ডাক্তারদের কাছে অনুরোধ, আপনার পেশার ক্ষেত্রে অবহেলা বা অযত্ন (negligence) করবেন না। এটা মহৎ পেশা। মানুষের ভুল হতেই পারে। ব্যাংকার হিসেবে ভুল করলে একটা ঋণ খারাপ হতে পারে, সাংবাদিক ভুল করলে একটা সংবাদ ভুল ভাবে উপস্থাপন হতে পারে কিন্তু ডাক্তার ভুল করলে একজন রোগীর প্রাণ যেতে পারে। আরেকটি বিষয়, দুই জন সাইকিয়াট্রিস্ট এর বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় অন্য চিকিৎসকদের বিব্রত হবার কিছুই নেই। আমাদের অনেক ব্যাংকার জেলে আছেন। তাদের ভুল ভ্রান্তির জন্য আমরা বিব্রত নই।
আমার পোস্টের প্রেক্ষিতে দয়া করে কেউ মানসিক রোগের চিকিৎসা থেকে দুরে সরে থাকবেন না। চিকিৎসা না করলে এই রোগ ভয়ানক। নিয়মিত ডাক্তারের কাছে যাবেন এবং ঔষধ এবং তার ডোজ জেনে-বুঝে খাবেন। দরকার হলে, দ্বিতীয় বা তৃতীয় কোন ডাক্তার দেখাবেন। আমি কোথাও বলিনি কিশোর-কিশোরীদের এন্টি ডিপ্রেশন ঔষধ খাওয়া যাবে না। কোন প্রেক্ষাপটে ঔষধ দেয়া হচ্ছে, তার ডোজ কি, সাইড এফেক্ট কি, কত দিনের জন্য ঔষধ খাবে এবং কিভাবে তার ম্যানেজমেন্ট হবে এগুলো গুরুত্তপুর্ন।ঐশীরতো আসলে কোন মানসিক রোগই ছিল না। আমরা তাকে নিয়ে গিয়েছিলাম লেখাপড়া সংক্রান্ত চাপ মুক্ত করতে। পরে বুঝেছি, অনেক বড় ভুল করেছি। যার শাস্তি পেতে হবে সারা জীবন।
ঐশীর জীবনটা মাত্র শুরু হয়েছিল। ও চলে গেল খুব দ্রুত। ওর এই ছোট্ট জীবনের নিশ্চয় একটা ‘পারপাজ’ ছিল। একটা 'উপলক্ষ' ছিল। সেটা হতে পারে মানুষের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করা। সুস্থ চিকিৎসার অধিকার আদায় করা আর চিকিৎসা ক্ষেত্রে জবাবদিহিতার ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। এগুলো বিবেচনা করলে মেয়েটির জীবনটা হয়তো আমাদের অনেকের চেয়ে বড় ছিল।ঐশী আর কখনোই ফিরবে না। আল্লাহ নিশ্চয়ই ঐশীকে ভাল রাখবেন! কেননা ঐশী কোন ভুল করেনি, আত্মহত্যা করেনি।ঐশী মা, ভালো থেকো । বাবা-মা- ভাইজু এতটুকুই করতে পেরেছে। আবার দেখা হবে মা।
1 comment:
emon kosto jen amar sotruro na hoy
:(
Post a Comment