এঁকে স্পর্শ করার ক্ষমতা আছে কিন্তু এঁর মমতাকে স্পর্শ করার ক্ষমতা নাই, কারও নাই! আমি বলছিলাম মার কথা। মা বলতে আমি কেবল আমাদের মত দুপেয়েদের মার কথাই বলছি না। মা তো মা-ই, দুপেয়ে-চারপেয়ে কী আবার! পৃথিবীর তাবৎ মা, এঁদের অবয়ব সম্ভবত একই রকম!
যে ঘৃণ্য ইদুরের গায়ে অনায়াসে থুথু ফেলা যায় কিন্তু সেই ইদুরটাই, মা ইদুরটাকে স্পর্শ করবে কে? এতো ক্ষমতা কার!
এই যে, এই শিশুটি অন্যদের চোখে অসুন্দর তাতে তাঁর মার কী আসে যায়, ঘন্টা! বা ওই হাতিটা যে তার সন্তানের জন্য দমাদম পিটিয়ে লোকোমটিভ বা ইঞ্জিন অচল করে ফেলেছিল [১]।
আমার কথাই বলি, এমন রোগাপাতলা, কালো-কালো, মুখে শৈশবের বসন্তের আঁচড় এই সব নিয়ে অন্যদের বিস্তর তাচ্ছিল্য থাকলেও আমার মার বিন্দুমাত্র সমস্যা ছিল না। তার ভাষায় আমি ছিলাম 'হ্যান্ডসুম'। তিনি হ্যান্ডসাম বলতে পারতেন না। যাদের চোখে আমি অনেকটা ইদুরের মত তাদের দেখার জন্য আমার মার সেই চোখ কই!
আমার ওয়ালেটে আমার মার একটা ছবি থাকে সব সময়, রাখলে কী হয় আমি জানি না কিন্তু আমি অন্য রকম এক শক্তি পাই। কিন্তু আমি ছবিটা সর্বদা উল্টে রাখি কারণ তাঁর চেহারা দেখলেই আমার মাথায় কী-একটা হয়ে যায়!
আমি অনেক আগে এক লেখায় বলেছিলাম, আমাকে খুনি বানাবার খুব সহজ রাস্তা হচ্ছে আমার মাকে কুৎসিত ভাষায় কিছু বলা। এরপর হয় ওই লোক বেঁচে থাকবে নইলে আমি। নো মার্সি-নো জেনেভা কনভেনশান! জঙ্গলে কেবল জঙ্গলের আইন! আজও আমার বক্তব্য অবিকল! পুরনো কয়েকটা হাড়ের জন্য আমি এখনও লড়ব হিংস্র কুকুরের মত।
অনেকে লেখাটা পড়ে হয়তো ভাবছেন আহা, এই লোক মার কী এক সুপুত্র। ভুল। আমি ছিলাম মার কুপুত্র। তাঁর ছোট ছেলে বরং অনেক খেয়াল রাখত। আমি আমার মার সেরকম খেয়াল রাখতে পারিনি। আবারও ভুল, খেয়াল রাখতে পারিনি কথাটা সত্য না, খেয়াল রাখিনি। কিন্তু এরপরও তিনি আমাকে ফেলে দেননি। ওই যে বললাম, মা তো মা-ই!
তাঁর চিকিৎসাপর্ব ছিল ব্যয়বহুল অথচ তখন আমার টাকা-পয়সার খুব টানাটানি। এই কষ্ট আমাকে আজীবন তাড়া করবে আমি তাঁর হয়তো ভাল চিকিৎসা করাতে পারিনি।
তাঁকে নিয়ে একটা লেখা শুরু করেছিলাম, হাসপাতালপর্ব [২]। তেরোটা পর্ব লিখে আর লিখতে পারিনি। সে সময়টা নিয়ে লেখা হয়নি এটা-সেটা, কতশত! ডাক্তার যখন আমাদের ডেকে নিয়ে গেলেন, 'যান, আপনার মার কাছে। তার এয়ার হাংগার শুরু হয়ে গেছে'। আইসিইউতে আমরা ভাই-বোন হাত ধরাধরি করে দাঁড়িয়ে আছি। আমরা জানি না এয়ার হাংগার কী! আহারে, না-জানলেই ভাল হত। এমন একটা দৃশ্য একটা মানুষের পক্ষে দেখা সম্ভব না। ইতিমধ্যেই আমাদের মার 'এয়ার-হাংগার' শুরু হয়ে গেছে। বাতাসের জন্য হাহাকার। এই গ্রহে এতো বাতাস অথচ আমার মা এক ফোঁটা বাতাসের জন্য মুখ হাঁ করে রেখেছেন।
এই দৃশ্যটার কথা আমার যখনই মনে হয় আমি ঝাড়া ২ মিনিট শ্বাস আটকে রাখি। এরপর আর পারি না- ফুসফুসে আগুন ধরে যায়!
আমি আমার মার মৃত্যু দৃশ্যটা লিখতে পারি না। আমার লেখা ওখানেই থেমে গেছে! আমি সম্ভবত আমার জীবদ্দশায় আর ওই লেখা লিখতে পারব না। আমার মা হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে-শুয়ে কেবল বকে যেতেন: 'আমারে বাড়িতে কবে নিয়া যাবি'। আহা, থাক না ভদ্রমহিলা ওভাবেই, হাসপাতালের বিছানায়- বাড়ি ফেরার অপেক্ষায়। এরিমধ্যে যে বছরের-পর-বছর চলে গেছে তাতে কী আসে যায়!
কেবল..., কেবল যখন খুব অস্থির লাগে তখন সেই ব্রিফকেসটা বের করি যেটায় তাঁর শেষ ব্যবহৃত হাবিজাবি জিনিসপত্র রেখে দিয়েছি। গায়ে জড়ানো শেষ কাপড়টা, গায়ে মাখার শেষ পাউডারটা, সেই টিনের পটটা যেটা দিয়ে তিনি চাল মেপে আমাদের জন্য ভাত বসাতেন, শেষশয্যার এক টুকরো মাটি। এগুলো অহেতুক ঘষে চকচকে করার আপ্রাণ চেষ্টা। অর্থহীন এক কাজ, অন্যদের চোখে বড়ই অর্থহীন হাস্যকর এক কাজ। হোক, তাতে আমার কী আসে যায়...।
সহায়ক সূত্র:
আমার কথাই বলি, এমন রোগাপাতলা, কালো-কালো, মুখে শৈশবের বসন্তের আঁচড় এই সব নিয়ে অন্যদের বিস্তর তাচ্ছিল্য থাকলেও আমার মার বিন্দুমাত্র সমস্যা ছিল না। তার ভাষায় আমি ছিলাম 'হ্যান্ডসুম'। তিনি হ্যান্ডসাম বলতে পারতেন না। যাদের চোখে আমি অনেকটা ইদুরের মত তাদের দেখার জন্য আমার মার সেই চোখ কই!
আমার ওয়ালেটে আমার মার একটা ছবি থাকে সব সময়, রাখলে কী হয় আমি জানি না কিন্তু আমি অন্য রকম এক শক্তি পাই। কিন্তু আমি ছবিটা সর্বদা উল্টে রাখি কারণ তাঁর চেহারা দেখলেই আমার মাথায় কী-একটা হয়ে যায়!
আমি অনেক আগে এক লেখায় বলেছিলাম, আমাকে খুনি বানাবার খুব সহজ রাস্তা হচ্ছে আমার মাকে কুৎসিত ভাষায় কিছু বলা। এরপর হয় ওই লোক বেঁচে থাকবে নইলে আমি। নো মার্সি-নো জেনেভা কনভেনশান! জঙ্গলে কেবল জঙ্গলের আইন! আজও আমার বক্তব্য অবিকল! পুরনো কয়েকটা হাড়ের জন্য আমি এখনও লড়ব হিংস্র কুকুরের মত।
অনেকে লেখাটা পড়ে হয়তো ভাবছেন আহা, এই লোক মার কী এক সুপুত্র। ভুল। আমি ছিলাম মার কুপুত্র। তাঁর ছোট ছেলে বরং অনেক খেয়াল রাখত। আমি আমার মার সেরকম খেয়াল রাখতে পারিনি। আবারও ভুল, খেয়াল রাখতে পারিনি কথাটা সত্য না, খেয়াল রাখিনি। কিন্তু এরপরও তিনি আমাকে ফেলে দেননি। ওই যে বললাম, মা তো মা-ই!
তাঁর চিকিৎসাপর্ব ছিল ব্যয়বহুল অথচ তখন আমার টাকা-পয়সার খুব টানাটানি। এই কষ্ট আমাকে আজীবন তাড়া করবে আমি তাঁর হয়তো ভাল চিকিৎসা করাতে পারিনি।
তাঁকে নিয়ে একটা লেখা শুরু করেছিলাম, হাসপাতালপর্ব [২]। তেরোটা পর্ব লিখে আর লিখতে পারিনি। সে সময়টা নিয়ে লেখা হয়নি এটা-সেটা, কতশত! ডাক্তার যখন আমাদের ডেকে নিয়ে গেলেন, 'যান, আপনার মার কাছে। তার এয়ার হাংগার শুরু হয়ে গেছে'। আইসিইউতে আমরা ভাই-বোন হাত ধরাধরি করে দাঁড়িয়ে আছি। আমরা জানি না এয়ার হাংগার কী! আহারে, না-জানলেই ভাল হত। এমন একটা দৃশ্য একটা মানুষের পক্ষে দেখা সম্ভব না। ইতিমধ্যেই আমাদের মার 'এয়ার-হাংগার' শুরু হয়ে গেছে। বাতাসের জন্য হাহাকার। এই গ্রহে এতো বাতাস অথচ আমার মা এক ফোঁটা বাতাসের জন্য মুখ হাঁ করে রেখেছেন।
এই দৃশ্যটার কথা আমার যখনই মনে হয় আমি ঝাড়া ২ মিনিট শ্বাস আটকে রাখি। এরপর আর পারি না- ফুসফুসে আগুন ধরে যায়!
আমি আমার মার মৃত্যু দৃশ্যটা লিখতে পারি না। আমার লেখা ওখানেই থেমে গেছে! আমি সম্ভবত আমার জীবদ্দশায় আর ওই লেখা লিখতে পারব না। আমার মা হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে-শুয়ে কেবল বকে যেতেন: 'আমারে বাড়িতে কবে নিয়া যাবি'। আহা, থাক না ভদ্রমহিলা ওভাবেই, হাসপাতালের বিছানায়- বাড়ি ফেরার অপেক্ষায়। এরিমধ্যে যে বছরের-পর-বছর চলে গেছে তাতে কী আসে যায়!
সহায়ক সূত্র:
১. মা হাতি: https://www.ali-mahmed.com/2009/01/blog-post_20.html
২.হাসপাতালপর্ব: https://www.ali-mahmed.com/search/label/%E0%A6%B9%E0%A6%BE%E0%A6%B8%E0%A6%AA%E0%A6%BE%E0%A6%A4%E0%A6%BE%E0%A6%B2%20%E0%A6%AA%E0%A6%B0%E0%A7%8D%E0%A6%AC
3 comments:
স্যার, আপনি কি বিশ্বাস করবেন এই লেথাটা পড়া শেষ করেই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি কাল সকালেই মাকে দেখতে যাব। এখান থেকে একশ বিশ কিলো বাট কুছ পারোয়া নেহি। ভাল থাকবেন আর আমার মাকে আপনার লেখাটা পড়তে দেব।
আলি ভাই, কতো সহজে পার্থক্যটা দাঁড়িয়ে গেল। ইঁদুরের ভিডিওটা ত আমিও দেখেছিলাম এই পরশুদিনই, আপনি কতো সহজে লেখার ভাষায় অমরত্ব দিলেন। মার জন্য আমার অনুভূতি ঠিকই আছে, কিন্তু ওখানে পাথর সিমেন্টের পলেস্তারা পড়ে গেছে, সেটা আপনার লেখা না পড়লে বুঝতাম না।
অনেক ধন্যবাদ। ভালো থাকবেন।
Post a Comment